বাঙ্গালী
Friday 19th of April 2024
0
نفر 0

সূরা আত তাওবা; (২০তম পর্ব)



সূরা আত তাওবা; আয়াত ৮৫-৯০

সূরা তাওবার ৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন-

وَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ وَأَوْلَادُهُمْ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُعَذِّبَهُمْ بِهَا فِي الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنْفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ

“মুনাফিকদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাকে যেন বিমুগ্ধ না করে, আল্লাহ এর দ্বারা তাদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি দিতে চান। কাফের থাকা অবস্থায় তাদের আত্মা দেহ ত্যাগ করবে।” (৯:৮৫)

ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের আর্থিক ও বৈষয়িক অবস্থা ভাল ছিল না। বেশিরভাগ মুসলমানই তখন মারাত্মক অর্থকষ্টে ছিলেন। কিন্তু মুনাফিকরা মুসলমানদের তুলনায় অর্থ-সম্পদে অনেক বেশি সচ্ছল ছিল। তাই দারিদ্রক্লিষ্ট মুসলমানরা যেন মুনাফিকদের পার্থিবো প্রাচুর্যে বিমুগ্ধ  না হয়, এই আয়াতে সে বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য এই সূরার ৫৫ নম্বর আয়াতেও একইভাবে মুনাফিকদের বৈষয়িক প্রাচুর্যে মোহগ্রস্ত না হওয়ার ব্যাপারে সাবধান করে দেয়া হয়েছে। কারণ আল্লাহতালা মুনাফিকদের সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদকে তাদের জন্য অকল্যাণ ও অশান্তির উপাদানে পরিণত করেছেন। তারা তাদের কপটতা  ও পাপাচারের পরিণতি এ জগতেই অনুভব করতে পারবে এবং অবিশ্বাসী কাফের অবস্থায়ই তাদের মৃত্যু হবে।

এই আয়াত থেকে আমরা এটা উপলব্ধি করতে পারি যে, সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের প্রাচুর্য সব সময় সবার জন্য কল্যাণ ও প্রশান্তি বয়ে আনে না। এসব অনেকের জন্য অশান্তি ও ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই কারো বাহ্যিক প্রতিপত্তি দেখে হীনমন্যতায় ভোগা উচিত নয়। কারণ মানসিক ও পারিবারিক প্রশান্তিই মানুষের বড় সফলতা। সম্পদের আধিক্য সব সময় এই প্রশান্তি বয়ে আনতে পারে না।

এই সূরার ৮৬ ও ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَإِذَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ أَنْ آَمِنُوا بِاللَّهِ وَجَاهِدُوا مَعَ رَسُولِهِ اسْتَأْذَنَكَ أُولُو الطَّوْلِ مِنْهُمْ وَقَالُوا ذَرْنَا نَكُنْ مَعَ الْقَاعِدِينَ (86) رَضُوا بِأَنْ يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ

“যখন এই মর্মে কোনো সূরা অবতীর্ণ হয় যে, তোমরা আল্লাহর ওপর ঈমান আন এবং তার রাসূলের সঙ্গী হয়ে জিহাদ কর, তখন মুনাফিকদের মধ্যকার সম্পদশালী ও সামর্থবানরা তোমার কাছে অব্যাহতি চায় এবং বলে আমাদেরকে রেহাই দাও, যাতে আমরা (নিষ্ক্রিয়ভাবে) বসে থাকা লোকদের সাথে থেকে যেতে পারি।”(৯:৮৬)

“তারা নিষ্ক্রিয় ও পেছনে পড়ে থাকা লোকদের সঙ্গে অবস্থান করাই পছন্দ করেছে এবং তাদের অন্তর মোহর করা হয়েছে, ফলে তারা বুঝতে পারে না।”(৯:৮৭)

আগের আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে বলা হয়েছে, যাদের ধন-সম্পদের প্রাচুর্যে তোমরা বিমুগ্ধ হয়েছো, তাদের কাছে বস্তুগত ভোগ-বিলাসিতাই মুখ্য বিষয়। কাজেই যখনি মুসলমানরা কোনো চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মুখোমুখি হয়, তখনই মুনাফিকরা যুদ্ধ থেকে পালাবার চেষ্টা করে এবং নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের মত যুদ্ধ গমনে অক্ষম ব্যক্তিদের সাথে ঘরে বসে থাকার অজুহাত খুঁজতে থাকে। তারা আসলে পার্থিব ভোগ-বিলাসিতার মোহে নিজের ধর্মকেই বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই ঈমানদার মুসলমানের মনে এ ধরনের সম্পদের মোহ থাকা উচিত নয়। যে সম্পদ ও প্রতিপত্তি মানুষকে বস্তুগত ভোগ-বিলাসিতার নিগড়ে আবদ্ধ করে ফেলে এবং তার দায়িত্ব-কর্তব্য ও লক্ষ্য থেকে সরিয়ে নেয়, ঈমানদার মুসলমানদের কাছে তা কাম্য হতে পারে না।

এই আয়াত থেকে আমরা তিনটি বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারি।

এক. ধর্ম রক্ষার জন্য হিজাদ করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দুই. দুনিয়াদারী এবং বস্তুগত ভোগ-বিলাসিতার মোহ জিহাদ বিমুখ হওয়ার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যোগায়।

তিন. মুনাফিকরা আত্মিক-রোগে আক্রান্ত। ফলে তাদের সুবিবেচনা শক্তি এবং সঠিক নির্বাচনের ক্ষমতা নেই।

সূরা তাওবার ৮৮ ও ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَأُولَئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (88) أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

“রাসূল ও যারা ঈমান এনেছে তারা নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তাদের জন্যই কল্যাণ রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।” (৯:৮৮)

“আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত বা কাননকুঞ্জ যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে প্রস্রবণ, তারা তাতে বাস করবে অনন্তকাল। এটাই মহাসাফল্য।” (৯:৮৯)

বিত্তবান মুনাফিকরা তাদের জীবন ও সম্পদের মোহে জিহাদে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে বরাবরই নির্লিপ্ত ছিল। অপরপক্ষে আল্লাহর রাসূল ও ঈমানদার মুসলমানরা আল্লাহর দ্বীন রক্ষার জন্য জীবন ও সম্পদ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। প্রকৃতপক্ষে, তারা লেনদেন করেছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে। কাজেই এটাই স্বাভাবিক যে, মহান আল্লাহ তাদেরকে ইহ ও পরকালে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করবেন।

জীবন ও সম্পদ বিসর্জনের মানসিকতা ছাড়া মানুষের পক্ষে মহান কোনো কাজ সমাধান করা সম্ভব নয়। যারা এই মানসিকতা অর্জন করতে সক্ষম হয়, তারা এই পার্থিব জগতেও যেমন সফল, অবিনশ্বর জগতেও মহান আল্লাহ তাদের ত্যাগের উত্তম প্রতিদান  দান করবেন। তারা পরকালে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করবেন এবং বেহেশত বা স্বর্গীয় উদ্যানে অনন্তকাল বাস করবেন।

মুনাফিক চরিত্রের মানুষেরা হয়তো মনে করে যে, তাদের কৃতকর্মের কারণে ইসলামের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে এবং ইসলামের অনুসারী হ্রাস পাবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, অতীতে মুনাফিকদের কপটতার মুখে আল্লাহর রাসূল ও ঈমানদার মুসলমানরা অসহায়বোধ করেননি। কাজেই আল্লাহর রাসূলের ওপর মুখে ঈমান আনাই যথেষ্ট নয়। তার অনুগামী হওয়া, তার মহান আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো জরুরী।

সূরা তাওবার ৯০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَجَاءَ الْمُعَذِّرُونَ مِنَ الْأَعْرَابِ لِيُؤْذَنَ لَهُمْ وَقَعَدَ الَّذِينَ كَذَبُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ سَيُصِيبُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“অক্ষম মরুবাসীদের মধ্যে কিছু লোক তোমার কাছে এসেছিল যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি পাবার অনুমতি গ্রহণ করতে, কিন্তু যারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে মিথ্যা কথা বলেছিল এবং (কোনো কারণ ব্যতীত) ঘরে বসেছিল, তাদের মধ্যে যারা কুফরি করেছিল, তাদের ওপর শীঘ্রই আসবে বেদনাদায়ক শাস্তি।” (৯:৯০)

এই আয়াতে যুদ্ধে না যাওয়া মুসলমানদেরকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একদল যারা শারীরিক অক্ষমতা বা অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য কারণে আল্লাহর রাসূলের অনুমতি নিয়ে ঘরে বসে ছিলেন। আর অন্য আরেক দল যারা যুদ্ধ থেকে পলায়নের উদ্দেশ্যে নানা বাহানা তুলে ধরেছিলেন, সর্বোপরি আল্লাহর রাসূলের অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধে না গিয়ে মদীনায় থেকে গিয়েছিলেন।

প্রথম দলের ব্যাপারে এই আয়াতে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহর রাসূলের অনুমতি গ্রহণ করেছিলেন এবং তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দলটি আল্লাহর রাসূলের কাছে মিথ্যা বক্তব্য উপস্থাপন করে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিলেন। আল্লাহর রাসূল অনুমতি না দেয়া সত্ত্বেও তারা যুদ্ধ পরিহার করেছিল। তাদের এই আচরণের ফলে তারা অবিশ্বাসী কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা : একটি ...
Protest einer Antikriegsgruppe gegen Luftangriff Amerikas auf ein Krankenhaus
খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি
‘বাতিলের মুকাবিলায় ঐক্যই ...
অর্থসহ মাহে রমজানের ৩০ রোজার দোয়া
কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান
শিয়াদের মৌলিক বিশ্বাস (পর্ব-১)
সূরা ইউনুস;(১৭তম পর্ব)
মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৪০টি হাদীস (২)
পরকালের জন্য প্রস্তুতি এবং ...

 
user comment