২১ অক্টোবর (রেডিও তেহরান): আজ হতে ১২২০ চন্দ্র-বছর আগে ২১২ হিজরির (বা খৃষ্টীয় ৮২৮ সালের) এই দিনে (১৫ ই জিলহজ্) বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে-বাইতে জন্ম নেয়া দশম ইমাম হযরত আলী বিন মুহাম্মাদ আন নাকী বা আল হাদী (আ.) মদীনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
২২০ হিজরিতে পিতা ইমাম জাওয়াদ (আ.)'র শাহাদতের পর তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব নেন। উম্মতের জন্য সুপথ বা হেদায়াতের দিশারি ছিলেন বলেই তাঁর উপাধি ছিল হাদী। তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আজ ইরানসহ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে এই মহান ইমামের পবিত্র জন্ম-বার্ষিকী।
ইমাম হাদী (আ.) আবদুল আজিম হাসানিসহ ১৮৫ জন ছাত্রকে উচ্চ শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করেছিলেন এবং তারা সবাই ছিল সে যুগের নানা জ্ঞানে শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ।
ইমাম হাদী (আ.) সাত জন আব্বাসীয় খলিফার সমসাময়িক ছিলেন। এই সাতজন হল যথাক্রমে খলিফা মামুন, মুতাসিম, ওয়াসিক, মোতাওয়াক্কিল, মুন্তাসির, মোস্তাইন এবং মুতাজ। খলিফা মুতাসিম ইমাম হাদী (আ.)'র পিতাকে বাগদাদে বিষ প্রয়োগে শহীদ করেছিল। এ সময় ইমাম হাদী (আ.) মদীনায় ছিলেন।
ইমাম হাদী(আ.)'র যুগে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মুতাওয়াক্কিল নিজ পুত্রের হাতে নিহত হয় এবং এরপর আরো ৩ জন আব্বাসিয় শাসক ক্ষমতাসীন হয়। এরাও মুতাওয়াক্কিলের মতো ইমাম হাদী (আ.)কে তাদের শাসন ক্ষমতার পথে কাঁটা হিসেবে দেখতে পায়। এ অবস্থায় ২৫৪ হিজরির ২৬ শে জমাদিউস সানি বা তেসরা রজব আব্বাসীয় খলিফা মুতাজ ৪১ বছর বয়সের ইমাম হাদী (আ.)কে বিষ প্রয়োগে শহীদ করেন। ফলে বিশ্ববাসী তাঁর উজ্জ্বল নূর থেকে বঞ্চিত হয়।
খলিফা মোতাওয়াক্কিল ইমাম হাদী (আ.)কে জব্দ ও অপমানিত করার জন্য বিভিন্ন চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। ইমামকে সম্মান প্রদর্শনের নামে মোতাওয়াক্কিল তাঁকে নিজ দরবারে হাজির করে অপমানিত এবং কখনও কখনও হত্যারও চেষ্টা করেছে।
মদীনায় নিযুক্ত মোতাওয়াক্কিলের গভর্নর ইমাম হাদী(আ.)'র নামে কিছু মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাঁর বিরুদ্ধে খলিফা মোতাওয়াক্কিলের কাছে চিঠি লেখে। ইমাম হাদী (আ.)'র পথ নির্দেশনায় জনগণ শাসকদের অত্যাচার অবিচার ও তাদের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অযোগ্যতার কথা খুব অচিরেই বুঝে ফেলবে ও এভাবে রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে বলেও মদীনার গভর্নর তার চিঠিতে উল্লেখ করেন। এ অবস্থায় মুতাওয়াক্কিল ইমামকে কৌশলে তৎকালীন রাজধানী সামেরা শহরে নিয়ে আসে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ইমাম হাদী (আ.) সামেরা শহরেও প্রকৃত ইসলাম প্রচারের কাজ অব্যাহত রাখেন।
ইমাম হাদী (আ.)'র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দানশীলতা, সদাচরণ, অধ্যবসায়, সত্যের পথে জিহাদ, পরোপকার ও খোদা-ভীতির মত মহত গুণাবলী আজও মুসলমানদের জন্যে মানবীয় পূর্ণতা লাভের আদর্শ।
ইমাম হাদী(আ.)'র দু'টি মো'জেজা বা অলৌকিক ঘটনা এখানে তুলে ধরা হল:
আব্বাসিয় শাসক মোতাওয়াক্কিল ইমামের সাহচর্য পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে এবং তাঁর প্রতি ভালবাসা, সম্মান প্রদর্শন ও আনুগত্যের কথা বলে এই মহান ইমামকে ইরাকের সামেরা শহরে আসতে বাধ্য করেন। ইমাম মোতাওয়াক্কিলের চালাকি বোঝা সত্ত্বেও সামেরায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। সামেরা সফরে ইমাম হাদী (আ.)'র সঙ্গী ছিলেন ইয়াহিয়া ইবনে হারসামা। ইমাম সামেরার উপকণ্ঠে পৌঁছলে মোতাওয়াক্কিল ইমামকে অপমান করার জন্য শহরে ঢোকার অনুমতি না দিয়ে 'খানুস সায়ালিক' নামের এক অনুপযুক্ত স্থানে তাঁকে থাকার নির্দেশ দেয়। এখানে থাকত ভিক্ষুকরা। মোতাওয়াক্কিল পরের দিন এখানে ইমামের জন্য একটি আলাদা ঘর বরাদ্দ করে। সালেহ ইবনে সাইদ নামের এক ব্যক্তি ইমামের সেবা করার জন্য সেখানে আসেন। তিনি ইমামকে বলেন যে, জালিম মোতাওয়াক্কিল সব ক্ষেত্রে আপনার নুর নিভিয়ে দিতে চায় এবং অগ্রাহ্য করতে চায় আপনার মর্যাদাকে। আর এ জন্যই আপনাকে নিম্নমানের এই সরাইখানায় উঠিয়েছে (যেখানে ফকিররা থাকে)। ইমাম একদিকে ইশারা করে বললেন: হে সাইদ! ওই দিকে দেখ। সাইদ বর্ণনা করেন: আমি চেয়ে দেখলাম একটি সুসজ্জিত বাগান যা ছিল নানা রকম ফলে ভরা, ছিল প্রবাহিত ঝর্ণাধারা, বেহেশতি হুর ও গিলমান। এ দৃশ্য দেখে আমি বিস্ময়ে দিশেহারা হয়ে যাই। ইমাম হাদী (আ.) বললেন: আমরা যেখানেই থাকি এগুলো আমাদের খেদমতে নিয়োজিত থাকে। হে ইবনে সাইদ, আমরা খানুস সায়ালিকে থাকি না।
* * *
সুন্নি আলেম শেখ সুলাইমান কানদুজি 'ইয়া নাবী আল মুয়াদ্দা' শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন: "(ঐতিহাসিক) মাসউদি বর্ণনা করেছেন, একদিন আব্বাসিয় শাসক মোতাওয়াক্কিল তার প্রাসাদের আঙ্গিনায় তিনটি হিংস্র পশু আনে এবং এরপর ইমাম হাদী (আ.)-কে দাওয়াত করে। যখনই ইমাম প্রাসাদের অঙ্গনে প্রবেশ করলেন তখনই মোতাওয়াক্কিল প্রাসাদের দরজা বন্ধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল হিংস্র পশুগুলো ইমামের চারপাশে পায়চারি করছিল এবং ইমামের প্রতি বিনয় প্রকাশ করল। আর ইমাম(আ.) জামার আস্তিন দিয়ে তাদের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। এরপর ইমাম উপরে মোতাওয়াক্কিলের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে আবার নীচে নেমে আসেন। ইমাম প্রাসাদ অঙ্গন থেকে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত হিংস্র পশুগুলো আবারও বিনয় প্রকাশ করছিল। পরবর্তীতে মোতাওয়াক্কিল ইমামের জন্য এক বিশাল উপহার পাঠায়। দরবারিরা মোতাওয়াক্কিলকে বলল: ইমাম হাদী (আ.) পশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন তাতো দেখলে। এবার তুমিও ওই একই কাজ কর। মোতাওয়াক্কিল বলল: তোমরা কি আমাকে মারতে চাও! আর বলল, এ ঘটনা কাউকে বলো না।" #