মহররমের চাঁদ এলো ওই কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়
ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা তারি মাতম শোনা যায়....
কারবালার মহাবিপ্লব ইসলামী পুনর্জাগরণ ও মৃতপ্রায় ইসলামের প্রাণ-সঞ্জীবনের এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে চির-ভাস্বর হয়ে আছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র প্রচারিত মহান ইসলাম ধর্ম এবং উদীয়মান ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য শয়তানের দোসর আর শত্রুদের প্রচেষ্টার কখনও কোনো কমতি ছিল না। শত্রুরা যখন প্রকাশ্যে ইসলামকে মোকাবেলা করার সর্বাত্মক চেষ্টায় ব্যর্থ হল তখন তারা বাহ্যিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ও মুসলমান সেজেই ভেতর থেকে এই মহান ধর্মের ওপর আঘাত হানতে সচেষ্ট হল যাতে এই ধর্মের মূল শিক্ষা, চেতনা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বিকৃত এবং বিলুপ্ত হয়। বৃহত্তর মুসলিম সমাজের নানা উদাসীনতা ও কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের চক্রান্তের পরিণতিতে ইসলামের এক সময়কার চরম শত্রু উমাইয়ারা মুসলমানদের নেতৃত্বের পদ দখল করে। তারা পবিত্র ইসলামী সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয় রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র।
উমাইয়ারা ইসলামী নেতৃত্বের প্রকৃত হকদার এবং মুসলিম সমাজের সবচেয়ে যোগ্য, জ্ঞানী ও খোদাভীরু ব্যক্তিদের তথা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যুদ্ধ ও সংঘাতের পাশাপাশি রাজকীয় কোষাগারের সীমাহীন অপব্যবহারেও অভ্যস্ত ছিল। অর্থ-সম্পদ, ভোগ-বিলাস ও রাজকীয় পদমর্যাদার লালসায় নিমজ্জিত দরবারি আলেমরা বিশ্বনবীর পবিত্র আহলে বাইতকে বিদ্রোহী এবং পথভ্রষ্ট বলে ফতোয়া দিয়েছিল। এর পাশাপাশি তারা উমাইয়া নেতাদের ফজিলত ও মাহাত্ম্য তুলে ধরার জন্য রচনা করেছিল শত-সহস্র বা লক্ষাধিক জাল হাদিস।
সে সময়কার সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার নানা চিত্র তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিকরা নানা বর্ণনায়। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন:
ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ্।..
তখতের লোভে এসেছে এজিদ কমবখতের বেশে !
এসেছে সীমার, এসেছে কুফা'র বিশ্বাসঘাতকতা,
ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা !
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ,
...কাঁদে আসমান জমিন, কাঁদিছে মহররমের চাঁদ।
একদিকে মাতা ফাতেমার বীর দুলাল হোসেনী সেনা,
আর দিকে যত তখত-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা।..
এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,
আলী'র সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান !
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়
হাসানে হোসেনে গালি দিতে যেত মক্কা ও মদিনায়।.. …
উল্লেখ্য, উমাইয়া শাসকরা সিরিয়ার জনগণকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষী প্রচারণায় এতোটা প্রভাবিত ও মাতিয়ে রেখেছিল যে আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ) যখন পবিত্র রমজান মাসে কুফার মসজিদে এক ধর্মান্ধ খারিজির সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ হন তখন সিরিয়ার অনেকেই বিস্মিত হয়ে বলেছিল: আলী কি মসজিদে যেতো ও নামাজ পড়তো!!? বলা হয় সিরিয়ার জনগণকে শৈশবেই আলী-বিদ্বেষী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শাসক-গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে শিশুদের জন্য ছাগল-ছানা উপহার হিসেবে পাঠানো হত। আর শিশুরা যখন ওই মেষ শাবক নিয়ে খেলাধুলায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠার কারণে এর গভীর অনুরাগী হয়ে উঠত তখন রাজ-দরবারের কর্মীরা এক রাতে ওই ছাগল-ছানা নিয়ে যেত। আর কে ওই ছাগল-ছানা নিয়ে গেছে শিশুরা তা জানতে চাইলে বলা হত আলী ওই ছাগল ছানা নিয়ে গেছে!! ফলে শৈশবেই সিরিয় শিশুদের কচি-মনে জন্ম নিত আলী (আ.) ও আহলেবাইতের প্রতি বিদ্বেষ।
৬০ হিজরিতে উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াজিদ ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়। সে মদীনার গভর্নরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ নির্দেশ দেয় যে, হুসাইনের কাছ থেকে যে কোনো ভাবেই হোক আনুগত্য আদায়ের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করবে এবং আনুগত্য এড়ানোর কোনো সুযোগ বা সময় তাকে দেয়া যাবে না। এ নির্দেশ পেয়ে মদীনার গভর্নর ওলিদ বিন উৎবা কুখ্যাত উমাইয়া নেতা মারোয়ান বিন হাকামের পরামর্শ অনুযায়ী সে রাতেই একটি সভার আয়োজন করে ইমাম হুসাইন (আ)-কে সেই সভায় আসতে বলে যাতে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার আগেই ইমামকে ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে বাধ্য করা যায়। ইমাম হুসাইন (আ) নিরাপত্তার খাতিরে তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত ত্রিশ জনের সশস্ত্র এক গ্রুপকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে ওই সভায় যোগ দেন। ওলিদ মুয়াবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে ইমামকে আহ্বান জানান। ইমাম তাকে জানান যে:
'হে ওলিদ! আমাদের বংশ হল নবুওত ও রেসালতের খনি এবং ফেরেশতাদের আসা-যাওয়ার স্থান ও খোদায়ী রহমতের স্থান। মহান আল্লাহ নবী-পরিবারের মাধ্যমে ইসলামকে উদ্বোধন করেছেন এবং এই বংশকে সঙ্গে নিয়েই ইসলামকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নেবেন। আর ইয়াজিদ যার আনুগত্য করতে তুমি আমায় বলছ সে হচ্ছে এমন এক মদখোর ও খুনি যার হাত নিরপরাধ মানুষের রক্তে রঞ্জিত। সে হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে আল্লাহর বিধি-বিধানের সীমানা লণ্ডভণ্ড করেছে এবং জনগণের সামনেই নানা অশ্লীল কাজ ও পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় অমন উজ্জ্বল রেকর্ড ও উন্নত পারিবারিক ঐতিহ্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আমার মত একজন ব্যক্তি কী এই পাপিষ্ঠের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে বা তার নেতৃত্ব মেনে নেবে? তোমার ও আমার উচিত এ বিষয়ে ভবিষ্যতের দিকে নজর দেয়া এবং তাহলে দেখতে পাবে যে খেলাফত বা মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আমাদের মধ্যে কে বেশি উপযুক্ত?'
এভাবে ইসলামের সেই চরম দুর্দিনে নানার ধর্ম ও সম্মান রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন তাঁরই সুযোগ্য নাতি হযরত ইমাম হুসাইন (অ)। মহানবী (সা) তাঁকে উম্মতের নাজাতের তরী ও হেদায়াতের প্রদীপ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এর অর্থ ইমাম হুসাইনের (আ) দেখানো পথ ও আদর্শ অনুসরণ ছাড়া মুসলমানরা তাদের ঈমান ও পবিত্র ধর্মকে রক্ষা করতে পারবে না। বিশ্বনবী (সা) গোটা আহলে বাইতকে (আ) নুহের নৌকার সঙ্গে তুলনা করলেও ইমাম হুসাইনের (অ) ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ওই বিশেষণ যুক্ত করেছেন যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একজন ডুবন্ত বা আহত ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য দ্রুত গতিশীল বাহন বা গাড়ি দরকার। অন্যদিকে সাধারণ রোগীকে ধীরে-সুস্থে বা কিছুটা পরেও সাধারণ কোনো গাড়িতে চড়িয়ে হাসপাতালে নেয়া যায়। কারবালার মহাবিপ্লবের আদর্শ ও ইমাম হুসাইনের (আ) ভূমিকা মৃতপ্রায় ইসলামকে বাঁচানোর জন্য দ্রুত গতিশীল নৌকা বা বাহনের ভূমিকাই পালন করেছিল। #
source : irib