বাঙ্গালী
Friday 27th of December 2024
0
نفر 0

খলিফাতুর রাসূলের প্রয়োজনীয়তা ও তার নিয়োগ প্রণালী

খলিফাতুর রাসূলের প্রয়োজনীয়তা ও তার নিয়োগ প্রণালী

রাসূলের (সঃ) তিরোধানের পর এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল যিনি ইসলামি উম্মাহর অনৈক্য এবং ইসলামি আইন-কানুনের পরিবর্তন ও প্রক্ষেপ রোধ করতে সমর্থ ছিলেন। কারণ এমন অনেকে ছিল যারা আপন কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য উন্মাহর ঐক্যে ফাটল ধরাতে ও আইন-কানুন পরিবর্তন করে তাতে নিজেদের ধ্যান-ধারণা প্রক্ষেপণে সদা চেষ্টিত ছিল। যদি এহেন ব্যক্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়,তাহলে রাসূলের উত্তরাধিকারিত্বের কোন গুরুত্ব থাকে না এবং সেক্ষেত্রে রাসূলের দাফন বাদ দিয়ে সকিফাহ্-ই-সাঈদার সম্মেলনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ নেহায়েত বাতুলতা মাত্র। আর যদি রাসূলোত্তরকালে একজন খলিফাতুর রাসূলের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হয়,তাহলে প্রশ্ন এসে পড়ে রাসূল (সঃ) কি এমন অবশ্যম্ভাবিতা অনুভব করতে পেরেছিলেন? যদি ধরা হয় তিনি এদিকে মনোযোগ দেননি বা এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেননি তাহলে এটা একটা বিরাট প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় যে,স্বধর্ম ত্যাগ,উন্মাহর খণ্ড-বিখণ্ডতা (বিভক্তি) ও দুষ্ট প্রক্ষেপ রোধ করার উপায় সম্পর্কে রাসূলের মন শূন্য ছিল। অথচ বাস্তবে এমনটি ছিল না। এহেন অবস্থা সম্পর্কে তিনি বারংবার সতর্ক করেছেন। যদি ধরা হয় তিনি এটা অনুভব করতে পেরেছিলেন। কিন্তু কোন কৌশলী-সুবিধার কারণে তা অমীমাংসিত রেখে গেছেন তাহলে গুপ্ত রাখার পরিবর্তে তিনি ওই সুবিধার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিতেন। কারণ উদ্দেশ্যবিহীন নীরবতা নবুয়তের দায়িত্ব পালনে অবহেলার সামিল। যদি কোন বাধা থাকতো তবে তা প্রকাশ হয়ে পড়তো। যেহেতু রাসূল (সঃ) দ্বীনের কোন বিষয় অসম্পূর্ণ রেখে যাননি। সেহেতু তাঁর অবর্তমানে তাঁর প্রাণপ্রিয় ইসলামের এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (খলিফাতুর রাসূল) অসম্পূর্ণ বা অমীমাংসিত রেখে যেতে পারেন না,এটাই সর্বসম্মত মত। হয়ত তিনি এমন কর্মপন্থা প্রস্তাব করে গেছেন যা কার্যকর হলে অন্যদের হস্তক্ষেপ থেকে দ্বীন নিরাপদ থাকত।

এখন প্রশ্ন হলো সেই কর্মপন্থাটি কী? যদি মনে করা হয় তা উন্মাহর ঐকমত্য,তাহলে তা সত্যিকারভাবে প্রতিফলিত হতে পারে না,কারণ এতে প্রত্যেক ব্যক্তির সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু মানব প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই অনুমিত হবে যে,কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে সকল মানুষের সম্মতি সম্পূর্ণ অসম্ভব। এমন একটা বিষয়ের উদাহরণ দেয়া যাবে না যাতে কোন না কোন ব্যক্তি ভিন্নমত পোষণ করেনি। খেলাফতের মতো একটা মৌলিক বিষয় কিভাবে উম্মাহর সর্বসম্মত ঐক্য নামক অসম্ভব কর্মপন্থার উপর নির্ভর করতে পারে? অথচ ইসলামের ভবিষ্যত আর মুসলিমের কল্যাণ এ মৌলিক বিষয়টির মুখাপেক্ষী। সুতরাং মৌলিক বিষয়ের জন্য একটা অসম্ভব প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে বিবেক সাড়া দেয় না। এ প্রক্রিয়ার পক্ষে রাসূলের (সঃ) কোন হাদিস কেউ দেখাতে পারবে না। ইজি যথার্থই লিখেছেনঃ

জেনে রাখো,খেলাফত নির্বাচনের মাধ্যমে ঐকমত্যের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না। কারণ এর স্বপক্ষে কোন ন্যায়সঙ্গত যুক্তি অথবা হাদিস দেখাতে পারবে না।

বস্তুতঃ সর্বসম্মত ঐকমত্যের সমর্থকগণ যখন দেখলো নির্বাচনে সকলের সম্মতি একটা দুরূহ ব্যাপার তখন তারা সর্বঐকমত্যের বিকল্প হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐকমত্য গ্রহণ করলো এবং তাতে সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত দারুণভাবে উপেক্ষিত হলো।

এসবক্ষেত্রে অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত এমন গতি পরিগ্রহ করে যাতে ন্যায়-অন্যায়,শুদ্ধ-অশুদ্ধ,ব্যক্তির গুণাগুণ ও উপযুক্ততা বিচার করার কোন সুযোগ থাকে না। এতে প্রকৃত উপযুক্ত ব্যক্তি অগোচরে থেকে যায় এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যেখানে মানুষের যোগ্যতাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের অযৌক্তিক প্রবাহ দ্বারা প্রদমিত করা হয় এবং প্রভাবশালীদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য ন্যায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেখানে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করা দুরাশা মাত্র। যদি ধরাও হয় যে,ভোটারগণ পক্ষপাতবিহীন দৃষ্টিকোণ থেকে নির্বাচন বিবেচনা করেছে এবং তাদের কারো কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল না। তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত সঠিক বা তা বিপথে যেতে পারে না এমন মনে করার কোন কারণ নেই। বাস্তবে দেখা গেছে,পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সংখ্যাগরিষ্ঠগণ নিজেদের মতামত ভুল হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠগণের প্রতিটি সিদ্ধান্ত যদি সঠিক বলে মনে করা হয় তবে শেষোক্ত সিদ্ধান্ত যার দ্বারা অন্য একটি সিদ্ধান্তকে ভুল বলে স্বীকার করা হয়েছে-তা নিশ্চয়ই ভুল। এ অবস্থায় ইসলামের খলিফা নির্বাচন যদি ভুল হয়ে থাকে তবে সে ভুলের জন্য দায়ী কে? এবং ইসলামি প্রশাসনিক ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য কাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে? একইভাবে খলিফা নির্বাচনোত্তর বিক্ষোভ ও সন্ত্রাসে যে রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার দায়-দায়িত্ব কার? যে সমস্ত লোক সর্বদা রাসূলের (সঃ) সম্মুখে বসে থাকতো তারা যেখানে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়েছে,সেখানে অন্য লোক বাদ পড়ার কথা চিন্তা করা যায় কিভাবে?

যদি ধরা হয় যে,ভবিষ্যত অমঙ্গল এড়ানোর জন্য রাসূল (সঃ) খলিফা নির্বাচন দায়িত্ববান লোকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন যেন তারা তাদের পছন্দ মতো একজনকে নির্বাচিত করে নেয়,তা হলেও একই দ্বন্দ্ব ও সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজমান থেকে যায়। কারণ সব লোক ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লক্ষ্যের উর্দ্ধে ওঠে একই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে কোন কিছু মেনে নিতে পারেনা। বস্তুত এক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের সম্ভাবনা বেশি ছিল,কারণ সকলে না হলেও অধিকাংশ লোক খলিফা পদে প্রার্থী হয়ে বিপক্ষকে পরাজিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতো। এ চেষ্টার অবশ্যম্ভাবী ফল হতো পারস্পরিক হানাহানি ও সার্বিক অমঙ্গল। সর্বঐকমত্য প্রক্রিয়ায় বিশেষ ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না বলেই “সংখ্যাগরিষ্ঠ” পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল। এতে একজন যোগ্য ব্যক্তি বেছে নেয়ার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠগণ তাদের মধ্যকার কারো ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনে যন্ত্রের মতে কাজ করেছিল। আবার,এসব কর্তৃত্বকারী লোকদের যোগ্যতার মাপকাঠি কী ছিল? তাদের যোগ্যতা তা-ই ছিল যা সচরাচর প্রচলিত অর্থাৎ ক’জন অন্ধ সমর্থক জোগাড় করে জোরালো বক্তব্য দ্বারা সভায় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারলেই কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলে সবাই গণ্য করে। এবার আসি খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি প্রসঙ্গেঃ

হযরত আবু বকরের খেলাফত লাভ

কথিত যে,নবী করিম (সা.) হযরত আবুকবরকে খেলাফত দিয়ে গেছেন। তিনি হযরত আবুবকরকে নামাজের ইমামতি করার দায়িত্ব দিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে হযরত আবু বকরই খেলাফতের আসন অলংকৃত করার জন্যে অন্য সবার চাইতে বেশী যোগ্য। আর তাই বনি সাক্বিফার সমাবেশে সাহাবীরা তাকে খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করেছেন।”

কিন্তু ইতিহাস স্বীকৃত সত্য যে,বনি সাক্বিফাতে খলিফা নির্বাচনের প্রসংঙ্গ নিয়ে মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে যে বাক -বিতন্ডা ও তর্ক বিতর্ক হয়েছিলো সেখানে কখনো নামাজের প্রসংঙ্গ উত্থাপিত হয়নি। উপস্থিত কেউ হযরত আবু বকরের খেলাফত লাভের জন্যে নামাজের ইমামতির যুক্তি উপস্থাপন করেননি। সেখানে আমরা দেখতে পাই আনসাররা খেলাফতের জন্যে নিজেদেরকে সর্বাধিক যোগ্য হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। আর মোহাজেররা খেলাফতের জন্যে নিজেদেরকে উপস্থাপন করেছিলন। তারা সেখানে কোন ক্রমেই আবুবকরের নামাজের ইমামতের ঘটনা তুলে ধরেননি। বরং হযরত ওমর সেখানে এগিয়ে এসে ঝগড়া ও মতভেদ এড়িয়ে ঘোষণা করলেন,“ আমি আবু বকরের হাতে বাইয়াত গ্রহন করলাম।” এভাবে সেদিন বনি সক্বিফাতে উপস্থিত সাহাবীরা হযরত আবুবকরের হাতে বাইয়াত গ্রহন করেছিলেন।

তখনও রাসূলের পবিত্র লাশ দাফন করা হয়নি খেলাফতের ব্যাপারে সাহাবীদের মধ্যে অনৈক্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। বনি সক্বিফার সমাবেশে সাহাবীদের মাঝে উত্তপ্ত মতদগ্ধ কি প্রমাণ করে না যে তাদের মধ্যে খেলাফতের ব্যাপারে কোন প্রকার ঐক্যমত ছিল না ? (তারিখে ইয়াকুবী,খণ্ড-২,পৃঃ -১২৩ -১২৬; সহি বুখারী,খণ্ড-৩,পৃঃ -১৯০; মিলাল ওয়ান নিহাল,শাহরেস্তানী,খণ্ড-১,পৃঃ -৫৭; তারিখে তাবারী,খণ্ড-২,পৃঃ -৭৮; তারিখে খোলাফা,পৃঃ -৪৩; আস -সিরাতুন নাবাবিয়্যা,ইবনে হিশাম,খণ্ড-৩,পৃঃ -৩৩১; তাফসীরে ইবনে কাসীর,খণ্ড-৪,পৃঃ -১৯৬)

মুলতঃ বনি সক্বিফার নির্বাচনী সমাবেশেরই বা কি প্রয়োজন ছিল ? নবী (সা.) তো হযরত আবু বকরকে খলিফা মনোনীত করে গেছেন -ই ! আর যদি তিনি নবী (সা.) কর্তৃক খলিফা মনোনীত হয়েই থ্কবেন তাহলে সেখানে সেদিন কারো মনে ছিলো না কেন ?

হযরত আব্বাস থেকে বর্ণিত যে,তিনি হযরত আবু বকর ও হযরত ওমরকে জিজ্ঞেস করেন,“খেলাফতের ব্যাপারে নবী (সা.) আপনাকে কি কিছু বলে গেছেন ? তারা উভয়েই বললেন না। অতঃপর তিনি হযরত আলীকে বলেন,“ হে আলী তোমার হাত বাড়িয়ে দাও,আমি তোমার হাতে বাইয়াত গ্রহন করি।” (আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ ,ইবনে কুতাইবা ,খণ্ড-১ ,পৃঃ -২১)

বস্তুতঃপক্ষে নবী (সা.) কর্তৃক খেলাফতের মনোনয়ন হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকেই প্রদান করা হয়েছিল যা গাদীরে খুমের ঘটনায় আমরা স্পষ্ট উপলদ্ধি করতে পারি।

আর নামাজে ইমামতির বিষয়টা কি করে খেলাফতের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে ? সাহাবী ও তাবেয়ীনের যুগে কখনো এ ধরণের ব্যাখ্যার অবতারণা করা হয়নি। তাবেয় ও তাবেয়ীনের যুগে যখন হযরত আবু বকরের খেলাফতের বৈধতার ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সংশয় উত্থাপিত হতে থাকে তখন তার নির্বাচনের বৈধতা প্রমাণের জন্যে নামাজে ইমামতির যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। আর হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হযরত আবু বকরের নামাজে ইমামতির হাদীস ছাড়াও হযরত হাফসা থেকে বর্ণিত হাদীসও বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন,“ আবু বকর নামাজে ইমামতি করেননি,বরং ওমর নামাজে ইমামতি করেছেন।” (ফাইযুল ক্বাদির শারহে আল জামেয়া আস সাগীর ,খণ্ড-৫ ,পৃঃ -৫২১)

অন্যদিকে এমন সব হাদীস বিদ্যমান যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে,অসুস্থ অবস্থায়ও প্রিয় নবী (সা.) স্বয়ং নামাজে ইমামতি করেছেন।(সহি মুসলিম ,খণ্ড-৩ ,পৃঃ -৫১; মুসনাদে আহমাদ ,খণ্ড-৬ ,পৃঃ -৫৭; তারিখে তাবারী ,খণ্ড-২ ,পৃঃ -৪৩৯)

সুতরাং নামাজে ইমামতির বিষয়টা কোনক্রমে খেলাফত লাভের বৈধ কারণ হতে পারে না।

আর যদি হযরত আবু বকর রাসূলের খলিফা হিসেবে মনোনীত হয়ে থাকবেন তাহলে এত সাহাবীদের বিরোধীতার কারণ কি ?

দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের নির্বাচন কালে এ পদ্ধতির অনুসরন করা হয়নি হযরত আবু বকর নিজেই হযরত ওমরকে মনোনয়ন দিয়েছেন।

অথচ সর্বসম্মতভাবে কোন নীতি গৃহীত হলে তা স্থায়ী নীতি হিসাবে ভবিষ্যতের জন্য পালনীয় হয়ে থাকে।

সকিফাহ-ই-সাঈদাহর তথাকথিত সর্বসম্মত নির্বাচনের অবস্থা এরূপ ছিল যে,এক ব্যক্তির (উমর) কর্মতৎপরতাকে সর্বসম্মত নির্বাচন এবং এক ব্যক্তির কার্যাবলীকে আলোচনা সভা নামে চালিযে দেয়া হয়েছে। আবু বকর ভালভাবেই জানতেন যে,নির্বাচন মানে দু একজন লোকের ভোট নয়- সাধারণ জনগণের ভোট। তাই তিনি সুকৌশলে সর্বসম্মত নির্বাচন বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট বা নির্বাচনী সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে উপেক্ষা করে উমরকে মনোনয়ন করেছিলেন। আয়শাও মনে করতেন জনগণের ভোটের উপর খেলাফতের বিষয়টি ছেড়ে দিলে অকল্যাণ ও সমস্যার সৃষ্টি হবে। তাই উমরের মৃত্যুকালে তিনি বাণী পাঠালেন-

ইসলামি উম্মাহকে নেতাবিহীন অবস্থায় রেখে যাবেন না। একজন খলিফা মনোনয়ন করুন অন্যথায় আমি অমঙ্গল ও সমস্যার আশঙ্কা করছি।

নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দ্বারা যখন নির্বাচন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো তখন “জোর যার মুলুক তার” নিয়মনীতিতে পরিণত হলো। যে কেউ অন্যদেরকে বশে আনতে পেরেছে,তাদের আনুগত্য আদায় করে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণাধীন করতে পেরেছে,সে-ই রাসূলের প্রকৃত উত্তরাধিকারী ও খলিফারূপে গৃহীত হয়েছে। এসব রীতি প্রভাবশালীদের স্ব-রচিত। এসব রীতি-নীতি রাসূলের (সঃ) বাণীর বিপরীত যা তিনি তাবুকের যুদ্ধে হিজরাহর রাতে পারিবারিক ভোজে সুরা আল-বারায়াহ্ (সুরা তওবা) জ্ঞাত করতে গিয়ে এবং গাদির-ই-খুমের ভাষণে বলেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো,যেখানে প্রথম তিন জন খলিফার প্রত্যেকেই একে অপরের পছন্দ দ্বারা মনোনীত হয়েছেন,সেখানে রাসূলের এহেন পছন্দের কথা স্বীকার করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। বিশেষত মতবিরোধ রোধ করার জন্য এটাই ছিল একমাত্র উপায়। রাসূল (সঃ) বিষয়টি কারো হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিজেই সমাধান করে গেছেন। এটা অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য সঠিক প্রক্রিয়া এবং রাসূলের (সঃ) সুনির্দিষ্ট বাণী দ্বারা সমর্থনপুষ্টও বটে।

 

হযরত ওসমানের খেলাফত লাভ

আবু লুলুআহ কর্তৃক আহত হবার পর উমর যখন বুঝতে পারলেন যে,তিনি আর বাঁচবেন না তখন তিনি খেলাফত বিষয়ে একটা পরামর্শক কমিটি গঠন করলেন। এ কমিটিতে তিনি আলী ইবনে আবি তালিব,উসমান ইবনে আফফান,আবদুর রহমান ইবনে আউফ,জুবায়ের ইবনে আওয়ান,সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহকে সদস্য মনোনীত করলেন। তিনি পরামর্শক কমিটিকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করলেন যেন তার মৃত্যুর তিন দিন পর তাদের মধ্য থেকে একজনকে খলিফা হিসাবে নিয়োগে করেন এবং এ তিন দিন সুহাইব যেন খলিফার কাজ চালিয়ে নেবে। এসব নির্দেশাবলী পাওয়ার পর কমিটির কয়েকজন সদস্য তাকে অনুরোধ  করেছিল যেন তিনি প্রত্যেক সদস্য সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত করেন যাতে তারা খলিফা নির্বাচনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। উমর প্রত্যেক সদস্য সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করে বললেন,“সাদ রূঢ় মেজাজের ও উগ্র মস্তিস্কের লোক; আবদুর রহমান উম্মাহর ফেরাউন; জুবায়ের স্বার্থে তুষ্ট হলে সত্যিকার ইমানদার কিন্তু স্বার্থ সিদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটলে কট্টর বেইমান হয়ে পড়ে; তালহা অহংকারী ও উদ্ধত প্রকৃতির-তাকে খলিফা নিয়োগে করলে সে খেলাফতের আংটি তার স্ত্রীর আঙ্গুলো পরিয়ে দেবে; উসমান তার জ্ঞাতি গোষ্ঠির বাইরে আর কিছুই দেখতে পায় না এবং আলী যদিও খেলাফতের প্রতি বেশি অনুরক্ত তবুও (আমার মতে) শুধুমাত্র তিনিই খেলাফতকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবেন।” আলীর যোগ্যতা সম্পর্কে এরূপ স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও উমর পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল খেলাফত যেন তার ইচ্ছার অনুকূলে যেতে পারে (অর্থাৎ আলীকে বঞ্চিত করা) এবং সেভাবেই তিনি পরামর্শক কমিটির সদস্য মনোনয়ন ও কমিটির কার্যপ্রণালী নির্ধারণ করেছেন। একজন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরও এ কথা বুঝতে কষ্ট হবে না যে,পরামর্শক কমিটির গঠন ও তার কার্যপ্রণালীর মধ্যেই উসমানের জয়ের সকল উপাদান নিহিত আছে। কমিটির সদস্যদের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে,আবদুর রহমান ইবনে আউফ উসমানের ভগ্নীপতি; সাদ ইবনে ওয়াক্কাস আবদুর রহমানের আত্মীয় ও জ্ঞাতি এবং সে সর্বদা আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতো। তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ উসমানের প্রতি অনুরক্ত ছিল এবং সে আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতো। কারণ তালহা ছিল তায়মি গোত্রের। আবু বকরের খেলাফত দখলের ফলে তায়মি ও হাশেমি গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক ভাল ছিল না। এমতাবস্থায় জুবায়ের আলীর পক্ষে ভোট দিলেও উসমানের জয়ের জন্য তার একটা ভোট কোন বাধা হয়ে দাড়ায় না। কেউ কেউ লিখেছেন। পরামর্শক কমিটির বৈঠকের দিন তালহা মদিনায় উপস্থিত ছিল না। তার অনুপস্থিতি এমনকি তাকে যদি আলীর পক্ষেও ধরা হয় তবুও উসমানের জয় অনিবার্য। কারণ উমর তার বিচক্ষণতা দিয়ে যে কার্যপ্রণালী করে দিয়েছেন তা উসমানের জয় সুনিশ্চিত করে দিয়েছে। কার্যপ্রণালীটি নিম্নরূপঃ

যদি দুজন সদস্য একজন প্রার্থীর পক্ষে যায় এবং অপর দুজন সদস্য অন্য প্রার্থীর পক্ষে যায়। তবে আবদুল্লাহ ইবনে উমর মধ্যস্থতা করবে। আবদুল্লাহ যে পক্ষকে নির্দেশ দেবে সে পক্ষ খলিফা নিয়োগ করবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমরের রায় যদি তারা মেনে না নেয়। তবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ,যার পক্ষে থাকবে। আবদুল্লাহ সে পক্ষ সমর্থনা করবে; অপরপক্ষ এ রায় অমান্য করলে তাদের মাথা কেটে হত্যা করা হবে। (তাবারী,১ম খণ্ড,পৃঃ ২৭৭৯-২৭৮০; আছীর,৩য় খণ্ড,পৃঃ ৬৭)

এখানে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমরের রায়ে অসম্মতির কোন অর্থ হয় না। কারণ আবদুর রহমান ইবনে আউফ যার পক্ষে থাকবে তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য আবদুল্লাহকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উমর তার পুত্র আবদুল্লাহ ও সুহাইবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে-

যদি মানুষ মতভেদ করে তোমরা সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষাবলম্বন করো,কিন্তু যদি তিনজন একদিকে এবং অপর তিনজন অপরদিকে থাকে তবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ যে দিকে থাকবে তোমরা সেদিকে থেকো। (তাবারী,১ম খণ্ড,পৃঃ ২৭২৫; আছীর,৩য় খণ্ড,পৃঃ৫১)

এ নির্দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলতে আবদুর রহমান ইবনে আউফকেই বুঝানো হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্য কারো পক্ষে হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কারণ আবদুর রহমানের আদেশের অপেক্ষায় পঞ্চাশটি রক্ত-পিপাসু তরবারি বিরোধী পক্ষের জন্য প্রস্তুত ছিল। অবস্থাদৃষ্ট আমিরুল মোমেনিন আগেই তার চাচা আব্বাসকে বলেছিলেন যে,উসমান খলিফা হতে যাচ্ছে,কারণ উমর সে পথই পরিস্কার করে দিয়ে গেছে।

যাহোক উমরের মৃত্যুর পর আয়শার ঘরে নির্বাচনী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভা চলাকালে আবু তালহা আল-আনসারীর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জন লোক উন্মুক্ত তরবারি হাতে দরজায় দাঁড়িয়েছিল। তালহা সভার কার্য শুরু করলেন এবং উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে নিজের ভোট উসমানের পক্ষে প্রদান করলেন। এতে জুবায়রের আত্মসম্মানবোধে আঘাত লেগেছে। কারণ তার মা সাফিয়াহ ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের কন্যা ও আমিরুল মোমেনিনের ফুফু। সুতরাং তিনি আলীর পক্ষে ভোট দিলেন। এরপর সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস তার ভোট আবদুর রহমানের পক্ষে প্রদান করলো। এতে তিনজনের প্রত্যেকেই এক ভোট করে পেয়ে সমান হলো। সুচতুর আবদুর রহমান এ অবস্থায় একটি ফাঁদ পেতে বললো,“আলী ও উসমান তাদের দুজন থেকে একজনকে খলিফা মনোনয়ন করার ক্ষমতা যদি আমাকে অর্পন করে তবে আমি আমার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেব। অথবা তাদের দুজনের একজন প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে খলিফা মনোনয়নের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।” আবদুর রহমানের এ ফাদ আলীকে সব দিক থেকে জড়িয়ে ফেললো। কারণ এ প্রস্তাবে হয় তাকে নিজের অধিকার ছেড়ে দিয়ে খলিফা মনোনীত করতে হবে,না হয় আবদুর রহমান ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে তার ইচ্ছামতো যা করে তা-ই মেনে নিতে হবে। নিজের ন্যায্য অধিকার ছেড়ে দিয়ে উসমান অথবা আবদুর রহমানকে খলিফা মনোনীত করা আলীর পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। প্রথম থেকেই তিনি বঞ্চিত হয়েও তার অধিকারের দাবি কখনো ছেড়ে দেন নি। কাজেই এবারও তিনি নিজের অধিকার আঁকড়ে ধরে রাখলেন। তা না হলে তার মনোনীত খলিফা কর্তৃক ইসলামি উম্মাহর ক্ষতির জন্য তিনিই দায়ী হতেন। সুতরাং আবদুর রহমান নিজেই তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে মনোনয়নের ক্ষমতা গ্রহণ করলো এবং আমিরুল মোমেনিনকে বললো,“আপনি যদি কুরআন,সুন্নাহ ও পূর্ববতী দু খলিফার রীতি-নীতি ও কর্মকাণ্ড মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে আমি আপনার বায়াত নেব।” প্রত্যুত্তরে আলী বললেন,“আমি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আমার বিচার বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবো।” তিনি তিনবার জিজ্ঞাসিত হলেন এবং তিনবারই একই উত্তর দিলেন। এরপর আবদুর রহমান উসমানের দিকে ফিরে বললো,“আপনি কি শর্তগুলো মেনে চলতে পারবেন?” উসমান সন্তুষ্ট চিত্তে তা মেনে নিলেন এবং আবদুর রহমান তার বায়াত গ্রহণ করলো। এভাবে আমিরুল মোমেনিনের অধিকার ও দাবি পদদলিত হলে তিনি বললেনঃ

এটা প্রথম দিন নয় যে,তোমরা আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছো। আমাকে শুধু ধৈর্য ধারণই করতে হবে; তোমরা যা কিছু বল আল্লাহ তার বিরুদ্ধে সাহায্যকারী। আল্লাহর কসম,তুমি এ আশা ব্যতীত উসমানকে খলিফা বানাও নিজে সে তোমাকে খেলাফত ফিরিয়ে দেবে।

ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেন যে,উসমানকে খলিফা নিয়োগ করে সভার কার্য সমাপ্ত করার পর আলী উসমান ও আবদুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“আল্লাহ্ তোমাদের দুজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করুন।” আলীর একথা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল। উসমান ও আবদুর রহমান একে অপরের এরূপ শক্রতে পরিণত হয়েছিল যে,জীবদ্দশায় তারা একে অপরের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি। এমনকি উসমানের মৃত্যুশয্যায় আবদুর রহমান তাকে দেখতেও যায় নি।

 

হযরত আলীর খেলাফত লাভ

আহলে বাইতের শিরমনি,মা ফাতিমার প্রিয় স্বামী,বেহেশ্তের সর্দার ইমাম হাসান ও হুসাইনের সম্মানিত পিতা আলী হচ্ছেন মু’ মিনদের নেতা বা অভিভাবক। এ প্রসঙ্গে আল কোরআন উল্লেখ করেছেঃ

إ نَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّـهُ وَرَ‌سُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَ‌اكِعُونَ

অর্থাৎঃ নিশ্চয় তোমাদের অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ ও তার রাসূল এবং যারা ঈমান এনেছে,নামায ক্বায়েম করেছে আর রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করেছে।(সূরা আল মায়েদা,আয়াত নং-৫৫)

অধিকাংশ তাফসীরকারকদের মতে উক্ত আয়াতটি ইমাম আলীর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। (তাফসীরে দুররুল মানসুর ,খণ্ড-২ ,পৃঃ -২৯৩; তাফসীরে আল কাবির ,খণ্ড-৩ ,পৃঃ -১৩; তাফসীরে তাবারী ,খণ্ড-৬ ,পৃঃ -১৬৫; তাফসীরে বাইযাভী ,খণ্ড-২ ,পৃঃ -১৬৫; তাফসীর আল কুরআনুল কারিম ,শেখ মুহাম্মদ আব্দুহ ,খণ্ড-৬ ,পৃঃ -৪৪২; তাফসীরে আল কাশশাফ ,সূরা আল মায়েদার ৫৫ নং আয়াত।)

আবু ইসহাক বিন মুহাম্মদ আসসা’ লিব তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে হযরত আবুযার গিফারী থেকে নিম্নলিখিত ভাবে ঘটনাটি বর্ণনা করছেন। হযরত আবু যার গিফারী বলেছেন,আমি স্বীয় কর্নে শ্রবন করেছি যে রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی قائد البرره، و قاتل الکفره، منصور من نصره، مخذول من خذله

অর্থাৎঃ আলী সৎ লোকদের নেতা,কাফেরদের হত্যাকারী,যে তাকে সাহায্য করবে সে (আল্লাহ কর্তৃক) সাহায্য প্রাপ্ত হবে,যে তাকে ত্যাগ করবে (আল্লাহ) তাকে ত্যাগ করবেন।(তাফসীরে আল কাশফ ওয়াল বায়ান,আস সা’ লাবী,খণ্ড-১,পৃঃ -৭৪;ফারায়েদুস সমিতাইন,খণ্ড-১,পৃঃ -১৫৭ ,১৯১,বাব ৩৯,হাদীস নং - ১১৯ ,১৬২।)

হযরত আবুযার গিফারী বলেন“ আমি একদা রাসূল (সা.) এর সাথে যোহরের নামাজ আদায় করছিলাম। ইতিমধ্যে একজন ভিখারী মসজিদে প্রবেশ করে ভিক্ষা চাইলো। কিন্তু কেউ তাকে কোন সাহায্য করলো না। ভিক্ষুকটি দু’ হাত তুলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালোঃ হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থেকো,আমি মসজিদে প্রবেশ করে সাহায্য চাইলাম কিন্তু কেউ কিছু দিল না। তখন হযরত আলী (আ.) নামাজে রুকু অবস্থায় ছিলেন। তিনি ইশারা করলে ঐ লোকটি আলীর হাতের আংটি খুলে নিয়ে যায়। আর এ ঘটনাটি নবীর চোখের সামনে ঘটে। নবীজি নামাজ শেষে দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করলেনঃ

“ হে আল্লাহ যখন হযরত মুসা (আ.) তোমাকে বলেছিল,

و اجْعَل لِّي وَزِيرً ‌ ا مِّنْ أَهْلِي هَارُ ‌ ونَ أَخِي اشْدُدْ بِهِ أَزْرِ ‌ ي وَأَشْرِ ‌ كْهُ فِي أَمْرِي

অর্থাৎঃ (হে আল্লাহ) তুমি আমার জন্যে আমার পরিবার থেকে আমার ভাই হারুনকে আমার পরামর্শদাতা নিয়োগ কর,তার মাধ্যমে আমার কোমরকে শক্তিশালী করে দাও এবং তাকে আমার কাজ কর্মে অংশিদার কর।(সূরা ত্বাহা,আয়াত নং-২৯ -৩২)

তখন অহি নাযিল হয়েছিল। তুমি তার ভাই হারুনকে দিয়ে তার বাহুবল শক্তিশালী করেছিলে।

اللهم انا محمد بنیک و صفیک اللهم فاشرح لی صدری و یسرلی امری و اجعل لی وزیرا من اهلی علیا اخی و اشدد به ازری

অর্থাৎঃ“ হে প্রভু,নিশ্চয়ই আমি তোমার নবী এবং নির্বাচিত ব্যক্তি। হে আল্লাহ তুমি আমার অন্তরকে প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কাজ সহজ করে দাও। আমার জন্য আমার‘ আহল’ থেকে আলীকে পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ কর। তার মাধ্যমে আমার কোমরকে শক্তিশালী করে দাও।”

তখনও প্রিয় নবী (সা.) এর মুনাজাত সমাপ্ত হয়নি এমনি সময় অবতীর্ণ হয় এ আয়াতঃ

إ نَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّـهُ وَرَ‌سُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَ‌اكِعُونَ

অর্থাৎঃ নিশ্চয় তোমাদের নেতা ও অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ ও তার রাসূল এবং যারা ঈমান এনেছে,নামায ক্বায়েম করেছে আর রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করেছে। (তাফসীরে আল কাশফ ওয়াল বায়ান,খণ্ড-১,পৃঃ -৭৪;ফারায়েদুস সমিতাইন,খণ্ড-১,পৃঃ -১৫৭ ,১৯১;কানযুল উম্মাল,খণ্ড-৬,পৃঃ -৩১৯ ;খণ্ড-৭,পৃঃ -৩০৫;মাজমায়ঃ হাইসামী,পৃঃ -৮৮ ,১০২;রিয়াদ আন নাদের,খণ্ড-২,পৃঃ -২২৭)

এখানে লক্ষ্যনীয় যে,আল্লাহ ও তার রাসূলের নেতৃত্বের পাশাপাশি আলীর বেলায়েত বা অভিভাবকত্বের কথা আল কোরআন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করছে। প্রিয় নবী (সা.) তার মুনাজাতে আলীকে তার সাহায্যকারী এবং তার হাত শক্তিশালী করার লক্ষে হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকে পরামর্শদাতা হিসেবে পাবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। আর তাই তার ইন্তেকালের পর আলীর অভিভাবকত্ব গ্রহন ইসলামকে শক্তিশালী করারই নামান্তর।

নবী পাক (সা.) এর নবুয়্যত লাভের তিন বৎসর পর নিম্ন আয়াতটি অবতির্ণ হয়ঃ

و أَنذِرْ‌ عَشِيرَ‌تَكَ الْأَقْرَ‌بِينَ

অর্থাৎঃ (হে নবী) তোমার নিকটতম আত্মীয় -স্বজনকে (দোযখের আযাবের প্রতি) ভয় প্রদর্শন কর।(সূরা আশ শুরা,আয়াত নং-২১৪)

প্রায় সকল তাফসীরকারক ও ঐতিহাসিকদের মতে মহানবী (সা.) তখন বনি হাশেম গোত্রের ৪৫জন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে দুপুরের আহারের নিমন্ত্রণ দেন। আপ্যায়ন শেষে তিনি মে হমানদের মু খোমুখী দাড়িয়ে মহান আল্লাহর প্রশংসার মধ্য দিয়ে তিনি তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে তার রেসালাতের সুমহান বার্তা সকলের সামনে ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেনঃ

ان الرائد لا یکذب اهله و الله لا اله الا هو انی رسول الله الیکم خاصة و الی الناس عامة و الله لتموتن کما تنامون و لتبعثن کما تستیقظون و لتحاسبن بما تعملون و انها الجنه ابدا و النار ابدا

অর্থাৎঃ এটা অতি সত্যি কথা যে কোন এক জনগোষ্ঠির পথ প্রদর্শক তার লোকজনদের নিকট মিথ্যা বলতে পারেনা। আল্লাহর শপথ তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই,আমি বিশেষভাবে তোমাদের জন্যে আর সাধারণভাবে সবার জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহর শপথ তোমরা নিদ্রার ন্যায় মৃত্যুমুখে ঢলে পড়বে এবং জাগ্রত ব্যক্তিদের ন্যায় পুনরুত্থিত হবে একদিন। তোমরা তোমাদের কর্মের ফলাফল ভোগ করবে সেদিন। নিশ্চয় জান্নাত চিরস্থায়ী আবাসস্থল (সৎ লোকদের জন্যে) আর জাহান্নামের অগ্নি হবে চিরস্থায়ী আবাস (অসৎ লোকদের জন্যে)। (সিরাহ আল হালাবী,খণ্ড-১,পৃঃ -৩২১)

অতঃপর তিনি বলেনঃ হে লোকসকল আমার মত উত্তম জিনিষ তোমাদের জন্যে অন্য কেউ আনেনি। আমি তোমাদের জন্যে ইহকাল ও পরকালের মঙ্গল নিয়ে আগমন করেছি। আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তোমাদেরকে সেই মঙ্গল কাজের দিকে আহবান জানাতে।

অবশেষে তিনি বলেনঃ

فایکم یوازرنی علی هذا الامر علی ان یکون اخی و وصی وخلیفتی فیکم ؟

অর্থাৎঃ তোমাদের মধ্য থেকে আমার সাহায্যকারী হবার মত এমন কে আছো ? যার ফলে সে আমার ভ্রাতা,উত্তরাধীকারী ও খলিফা হিসাবে পরিগনিত হবে ?

যখন মহানবীর বক্তব্য এখানে এসে সমাপ্তি ঘটে তখন সমাবেশে নিঃশব্দ বিরাজ করছিলো। কেউ টু শব্দটুকু করেনি। ইত্যবসরে একজন যুবক হাত উচু করে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করলো“ তিনি আর কেউ নন,তিনি হলেন শেরে খোদা হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.) তাকে বসতে বললেন। আবারো তিনি পূর্ব প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করেন। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেলনা। আলী ছাড়া কারো কাছ থেকে। পুনরায় তিনি আলীকে বসতে বললেন। এভাবে তিন বার তিনি পুনরাবৃত্তি করেন এবং প্রতিবার আলীই হাত উচু করে তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

এ পর্যায়ে রাসূল (সা.) তার ঐতিহাসিক ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি বলেনঃ

ان هذا اخی وصی و خلیفتی علیکم فاسمعوا له اطیعوا

অর্থাৎঃ“ নিশ্চয় এই যুবক (আলী) আমার ভাই,আমার উত্তরাধীকারী এবং তোমাদের মাঝে আমার খলিফা। তোমরা সকলে তার কথা শ্রবণ করো এবং তাকে অনুসরণ করো। (উক্ত ঘটনা বিভিন্ন হাদীস বেত্তা তাদের স্ব -স্ব গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ কয়েকটি উদ্ধৃতি নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ তারিখে তাবারী,খণ্ড-২,পৃঃ -৬২ -৬৩;তারিখে কামেল,খণ্ড-২,পৃঃ -৪০ -৪১;মুসনাদে আহমাদ,খণ্ড১-,পৃঃ -১১১;শারহে নাহজুল বালাগা লি ইবনে হাদীদ,খণ্ড-১৩,পৃঃ -২১০ -২২১;কানযুল উম্মাল,খণ্ড-৬,পৃঃ -৩৯৬।)

পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে নবী (সা.) এর দাওয়াত তার নবুয়্যত লাভের তিন বৎসর পর সংঘটিত হয়েছির। তার দাওয়াতী মিশনের প্রথম ভাগেই এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়। তখনও তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৌহীদ ও নবুয়্যতের দাওয়াতই দিয়ে যাচ্ছিলেন।

আল -কোরআনের ভাষায়ঃ

قالوا لا اله الا الله تفلحون

অর্থাৎঃ তোমরা বল আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই তাতেই তোমরা সফলকাম হবে। এবং

ان محمدا رسول الله

মোহাম্মদ আল্লাহর রাসূল।

তবে এ ঐতিহাসিক দাওয়াতের ব্যবস্থাপনা,প্রিয় নবীর বক্তৃতা ও তৌহীদ -নবুয়্যতের ঘোষণার পাশাপাশি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের খেলাফতের ঘোষণা খেকে এটাই উপলদ্ধি করতে পারি যে,মহানবীর দাওয়াতের সূচনা পূর্বেই তিনি তার পরবর্তী খলিফা ও উত্তরাধীকারী নিযুক্তিতে ত্রুটি করেন নি। এটা এমন একটি বিষয় যা তৌহীদ ও নবুয়্যত থেকে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তৌহীদ ও নবুয়্যতের স্থায়িত্বের জন্যে ইমামতের ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় সেদিন মহানবী (সা.) সবার সম্মুখে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলেন পরবর্তী নেতার মনোনয়নের বিষয়টি। এ দু’ টি পদ তথা নবুয়্যত ও খেলাফত,মর্যাদার ক্ষেত্রে একটি বৃক্ষের দু’ টি শাখার ন্যায়। রেসালাত দ্বীন ইসলামের প্রবর্তক এবং ইমামত বা খেলাফত সেই প্রবর্তীত দ্বীনের সংরক্ষক। সকল হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিক তাদের স্ব -স্ব গ্রন্থে নিম্নোক্ত ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছেন।

“মুহাম্মদ (সা.) তাবুকের যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে লোকজন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্যে তাকে সংঙ্গ দিয়েছিল। এ যুদ্ধে তিনি হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকে মদীনার গভর্নর করে তার উপর দায়িত্বভার অর্পন করে যান। মদিনার আভ্যন্তরীন অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে তিনি এ ব্যবস্থা নিয়ে ছিলেন। কিন্তু আলী জেহাদের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আবেদন করলেন,হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমি কি যুদ্ধে যেতে পারবো না ? নবী (সা.) উত্তরে বললেন,না। তৎক্ষণাৎ আলী ক্রন্দন শুরু করে দিলেন। তখন নবী (সা.) হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ

انت منی بمنزلة هارون من موسی الا لا نبی بعدی

অর্থাৎঃ (হে আলী) তুমি আমার কাছে সে স্থানে অবস্থান করছো যে স্থানে হারুন মুসার কাছে ছিলো। তবে পার্থক্য হলো আমার পরে আর কোন নবী আগমন করবে না। (সহি বুখারী,খণ্ড-৫,পৃঃ -;বাবে ফাযায়িলে আন -নাবী,বাবে মানাকিবে আলী,পৃঃ -২৪;আসনা আল মাতালিব লি জায়রী,পৃঃ -৫৩;তারিখে দামেস্ক লি ইবনে আসাকের ,খণ্ড -১;শাওয়াহিদ আত তানযিল ,খণ্ড-১,পৃঃ -১৫।)

মহানবী (সা.) এর উপরোক্ত উক্তি থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে,নবুয়্যত ব্যতীত হযরত হারুনের সকল পদমর্যাদাই হযরত আলীর জন্যে সংরক্ষিত। আল -কোরআন উল্লেখ করছে,মুসা (আ .) আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে বলেছিলেনঃ

اجعل لی وزیا من اهلی هارون اخی اشدد به ازری و اشرکه فی امری

অর্থাৎঃ (হে আল্লাহ) তুমি আমার জন্যে আমার বংশ থেকে আমার ভাই হারুনকে আমার পরামর্শদাতা ও সাহায্যকারী হিসাবে নিয়োগ করো। তার মাধ্যমে আমার কোমর শক্তিশালী করে দাও এবং তাকে আমার কাজ কর্মে অংশীদার কর। (সূরা ত্বাহা,আয়াত নং-২৯ -৩২)

 

গাদীরে খুমের ঘটনা

হিজরী দশম বছর। রাসূল (সা.) বিদায় হজ্ব সম্পন্ন করেছেন। এ নশ্বর পৃথিবী থেকে শেষ বিদায়ের জণ্যে প্রহর গুনছেন। প্রথম থেকে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন এ বৎসর তিনি শেষ হজ্ব সমাপন করবেন। চতুর্দিক থেকে নবীর সাথে হজ্বে অংশগ্রহনের জন্যে অশংখ্য লোকের সমাগম হয়েছিলো। ঐতিহাসকিদের মধ্যে হাজীদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। সর্বাপরী ৯০ হাজার থেকৈ ১২৪ হাজার মানুষের সমাগম ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এ বৎসর তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন যা“ বিদায় হজ্বের ভাষণ” নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।

হজ্ব সমাপ্ত করে তিনি আসহাবকে সাথে নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেছেন। প্রচন্ড গরম,মাটি ফেটে চৌচির। পথিমধ্যে‘ গাদীরে খুম’ নামক চৌরাস্তায় এসে তিনি থেমে গেলেন। এখানেই ঘটেছে সেই ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ গাদীরে খুমের ঘটনা। শীয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকল এতিহাসিক ও হাদীস বিশারদ এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে তাদের স্ব - স্ব গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

নবী করিম (সা.) তার কয়েকজন ঘনিষ্ট সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন এ স্থানে সকলকে সমবেত করতে। যারা এখনো পিছে পড়ে আছে তাদের জন্যে অপেক্ষা করতে বললেন। যারা সিরিয়া ও ইরাক অভিমুখে এ চৌরাস্তা থেকে রওয়ানা হয়ে গেছেন তাদেরকে এ স্থানে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। উত্তপ্ত বালুকাময় পথঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই।

নবী (সা.)- এর জন্যে আসন প্রস্তুত করা হল। আসনের উপর সামিয়ানা টাংগানো হল। আসনটি এমন ভাবে উচু করে নির্মান করা হলো যেন বহুদূর থেকেও সকলে সুন্দরভাবে নবী করিম (সা.) কে দেখতে পায়।

এমনকি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার জন্যে নবী (সা.) আসহাব ও হাজীদের কষ্ট দিবেন ? গাদীরে খুমে অবস্থান এবং ভাষণ দেয়ার জন্যে আসন তৈরী করার যে কারণ নিহিত আছে তাহলো অব্যবহিত পূর্বে অবতীর্ণ হওয়া নিম্ন আয়াত

يا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ

অর্থাৎঃ“ হে রাসূল আপনার রবের নিকট থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা পৌছিয়ে দিন। আর যদি এ কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম না হন তা হলে রেসালাতের দাওয়াত - ই পৌছাতে পারলেন না। আল্লাহ মানুষের অনিষ্ট থেকে আপনাকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফের জনগোষ্ঠিকে হেদায়েত করবেন না। (সূরা আল মায়েদা,আয়াত নং-৬৭)

উপরোল্লিখিত আয়াতটিতে রাসূল (সা.) কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ আয়াতটি অবতীর্ণ করেছেন। নিশ্চয়ই এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা শুধুমাত্র তিনি নবীকেই অবগত করিয়েছেন। আর তা এক্ষনে মানুষের সমক্ষে পেশ করতে হবে ? এমন কি আবতির্ণ করা হয়েছে যা এভাবে ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যক্ত করতে হবে ? সূরা মায়েদা হচ্ছে নবী (সা.) এর উপর অবতীর্ণ সর্বশেষ সূরা। এ সূরাটি নবীর শেষ জীবনে নাযিল হয়েছে। ইতিপূর্বে তৌহীদ,শেরক,রেসালাত,ক্বিয়ামত,নামাজ,রোজা,হজ্ব,যাকাত ইত্যাদি সব ধরণের বিষয়ে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। এমন কি বিষয় অবশিষ্ট রয়ে গেছে যা কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিতে হবে ? রাসূল (সা.) তো কোন ভীতু ব্যক্তি নন। তিনি কঠোর বিপদেও মু’ মিনদের সান্তনাকারী ছিলেন। তিনি সকল ধরণের বিপদ সংকুল পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন অবশেষে তিনি মক্কা বিজয় করেছেন,বীর দর্পে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেছেন বিজয়ীর বেশে। কাবার মুর্তিগুলোকে তিনি ভেঙ্গে সেখানে নামাজ ক্বায়েম করেছেন।

আল্লাহ তাকে এ আয়াতে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে দিচ্ছেন,যদি এ কাজটি আঞ্জাম দেয়া না হয় তাহলে রেসালাতের কোন কিছুই পৌছানো হলো না। এটা এমন একটা কাজ যার ফলে রেসালাত পরিপূর্ণ হবে। আর আল্লাহ রাসূলকে অভয় দিয়ে বলছেন“ আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন।”

মুলতঃ একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার জন্যেই প্রিয় নবী (সা.) সবাইকে গাদীরে খুমে সমবেত হতে বলেছেন। মহানবী (সা.) তার আসন অলংকৃত করেছেন। তিনি ভাষণ দিচ্ছেনঃ

“……………… হে মানব মন্ডলী। আমি কি সকল মু’ মিনদের চেয়ে সর্বোত্তম নেতানই ? … .. তোমরা কি জানোনা আমি প্রতিটি মু’ মিনের প্রানের চেয়েও প্রিয় নেতা…… ..? ” তখন সকলে সমস্বরে বলে উঠলো,জ্বি ইয়া রাসূল আল্লাহ” !… . অতঃপর তার পার্শ্বে উপবিষ্ট হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের হাত সকলের সম্মুখে উচু করে তুলে ধরলেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন,নবী (সা.) হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের হাত এমনভাবে উচুতে তুলে ধরেছিলেন যে তাদের উভয়ের বাহুমুলদ্বয় সবাই দেখতে পেয়েছেন।

অতঃপর মহানবী (সা.) বললেনঃ

” ایها الناس! الله مولای و انا مولاکم، فمن کنت مولاه فهذا علی مولاه، اللهم وال من والاه و عاد من عاداه و انصر من نصره و اخذل من خذله."

অর্থাৎঃ“ হে লোকসকল ! আল্লাহ আমার প্রভূ ও নেতা,আর আমি তোমাদের নেতা বা মওলা। সুতরাং আমি যার মওলা বা অভিভাবক আলীও তার মওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ যে আলীকে ভালবাসে তুমিও তাকে ভালবাস,যে আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করে তুমিও তাকে শত্রু গণ্য কর। আর যে তাকে সাহায্য করে তুমিও তাকে সহায়তা দান কর এবং যে তাকে ত্যাগ করে তুমিও তাকে পরিত্যাগ কর………… .।”

পরক্ষণই অবতীর্ণ হলো নিন্মোক্ত আয়াতটিঃ

اليَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

অর্থাৎঃ“ আজকে তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হলাম। (সূরা আল মায়েদা,আয়াত নং-৩)

সাথে সাথে রাসূল (সা.) বলেনঃ

الله اکبر علی اکمال الدین و اتمام النعمة و رضا الرب بر سالتی و الولایه لعلی

অর্থাৎঃ“ আল্লাহু আকবার,দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং নেয়ামত সম্পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমার রব আমার রেসালাত ও আলীর বেলায়াতের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছেন।”

অতঃপর সকলে পর্যায়ক্রমে আলীকে অভিন্দন জ্ঞাপন করতে লাগলেন। ইত্যবসরে হযরত ওমর বলে উঠেলেন,

هنیئا لک یا ابن ابی طالب اصبحت و امسیت مولی کل مؤمن و مؤمنه.

অর্থাৎঃ“ শুভ হোক আপনার জন্যে হে আলী বিন আবি তালিব। আজ থেকে আপনি সকল মুমিন নর নারীদের মওলা হিসেবে পরিগণিত হলেন।”

অন্য রেওয়ায়েত এরূপ আছে যে,হযরত ওমর বলেছেন,

بخ بخ لک یا ابن ابی طالب

অর্থাৎঃ মারহাবা,,মারহাবা হে আবু তালিবের পুত্র।

গাদীরে খুমের এ ঐতিহাসিক ঘটনাটি ১১০ জন সাহাবী,১০জন সর্বজন শ্রদ্ধেয় তাবেয়ী এবং ৩৬০ জন বিশিষ্ট ওলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদ সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনাটির বর্ণনা সর্বস্তরের ইতিহাসবেত্তাগণ তাদের স্ব -স্ব পুস্তকে সহি হাদীস বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইয়াক্বুবী এটাকে সুস্পষ্ট সহি হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেন। পাঠকের গবেষণার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিম্নে কয়েকটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি মাত্র। (সহি মুসলিম,খণ্ড-২,পৃঃ -৩৬২;মুসতাদরাক আল হাকেম,খণ্ড-৩,পৃঃ -১০৯;তারিখে ইবনে কাসির,খণ্ড-৪,পৃঃ -২৮১ ,৩৬৮,৩৭০;খণ্ড -৫ ,পৃঃ -২১ ,২০৯;মুসনাদে আহমাদ,খণ্ড-১,পৃঃ -১১৮ -১১৯;সুনানে ইবনে মাজা,খণ্ড-১,পৃঃ -৪৩,হাদীস নং -১১৬;তারিখে ইয়াকুবী,খণ্ড-২,পৃঃ -৪৩;তাবাক্বাত আল কুবরা,খণ্ড -২ ,অংশ -২,পৃঃ -৫৭;সিরাহ আল হালাবী,খণ্ড-৩,পৃঃ -৩৯০;তারিখে তাবারী,খণ্ড-২,পৃঃ -৪২৯;মাযমাউয যাওয়ায়েদ,খণ্ড-৯,পৃঃ -১৬৪;আস সাওয়ায়েক আল মুহরিক্বা,পৃঃ -২৫;তারিখে দামেস্ক,খণ্ড-২,পৃঃ -৪৫;উসূল আল মুহিম্মা,পৃঃ -২৪,নাজাফ;আনসাব আল আশরাফ,খণ্ড-২,পৃঃ -৩১৫;খাসায়েস আল আমিরুল মু’ মেনিন,নাসাঈ,পৃঃ -৩৫ -৯৩;কানযুল উম্মাল,খণ্ড-৪,পৃঃ -৫৩,হাদীস নং -১০৯২)

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

হযরত আলী (আ.) এর মর্যাদা
রমজানের ত্রিশ রোজার দোয়া
শিয়ারা কেন হযরত আলী (আ.) কে নিয়ে ...
ফাদাক সম্পর্কে “প্রথম খলিফার ...
হযরত ফাতেমার প্রতি নবী (সা.)-এর ...
খলিফাতুর রাসূলের প্রয়োজনীয়তা ...
ইমাম রেজা (আ.)-এর জিয়ারতের সওয়াব এক ...
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা : একটি ...
মুবাহালা
আখেরাতের ওপর বিশ্বাস

 
user comment