বাঙ্গালী
Monday 25th of November 2024
0
نفر 0

ইমাম হাসান (আ.)-এর জন্মদিন

ইমাম হাসান (আ.)-এর জন্মদিন

১৫ রমজান ইমাম হাসান ইবনে আলী আল-মুজতাবা (আ.)-এর জন্মদিন। তৃতীয় হিজরির এই দিনে তিনি মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের দিনটি ছিল মঙ্গলবার।

হযরত হাসান (আ.)-এর মূল নাম ছিল আল-হাসান এবং আল-মুজতবা ছিল তাঁর উপাধি। তাঁর একটি ডাক নাম ছিল আবু মুহাম্মাদ। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) ছিলেন তাঁর পিতা এবং মহানবী (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতেমা (আ.) ছিলেন তাঁর মাতা। ইমাম হাসান ছিলেন তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র। হযরত হাসান ছিলেন মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যেদিন তাঁর এই দৌহিত্রের জন্মের আনন্দ সংবাদ শোনেন সেদিন তিনি তাঁর স্নেহাস্পদ কন্যার বাড়িতে যান এবং  নবজাতককে কোলে তুলে নেন। তিনি শিশু হাসানের ডান ও বাম কানে যথাক্রমে আযান ও ইকামত দেন এবং আল্লাহ তাআলার নির্দেশ মোতাবেক তাঁর নাম রাখেন আল-হাসান।

ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)-এর শৈশব জীবনের প্রথম সাত বছর অতিবাহিত হয় মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দয়ার্দ্র পৃষ্ঠপোষকতায়। তিনি তাঁর সকল মহান গুণের শিক্ষা দান করে এবং খোদায়ী জ্ঞান, ধৈর্য, সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা, দানশীলতা ও সাহসিকতার প্রশিক্ষণ দিয়ে ইমাম হাসান (আ.)-কে সমৃদ্ধ করে তোলেন। জন্মগতভাবে মাসুম এবং আল্লাহ কর্তৃক স্বর্গীয় জ্ঞানে সজ্জিত হওয়ায় তাঁর অন্তরাত্মা লওহে মাহফুজে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।

আল্লাহতাআলার পক্ষ থেকে যখনই কোনো অহী নাজিল হতো এবং মহানবী (সা.) তাঁর সঙ্গী-সাথিদের কাছে তা পকাশ করতেন ইমাম হাসান তৎক্ষণাত তা অবগত হতেন। মহানবী (সা.) প্রায়শঃই বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করতেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে হযরত ফাতেমা (আ.)-কে বলার আগেই তিনি নতুন নাযিলকৃত অহীর আয়াতসমূহ হুবহু তেলাওয়াত করছেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে হযরত ফাতেমা মহানবী (সা.)-কে জানান যে, ঐ আয়াতগুলো তিনি ইমাম হাসানের কাছ থেকে শিখেছেন।

ইমাম হাসান আল-মুজতাবা এত অধিক নিষ্ঠার সাথে নামায আদায় করতেন যে, সেজদাকালে তাঁর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই যেন আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যেত। তাঁর জীবনের অধিকাংশ রাত অতিবাহিত হয়েছে জায়নামাযের ওপর। নামাযের মধ্যে এত বেশি বিনীত ও আত্মনিবেদিত ভাব সৃষ্টি হতো যে, খোদার ভয়ে তাঁর চোখে অঝোর ধারায় পানি এসে যেত। ওজুর সময় থেকেই খোদার ভয়ে ইমাম হাসানের শরীরে কম্পন সৃষ্টি হতো এবং নামাযের সময় তাঁর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যেত। নামাযের মধ্যে তিনি এত ধ্যানমগ্ন ও খোদার সাথে একাত্ম হয়ে যেতেন যে, আশপাশের অবস্থা সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি যেন অবচেতন হয়ে যেতেন।

বিলাসী জীবনযাপনের মতো পর্যাপ্ত বিষয়-সম্পত্তি ইমাম হাসান (আ.)-এর ছিল, কিন্তু তিনি তার সবটাই দরিদ্রদের কল্যাণে ব্যয় করেছেন।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৌজন্যবোধ সম্পন্ন ও নিরহংকার মানুষ। রাস্তার ভিক্ষুকদের পাশে বসতে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না। ধর্মীয় বিষয়াদিতে জিজ্ঞাসার জবাব দিতে তিনি মদীনার পথেও বসে যেতেন। তিনি অত্যন্ত সম্প্রীতিবোধসম্পন্ন ও অতিথিপরায়ণ ছিলেন এবং কোনো দরিদ্র ও নিঃস্ব লোক তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি তাদেরকে কখনই খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি।

মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর এক ঘটনাবহুল যুগের সূচনা হয়। এমনি ধরনের এক পরিবের্তনের পর্যায়ে ইমাম আল-হাসান আল-মুজতাবা (আ.) তাঁর মহান পিতা ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে মিলিত হয়ে ইসলামের শান্তির বাণী ও মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা প্রচারের পবিত্র মিশন অব্যাহত রাখেন।

২১ রমজান ইমাম আলী (আ.) শাহাদাত লাভ করলে সেদিন থেকেই হযরত হাসান ইমামতি লাভ করেন। মুসলমানদের অধিকাংশই তাঁর কাছে আনুগত্যের অঙ্গীকার ঘোষণা করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাইয়াত গ্রহণ করে। নেতৃত্ব গ্রহণের সাথে সাথে ইমাম আল-হাসান আল-মুজতাবা (আ.)-কে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী সিরিয়ার গভর্নর আমীরে মুআবিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। অবশ্য, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা মোতাবেক মুসলমানদের একটি ব্যাপক হত্যাকাণ্ড এড়ানোর জন্য তিনি মুআবিয়ার সাথে একটি শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হন (যদিও মুআবিয়া পুরোপুরি ঐ চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাননি এবং মেনে চলেননি)। তবে এভাবে তিনি ইসলামকে রক্ষা করেন ও গৃহযুদ্ধ বন্ধ করেন। তাই বলে এই শান্তি চুক্তির অর্থ কখনই মুআবিয়ার স্থায়ী নেতৃত্ব মেনে নেয়া বুঝায় না। এটি ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসন হস্তান্তরের একটি অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা এবং তাও এই শর্তে যে, মুআবিয়ার ইন্তেকালের পর প্রশাসন ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং পরবর্তীকালে ইমাম হোসাইন (আ.) তার উত্তরাধিকারী হবেন। এই ঘটনার পর ইমাম আল-হাসান আল-মুজতাবা (আ.) প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকেন, তবে ধর্মীয় নেতৃত্ব নিজের কাছেই সংরক্ষণ করেন এবং মদীনায় ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।

ইমাম হাসান মুজতাবার বিরুদ্ধে চক্রান্ত এতদূর পর্যন্ত পৌঁছায় যে, তাঁর স্ত্রী যাদাকে পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের সাথি করে নেয়া হয়। যাদা ইমামকে বিষপান করায়, যা তাঁর যকৃতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এভাবে ইমাম হাসান (আ.) এক মারাত্মক অনিষ্টকর অপকর্মের শিকার হন এবং ৫০ হিজরির ২৮ সফর শাহাদাত বরণ করেন। মদীনার জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে দাফন করা হয়।

ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (আ.) ইমামতি লাভ করেন খোদায়ী নির্দেশ মোতাবেক এবং তাঁর পিতার অসিয়ত অনুসারে। তিনি ইমাম ছিলেন এবং একই সাথে ছয় মাসের জন্য খলিফা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ইমাম হাসান আমীর মুআবিয়ার কাছে খেলাফত ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। দশ বছরের ইমামতকালে ইমাম হাসান (আ.)-কে অত্যন্ত কঠিন অবস্থা ও অত্যাচার-নির্যাতন ভোগের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এমনকি নিজ গৃহেও তাঁর নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়।

মানবীয় পরিশুদ্ধতার দিক থেকে ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন তাঁর মহান মাতামহের এক খাঁটি দৃষ্টান্ত ও পিতার এক স্মারকচিহ্ন।

মহানবী (সা.) অনেক সময়ই বলতেন : ‘হাসান ও হোসাইন আমার সন্তান।’ এ কারণে হযরত আলী তাঁর অন্য সন্তানদের কাছে বলতেন : ‘তোমরা আমার সন্তান আর হাসান ও হোসাইন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তান।’ মহানবী (সা.) হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) সম্পর্কে আরো বলেছেন, দণ্ডায়মান থাক আর উপবিষ্ট থাক আমার এই দুই সন্তান হচ্ছে ইমাম।’

ইমাম হাসান (আ.)-এর কয়েকটি উক্তি

১. যদি তুমি কোনো পার্থিব কল্যাণ লাভে ব্যর্থ হও, তাহলে বিষয়টিকে এভাবে গ্রহণ কর যে, ঐ চিন্তা একেবারেই তোমার মনে আসেনি।

২. পরিপক্বতা বা পরিপূর্ণতা দ্বারা পরিচালিত হওয়ার যোগ্যতা ব্যতিরেকে কোনো জাতি পারস্পরিক পরামর্শের পন্থা অবলম্বন কখনই করতে পারে না।

৩. বংশগতভাবে যারা দূরবর্তী, ভালোবাসার দ্বারা তাদেরকে নিকটতর করা যায়। আবার ভালোবাসার অভাব হলে বংশগত আত্মীয়দের মধ্যেও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়।

৪. সুযোগ-সুবিধা এমন জিনিস যা খুব দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায় এবং ফিরে আসে দেরিতে।

(নিউজলেটার, মার্চ-এপ্রিল, ১৯৯২)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আত্মগঠনের মাস : রমযান
দুঃখ-কষ্ট মোকাবেলার উপায়
পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ
রজব মাসের ফজিলত ও আমলসমূহ
তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
শাবে জুম্মা
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...

 
user comment