(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী
এ প্রসঙ্গে প্রচুর হাদীস ও বর্ণনা রযেছে। মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময়ে মুসলিম উম্মাহকে ইমাম হুসাইনের শাহাদাত সম্পর্কে অবগত করেছেন যাতে করে তারা পূর্ব হতেই ইমাম হুসাইনের মর্যাদা,গুরুত্ব,ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড অনুধাবন করতে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ভুল না করে। এখানে ইমাম হুসাইনের শাহাদাত সংক্রান্ত কতিপয় হাদীস উল্লেখ করব :
১. হযরত আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রা.) বলেন,“আমাদের কোন সন্দেহই ছিল না এবং মহানবীর পরিবারের সকলেই জানতেন,ইমাম হুসাইন কারবালার মরুপ্রান্তরে শহীদ হবেন।’’১
২. উম্মে সালামাহ্ (রা.) বলেন,‘‘একদিন মহানবী আমাকে বললেন : দরজার সামনে বসে থাকো আর কাউকে ঢুকতে দিও না। আমিও মহানবীর নির্দেশ মত কাজ করলাম। হঠাৎ হুসাইন এসে সেখানে উপস্থিত হলো। তাকে ধরতে চাচ্ছিলাম কিন্তু আমার হাত থেকে ছুটে ঘরের ভেতরে একদম মহানবীর নিকট পৌঁছে গেল। আমি মহানবীর নিকট গিয়ে বললাম : হে রাসূলাল্লাহ্! আমার প্রাণ আপনার জন্য উৎসর্গ হোক। আপনি আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন যেন কেউ এ ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু আপনার দৌহিত্র (হুসাইন) আমার হাত থেকে পালিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। মহানবী এ কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। হুসাইনও তাঁর কাছে দীর্ঘ সময় রইল। তাই কৌতূহলবশত আমি দরজার বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে উঁকি দিলাম এবং দেখতে পেলাম,মহানবীর পবিত্র দু’ নয়ন বেয়ে অশ্রু ঝরছে এবং তিনি হুসাইনকে বুকে জড়িয়ে রেখেছেন। মহানবীকে আমি এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন : জিবরাঈল এসে আমাকে জানিয়েছেন,আমার উম্মত হুসাইনকে হত্যা করবে। আর যে স্থানে হুসাইন নিহত হবে সে স্থানের মাটিও তিনি আমার কাছে নিয়ে এসেছেন।”২
৩. উম্মে সালামাহ্ থেকে বর্ণিত,“মহানবী (সা.) বলেছেন : জিবরাঈল আমাকে জানিয়েছেন,আমার এ সন্তানকে (ইমাম হুসাইন) হত্যা করা হবে এবং হত্যাকারী মহান আল্লাহর তীব্র রোষানলে পড়বে।”৩
৪. হযরত আয়েশা বলেন,“মহানবী বলেছেন : যে ভূমিতে হুসাইনকে হত্যা করা হবে জিবরাঈল আমাকে সে স্থানের মাটি দেখিয়েছেন। যে ব্যক্তি হুসাইনের রক্ত ঝরাবে সে মহান আল্লাহর তীব্র রোষানলে দগ্ধ হবে। হে আয়েশা! এ ঘটনা আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত ও দুঃখ ভারাক্রান্ত করেছে,আমার উম্মতের মধ্য থেকে কে সেই ব্যক্তি যে আমার হুসাইনকে হত্যা করবে?’’৪
৫. হযরত উম্মে সালামাহ্ থেকে বর্ণিত আছে,“আমার হুজরায় মহানবীর সামনে হাসান ও হুসাইন খেলছিল। এমন সময় জিবরাঈল অবতীর্ণ হয়ে হুসাইনের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন : হে মুহাম্মদ! আপনার পরে আপনার উম্মত আপনার এ দৌহিত্রকে হত্যা করবে। এ কথা শুনে মহানবী হুসাইনকে বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন : তোমার কাছে এ মাটিটি রাখলাম। তিনি উক্ত মাটিটি শুঁকে বললেন : হে উম্মে সালামাহ্! যখন এ মাটিটি রক্তে রূপান্তরিত হবে তখন জেনে নিও যে,আমার দৌহিত্রকে হত্যা করা হয়েছে।” অতঃপর উম্মে সালামাহ্ উক্ত মাটিটি একটি বোতলে রেখে দিলেন। তিনি প্রতিদিনই উক্ত বোতলটির দিকে তাকিয়ে বলতেন,“এক মহাদিবসে হে মাটি তুই রক্তে রূপান্তরিত হয়ে যাবি!’’৫
হযরত আলী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ
আবদুল্লাহ্ বিন নাজীর পিতা হযরত আলীর খিলাফতের একজন পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি হযরত আলীর সাথে সিফ্ফিনের দিকে যাচ্ছিলেন। নেইনাভা বা কারবালার কাছাকাছি কোন এক স্থানে পৌঁছলে হঠাৎ করে হযরত আলী উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন,‘‘হে আবু আবদুল্লাহ্ (হুসাইন)! ফুরাত নদীর তটে তোমাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।’’ বর্ণনাকারী বলেন,‘‘আমি জিজ্ঞেস করলাম : ব্যাপারটি কি? কেন আপনি ‘হে আবু আবদুল্লাহ্’ বলে উঠলেন?” তখন হযরত আলী (আ.) বললেন,‘‘একদিন মহানবীর কাছে গিয়েছিলাম। দেখলাম,তাঁর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম : হে রাসূলাল্লাহ্! কেউ কি আপনাকে ক্রোধান্বিত করেছ যার দরুন আপনি কাঁদছেন? মহানবী বললেন : না,তবে কিছুক্ষণ পূর্বে জিবরাঈল আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে এবং আমাকে জানিয়েছে,হুসাইনকে ফুরাতের তীরে হত্যা করা হবে। মহানবী আমাকে বললেন : তুমি কি চাও সেখান থেকে কিছু মাটি তোমাকে দেই এবং তা তুমি শুঁকো? আমি বললাম: জী হ্যাঁ,রাসূলাল্লাহ্। অতঃপর ঐ স্থানের এক মুষ্টি মাটি আমাকে দিলেন। আর আমিও তখন কান্না থামিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।”৬
হযরত আনাস (রা.) বলেন,“মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার এ দৌহিত্রকে অর্থাৎ হুসাইনকে ইরাকের এক এলাকায় হত্যা করা হবে। অতএব,তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাকে ঐ অবস্থায় পাবে তাকে সাহায্য করা তার ওপর ওয়াজিব হবে।”৭
এখানে উল্লেখ্য,আনাস বিন হারেস কারবালায় ইমামের পক্ষে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন।৮
ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীর ওপর অভিশাপ
জাবির বিন আব্দুল্লাহ্ আল-আনসারী থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,“আমি মহানবীকে শিশু ইমাম হুসাইনের ঊরুদ্বয় ফাঁক করে চুম্বন করতে দেখলাম। এ সময় তিনি বলেছিলেন : হে হুসাইন! তোমার হত্যাকারীর ওপর অভিশাপ বর্ষিত হোক!’’ জাবির বলেন,“আমি এ কথা শুনে বললাম : হে রাসূলাল্লাহ্! কে হুসাইনকে হত্যা করবে? মহানবী বললেন : আমার উম্মতের মধ্যে থেকে আমার বংশধরদের প্রতি শত্রুতা পোষণকারী এমন এক ব্যক্তিই হবে আমার হুসাইনের হত্যাকারী। আমি কিয়ামত দিবসে তার জন্য শাফায়াত করব না।’’৯
ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনকে হত্যা করবে
হযরত মায়ায (রা.) বলেন,“মহানবী (সা.) বলেছেন : ইয়াযীদের অমঙ্গল হোক!... যে মাটিতে ইমাম হুসাইন নিহত হবে সে মাটির কিছু অংশ আমার কাছে আনা হযেছিল।”
এ প্রসঙ্গে মহানবী থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহেও উল্লিখিত অনেক হাদীসে ইমাম হুসাইনের হত্যাকারী ও এ ব্যাপারে যারা জড়িত থাকবে তাদেরকে কিয়ামত দিবসে মহানবী যে শাফায়াত করবেন না- এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাই বর্ণনা সংক্ষেপ করার জন্য কেবল উপরোক্ত দু’টি বর্ণনা উল্লেখ করা হলো।
মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর থেকে ইমাম আলীর শাহাদাত পর্যন্ত
সম্ভবত নবী দৌহিত্রদ্বয়ের জীবনের সবচেয়ে মধুর ও সুন্দর অধ্যায় ছিল শৈশবের অল্প কয়েকটি বছর যা তাঁরা নানা মহানবীর স্নেহ ও মমতামাখা ক্রোড়ে কাটিয়েছেন। কারণ মহানবীর ওফাতের পর তাঁদের জীবনে নেমে আসতে থাকে একের পর এক দুঃখ-বেদনা ও বিপদাপদ। আর কারবালায় শাহাদাত বরণের মাধ্যমে সে সকল দুঃখ-কষ্ট ও বেদনার অবসান হয়। যা হোক,এসব বিপদাপদ ও দুঃখজনক ঘটনাসমূহ ইমামভ্রাতৃদ্বয়ের মনে সুগভীর প্রভাব ফেলেছিল।
ইমাম ভ্রাতৃদ্বয়ের জন্য মহানবীর ওসিয়ত
হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ্ আল-আনসারী থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,“ওফাতের তিন দিন পূর্বে মহানবী (সা.) আলীকে সম্বোধন করে বলতে শুনেছিলাম,মহান আল্লাহর শান্তি তোমার ওপর বর্ষিত হোক,হে সুগন্ধ পুষ্পদ্বয়ের পিতা! আমার পৃথিবীর এ দু’রায়হান (সুগন্ধি) সম্পর্কে তোমাকে ওসিয়ত করছি। কারণ অতি শীঘ্রই তোমার স্তম্ভদ্বয় ভেঙ্গে পড়বে। আর মহান আল্লাহ্ই হচ্ছেন তোমার রক্ষাকারী। অতঃপর যখন মহানবী ইন্তেকাল করলেন তখন হযরত আলী বললেন : মহানবীই ছিলেন আমার জীবনের স্তম্ভদ্বয়ের একটি। এরপর যখন হযরত ফাতেমার ওফাত হলো তখন হযরত আলী বললেন : এ হচ্ছে আমার দ্বিতীয় স্তম্ভ যে সম্পর্কে মহানবী বলেছিলেন।”
খাওয়ারিযমী প্রণীত ‘মাকতালুল হুসাইন’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে,মহানবী (সা.)-এর ওফাতের সময় ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন তাঁর পবিত্র বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। হযরত আলী (আ.) তাঁদের দু’জনকে মহানবীর বুক থেকে উঠিয়ে নিতে চাচ্ছিলেন। তখন মহানবী বলছিলেন,“এ দু’জনকে আমার থেকে এবং আমাকেও তাদের থেকে সরিয়ে নিও না। কারণ এ দু’জনকে বিপদাপদ স্পর্শ করবে।” মহানবী তখন তাঁর আশেপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বললেন,‘‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে মহান আল্লাহর কিতাব আল-কোরআন ও আমার বংশধরদের রেখে যাচ্ছি। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে যারা মহান আল্লাহর কিতাব আল-কোরআনকে হারাবে তারা আমার সুন্নাহকেও হারাবে। আর যারা আমার সুন্নাহকে হারাবে তারা আমার বংশধরদেরকেই (আহলে বাইত) হারাবে। নিশ্চয়ই হাউযে কাউসারে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত এরা (আল-কোরআন ও নবীর বংশধর) কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।
মায়ের পবিত্র লাশের পাশে
আলী ইবনে ‘ঈসা আল-আরবীলী ‘কাশফুল গাম্মাহ্’ গ্রন্থে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর ওফাতের ঘটনা আসমা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,“যখন হযরত ফাতেমা মৃত্যুবরণ করলেন তখন আমি তাঁর পবিত্র লাশ একটি চাদর দিয়ে ঢেকে দিলাম। এ সময় ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ঘরে প্রবেশ করে বললেন : আসমা! আমাদের মা তো এ সময় ঘুমাতেন না?” হযরত আসমা তখন বললেন,“হে রাসূলাল্লাহর দৌহিত্রগণ! আপনাদের মা ঘুমান নি;তিনি এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।”
ইমাম হাসান যখন এ কথা শুনলেন তখন তিনি মায়ের পবিত্র লাশের ওপর আছড়ে পড়লেন এবং তাঁর মুখমণ্ডল চুম্বন করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন,“মা! আমার দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবার আগেই আমার সাথে কথা বল।”
ইমাম হুসাইন ঐ সময় সামনে এসে মায়ের পা চুম্বন করে বলতে লাগলেন,“মা! আমি তোমার ছেলে হুসাইন,আমার বুক ফেটে মৃত্যু হবার আগেই আমার সাথে কথা বল।”
হযরত আসমা যখন এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন তখন তিনি ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে বললেন,“হে রাসূলুল্লাহর দৌহিত্রগণ! আপনারা আপনাদের পিতার কাছে গিয়ে আপনাদের মায়ের মৃত্যুর খবর দিন।’’ হাসান ও হুসাইন মসজিদে পৌঁছে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহর সাহাবিগণ বের হয়ে এসে তাঁদের কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। হযরত আলী (আ.) যখন হযরত ফাতেমার মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত হলেন তখন তিনি অত্যন্ত ব্যাকুল চিত্তে ঘরে ফিরে আসলেন এবং হযরত ফাতেমার লাশের গোসল ও কাফনের নির্দেশ দিলেন।১০
আল্লামাহ্ মাজলিসী (রহ.) অন্য একটি রেওয়ায়েতে হযরত ফাতেমার সাথে ইমাম হুসাইনের শেষ বিদায় গ্রহণের কাহিনীটি বর্ণনা করেছেন,আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) যখন হযরত ফাতেমার গোসল দেয়া শেষ করলেন,তখন তিনি ফাতেমার সন্তানদেরকে ও গৃহপরিচারিকা ফিয্যাকে ডাকলেন যাতে করে তাঁরা হযরত ফাতেমাকে শেষ বিদায় জানাতে পারেন এবং বললেন,
یا زینب! یا سکینة! یا فضّة! یا حسن! یا حسین! هلمّوا تزوّدوا من امّکم فهذا الفراق و اللّقاء الجنّة
“হে যয়নাব! হে সাকীনাহ্! হে ফিয্যা! হে হাসান! হে হুসাইন! দ্রুত এসো,তোমাদের মা থেকে তোমাদের পাথেয় সংগ্রহ কর। কারণ এখন বিচ্ছেদের সময় এবং বেহেশ্তে মিলন।”
তখন ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন দ্রুত চলে আসলেন এবং উচ্চৈঃস্বরে আর্তনাদ করে বললেন,“হায়! আফসোস,আমাদের নানা ও আমাদের মায়ের হারানোর মুসিবতে আমাদের হৃদয়ের বহ্নি কখনো নির্বাপিত হবে না।”
আলী বললেন,“আমি মহান আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি,সে (ফাতেমা) এ সময় কাঁদল,দু’হাত খুলল,প্রসারিত করল এবং দীর্ঘক্ষণ তা বুকের ওপর রাখল। এই সময় আকাশ থেকে এক অদৃশ্য কথক বলল : হে আবুল হাসান! ফাতেমার হাত দু’টি তার বুকের ওপর থেকে সরিয়ে ফেল। কারণ মহান আল্লাহর শপথ,তা আসমানের ফেরেশতাদেরকে কাঁদিয়েছে। আমিও তার বুকের ওপর থেকে তাঁর হাত দু’টি সরিয়ে ফেললাম এবং কাফনের বাঁধনগুলো বাঁধলাম।”
নামায আদায় ও দাফন
কতিপয় রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে,হযরত ফাতেমার জানাযা নামায ও দাফন অনুষ্ঠানে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন উপস্থিত ছিলেন। শেখ সাদূক (রহ.) ‘খিসাল’ গ্রন্থে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলীর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন,হযরত ফাতেমার জানাযার নামাযে যে সব পুরুষ অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছয়জনের নাম ছিল নিম্নরূপ : আবু যার,সালমান,মিকদাদ,আম্মার,হুযাইফাহ্ ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ।
তাবারী থেকে ইবনে শাহরাশুব যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাতে তিনি বলেছেন,“হযরত ফাতেমাকে রাতের বেলায় দাফন করা হয়। আব্বাস,আলী,মিকদাদ ও যুবাইর ব্যতীত আর কেউ উপস্থিত ছিল না।” এর পরপরই ইবনে শাহরাশুর বলেছেন,“আমাদের রেওয়ায়েতসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে,হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী,হাসান,হুসাইন,আকীল,সালমান,আবু যার,আম্মার,ও বুরাইদাহ্ তাঁর জানাযা নামায পড়েছিলেন এবং অন্য একটি রেওয়ায়েতে হযরত আব্বাস ও তাঁর সন্তান ফযলের নামও উল্লিখিত হয়েছে। আবার অন্য একটি রেওয়ায়েতেও হুযাইফাহ্ ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের নাম এসেছে।”১১
স্নেহময়ী জননীর মৃত্যুর পরে
মা হযরত ফাতেমার অকাল বেদনাদায়ক মৃত্যু ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের পবিত্র কোমল হৃদয়ের ওপর গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল যে,তাঁদের কাছে অন্য কোন মহিলা যতই স্নেহময়ী হোক না কেন,হযরত ফাতেমা (আ.)-এর স্থান পূরণ করতে পারে নি। হযরত আলী মহানবী (সা.) ও হযরত ফাতেমা যাহরার ওফাতের পর গৃহে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সকল প্রশাসনিক,রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে তাঁকে ও বনি হাশেমকে দূরে রাখা হয়েছিল।১২ পক্ষান্তরে মহানবী ও ইসলাম ধর্মের সাথে আজীবন তীব্র শত্রুতা পোষণকারী বনি উমাইয়্যা,১৩ বিশেষ করে আমীর মুয়াবিয়া তদানীন্তন প্রশাসন-যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের ক্ষমতার স্পর্ধা,দাপট ও অপকর্মসমূহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাচ্ছিল।১৪ ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন তাঁদের স্রষ্টাপ্রদত্ত অসাধারণ মেধা ও ধীশক্তি দিয়ে ঐ শৈশবেই মুসলিম উম্মাহর এ ধরনের হৃদয়-বিদারক দুঃখ ও গুরুতর সমস্যা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আলী (আ.)-এর প্রসিদ্ধ খুতবা ‘শিকশিকিয়াহ্’ থেকে বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। তিনি উক্ত খুতবায় বলেছিলেন,
“অতঃপর আমি ধৈর্য ধারণ করলাম,অথচ আমার চোখে ছিল কণ্টক এবং গলায় ছিল হাড় ।”১৫
খুম্সের অংশসহ সকল অর্থনৈতিক অধিকার যা মহানবীর আহলে বাইত তাঁর জীবদ্দশায় প্রাপ্ত হতেন এবং ভোগ করতেন তা তাঁর ওফাতের পর প্রশাসন নিজ তত্ত্বাবধানে নিয়ে নেয়। ফাদাকের মত ভূ-সম্পত্তিও তাঁদের কাছ থেকে প্রশাসন ক্রোক করে নিয়েছিল।১৬ এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই হযরত আলী ও আহলে বাই্ত তীব্র আর্থিক চাপ ও অনটনের মধ্যে পতিত হয়েছিলেন।
হযরত উমর তাঁর খেলাফতকালে সাহাবীদের মদীনার বাইরে গমন ও বসবাস করার ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন হযরত আলীও সেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন। প্রখ্যাত মিসরীয় লেখক ও সাহিত্যিক ড. ত্বাহা হুসাইন তাঁর ‘আল-ফিতনাতুল কুবরা’ গ্রন্থে দ্বিতীয় খলীফার এই নিষেধাজ্ঞা জারী করার উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে লিখেছেন,“দ্বিতীয় খলীফা আশংকা করতেন,সাহাবীরা অন্যান্য শহর ও নগরে গিয়ে জনগণকে নিজেদের দিকে একত্র করে ফিতনা সৃষ্টি করতে পারেন।”১৭ যা হোক,মদীনা নগরী থেকে বের হবার এ নিষেধাজ্ঞা হযরত আলীকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং ধীরে ধীরে তাঁকে রাজনীতির অঙ্গন ও সামাজিক পরিমণ্ডল থেকেও বের করে আনে অর্থাৎ তিনি কার্যত সার্বিকভাবে জনগণের কাছে বিস্মৃত হয়ে যান।
প্রশাসন যখন সমস্যার সম্মুখীন হতো এবং তা সমাধান করতে সক্ষম না হতো তখন নিরুপায় হয়ে আলী (আ.)-এর শরণাপন্ন হতো।১৮ তখন তিনি ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর কল্যাণ ও স্বার্থে ঐ সকল সমস্যার সঠিক সমাধান পেশ করতেন।
আমার পিতার মিম্বার থেকে নীচে নেমে আসুন
আল্লামাহ্ ইবনে হাজার আসকালানী ‘আল-ইসাবাহ্’ গ্রন্থে সনদসহ বর্ণনা করেছেন,খলীফা উমর একদিন (মসজিদে নববীর) মিম্বারে বক্তৃতারত ছিলেন। তখন ইমাম হুসাইন তাঁর সামনে এসে বললেন, انزل عن منبر ابی و اذهب الی منبر ابیک“আমার পিতার মিম্বার থেকে নেমে আসুন এবং আপনার নিজ পিতার মিম্বারে গিয়ে দাঁড়ান।”১৯
ইবনে আসাকিরের গ্রন্থেও এ রেওয়ায়েতটির অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। আল্লামাহ্ যাহাবীও তাঁর ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ৩৪৬ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন : ইয়াহ্ইয়া ইবনে সাঈদ আল আনসারী,উবাইদ বিন হুনাইন হতে বর্ণনা করেছেন। উবাইদ বিন হুনাইন বলেছেন,“আমাকে হুসাইন ইবনে আলী বলেছেন : আমি হযরত উমরের কাছে আসলাম। তখন তিনি মিম্বারে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন। আমি তাঁর দিকে গিয়ে বললাম : আমার পিতার মিম্বার থেকে নেমে আসুন এবং আপনার পিতার মিম্বারে গিয়ে দাঁড়ান! অতঃপর হযরত উমর বললেন : আমার পিতার তো কোন মিম্বার ছিল না। এ কথা বলে তিনি আমাকে তাঁর সাথে বসালেন। তখন আমি আমার হাতের মধ্যে নুড়ি-পাথর নাড়াচাড়া করতে থাকি। মিম্বার থেকে নেমে এসে তিনি আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন : তোমাকে এ কথা কে শিখিয়েছে? আমি তখন বললাম : মহান আল্লাহর শপথ! আমাকে কেউ শেখায় নি। এরপর তিনি বললেন : আমার কাছে নিয়মিত এসো। ইমাম হুসাইন বলেন : অতঃপর এক দিন আমি তাঁর কাছে গেলাম। ঠিক ঐ সময় তিনি মুয়াবিয়ার সাথে গোপনে পরামর্শ করছিলেন এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর দরজার সামনে ছিলেন। অতঃপর আমি ইবনে উমরের সাথে চলে আসলাম। পরে (এক দিন) হযরত উমরের সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন : কই,তোমাকে তো আর দেখলাম না। তখন আমি তাঁকে বললাম : হে আমীরুল মুমিনীন! আমি আপনার কাছে এসেছিলাম। তখন আপনি মুয়াবিয়ার সাথে পরামর্শ করছিলেন। আর ইবনে উমরও তখন ঘরের দরজার কাছে দণ্ডায়মান ছিলেন। তিনি ফিরে গেলে আমিও তাঁর সাথে সেখান থেকে চলে এলাম। এ কথা শুনে তিনি বললেন : অনুমতি পাবার ক্ষেত্রে তুমি ইবনে উমর অপেক্ষা অধিকতর উপযুক্ত। আমাদের মাথার ওপর যা তুমি দেখছ আসলে তা মহান আল্লাহ্ই প্রদান করেছেন। অতঃপর তোমরা (অর্থাৎ মহানবী ও তাঁর আহলে বাইত)।” আল খতীব এ হাদীসটি ইয়াহ্ইয়ার কাছে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
(চলবে)
তথ্যসূত্র:
১. হাকিম আল-নিশাপুরী প্রণীত মুস্তাদরাকুস্ সহীহাইন,আল-খাওয়ারিযমী প্রণীত মাকতালুল হুসাইন,আল্লামাহ্ সুয়ূতী প্রণীত খাসায়িস আল-কুবরা।
২. তাবরানী প্রণীত আল-মু’জাম আল-কাবীর,আল্লামাহ্ গাঞ্জী শাফেয়ী প্রণীত কিফায়াতুত্ তালিব গ্রন্থ।
৩. কানযুল উম্মাহ,১৩তম খণ্ড,পৃ. ১১২।
৪. কানযুল উম্মাহ্,১৩তম খণ্ড,পৃ. ১১২।
৫. ইবনে হাজার আল-আসকালানী প্রণীত তাহযীব আল-তাহযীব,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৪৭।
৬. মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল,ইবনে হাজার আস-কালানী প্রণীত তাহযীব আত্-তাহযীব,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৪৭;যাহাবী,তাবরানী,খাওয়ারিযমী,তাবারী,ইবনে হাজার আল-হাইসামী,আল্লামাহ্ মুহিব্বুদ্দীন আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ্ আত্-তাবারী প্রণীত যাখায়িরুল উকবা,পৃ. ১৪৮;দরুল-মা’রেফাহ্ বৈরুত থেকে মুদ্রিত,এই একই ধরনের ২০টির অধিক হাদীস আল্লামাহ্ সুয়ূতীসহ অন্যান্য আলেম তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
৭. আল্লামাহ্ মুহিব্বুদ্দীন আহমদ বিন আবদুল্লাহ আত্-তাবারী প্রণীত যাখায়িরুল উকবা ফী মানাকিবে যাভীল কুরবা,দারুল-মা’রেফাহ্,বৈরুত,লেবালন থেকে মুদ্রিত,পৃ. ১৪৬।
৮. প্রাগুক্ত যাখায়িরুল উকবা,পৃ. ১৪৬।
৯. আল-হাফেয আবু বকর আল-বাগদাদী প্রণীত তারীখে বাগদাদ,৩য় খণ্ড,পৃ. ২০৯;আল-মাআদাহ্,মিসর কর্তক মুদ্রিত।
১০. কাশফুল গাম্মাহ্,২য় খণ্ড,পৃ. ১২৬।
১১. মানাকেব,৩য় খণ্ড,পৃ. ৩৬৩।
১২.ইসলামিক ফাউণ্ডেশন,ঢাকা,বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত মুহম্মদ আহসান উল্লাহ প্রণীত খিলাফতের ইতিহাস গ্রন্থের ৭৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে : পূর্ববর্তী তিন খলীফার আমলেই হাশেম বংশের লোকগণের প্রতি যে উপেক্ষা ও অবিচার করা হইয়াছে,তাহার কিছুটা পূরণের আশায় হযরত আলী (রা.) নূতনভাবে প্রাদেশিক গভর্ণরগণকে নিযুক্ত করিলেন...।
১৩.মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর প্রথম খলীফার আমলেই ইসলাম ও মহানবীর বিরুদ্ধাচারী আবু সুফিয়ান পরিবার শামের (সিরিয়া) শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে। আল্লামাহ্ সুয়ূতী তাঁর ‘তারীখুল্ খুলাফা’ (খলীফাদের ইতিহাস) প্রন্থে লিখেছেন :
لما بعث ابو بکر الجیوش الی الشام سار معاویه مع اخیه یزید بن ابی سفیان فلماّ مات یزید استخلفه علی دمشق فاقرّه عمر ثمّ اقرّه عثمان و جمع له الشّام کله فاقام امیرا عشرین سنة و خلیفة عشرین سنة
যখন খলীফা আবু বকর শামে সেনাবাহিনী প্রেরণ করলেন তখন মুয়াবিয়া তাঁর নিজ ভ্রাতা ইয়াযীদ ইবনে আবু সুফিয়ানের সাথে শাম গমন করেন। অতঃপর ইয়াযীদের মৃত্যু হলে খলীফা আবু বকর মুয়াবিয়াকে দামেশকের শাসক (গভর্নর) নিযুক্ত করেন। এরপর দ্বিতীয় খলীফা উমর এবং তারপর তৃতীয় খলীফা উসমান তাঁকে উক্ত পদে বহাল রাখেন। তিনি (তৃতীয় খলীফা) সমগ্র শামকে তাঁর (মুয়াবিয়ার) শাসনাধীন করে দেন। তাই মুয়াবিয়া সেখানে ২০ বছর গভর্নর এবং ২০ বছর খলীফা হিসেবে শাসন করেছিলেন। (তারীখুল খুলাফা,পৃ. ১৯৪,দারুল কালাম আল আরাবী,সিরিয়া কর্তৃক মুদ্রিত)
১৪.হযরত উমরের শাসনামলে মুয়াবিয়া শামের রাজধানী দামেশকে এক বিরাট জমকালো প্রাসাদ নির্মাণ করেন যা ইতিহাসে ‘সবুজ প্রাসাদ’ বলে খ্যাতি লাভ করেছে। রাজকীয় চাল-চলনের কারণে খলীফা উমর তাঁকে ‘আরবের খসরু’ বলে অভিহিত করতেন (প্রাগুক্ত তারিখুল খুলাফা,পৃ. ১৯৩)। মুয়াবিয়া হযরত উসমানের শাসনামল থেকেই এক রকম স্বাধীনভাবে শামের শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের শাসনামলে উমাইয়্যা বংশীয়দের দৌরাত্ম,দাপট ও দুর্নীতি বহুগুণ বৃদ্ধি পায় যা আমরা পরে বর্ণনা করব।
১৫. সাইয়্যেদ রাযী সংকলিত নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা ৩ : খুতবা-ই শিকশিকিয়াহ্।
১৬.ফাদাকের ভূ-সম্পত্তি যে হযরত আবু বকর হযরত ফাতেমা ও আহলে বাইতের কাছ থেকে ক্রোক করেছিলেন এবং এ কারণে হযরত ফাতেমা তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এতদ্সংক্রান্ত বর্ণনাটি আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল-বুখারীর ৬ষ্ঠ খণ্ডের ১৪৮ পৃষ্ঠায় ৬২৫৮ নং হাদীস হিসেবে এসেছে। হাদীসটি নিম্নরূপ :
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। (একদা) ফাতেমা ও আব্বাস এসে আবু বকর (রা.)-এর কাছে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তাঁদের উভয়ের মীরাসের দাবী তুললেন। বিশেষ করে সেদিন তাঁরা ‘ফাদাক’ উপত্যকা ও তাঁর খায়বার ভূমির হিস্যে থেকে অংশ চেয়েছিলেন। এরপর (খলীফা) আবু বকর বললেন,“আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) থেকে শুনেছি,তিনি বলেছেন আমরা (নবীগণ) কাউকে ওয়ারিশ (উত্তরাধিকারী) বানাই না,বরং যা কিছু অবশিষ্ট রেখে যাই তা হচ্ছে সাদাকা। অবশ্য মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারবর্গ সে সম্পদ থেকে কেবল ভোগের অধিকারী।” আবু বকর বললেন,“আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে এ ব্যাপারে যে পদ্ধতি গ্রহণ করতে দেখেছি,আমিও শুধু তাই করব এবং এর ব্যতিক্রম করব না।” বর্ণনাকারী বলেন,ফলে ফতেমা তাঁর [আবু বকর (রাঃ)-এর] সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন এমন কি মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সাথে আর কথাবার্তাও বলেন নি।
আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারীর ৪র্থ খণ্ডের ১৭৬ পৃষ্ঠার ৩৯১৩ নং হাদীসটি এরূপ : আয়েশা থেকে বর্ণিত। (তিনি বলেছেন) নবী (সা.) এর কন্যা ফাতেমা আবু বকরের কাছে লোক পাঠিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওয়ারিস হিসেবে মদীনা ও ফাদাকের ফাই (বিনা যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ) এবং খাইবারের ‘খুমস’ বা এক-পঞ্চমাংশের মিরাস চেয়ে পাঠালেন। জবাবে আবু বকর বললেন,“রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : আমাদের (নবীদের) কোন ওয়ারিস নাই। আমরা যা রেখে যাই তা সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে। মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধরগণ অবশ্য প্রয়োজন মতো এ সম্পদ হতে ভোগ করতে পারেন। আল্লাহর কসম,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর রেখে যাওয়া এই সাদাকা তাঁর জীবদ্দশায় যে অবস্থায় ছিলো তাতে সামান্যতম পরিবর্তনও আমি করতে পারবো না। আর এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যে নীতিতে কাজ করেছেন আমিও ঠিক তাই করব।” সুতরাং আবু বকর ঐ সম্পদ থেকে ফাতেমাকে দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তাই এ ব্যাপারে ফাতেমা আবু বকরের ওপর রাগান্বিত হলেন এবং তাঁকে বর্জন করলেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর তাঁর সাথে কথা বলেন নি। তিনি নবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ছয় মাস জীবিত ছিলেন। তিনি ইন্তেকাল করলে তাঁর স্বামী আলী একাই তাঁকে রাতের বেলা দাফন করলেন,এমন কি তাঁর ইন্তেকালের খবর তিনি [আলী (রা.)] আবু বকরকেও জানালেন না। তিনি [আলী (রা.)] নিজেই তাঁর জানাযা পড়েছিলেন। ফাতেমা রোগশয্যায় জীবিত থাকা পর্যন্ত লোকজনের কাছে আলীর মর্যাদা ও প্রভাব ছিলো। কিন্তু ফাতেমা ইন্তেকাল করলে মানুষের কাছে আলীর সেই মর্যাদা নষ্ট হয়ে গেলো। (অর্থাৎ সামাজিকভাবে তিনি একঘরে হয়ে গেলেন এবং জনগন তাঁকে ত্যাগ করল।)
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘ফুতুহুল বুলদান’ গ্রন্থে এসেছে : রাসূলুল্লাহ্ (সা.) খায়বার হতে ফিরে এসে মুহাইয়িসা ইব্ন মাসউদ আনসারী (রা.)-কে ইসলামের দিকে দাওয়াত দানের উদ্দেশে ফাদাকবাসীদের নিকট প্রেরণ করেন। ইয়াহুদী ইউশা’ ইব্ন নূন তাদের নেতা ছিল। তারা ফাদাকের অর্ধেক জমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে প্রদান করার শর্তে সন্ধির প্রস্তাব দিল। তিনি তা মঞ্জুর করে নিলেন। এ জন্যে ফাদাকের অর্ধেক জমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জন্যে খাস হয়ে গেল। কেননা মুসলমানগণ এর জন্যে তাদের ঘোড়া ও উটে আরোহণ করে যুদ্ধ করেন নি। (পৃ. ২৮)
ইবরাহীম ইব্ন মুহাম্মদ (র.) ... কালবী (রা.) সূত্রে বর্ণনা করেন যে,উমাইয়া শাসকগণ ফাদাকের আয়কে নিজেদের খাস সম্পত্তিতে পরিণত করে নিলেন। কিন্তু যখন উমর ইব্ন আবদুল আযীয শাসনকর্তা হলেন তখন তিনি তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেন।
আবদুল্লাহ্ ইব্ন মায়মূন মুকাত্তিব (রা.) .... মালিক ইব্ন জাউনা (রা.) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন যে,ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.)-কে বললেন,ফাদাকের ভূমিটি আমাকে দিয়ে দিন। কেননা তা রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আমার জন্যে খাস করে দিয়েছেন। তিনি সাক্ষীস্বরূপ ‘আলী ইব্ন আবু তালিব (রা.)-কে পেশ করলেন। তিনি দ্বিতীয় সাক্ষী চাইলেন। তিনি উম্মু আইমন (রা.)-কে পেশ করলেন। আবু বকর (রাঃ) বললেন,“হে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কন্যা! আপনি জানেন যে,কোন সাক্ষ্য ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নয়,যতক্ষণ পর্যন্ত হয় দু’জন পুরুষ হবে,আর না হয় একজন পুরুষ ও দু’জন স্ত্রীলোক হবে।” একথা শুনে তিনি ফিরে চলে গেলেন। (পৃ. ২৯)
রাওহুল কারাবীসী (র.) জাফর ইব্ন মুহাম্মদ (রা.) সুত্রে বর্ণিত রিওয়ায়াতে উম্মু আইমান (রা.)-এর সাথে রাবাহকে সাক্ষীরূপে পেশ করার কথা বর্ণিত হয়েছে। রাবাহ্ ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আযাদকৃত দাস।
ইব্ন আইশা তায়মী (র.) ... উম্মু হানী (রা.) সূত্রে বর্ণনা করেন যে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কন্যা ফাতিমা (রা.) আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলেন,আপনি ইন্তিকাল করলে আপনার ওয়ারিছ কে হবে? তিনি বললেন,আমার সন্তান ও আমার পরিবার। হযরত ফাতিমা (রা.) বললেন,“তবে এটাই কেমন কথা যে,আমি থাকতে আপনিই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওয়ারিস হয়ে গেলেন?” তিনি বললেন,“হে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কন্যা! আল্লাহর কসম! আমি আপনার পিতা থেকে স্বর্ণ-রৌপ্য বা অন্য কোন জিনিসের ওয়ারিস হই নাই।” ফাতিমা (রা.) বললেন,“খায়বারের জমিতে আমাদের অংশ আছে এবং ফাদাকের বাগানটি আমাদের জন্যে সাদাকাস্বরূপ।” তিনি বললেন,“হে রাসূলুল্লাহর কন্যা! আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি,এ জীবনোপকরণ আল্লাহ্ আমাকে আমার জীবনকালের জন্যে দান করেছেন। আর আমার ইন্তিকালের পর তা মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে।”
২১০ হিজরী সনে খলীফা আল-মামুন ফাতিমা (রাঃ)-এর উত্তরাধিকারীদেরকে ‘ফাদাক’ ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। এ সম্পর্কে তিনি মদীনার গভর্নর কাসিম ইব্ন জাফরকে নিম্নরূপ লিপি প্রদান করেন :
আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসূলের প্রতি দরূদের পর। আল্লাহর দীনে মর্যাদাসম্পন্ন,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতিনিধি এবং তাঁর আত্মীয় হবার কারণে আমীরুল মু’মিনীন এ কথার সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত যে,তিনি তাঁর সুন্নাতের সর্বাধিক অনুসারী হবেন এবং তাঁর হুকুম কার্যকরী করবেন এবং যাকে তিনি কোন কিছু অনুগ্রহ করেছেন বা সাদাকা করেছেন বা দান করেছেন,তা তিনি অবশ্যই তাকে সমর্পণ করবেন। সামর্থ্য এবং আল্লাহর সহায়তা আমীরুল মু’মিনীনের সাথে আছে এবং প্রতিটি কাজে তারই সন্তুষ্টি কাম্য। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) নিজ দুলালী ফাতিমা (রা.)-কে ফাদাক প্রদান করেছিলেন। আর তা এত স্পষ্ট এবং সুবিদিত যে,এতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর পরিবার-পরিজনের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। এ কারণে আমীরুল মু’মিনীনের কাছে ফাদাকের জমি এমন জিনিসের দাবী করছে,যা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে আন্তরিকতা ও সরলতার কারণে তার জন্যে সবচেয়ে উত্তম ও শ্রেয় কাজ। এ জন্যে আমীরুল মু’মিনীন যথার্থ মনে করছেন যে,ফাদাকের জমি ফাতিমা (রা.)-এর ওয়ারিসদেরকে ফিরিয়ে দেন এবং এটি ওদের কাছে প্রত্যর্পণ করেন আল্লাহর হক ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দ্বারা এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর হুকুম ও সাদাকাকে জারি করে আল্লাহ্ ও রাসূলের নৈকট্য লাভ করেন সুতরাং আমীরুল মু’মিনীন নির্দেশ দিচ্ছেন যে,এ কথা তার দপ্তরে লিখে রাখা হোক এবং তার গভর্নরদেকে এ বিষয়ে লিখে জানান হোক।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইন্তিকালের পর যখন প্রত্যেক হজ্বের মৌসুমে এ আহ্বান করা হতো যে,যাদেরকে কোন সাদাকা দেয়া হয়েছে বা কোন কিছু হিবা করা হয়েছে কিংবা তাদের সাথে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে,তা যেন পালন করা হয়,তখন তারা এসে তা বর্ণনা করত এবং তাদের কথা গ্রহণ করা হতো। আর তাদের অংশ তাদেরকে যথারীতি দিয়ে দেয়া হতো। তাহলে ফাতিমা (রা.)-এর এ দাবী যে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ঐ ভূমি তাঁরই জন্যে খাস করে দিয়েছেন,তা অধিকতর গ্রহণযোগ্য প্রতিপন্ন হয়। (পৃ. ৩১,৩২)
আমীরুল মু’মিনীন তার আযাদকৃত দাস মুবারক তাবারী (রা.)-কে এ মর্মে নির্দেশ দিলেন যে,ফাদাক তার আসল সীমা,তার সাথে সেখান হতে অর্জিত পাওনাদি,তার সাথে সেখানকার গোলাম এবং ফসলাদিসহ ফাতিমা (রা.)-এর উত্তরাধিকারী মুহাম্মদ ইব্ন ইয়াহ্ইয়া (ইব্ন হুসাইন ইব্ন যায়দ ইব্ন আলী ইব্ন আবু তালিব) এবং মুহাম্মদ ইব্ন আবদুল্লাহ্ (ইব্ন হাসান ইব্ন হুসাইন ইব্ন আলী ইব্ন আবু তালিব)-কে প্রদান করা হোক। কেননা,আমীরুল মু’মিনীন তাদের উভয়কে ফাদাকবাসীদের ব্যাপারে ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করেছেন। সুতরাং জেনে রাখুন এটি আমীরুল মু’মিনীনের অভিমত এবং ঐ জিনিস যা আল্লাহ্ তার অন্তরে ঢেলে দিয়েছেন তার কারণে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর সাথে তার নৈকট্যের কারণে আল্লাহ্ তাকে এর তাওফীক দিয়েছেন। আপনি নিজের পক্ষ থেকে মুবারক তাবারীকে এ বিষয়ে সাবধান করে দিন। আর মুহাম্মদ ইব্ন ইয়াহ্ইয়া এবং মুহাম্মদ ইব্ন আবদুল্লাহ্ যাদেরকে আমীরুল মু’মিনীন মুতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেছেন,তাদের সাথেও ঐ ব্যবহার করবেন,যা মুবারক তাবারীর সাথে করছিলেন। আর ফাদাকের উন্নতি,কল্যাণ সাধন,উৎকর্ষ সাধন এবং এর উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে তাদেরকে সহায়তা প্রদান করবেন। আপনাদের প্রতি সালাম। এ নির্দেশনামাটি ২১০ হিজরী সনের ২রা যিলকাদ বুধবার লেখা হয়েছিল। কিন্তু মুতাওয়াক্কিল খলীফা হয়ে ফাদাকের ব্যবস্থাপনা আল-মামুনের পূর্বেকার অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ জারী করেন। (পৃ. ৩২)
আল্লামাহ্ বালাযুরীর ফাদাক সংক্রান্ত ঐতিহাসিক বিবরণ এবং সহীহ বুখারীর বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে,ফাদাকের ভূ-সম্পত্তি সংক্রান্ত খলীফাদের সুস্পষ্ট একক কোন নীতি ছিল না এবং ফাদাকের মালিকানা সংক্রান্ত হযরত ফাতেমার দাবী সত্য।
১৭. ড. ত্বাহা হুসাইন প্রণীত আল-ফিতনাতুল কুবরা,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭।
১৮. দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর প্রায়শ বলতেন,“যদি আলী না থাকতেন তাহলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত।” সাঈদ বিন মুসাইয়াব থেকে আল-হাকিম বর্ণনা করেছেন,তিনি (সাঈদ) বলেছেন,“খলীফা উমর ইবনুল খাত্তাব যে সমস্যায় আবুল হাসান [আলী (রা.)] নেই সে সমস্যার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।” (আল্লামাহ্ সুয়ূতী প্রণীত তারীখুল খুলাফা,পৃ. ১৭২,দারুল কালাম আল-আরাবী,আলেপ্পো,সিরিয়া কর্তৃক মুদ্রিত)
২৯ হিজরীতে খলীফা উসমান মক্কায় হজ্জ্ব করিতে যান এবং মীনা নামক প্রান্তরে কোরবানীস্থলে তাবু গাড়িয়া বিশ্রামের জায়গা স্থাপন করেন। সমগ্র আরব দেশ এই বিদয়াত বা নতুন ক্রিয়ার ফলে উত্তেজিত হইয়া উঠে। কারণ রসূলে করীম (সাঃ) এবং তাহার দুই খলীফা আবু বকর এবং উমর ঐ কাজ করেন নাই। এই সফরেই খলীফা একটি বিধবা স্ত্রীলোককে ব্যভিচারের অপবাদে প্রস্তরাঘাতে নিহত করার আদেশ দান করেন। উক্ত দণ্ডদানের কারণস্বরূপ বলা হইয়াছিল যে,স্ত্রীলোকটি স্বামীর মৃত্যুর ছয় মাস পরেই একটি সন্তান প্রসব করে। হযরত আলী (রা.) খলীফাকে যখন বুঝাইয়া দিলেন যে,স্ত্রীলোকের গর্ভধারণ সময়কাল কমপক্ষে ছয় মাস হওয়ার কথা কুরআন শরীফেই উল্লেখ আছে,তখন তিনি নিজের ভুল স্বীকার করিলেন। আফসোস,ভুল ধরা পড়িবার আগেই স্ত্রীলোকটি নিহত হইয়াছিল। (মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ প্রণীত খিলাফতের ইতিহাস,পৃ. ৫৯,ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ,ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত।)
১৯. আল ইসাবাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ২৩২।