বাঙ্গালী
Saturday 4th of May 2024
0
نفر 0

'অটিস্টিক শিশু সমস্যা নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী ফলপ্রসূ চিকিৎসা'

১৫ এপ্রিল (রেডিও তেহরান): বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালের নতুন এক আবিষ্কারের নাম 'অটিজম'। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব বিষয়টি নিয়ে বেশ সচেতন। সম্প্রতি দু'টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন এর প্রমাণ। প্রথমটি (International Conference on Autism Disorders and Developmental Disabilities
'অটিস্টিক শিশু সমস্যা নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী ফলপ্রসূ চিকিৎসা'


১৫ এপ্রিল (রেডিও তেহরান): বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালের নতুন এক আবিষ্কারের নাম 'অটিজম'। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব বিষয়টি নিয়ে বেশ সচেতন। সম্প্রতি দু'টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন এর প্রমাণ। প্রথমটি (International Conference on Autism Disorders and Developmental Disabilities in Bangladesh and South Asia.25-26,July 2011) ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে বিশ্বের ১১টি  দেশের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। ভারতের কংগ্রেস দলের সভানেত্রী শ্রীমতি সোনিয়া গান্ধী এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে প্রায় ২০০ পিতা-মাতা ছিলেন যাদের সন্তানেরা নানা ধরনের অক্ষমতায় (Disorder) ভুগছে। সম্মেলনে অটিজমের কল্যাণে ঢাকা ঘোষণা ২০১১ গৃহীত হয়, যা জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনের ২৭৩তম এজেন্ডার মাধ্যমে অনুমোদিত হয়। যেখানে UNO সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশ ভোট প্রদান করে। দ্বিতীয়টি ২০১৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি (South Asian Autisim Network-SAAN) দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও দিল্লি ঘোষণা ২০১৩ গৃহীত হয়।২
 
এছাড়া, ২০১৩ সালের ৩০ মে তারিখে WHO-এর নির্বাহী পরিষদে অটিস্টিক শিশুর জন্য "সর্বাত্মক ও সমন্বিত উদ্যোগ" নামে একটি প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সৌদি আরবসহ অন্তত ৫০টি দেশ সমর্থন দিয়েছে।৩


 
 
উপরোক্ত প্রতিটি সম্মেলনেও কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা আন্তর্জাতিক অটিজম বিষয়ক দূত, Global Autism Public Health- এর চেয়ারম্যান সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয় ও অনেক বেসরকারি সংস্থা সম্মিলিতভাবে অটিজম বিষয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশে অটিজম সম্পর্কে সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী অনেক নেতিবাচক,অনেকে এটাকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ বলে মনে করে। অনেক ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ে ভুল হওয়ার কারণে মানসিক রোগীর ঔষধ প্রয়োগ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন রকম Disable শিশু নিয়ে অনেক কার্যক্রম থকলেও অটিজম নিয়ে কার্যক্রম সাম্প্রতিক কালের। বাংলাদেশ সরকারের বেশ কয়েকটি হাসপাতাল যেমন, শিশু হাসপাতাল, শেখ মুজিবুর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনসহ অনেক বেসরকারি সংস্থা যেমন, SWAC (Society for Autistic children) অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, অটিজম কোন অক্ষমতা নয়। উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে এরাও  দেশ বা সমাজের জন্য বোঝা না হয়ে সম্পদ হতে পারে।
 
 
 
অটিজমের ধারণা:
 
'অটিজম' শব্দটি গ্রীক শব্দ Autos থেকে এসেছে। যার ইংরেজী হলো Self এবং বাংলা অর্থ স্বয়ং বা স্বীয়। আর ইংরেজী Autism এর বাংলা অর্থ আত্মসংবৃতি বা মানসিক রোগ বিশেষ। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে নিজের মধ্যে। এজন্য এরোগটির নাম হয়েছে অটিজম। আগে অটিজমকে সিজোফ্রেনিয়া বলে ভুল করা হতো।৫ '
 
'Autism' শব্দটির আরও একটি বিশ্লেষণ হলো, Autos যার অর্থ-শরীরের অভ্যন্তরে বিষাক্ত পদার্থের ক্রিয়া এবং ism বিশিষ্ট মতবাদ থেকে এসেছে। সুতরাং অটিজম হলো শরীরের ক্ষতিকর পদার্থের ক্রিয়াগত ফলাফল।৬
 
১৯৪৩ সালে আমেরিকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লিও ক্যানার সর্বপ্রথম মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে রোগটি শনাক্ত করে অটিজম শব্দটি ব্যবহার করেন।৭
 
 
 
দ্য আমেরিকান হেরিটেজ ডিকশনারি অব দ্য ইংলিশ ল্যাগুয়েজ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী- "অটিজম হলো, শিশুর ব্যাপক বিকাশজনিত অসমর্থতা, যার বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক মিস্থক্রিয়া ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রবল ঘাটতি এবং ক্রিয়াকলাপ ও মনোযোগের চরম সীমাবদ্ধতা এবং পুনরাবৃত্তি নির্দিষ্ট কিছু আচরণ।৮
 
 
 
অটিজম শিশুর মানসিক বিকাশজনিত একটি সমস্যা বা Neurodevelopment Disorder. মানব শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। রবার্ট এল বার্কার উল্লেখ করেছেন, অটিজম একটি ব্যাপক বিকাশজনিত সমস্যা। এতে ব্যক্তির মধ্যে বাইরের জগত সম্পর্কে সামান্য আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির অন্য মানুষ বা বিষয়ের সাথে সম্পর্ক থাকে না বললেই চলে। বরং তার সকল মনোযোগ যেন তার ইচ্ছা ও অনুভূতির মধ্যেই মগ্ন থাকে। (A pervasive development disorder in which the individual appears to have little interest in the external world or capacity to relate effectively to people or objects and is persumed to be devoting full attention to inner wishes and sensation)9
 
 
 
অটিজম সম্পর্কে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২১তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রকাশনায় দেখা  গেছে যে,"অটিজম একটি ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার যা সাধারণত জীবনের প্রথম তিন বছরের প্রকাশ  পেয়ে থাক। অনেকের মতে, অটিজম হচ্ছে শিশুর মস্তিস্ক বিকাশের এক প্রকার প্রতিবন্ধকতা। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ, সামাজিক আচরণ, সামাজিক কল্পনা ইত্যাদি  ক্ষেত্র সমূহে  বেশ সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা একে অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার (Autism Spectrum disorder) বলে আখ্যায়িত করেছেন (ASD)। এই  স্পেকট্রামে অতিমাত্রায় সমস্যাগ্রস্থ, স্বল্পবুদ্ধি, স্বল্পসক্ষম, মানসিক প্রতিবন্ধীসহ উচ্চমেধাসম্পন্ন আত্মনিভর্রশীল কিন্তু সামাজিকতায় পেছনে ফেলা  নয়। অটিস্টিক শিশুর বিকাশ তিনটি ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়।১০ যেমন-
 
১. সামাজিক মিথস্ক্রিয়া  (social Interaction): অন্য কোন ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ না থাকা, কে কি করছে তা নিয়ে কৌতুহল না থাকা, অন্যের আচরণ বুঝতে না পারা।
 
২. যোগাযোগ (Communication): কথা বলতে না শেখা, কোনোমতে কথাবলা, কথা বলতে পারলেও অন্যের সাথে আলাপচারিতা করতে সমর্থ না হওয়া।
 
৩ আচরণের ধরণ (Pattern of Behaviors): পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করা,একই কাজ বার বার করা।
 
 
 
দীর্ঘমেয়াদী ফলপ্রসূ চিকিৎসা পদ্ধতি:
 
১. এই চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। কোন ঔষধ ব্যবহার ছাড়াই নতুন ও বিশেষ ধরনের সইকো থেরাপির মাধ্যমে শিশুদের চিকিৎসা দেয়া হয়। একজন রোগীকে নিয়মিত বেশ কয়েকবছর পর্যন্ত একাধারে চিকিৎসা দিতে হয়। এসময়ের মধ্যে রোগীকে দীর্ঘসময় ধরে নীবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে তার জন্য প্রতিবার ইন্ডিভিজুয়াল ও স্পেশালাইজ পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করা হয়। শিশুটির চিকিৎচলাকালীন নিয়মিত ফলোআপ ও মনিটরিং চলতে থাকে। প্রতিটি শিশুর মধ্যে একাধিক বা অত্যধিক রোগের লক্ষণ দেখা যায়। যার কারণে চিকিৎসা দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে। ৩ বছর, ৫ বছর, ১০ বছর ধরে চিকিৎসার মাধ্যমে ধীরে ধীরে শিশু সম্পূর্ণ বাস্তব জগতে ফিরে আসে। পরিবার, স্কুল, কমিউনিটির মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য তাকে মনোবৈজ্ঞানিক বিশেষ ধরনের চিকিৎসার মাধ্যমে সকল যোগ্যতা অজর্ন করার  কৌশল শেখানো হয়, যেন তাকে স্পেশাল বেবী হয়ে আজীবন আলাদা ও একাকী জীবনযাপন করতে না হয়।১১
 
 
 
অটিস্টিক শিশুর বৈশিষ্ট্য:
 
বুদ্ধিবৃত্তীয় ও আচরণের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে অটিস্টিক শিশুর প্রধান বৈশিস্ট্য। এছাড়া কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখ করা হল:
 
১. আচরণগত দিক থেকে এসব শিশু অন্যের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে না, কৌতুহলী নয়।
 
২. কোন খেলনা বা আনন্দদায়ক বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় না।
 
৩. কারো আদর পেতে চায় না।
 
৪. বিশেষ আচরণ বারবার করতে চায়।
 
৫. তারা রুটিন মেনে চলতে চায়, যেমন- বিছানায় শোবার পূর্বে হাত-মুখ ধোবার অভ্যাস গড়ে উঠলে একদিন তা বাদ পড়লে চিৎকার করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। স্বাভাবিক নিয়মকে বাধাগ্রস্ত করলে বা পরিবর্তন করলে তাদের জীবন অসহায় হয়ে পড়ে।
 
৬. অটিস্টিক শিশু খুব জেদী প্রকৃতির হয়।
 
৭. অটিস্টিক শিশু  নিজ বাসা থেকে অন্য কোথাও যাওয়া পছন্দ করে না।
 
 
 
অটিস্টিক শিশুদের পরিণতি:
 
চিকিৎসাহীন অটিস্টিক শিশুরা পরনির্ভরশীল জীবনযপন করে থাকে।এরা স্বাভাবিক শিশুর মত নিজে থেকে  বেশী কিছু শিক্ষতে পারে না বলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না। স্বাভাবিক মানুষের মত বিয়ে করা, চাকরি বা ব্যবসা করে জীবনযাপন করা অটিস্টিক শিশুর জন্য খুবই দুঃসাধ্য কাজ। নিজস্ব ব্যক্তিগত কাজ শেখাতেই এদের জন্য আট দশ বছর বা আরো বেশী সময় ব্যয় করতে হয়। প্রশিক্ষণ বন্ধ হলে শিশু পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। অপেক্ষার পর অপেক্ষা এবং সময় অদৃষ্টের উপর ছেড়ে দিয়ে'গিফটেড চাইল্ড বা স্পেশাল চাইল্ড' ইত্যাদি নামে অভিভাবকেরা সান্তনা পেয়ে আসছেন। শুধু আমাদের দেশেই নয়, আমেরিকা, ইউরোপের মত উন্নত বিশ্বেও দেখা গেছে একই চিত্র।১৭
 
 
 
অটিজমের কারণ:
 
বিজ্ঞানের এত জয় যাত্রার যুগেও শিশুর এমন সমস্যা কেন হয়? এ সত্যটি এখনও আবিস্কৃত হয়নি। গবেষকরা এবিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন,কেউ কেউ মনে করেন,অটিজমের পিছনে দু'টি কারণ রয়েছে,
 
১. জিনগত সমস্যা ২. পরিবেশের বিষাক্ত উপকরণ। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর DNA জিনে Copy number of variant (CNV) নামক ত্রুটি বহন করে। পরিবেশের বিষাক্ত উপকরণ জিনের উপর কাজ করে স্নায়ুকোষ ধ্বংস করে। বিষাক্ত গর্ভের শিশু এবং শিশুর বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ের ব্রেইনের স্নায়ুকোষকে ধ্বংস করে। যেসব রাসায়নিক দ্রব্য অটিজমের জন্য দায়ী তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মার্কারী, লেড, Pesticides.18  মা ধুমপান করলে, মদ খেলে, ক্ষতিকর ঔষধ খেলে অটিস্টিক শিশুর জন্ম হয়।১২
 
 
 
উন্নত বিশ্বের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা যায় যে,৭৫ - ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে অটিজমের সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে এখনও সঠিক কোন কিছু জানা যায়নি। তবে অনেকে মনে করেন, এটি কেবল নিউরোলজিক্যাল বা ব্রেনের সমস্যা। ২০-২৫ ভাগ ক্ষেত্রে কিছু কিছু কারণ মনে করা হয়।১৬
 
১. মস্তিস্কের কোন রূপ গঠনগত ত্রুটি,
 
২. মস্তিস্কের অস্বাভাবিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়া,
 
৩. মস্তিস্কের নিউরোকেমিকেলের অসামঞ্জস্যতা,
 
৪. শিশুর জন্মপূর্ব বা জন্মপরবর্তী কালের কোনরূপ সংক্রমন ব্যাধি,
 
৫. জিন অথবা ক্রোমোজমগত অস্বাভাবিকতা,
 
৬. অন্তক্ষরা গ্রন্থির হরমোন নিঃসরণে অসামঞ্জস্যতা।১৬
 
 
 
বাংলাদেশে অটিজম পরিস্থিতি :
 
বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ১৯৮০ সালে প্রতি ২৫০০ জনে একজন ছিল অটিস্টিক এবং ২০১৪ সালে ১৫০ জনে একজন অটিস্টিক শিশু।১২
 
 
 
মাননীয় অর্থমন্ত্রী ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, বাংলাদেশে অটিজম আক্রান্তদের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার। তবে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আনুমানিক হিসাব, এদেশে ১০ লাখ ৪০ হাজার মানুষ অটিজমের শিকার যাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনকে সঠিকপন্থায় সনাক্ত করা হয়েছে। অপর এক আনুমানিক হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি ৫০০ শিশুর মধ্যে একটি  অটিজমের শিকার। সে হিসাবে মোটামুটিভাবে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ২ লাখ ৮০ হাজারের কম হবে না।
 
 
 
বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের চিকিৎসা ও পূনর্বাসনের জন্য পূর্ণাঙ্গ কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সম্প্রতি ২০১০ সালে ঢাকার মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অটিজম রিসোর্স সেন্টার এবং ২০১১ সালে অটিস্টিক স্কুল খোলা হয়েছে। ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট এন্ড অটিজম ইন চিল্ড্রেন' খোলা হয়েছে। সরকারী হাসপাতালগুলোতে শিশু বিকাশ কেন্দ্র এবং দেশের সব জেলায় প্রতিবন্ধী  সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে একটি করে অটিজম কর্ণার খোলা হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি আর্ন্তজাতিক সংস্থা, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানও অটিজম রোগীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এগুলোর সংখ্যা খুবই কম।
 
 
 
অটিজমের প্রভাব:
 
বাংলাদেশে অটিজমের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব লক্ষণীয়:
 
১. অটিজম সম্পর্কে সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় অটিস্টিক শিশুদেরকে পরিবার ও সমাজ বিরাট বোঝা মনে করে। ফলে অটিস্টিক শিশুরা সামাজিকভাবে উপেক্ষিত।
 
২. অটিস্টিক শিশুর পরিবারকে সমাজের লোকেরা এড়িয়ে চলে। তাই পরিবারটি হীনমন্যতায় ভুগে।
 
৩. অনেকে অটিস্টিক পরিবারে ছেলে মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। এতে পরিবারটি একঘরে হয়ে যায়।
 
৪. পরিবারের অন্য সদস্যরা লোকলজ্জার ভয়ে এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে বাইরে বের হতে চায় না।
 
৫. অটিস্টিক শিশুর চিকিৎার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়।
 
৬. সমাজের কেউ না জানতে পারে এ কারণে শিশুটিকে ঘরে বন্ধ করে রাখে।
 
৭. অটিস্টিক শিশুর মায়ের অবস্থা আরও করুণ, কন্যা শিশুর জন্মদান থেকে শুরু করে সন্তানের যেকোনো জন্মগত অস্বাভাবিকতার জন্য গর্ভধারিনীকেই দায়ী করা হয়।
 
৮. অশিক্ষিত পিতা-মাতার অটিস্টিক শিশুরা সবচেয়ে বেশী অযত্নে বেড়ে ওঠে।
 
৯. সামাজিক যোগাযোগের অক্ষমতা ও দক্ষতা না থাকায় অটিস্টিক শিশু নির্ভরশীল হওয়ায় দরিদ্র পরিবার এদেরকে ভিক্ষায় বসায়। ভিক্ষা ব্যবসায়ীরা (Begger-King) অটিস্টিক শিশুকে লুফে নেয়। ফলে অটিজম এদেশে ভিক্ষাবৃত্তি ও বেকারত্বের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে অটিজমের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতি বছর অটিজমের জন্য ১৩৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়। আর একজনের জন্য সারা জীবনে ব্যয় হয় ২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। US Today-এর একটি আর্টিকেলে 'স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়' এর অধ্যাপক Ricrdo Dlmetsh উল্লেখ করেন, তার অটিজম আক্রান্ত পুত্রের জন্য তার পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন,অটিস্টিক শিশুর পিতা-মাতার সার্বক্ষনিক(Full time) চাকরি করা অনেক কঠিন। এ সমস্ত মিশুর যত্নের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, যা তার পরিবারকে বহন করতে হয়। সম্প্রতি ডেভিড মনডেল (David Mondell) নামে "The centre for Autism Research at the children's Hospital of Philandelphia"-এর সহযোগী পরিচালক অটিজম নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, একজন অটিস্টিক শিশুর মা বছরে গড়ে ২১০০০ মার্কিন ডলার কম আয় করেন। যা অন্যান্য মায়েদের (যাদের ছেলে মেয়ের কোন স্বাস্থ্যগত সমস্যা নেই) থেকে ৫৬% কম। এবং যে সমস্ত মায়েদের সন্তানের অন্য কোনো স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের থেকে ৩৫% কম। এ থেকে বোঝা যায়,অটিস্টিক শিশুর জন্য একজন মাকে অনেক  আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
 


অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসা:
 
গবেষকদের গবেষণায় এটা নিশ্চিত যে, শৈশবে হস্তক্ষেপ করা গেলে অটিজম নিয়ে জন্ম নেয়া শিশু প্রাপ্ত বয়সে স্বাভাবিক মানুষ হবে। শৈশবে হস্তক্ষেপ বলতে বুঝায়, জন্মের ১৮ মাস থেকে ৩৬ মাস বয়সের মধ্যে অটিজম শনাক্তকরণ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষা পরিকল্পনার মাধ্যমে শিশুকে সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিতে শিক্ষাদান। অটিস্টিক-এর প্রধান চিকিৎসা নিওরোবিহেভিওরাল থেরাপি (Neurobehavioral Therapy).  Neuro মানে ব্রেইন ও Behavioral মানে আচার আচরণ। শিশুর সাথে এমন আচরণ করা যাতে ব্রেনের উন্নতি হয় এবং শিশুর অটিস্টিক উপসর্গগুলো লোপ পায়। অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট ঔষধ আছে, কিন্ত অটিস্টিক চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট ঔষধ নাই। তাই অটিস্টিকের চিকিৎসা হলো "বিহেভিয়েরাল থেরাপি"১৪ যেমন-
 
 
 
১. অটিস্টিক শিশু সামাজিক নয়। সুতরাং শিশুকে সামাজিক করতে হবে। ওদের নিজের জগত থেকে বাইরে আনতে হবে। একা থাকতে দেবেন না। জোর করে শিশুকে বাসা থেকে বাইরে আনলে শিশুর মধ্যে একটু একটু করে পরিবর্তন আসবে। বাইরে এসে শিশু অস্থিরতা দেখাবে, বিরক্ত হবে, উত্তেজিত হবে, রাগারাগি করবে। আপনি ঐদিকে তাকাবেন না। কারণ উদ্দেশ্য অটিস্টিক শিশুকে তার জগত থেকে বের করে নিয়ে এসে অন্যদের সাথে মিশানো।
 
২. অটিস্টিক শিশুরা কথা বলে না, আবার কেউ কেউ দু'বছর পর্যন্ত কথা বলে, তারপর ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়ে, এর চিকিৎসা হলো, শিশুকে একটা একটা করে শব্দ শেখাতে হবে। অনেক ধৈর্য্য ধরতে হবে, চেষ্টা করতে হবে। যেমন- শিশুর হাতে একটা খেলনা 'বল' দিয়ে নাম ধরে বলুন বাবু, বল নাও এবং একটু পরে আবার আপনি হাত পাতুন এবং তার নাম ধরে বলুন, বাবু  বল দাও। এভাবে কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে চেষ্টা করলে সে একটা কথা বুঝতে শিখবে,'বল দাও', 'বল নাও'।
 
৩. অটিস্টিক শিশুরা তাদের হাত দিয়ে একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গীতে খেলে। এই খেলা বন্ধ করতে হবে। তার দু'টো হাত দিয়ে Picture Puzzle খেলা খেলতে দিতে হবে। সিদ্ধ ডিমের খোসা ছিলতে দেয়া বা Building Bricks  বা শিশুদের হাত দিয়ে যেসব মজার খেলা আছে ঐগুলো খেলতে দেয়া বা ছড়া বলা সাথে সাথে হাত দিয়ে অভিনয় করা। তাহলে তার হাত দু'টো কর্মের হাতে পরিণত হবে। এটাকেই বলে Occupational therapy. এই তিনটি এদের চিকিৎসা। একটি অটিস্টিক শিশুর IQ যদি ৭০ এর উপরে থাকে তবে এই শিশুর অনেক তাড়াতাড়ি উন্নতি হয় এবং স্বাভাবিক হবার সম্ভাবনা থাকে।১৪
 
 
 
উপসংহার :
 
বাংলাদেশে অটিজমের ভয়াবহ রূপ হল, চিকিৎসা বিভ্রাট ও অপচিকিৎসা। অটিজম সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবে চিকিৎসকেরা একে জটিল মানসিক ব্যাধি মনে করে থাকেন। ফলে চিকিৎসার পরিণতি অটিস্টিক শিশুর স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামের, অশিক্ষিত দরিদ্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠী অপচিকিৎসা ও প্রতারণার শিকার হয়। প্রতারকরা অটিজমকে জিন-ভূতের আক্রমণ বলে ঝাড়ফূঁক ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়। শিক্ষিত ও সচেতন পরিবারের পিতামাতা অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসায় অনেক ব্যয় করে এক সময় হতাশায় ভোগেন। বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুদের জন্য কোনো রাজনৈতিক অঙ্গীকার  নেই। এসব শিশুর চাহিদা পূরণের জন্য জাতীয়ভাবে কোনো বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অটিস্টিক শিশুরা আমাদের জাতীয় জীবনে যতই নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করুক না কেন, মনে রাখতে হবে, অটিস্টিক শিশুকে যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা হয় তবে শিশুটি সমাজের অন্য শিশুদের মত সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে না পারলেও কিছুটা স্বাবলম্বী হতে পারবে। এখন প্রয়োজন অটিস্টিক শিশুদের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সকলের ভালবাসা-সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসা, পাশাপশি প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
 
 
 
তথ্যসূত্র :
 
১.   মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণাগ্রন্থ  'অটিস্টিক শিশু'- পৃ: ১১ মনোবিজ্ঞানী উম্মে কুলসুম কলি।
 
২.   World Autism Awareness Day- 2013, স্মরনিকা সমাজসেবা অধিদপ্তর, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ২ এপ্রিল ২০১৩।
 
৩.  Bdnews24.com.
 
৪.  Ibid-Page: 21.
 
৫.  সমাজকর্ম- পৃ: ৮৩, তৌফিক মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, হারুন অর রশিদ।
 
৬.   সমাজকর্ম পৃ: ৮০, মো: শফিকুল, মাকসুদুর রহমান, শামীমা নাছরিন।
 
৭.  ৫ম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ও সোয়াকের বর্ষপূর্তি সংখ্যা ২০১২ সোয়াক (Centre for the Welfare of the Autistic Child). ঢাকা পৃ: ১৮।
 
৮.  TheAmerican Herriage Dictionary of the English Language,4th ed Houghton Miffin Company-2009.
 
৯. Barker,Robert L.The Social Work Dictionary,2014, 6th edition.National Association of Social Workers. Washing DC.P-161.
 
১০. Ibid p.21.
 
১১.  মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণাগ্রন্থ  'অটিস্টিক শিশু' পৃ: ১৪, মনোবিজ্ঞানী উম্মে কুলসুম কলি।
 
১২. Internet.
 
‌১৩.  Internet
 
১৪. ড. সেলিনা ডেইজি" এলিলেপ্সি ও অটিজম" পৃ:১২-১৪।
 
 
 
লেখক পরিচিতি:
 
নাসিমা বেগম
 
এম.এস.এস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 
বি.এড. (ফার্স্ট ক্লাস) অ্যান্ড মাস্টার ট্রেইনার
 
সেসিপ, বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়
 
প্রভাষক, সমাজ কর্ম বিভাগ
 
ময়মনসিংহ মহিলা ডিগ্রী কলেজ, ময়মনসিংহ


source : abna
0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

সূরা ইউসুফ; (২৪তম পর্ব)
জ্ঞান অর্জনের দায়িত্ব-কর্তব্য (১ম ...
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক
যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ!
মৃতের সংখ্যা ১০০ ছুঁতে পারে, ...
ভারতের বিরুদ্ধে পরমাণু বোমা ...
ধরা পড়ল আইএসআইএলে প্রশিক্ষিত ...
চলে গেলেন আয়াতুল্লাহ শাহরুখি
শিকাগোতে কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর হত্যার ...
নগরনো-কারাবাখে একতরফা ...

 
user comment