(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইমাম আলী (আ.)-এর সংস্কার কার্যক্রম : নিম্নে আমরা এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেব:
ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ভোজ সভায় যোগদান করার জন্য হযরত আলী (আ.) তাঁর এক প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে তিরস্কার ও নিন্দা করেছিলেন। একবার বাইতুল মাল স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা দ্বারা ভরে গেলে হযরত আলী (আ.) জনগণকে ডেকে সেগুলো তাদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করে দিয়েছিলেন।১
ভ্রাতুষ্পুত্র আবদুল্লাহ্ ইবনে জাফর একবার হযরত আলী (আ.)-এর কাছে বাইতুল মাল থেকে অতিরিক্ত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্যের আবেদন করলে তাঁর এ আবেদন তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং বলেছিলেন,“না,মহান আল্লাহর শপথ,তোমার জন্য কোন কিছু খুঁজে পাচ্ছি না,কেবল তোমার নিজ চাচাকে তোমার চুরির আদেশ দান ব্যতীত।”২
হযরত আলী (আ.) ব্যবসায়ীদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং লেন-দেনের ক্ষেত্রে ন্যায়ভিত্তিক আচরণ করতে,সূদের নিকটবর্তী না হতে,ইনসাফের সাথে দাড়ি-পাল্লা ও ওজন মাপক যন্ত্রগুলোকে পূর্ণ করতে এবং ক্রেতাদেরকে পণ্যে না ঠকাতে বলতেন।
এ ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর অনুসৃত নীতি। আর এর মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচারের এক উজ্জ্বল বাস্তব চিত্রও ফুটে ওঠে।
হযরত আলী (আ.)-এর কাছে তাকওয়া-পরহেজগারী,ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী হওয়া,জিহাদ এবং মহানবী (সা.)-এর সাহচর্য বা সাহাবী হওয়া অর্থনৈতিক অধিকারসমূহের ক্ষেত্রে প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব পাওয়ার মাপকাঠি ছিল না;বরং এগুলো ছিল পরকালে মহান আল্লাহর কাছে উচ্চ সম্মান-মর্যাদা এবং পুণ্যার্জনের সোপান। এ পার্থিব জগতে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সকল মানুষ সমান এবং এ ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই। সবার মাঝে সম্পদ সমানভাবে বণ্টন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য করা যাবে না;বরং বৈষম্য করাটাই হচ্ছে ইসলামী নীতিরিরুদ্ধ।
মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় সকল নাগরিক সমান আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত এবং তাদের মাঝে সম্পদ সমানভাবে বণ্টন করা হতো। মহানবী (সা.)-এর পরে প্রথম খলীফার আমলেও এ নীতি মোটামুটি পালিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমরের আমলে এ নীতিতে পরিবর্তন আনা হয় এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বাইতুল মাল থেকে বিভিন্ন ধরনের ভাতা প্রদান করা হতে থাকে।৩ তবে তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের আমলে বাইতুল মালের সম্পদ বণ্টন ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দান ও ভোগ করার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। এ সময় উমাইয়্যা বংশীয়গণ ও তাদের বশংবদগণই বায়তুল মালের সিংহভাগ সম্পদ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে থাকে যা সর্বজনবিদিত ঐতিহাসিক সত্য। এ কারণেই এ সময় মুসলিম বিশ্বে ধনী-দরিদ্রের মাঝে দুস্তর ব্যবধানের সৃষ্টি হয় এবং সর্বপ্রথম জমিদারী প্রথার উদ্ভব হয়। উমাইয়্যা বংশীয়গণ বাইতুল মালকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত ও কুক্ষিগত করে ফেলেছিল এবং প্রশাসনকে সম্পূর্ণ কব্জা করে ফেলেছিল। অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অনিয়ম জনগণকে ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী করে তুলেছিল যার ফলাফল সবারই জানা আছে।
অর্থনৈতিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর সাম্য নীতি কুরাইশদের জন্য প্রচণ্ডভাবে অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়। হযরত আলী (আ.) অধিকারসমূহের ক্ষেত্রে স্বাধীন ও দাস,সাদা-কালো এবং আরব-অনারবের মধ্যে কোন পার্থক্য করতেন না।
আয যুবাইর ইবনুল আওয়াম এবং তালহা বিন উবাইদুল্লাহ্ সম্পদ বণ্টন ও অধিকারসমূহ প্রদান করার ক্ষেত্রে হযরত আলীর সাম্য নীতি ও উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান ও সমালোচনা করেন এবং মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর জনগণ যে পথ ও পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল তার পরিপন্থি বলেই মনে করতে থাকেন।
হযরত আলী (আ.) তাঁদেরকে বিরোধিতা করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন,“বণ্টন করার ক্ষেত্রে আপনি আমাদের অধিকারকে অন্যদের অধিকারের ন্যায় করছেন (সমান করে দিয়েছেন) এবং আমাদের সাথে যাদের তুলনা করা যায় না তাদের এবং আমাদের মাঝে সাম্য নীতি অবলম্বন করেছেন।”
এ ব্যাপার তাঁদের দু’জনকে উদ্দেশ্য করে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন :
“তবে তোমরা দু’জন যে আদর্শের (সম বণ্টনের) ব্যাপারে যা কিছু উল্লেখ করেছ আসলে তা হচ্ছে এমন বিষয় যে ব্যাপারে আমি আমার মর্জি মাফিক কোন বিধি জারী করি নি ও সিদ্ধান্ত নেই নি,প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েও আমি কোন প্রকার হস্তুক্ষেপ করি নি;বরং আমি এবং তোমরা সবাই অবশ্যই প্রত্যক্ষ করেছি যে,মহানবী (সা.) যা আনয়ন ও প্রবর্তন করেছিলেন তা-ই পালন করা হয়েছে। সুতরাং মহান আল্লাহ্ যে বিষয়ের বণ্টন নীতি সুস্পষ্ট নির্ধারণ করে দিয়েছেন সে ব্যাপারে আমি তোমাদের দু’জনের প্রতি মোটেও মুখাপেক্ষী নই। অতএব,মহান আল্লাহর শপথ,তোমাদের ও অন্যদের এ ব্যাপারে আমাকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করার কোন অধিকার নেই। মহান আল্লাহ্ আমাদের ও তোমাদের অন্তঃকরণসমূহকে সত্যের দিকে পরিচালিত করুন।” (নাহজুল বালাগাহ্)
হযরত আলী (আ.)-এর এ বক্তব্য যে তালহা ও যুবাইরকে সন্তুষ্ট করে নি এটিই স্বাভাবিক। তাই তাঁরা দু’জন হযরত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং হযরত উসমানের হত্যার বিচারের দাবি তুলে তাঁর বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে উত্তেজিত করতে লাগলেন। তাঁদের সৃষ্ট এ ফিতনা উম্মতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে দামেস্কের শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানকে হযরত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করে যা ইতিহাসে সিফ্ফিনের যুদ্ধ বলে খ্যাতি লাভ করেছে। তাঁরা (তালহা ও যুবাইর) মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী হযরত আয়েশা বিনতে আবু বকরকে তাঁদের সাথে বসরা গমন করতঃ হযরত আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধে নেতৃত্বদানের ব্যাপারে সম্মত করাতে সক্ষম হন। আসলে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যে সব আদেশ দিয়েছেন সেগুলো থেকেই আলীর কর্মপদ্ধতি ও রীতিনীতির উদ্ভব,আর আলীর বিরোধিতাকারীরা সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকেই তাঁদের কর্মপদ্ধতি ও রীতিনীতি উদ্ভাবন করতেন।
রাজনীতি ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর সংস্কার কার্যক্রম
হযরত আলী (আ.) তাঁর খিলাফতকালে ইতিহাসে যে সবচেয়ে বড় সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিলেন তা ছিল হযরত উসমানের আমলে বিভিন্ন অঞ্চলে ও প্রদেশে দুর্নীতিপরায়ণ শাসনকর্তা ও প্রাদেশিক গভর্নরদের সমস্যা। এদের অধিকাংশই ছিল অত্যাচারী,সীমালঙ্ঘনকারী ও অবিশ্বস্ত। তারা জনগণের মান-সম্ভ্রম ও জান-মালের ব্যাপারে মোটেও বিশ্বস্ত ছিল না। তাই আলী (আ.) খলীফা নির্বাচিত হয়েই হযরত উসমান কর্তৃক নিযুক্ত উমাইয়্যা বংশীয় দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও দৃস্কৃতিকারী গভর্নরদেরকে পদচ্যুত করতে মনস্থ করলেন। তাদের পদচ্যুত করার আরো কতিপয় কারণ ছিল। সেগুলো নিম্নরূপ :
১. হযরত আলী (আ.)-এর বৈপ্লবিক সংস্কার কার্যক্রম-যার মাধ্যমে তিনি মুসলিম উম্মাহর অবনতিশীল মন্দ অবস্থার সংস্কার ও পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। আর তা ছিল বিশ্বস্ত ধার্মিক ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য দুর্নীতিপরায়ণ এসব প্রাদেশিক শাসনকর্তা অপসারণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
২. সাময়িকভাবে হলেও ঐ সকল জালেম দুর্নীতিপরায়ণ শাসকদের স্বীয় পদে অধিষ্ঠিত রাখা হলে পরবর্তীতে তা তাদেরকে বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে এক বিরাট বাধা হয়ে দেখা দিত। কারণ এর ফলে স্বভাবতই মুসলিম উম্মাহর মনে প্রশ্ন দেখা দিত যে,যদি এসব শাসনকর্তা অযোগ্যই হয়ে থাকে,তাহলে তিনি কি কারণে তাদেরকে তাদের পদে বহাল রেখেছিলেন? আবার যদি তারা যোগ্যই হয়ে থাকে তাহলে কেনই বা তিনি তাদেরকে তাদের পদ থেকে অপসারণ করছেন?
৩. হযরত আলী (আ.) যদি ঐ সকল শাসনকর্তাদেরকে তাদের পদে অধিষ্ঠিত রাখতেন তাহলে তাদের যাবতীয় অপকর্ম,পাপ,অন্যায়,সীমালঙ্ঘন এবং অপরাধের সকল দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই বর্তাত;কারণ তিনি তাদের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। তাই এসব অযোগ্য পাপিষ্ঠ শাসনকর্তাদেরকে তাদের পদ থেকে অপসারণ করা ছিল তাঁর ন্যায়সংগত ও শারয়ী অধিকার।
৪. এ সকল ফাসিক শাসনকর্তাদেরকে তাদের পদে বহাল রাখার কারণে এমন এক ঐতিহাসিক শারয়ী-নযীর ও উদাহরণের সৃষ্টি হতো যার ফলে শারয়ী অথবা রাজনৈতিক ফায়দার ধুঁয়ো তুলে ফাসিক শাসকবর্গকে নিযুক্ত অথবা তাদেরকে তাদের নিজ নিজ পদে বহাল রাখা বৈধ বলে পরিগণিত হতো।
ইমাম আলী (আ.)-এর অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার কার্যক্রম এবং ইসলামী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য স্বার্থবাদীরা,বিশেষ করে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বনি উমাইয়্যা যারা মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর পরই প্রশাসনিক ক্ষমতা ও প্রভূত অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও শক্তির অধিকারী হয়েছিল তারা হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে সিফ্ফিনের যুদ্ধের সূচনা করে। আর এ যুদ্ধে আমর ইবনে আসের পরামর্শে মুয়াবিয়ার আদেশে শামীয় বিদ্রোহীদের বর্শার মাথায় পবিত্র কোরআন ঝুলানো এবং পবিত্র কোরআনের মীমাংসার দিকে আহ্বান চরম নৈরাশ্যবাদী খারেজী ফিতনার উদ্ভব ঘটায়। অবশেষে খারেজী চক্রান্তে হযরত আলী (আ.) শহীদ হন। হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর ইসলামের শত্রু বনি উমাইয়্যা প্রকৃতপক্ষে পুরো প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। এরা ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী এবং ইসলামী ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। তাই এরা যে কারণে হযরত আলী (আ.)-এর বিরোধিতা এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছিল সেই একই কারণে তারা ইমাম হাসানের খিলাফতের বিরোধিতা করে তাঁকে খিলাফত ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল এবং ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ঐ একই কারণে কারবালায় পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ-বাহিনীর হাতে স্বীয় সঙ্গী-সাথীসহ করুণভাবে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছিল। তাই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কিয়াম ও আন্দোলনের সঠিক মূল্যায়নের জন্য ‘হযরত আলী (আ.)-এর সাথে কেন বিরোধিতা করা হয়েছিল?’-এ প্রশ্নটির সঠিক জবাব দান অতীব জরুরী বিধায় এ ব্যাপারে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। (চলবে)
তথ্যসূত্র :
১. সিবতু ইবনিল জূযী প্রণীত তাযকিরাতুল খাওয়াস,পৃ. ১১৭।
২. শারহু নাহজিল বালাগাহ্,ইবনুল আবিল হাদীদ প্রণীত,২য় খণ্ড,পৃ. ২০০।
৩. আল্লামা বালাযুরী প্রণীত ফুতূহুল বুলদান,‘হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ভাতা জারির বিবরণ’,পৃ. ৪৬৩-৪৭৫,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।
(জ্যোতি বর্ষ ২ সংখ্যা ৪)