দূরে বহু দূরে দিগন্ত রেখা যেখানে আকাশের সাথে মিশে আছে বলে মনে হয়, সেই স্থানে যাবার পর দিগন্ত রেখা যেমন আরো দূরে চলে যায় এবং এভাবে তা সব সময়ই যেমনটি নাগালের বাইরে থেকে যায় তেমনি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র কন্যা হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)ও এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাঁর অতুল সম্মান, মর্যাদা, গুণ, আদর্শ ও সামগ্রীক ব্যক্তিত্ব তুলে ধরা বা উপলব্ধি করা অসম্ভব ৷ তবুও গত ১৪০০ বছর ধরে অনেক চিন্তাবিদ, বক্তা ও লেখক নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ নারী ও আদর্শ এই মানবীর অতুল মহত্ত্ব এবং ব্যক্তিত্বের নানা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ৷ মহান আলেম ও ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর দৃষ্টিতে হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র অসাধারণ ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করা জরুরী ৷ কারণ, তিনি গোটা মানব জাতির জন্যে ও বিশেষ করে নারী জাতির জন্যে আদর্শ ৷
হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.) এমন এক পরিবারে শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেয়েছেন যে পরিবার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবার এবং যে পরিবার নৈতিক গুণাবলী ও আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার অশেষ ফল্গুধারার উৎস৷ খোদাভীতি ও মানবীয় গুণাবলীর পরিপূর্ণতম আদর্শ আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল বিশ্বনবী (সা.)’র তত্ত্বাবধানে বিকশিত হয়েছিল হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র ব্যক্তিত্ব ৷ এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, হযরত ফাতিমা (সা.) তাঁর পুরো শৈশব কাটিয়েছেন পিতা বিশ্বনবী (সা.)’র সান্নিধ্যে ৷ সে সময়ই তিনি ছিলেন বিশ্বসেরা ও অবিস্মরণীয় সংগ্রামী ৷ হযরত ফাতিমা (সা.) শৈশবেই মক্কার সংগ্রামী জীবনের কষ্টকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন ৷ তাঁকে থাকতে হয়েছিল অবরুদ্ধ শোআবে আবুতালিব বা আবুতালিব উপত্যকায় ৷ সেখানে অনাহারসহ সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন ধরনের কষ্ট ও দূর্ভোগ তাঁকে সইতে হয়েছিল ৷ পরবর্তীকালে মদীনায় হিজরতের পর তিনি হয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তির স্ত্রী যাঁর সমগ্র জীবন কেটেছে আল্লাহর পথে জিহাদ বা সংগ্রামে ৷
হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র অন্যতম গৌরবময় উপাধি ছিল উম্মে আবিহা ৷ যার অর্থ হলো পিতার মাতা ৷ কারণ ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে কষ্ট বা বেদনার ফলে তাঁর পিতা যেসব অস্বস্তি বা দূর্ভোগের সম্মুখীন হতেন তা দূর করতে এবং পিতার প্রশান্তির জন্যে মা ফাতিমা (সা.) এত বেশী প্রচেষ্টা চালাতেন যে তা সন্তানের জন্যে মায়ের আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা ও ব্যথিত চিত্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ৷ হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র আত্মত্যাগ সম্পর্কে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, মক্কী জীবনে মুশরিক কোরাইশরা রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের ওপর প্রবল অত্যাচার করেছিল ৷ তাঁদেরকে মক্কার কাছে শোআবে আবু তালিব উপত্যকায় অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে থাকতে হয়েছে ৷ এ সময়ই রাসূল (সা.)’র বিশ্বস্ত দুই সহায় তথা স্ত্রী হযরত খাদিযা (সা.) ও চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন ৷ আর এ অবস্থায় মমতাময়ী হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.) পিতার দুঃখ ও বেদনা লাঘবে সবচেয়ে বড় সহায় হিসেব পাশে থেকেছেন ৷
খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র ছিল অসাধারণ অনেক গুণ ৷ ফলে তিনি ছিলেন এক আদর্শ মানুষ ৷ তাঁর উচ্চতর আধ্যাত্মিক মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়েদ আলী খামেনেয়ী বলেছেন, ‘বাহ্যিক দিক থেকে হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)একজন মানুষ, একজন নারী তথা একজন যুবতী নারী, কিন্তু আধ্যাত্মিক দিক থেকে তিনি এক মহান বাস্তবতা, এক অত্যুজ্জ্বল খোদায়ী নূর এবং একজন পবিত্র বান্দা ৷ তিনি অতি উচ্চস্তরের ও আল্লাহর নির্বাচিত বা নৈকট্যপ্রাপ্ত মানুষ ৷ বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিনে বা বিচার দিবসে আলী (আ.) ঈমানদার পুরুষ এবং ফাতিমা (সা.) মুমিন নারীদেরকে বেহেশতের পথ দেখিয়ে দেবেন ৷
নবীনন্দিনী হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.) আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে এত উচ্চ পর্যায়ে ছিলেন যে, আল্লাহর ফেরেশতারা তাঁর সাথে কথা বলতেন এবং তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী বলে অভিহিত করেছেন ৷ মাসহাফে ফাতিমা শীর্ষক একটি বই হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র রচনা হিসেবে স্বীকৃত ৷ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিভিন্ন বর্ণনায় বলা হয়েছে, ইমামগণ বা মহানবী (সা.)’র আহলেবাইত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান জানার জন্যে মাসহাফে ফাতিমার শরণাপন্ন হতেন৷ রাসূল (সা.)’র আহলে বাইতের একজন সদস্য এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এ বইয়ে শুধু হালাল ও হারামের বিধান ছাড়াও মানবজাতির ভবিষ্যত ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে৷ এটা কি অতি উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান নয়? এ তো অসাধারণ প্রজ্ঞা ও হেকমাতের নিদর্শন যা মহান আল্লাহ একজন মহিলাকে যুব বয়সেই দান করেছেন ৷ এসবই আধ্যাত্মিকতার সাথে সম্পর্কিত ৷
ইবাদতের ক্ষেত্রে হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র বিনয়ও ছিল অসাধারণ ৷ এ প্রসঙ্গে হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ফাতিমা (সা.) যখন এবাদতে মশগুল হতেন তখন মহান আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত হাজার হাজার ফেরেশতা তাঁকে সম্বোধন করে সালাম করতেন ও তাঁর ওপর দরুদ পেশ করতেন ৷
মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতা বা আল্লাহর ইচছার কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনের কারণেই হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.) এ ধরনের যোগ্যতা বা সম্মানের অধিকারী হয়েছেন ৷ এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, ফাতিমা (সা.)’র আধ্যাত্মিক মর্যাদা ও অবস্থান পুরোপুরি উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় ৷ হযরত ফাতিমা (সা.)’র আমল বা কাজের বৈশিষ্ট হলো তিনি সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর বিধানের কাছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পন করেছিলেন ৷ এ কারণেই ইসলামের ইতিহাসে তিনি এক নজিরবিহীন সংগ্রামী এবং মাজলুমিয়াত ও সত্যের পতাকাবাহী হিসেব স্বীকৃতি পেয়েছেন ৷
পিতা এবং স্বামীর মতো অনাড়ম্বর ও সাধাসিধে জীবন যাপন ছিল হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র জীবনের ভূষণ ৷ এ সম্পর্কিত বহু দৃষ্টান্তের মধ্যে সাদাসিধে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর বিয়ের ঘটনাও ছিল অন্যতম ৷ আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ইসলামী দুনিয়ার সর্বপ্রধান ব্যক্তিত্বের কন্যার বিয়ের মোহরানা ও উপহার ছিল কত সাদামাটা ও দারিদ্রব্যাঞ্জক!
সাদামাটা ও দরিদ্র জীবন সত্ত্বেও দরিদ্র ও অভাবীরা ফাতিমা (সা.)’র সাহায্য থেকে বঞ্চিত হত না ৷ তিনি বেশ কয়েকবার ঘরের সবচেয়ে দামী বা ভালো জিনিষ অভাবী ব্যক্তিকে দান করেছিলেন ৷ পবিত্র কোরআনের সূরা দাহরে হযরত ফাতিমা (সা.)সহ আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.), ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (রা.)’র দানশীলতার প্রশংসা করা হয়েছে ৷
ব্যক্তিগত জীবন ছাড়াও স্বামী সেবা ও সন্তান প্রতিপালন তথা পারিবারিক জীবনেও হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.) ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ৷ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, হযরত ফাতিমা (সা.) সম্পর্কে আমীরুল মুমেনিন আলী (আ.) বলেছেন, গোটা দাম্পত্য জীবনে ফাতিমা আমাকে একবারও রাগান্বিত করেনি৷
সত্যের পথে সংগ্রাম ছিল হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র স্বল্পায়ু জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক৷ এ প্রসঙ্গে আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়েদ আলী খামেনেয়ী বলেছেন, হযরত ফাতিমা (সা.) বিশ বছরের বেশী জীবীত ছিলেন না, কিন্তু তাঁর সংগ্রাম, বিপ্লবী তৎপরতা, ধৈর্য, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, ভাষণ এবং নবুওত, ইমামত ও ইসলামী রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্যে তাঁর সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা সাগরের মতো বিস্তৃত ছিল, অবশেষে এ পথেই তিনি শাহাদত বরণ করেছেন৷ তাঁর সংগ্রামী জীবন সত্যিই অতুলনীয় এবং নিশ্চয়ই মানুষের মনে তা ব্যতিক্রমী ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ভাস্বর৷
হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র এ ধরনের অসাধারণ গুণের কারণেই বিশ্বনবী (সা.) তাঁকে বিশেষভাবে ও অসাধারণ পর্যায়ে সম্মান করেছেন৷
এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বিশ্বনবী (সা.)’র একজন স্ত্রীর বর্ণনা উদ্বৃত করে বলেছেন, ফাতিমা জাহরা (সা.) যখন রাসূলে খোদা (স.)’র কাছে আসতেন তখন তিনি উঠে দাঁড়াতেন এবং গভীর মমতা নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে যেতেন৷ তিনি ফাতিমা (সা.)কে চুম্বন করতেন এবং ফাতিমা (সা.)’র হাত ধরে তাঁকে নিজের আসনে বসাতেন৷ ফাতিমা (সাঃ) এমনই সম্মানের অধিকারী!
এ কারণেই রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ফাতিমা (সা.)রাগান্বিত হলে আল্লাহ ক্রুদ্ধ হন এবং তাঁর খুশীতে আল্লাহ খুশী হন৷ এ থেকেও বোঝা যায় হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.) তাঁর আমল বা কাজকর্ম ও কথাসহ সব দিক থেকে একজন আদর্শ মানুষ ও নারী জাতির আদর্শ৷ এজন্যেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়েদ আলী খামেনেয়ী বলেছেন, হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (সা.)’র জীবনের সমস্ত বক্তব্য, কথা ও ইঙ্গিতে আমাদের জন্যে শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে৷