পবিত্র কাবায় অগণিত মানুষের সাথে নামাজ শেষে ধীর পায়ে এক মিনিট দূরত্বের হোটেলে এলাম চোখধাঁধানো আলোর ভেতর দিয়ে। রাতভর জেগে থেকেও শরীর কান্তিহীন। যাবো আরাফাতের ময়দানে। এক ঘণ্টার ব্যবধানে ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৬টা। বেরিয়ে পড়লাম। স্বচ্ছ নীলাকাশ, কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড তাপ বিলাতে শুরু করল সূর্য। তাপমাত্রার সূচকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তবুও এতটুকু ঘাম নেই।
মক্কার ইব্রাহিম খলিল রোডে তখনো কাবামুখী লাখো মানুষের সারি। একটু এগিয়ে ফিলিস্তিন হোটেলের সামনে গিয়ে মার্সিডিজ বেঞ্জে চেপে বসলাম। সাথে দুই প্রবাসী বাংলাদেশী, তিনজন সাংবাদিক। ৮০ কিলোমিটার বেগে ছুটছে গাড়ি। যত দূর নয়, তার চেয়ে গতিই বেশি! দৃষ্টিনন্দন প্রশস্ত রাস্তা, মাঝখানে সারি সারি সবুজ গাছ দেখতে দেখতেই চলে এলাম মিনায়। এরপর মুজদালিফা। মুজদালিফা পার হতেই মরুর বুকে বিশাল সবুজ চত্বর। এ কি নিমগাছ! পরিচিত নিমগাছ দেখে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সারি সারি, হাজার পেরিয়ে লাখ; এত নিমগাছ আরাফাতজুড়ে! মসজিদে নামিরার (রাসূল সা:-এর নিজ হাতে তৈরি) কাছেই থামল গাড়ি। ছুঁয়ে দেখলাম নিমগাছ। ১০ হাত উচু উচ্চতা নিয়ে চিকন ডালে সবুজ ঘন পাতা মেলে ধরে মরুভূমিতে ছায়া বিলাচ্ছে আমাদের নিমগাছ।
যতই দেখছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম। মনে প্রশ্ন জাগল, মরুর দেশে কী করে এলো এত নিমগাছ? তাও আবার এতটা ঘন সবুজ।
অনুসন্ধানে জানা গেল, সালটা ছিল ১৯৭৭ ইংরেজি। বাদশাহ ফাহদের আমন্ত্রণে সৌদি আরব যান বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আর উপহার হিসেবে সাথে নিয়ে যান বেশ কিছু নিমগাছের চারা। বাদশাহকে উপহার দেয়ার সময় বলেন, গরিব মানুষের দেশের গরিব রাষ্ট্রপতির প থেকে আপনার জন্য এই সামান্য উপহার। বাদশাহ ফাহদ বহু দেশ থেকে বহু মূল্যবান উপহার পেয়েছেন; কিন্তু এমন মূল্যবান উপহার আর পাননি। আবেগে আপ্লুত বাদশাহ জড়িয়ে ধরেন রাষ্ট্রপতি জিয়াকে। তিনি বলেন, আজ থেকে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ পরস্পর অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নে অর্থ সাহায্য দিতে চান। জিয়াউর রহমান এ সময় বলেন, আমাদের দেশের মানুষ গরিব, কিন্তু তারা পরিশ্রম করতে জানে। আপনার দেশের উন্নয়ন কাজের জন্য হাজার হাজার শ্রমিক দরকার। একটি নব্য স্বাধীন মুসলিম দেশের জন্য যদি আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে চান, তবে আমার দেশের বেকার মানুষদের কাজ দিন। বাদশাহ ফাহদ রাজি হলেন। উন্মোচিত হলো এক নতুন দিগন্ত।
আর জিয়ার দেয়া সেই নিমের চারাগুলো আজ মহীরূহ ! ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সৌদি আরবে। মরুভূমিতে যেন টিকে গেছে বাংলাদেশের স্মৃতি উঁচু করে। আরাফাতের ময়দানে সবুজ শীতল ছায়া দিয়ে চলেছে অসংখ্য নিমগাছ। সৌদি আরবে এখন এসব গাছকে সবাই চেনে 'জিয়া ট্রি' হিসেবেই। আরবিতে কেউ কেউ বলেনÑ'জিয়া সাজারাহ'।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি সরকার যখন দেখল খেজুরগাছ নয়, নিমগাছই মরুভূমিতে শীতল ছায়া ছড়ানোর উপযোগী। এ গাছ কম পানিতে দীর্ঘ দিন টিকে থাকতে পারে, গাছের পাতায় প্রচুর পানি ধরে রাখে। বৃষ্টির জন্যও নিমগাছ যথেষ্ট সহায়ক। দেখা গেছে, যে এলাকায় নিমগাছ আছে সেখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং মানুষের অসুখ-বিসুখও কম হচ্ছে। তখন তারা ব্যাপকভাবে নিমের চারা রোপণের কাজে হাত দেন। ১৯৮৩-৮৪ সালে সৌদি সরকার সর্বপ্রথম আরাফাত ময়দানে ব্যাপকভাবে নিমের চারা রোপণ করে। আরাফাত ময়দানে আজ তাই হাজার হাজার নিমগাছ। হাজীরা এই নিমগাছের শীতল ছায়ায় হজ পালন করেন। প্রচণ্ড গরমে নিমগাছের বাতাস তাদের প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। আরাফাতের ময়দানের জাবালে রহমতে (রহমতের পাহাড়) উঠে চার দিকে তাকালে দেখা যায়, পাহাড়ঘেরা বিশাল এলাকাজুড়ে শুধু নিমগাছ আর নিমগাছ।
এই পাহাড়ের ওপরে ছোট্ট উন্মুক্ত দোকান দিয়ে বসেছেন কুমিল্লার সোবহান। নিমগাছের কথা তুলতেই তিনি বলেন, 'এগুলো বাংলাদেশের গাছ, জানেন? আমাদের জিয়াউর রহমান এই গাছ সৌদি সরকারকে উপহার দিয়েছিলেন।' গর্বে এ সময় সোবহানের চোখ যেন ছলছল করছিল। পাশে আতর, তসবিহর আরেক বিক্রেতা আবদুল আলিম এ সময় বলেন, হাজীদের জন্য এই নিমগাছ রহমত। নিমগাছের কারণে এই আরাফাতের ময়দানে গরমও কম।
আরাফাত ময়দানে গিয়ে খুব কাছ থেকে নিমগাছগুলো দেখলাম, আর বাংলাদেশের নিমগাছের সাথে মিলানোর চেষ্টা করলাম। বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে সবই এক রকম। আমাদের সাথে থাকা সৌদি প্রবাসী ব্যবসায়ী রনি ও মো: মুরাদ এ সময় জানান, সারা বছরই এসব গাছের সেবা করার জন্য লোক রাখা আছে। গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দেয়া হয়। ডালপালা ছেঁটে দেয়া হয়। পোকামাকড় থেকে মুক্ত রাখতে ছিটানো হয় কীটনাশক। সৌদি নাগরিক ও হাজীরা নিমগাছের ডালকে দাঁত মাজার মেসওয়াক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন।
মানিকগঞ্জের ফিরোজ নুন শিক্ষিত ভদ্রলোক। ২৫ বছর ধরে আছেন সৌদি আরবে। নিমগাছ নিয়ে সৌদিদের মনোভাব কীÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'নিমগাছের জন্য এরা বাংলাদেশের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ। জিয়াই সৌদি সরকারকে নিমগাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, যার সূত্র ধরে বিএনপির সাথে এ দেশের সরকারের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।'
সৌদি আরবে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সভাপতি, বিএনপি নেতা আবদুর রহমান বলেন, জিয়া ট্রির জন্য আমরা গর্বিত। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিমগাছ উপহার হিসেবে দিয়ে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন।
শুধু আরাফাত ময়দানে নয়, নিমগাছ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সৌদি আরবেই। জেদ্দায় বিশাল আকৃতির মোটা এক নিমগাছ দেখে রীতিমতো বিস্ময় জাগে। বাংলাদেশেও এত বড় নিমগাছ খুব একটা দেখা যায় না।
নিমগাছ : নিম একটি ঔষধি গাছ, (বৈজ্ঞানিক নাম : AZADIRACHTA INDICA)। এর ডাল, পাতা, রস, সবই কাজে লাগে। নিম একটি শতায়ু ও চির হরিৎ বৃ। এই গাছ ৪০-৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এর কাণ্ড ২০-৩০ ইঞ্চি ব্যাস হতে পারে। ডালের চার দিকে ১০-১২ ইঞ্চি যৌগিকপত্র জন্মে। পাতা কাস্তের মতো বাঁকানো থাকে এবং পাতায় ১০-১৭টি করে কিনারা খাঁজকাটা পত্রক থাকে। পাতা ২ দশমিক ৫-৪ ইঞ্চি লম্বা হয়। নিমগাছে একধরনের ফল হয়। আঙুরের মতো দেখতে এ ফলের একটিই বিচি থাকে। জুন-জুলাইতে ফল পাকে, ফল তেতো স্বাদের। বাংলাদেশের সর্বত্রই জন্মে নিমগাছ। প্রাপ্তবয়স্ক হতে সময় লাগে ১০ বছর। নিমগাছ সাধারণত উষ্ণ আবহাওয়া অঞ্চলে ভালো হয়। নিমের পাতা থেকে আজকাল প্রসাধনীও তৈরি হচ্ছে। কৃমিনাশক হিসেবে নিমের রস খুবই কার্যকর। নিমের কাঠ খুবই শক্ত। এ কাঠে কখনো ঘুন ধরে না। পোকা বাসা বাঁধে না। এ কারণে নিম কাঠের আসবাবপত্রও তৈরি হচ্ছে আজকাল। এ ছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই বাদ্যযন্ত্র বানানোর জন্য এ কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। নিমের নানাবিধ গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই গাছকে 'একুশ শতকের বৃক্ষ ' বলে ঘোষণা করেছে।
মঈন উদ্দিন খান