সূরা হুদ; আয়াত ৬-৮
সূরা হুদের ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ
“পৃথিবীর প্রত্যেক জীবের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত। সুস্পষ্ট গ্রন্থে সব কিছুই আছে।” (১১:৬)
এই আয়াতে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার অফুরন্ত নেয়ামত এবং তার নিরঙ্কুশ ও সর্বাত্মক জ্ঞানের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই হচ্ছেন, জীবিকা ও জীবনোপকরণের মালিক। এই আয়াতের মত পবিত্র কুরআনের আরো অনেক আয়াত থেকে এটা বুঝা যায় যে,মহান আল্লাহ শুধুমাত্র জীবের সৃষ্টিকর্তাই নন,তিনি সকল জীবের প্রতিপালক। মানুষসহ ছোট বড় সকল জীবের জীবনোপকরণ তিনিই প্রদান করেন। কোন কিছুই আল্লাহর আয়ত্তের বাইরে নেই।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একদিকে আলো-বাতাস, তাপ-অক্সিজেনসহ নানা উপকরণের মাধ্যমে এই বিশ্বজগতকে জীবের বসবাস উপযোগী করেছেন অপরদিকে এসব নেয়ামত কিভাবে ব্যবহার করা উচিত সেই শিক্ষাও মানুষকে দান করেছেন। মায়ের বুকে যেমন নবজাতক শিশুর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন তেমনি মায়ের দুধ কিভাবে খেতে হবে নবজাতক শিশুকে সেই শিক্ষাও দিয়ে দিয়েছেন।
এই আয়াত থেকে আমরা এটা বুঝে নিতে পারি যে,আল্লাহতায়ালা সকল সৃষ্টজীবের এবং জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করেছেন, এটা আল্লাহর প্রতি সকল সৃষ্টজীবের অধিকার। তবে এর অর্থ এই নয় যে, মানুষ তার জীবিকার জন্য আল্লাহর ওপর নির্ভর করে বসে থাকবে। জীবিকার জন্য প্রত্যেককে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে চেষ্টা চালাতে হবে ।
সূরা হুদের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَلَئِنْ قُلْتَ إِنَّكُمْ مَبْعُوثُونَ مِنْ بَعْدِ الْمَوْتِ لَيَقُولَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَذَا إِلَّا سِحْرٌ مُبِينٌ
“তিনি সেই সত্ত্বা যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। আর তার আরশ ছিল পানির উপরে যেন তিনি যাচাই করতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে কে আচরণে শ্রেষ্ঠ। হে পয়গম্বর! আপনি যদি বলেন যে, মৃত্যুর পর তোমরা পুনরুত্থিত হবে , তাহলে অবিশ্বাসীরা নিশ্চয়ই বলবে এ তো স্পষ্টত অলীক কল্পনা।” (১১:৭)
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন পানি বা পানির কোন উপাদান থেকে। তিনি এই বিশ্ব জগতকে মুহূর্তেই সৃষ্টি করেননি বরং ধাপে ধাপে এবং দীর্ঘমেয়াদে তা সৃষ্টি করেছেন। মানুষ প্রকৃতির নিয়ম এবং নানা পরীক্ষার ভিতর দিয়ে আত্মিক উৎকর্ষতা এবং পূর্ণতা অর্জন করবে এটাই মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য। প্রকৃতিতে আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যম হচ্ছে সৎকর্ম। আর এর প্রেরণা হচ্ছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। পরীক্ষার নিয়মই হচ্ছে একদল তাতে কৃতকার্য হবে এবং আরেকটি দল হবে ব্যর্থ। নশ্বর জীবনের পরীক্ষার ফল জানা যাবে পরকাল। সেখানে প্রত্যেকেই তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত ফল লাভ করবে। আল্লাহতায়ালা ইচ্ছে করলে যে কোন বস্তু মুহূর্তেই সৃষ্টি করতে পারেন । কারণ তিনি সর্বময় ক্ষমতাবান। কোন নেতিবাচকতা তার সত্ত্বার জন্য অকল্পনীয় । তবে আল্লাহতায়ালা প্রকৃতিতে বা সৃষ্টিজগতে ক্রমপর্যায়ের ধারা প্রবর্তন করেছেন। ফলে প্রকৃতির সবকিছুই সম্পন্ন হয় ধাবে ধাপে।
এই সূরার ৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন-
وَلَئِنْ أَخَّرْنَا عَنْهُمُ الْعَذَابَ إِلَى أُمَّةٍ مَعْدُودَةٍ لَيَقُولُنَّ مَا يَحْبِسُهُ أَلَا يَوْمَ يَأْتِيهِمْ لَيْسَ مَصْرُوفًا عَنْهُمْ وَحَاقَ بِهِمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ
“নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য আমি যদি ওদের শাস্তি স্থগিত রাখি তাহলে ওরা নিশ্চয়ই বলবে, কিসের ফলে আমাদের শাস্তি বাধা প্রাপ্ত হয়েছে। জেনে রাখ, শাস্তি যেদিন তাদের নিকট আসবে সেদিন তাদের নিকট থেকে তা আর ফিরে যাবে না এবং যা নিয়ে তারা ঠাট্টা বিদ্রুপ করে তা তাদের পরিবেষ্টন করবে।” (১১:৮)
মানুষ যাতে আল্লাহর অবাধ্য না হয়, পাপ এবং মন্দ কাজ না করে সেজন্য নবী রাসূলগণ সব সময়ই সতর্ক করে দিতেন। পৃথিবীতেই যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে সে ব্যাপারে পয়গম্বরগণ বারবার সাবধান করে দিতেন। কিন্তু পাপাচারী মানুষ অজ্ঞাত ও দম্ভের বশবর্তী হয়ে নবী-রাসূলদের সতর্ক বাণী নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করতো এবং এ নিয়ে তারা নানা রসিকতায় মেতে উঠতো।'
এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমি বিশেষ অনুগ্রহের কারণে যদি কোন পাপাচারী সম্প্রদায়কে শাস্তি দিতে বিলম্ব করি তার অর্থ এই নয় যে, তারা শাস্তি বা প্রতিদান থেকে অব্যাহতি পেয়ে গেছে। বরং পাপাচারী সম্প্রদায় এই জগতেই তাদের শাস্তি লাভ করবে। তারা যা নিয়ে রসিকতা করতো তাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, শাস্তি বিলম্বিত হলে অনেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি অনুশোচনার সুযোগ লাভ করতে পারবে।
আল্লাহতায়ালা মানুষকে পাপ এবং অতীত ভুলে সংশোধনের জন্য সময় দিতে থাকেন। ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা অবিশ্বাসী কাফিরদের একটি বৈশিষ্ট্য। ঈমানদার মুসলমানদের যুক্তি খণ্ডন করার মতো তাদের কাছে যখন কোন যুক্তি থাকে না তখনই তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ বা রসিকতায় মেতে উঠে।