প্রথম পর্ব
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ এবং সামগ্রিক জীবন বিধান হিসেবে ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে জ্ঞানী গুণী বিশেষজ্ঞগণ মহান এই ধর্ম নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে এই ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও স্বরূপের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পান। যার ফলে শত্রুদের তাবৎ ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিকাশ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। আসলে ইসলামের নীতিমালা এবং শিক্ষাগুলো জুলুম অত্যাচার নিপীড়নের বিরোধী হবার কারণে বিশ্বের বলদর্পী শক্তিগুলোর স্বার্থের পথে তা মারাত্মক অন্তরায়। যার ফলে আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ এবং তার বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্যে তাদের সর্বপ্রকার সামর্থ ও শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। আমরা তাই এই আসরে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ ও বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
সূচনালগ্ন থেকেই ইসলাম শত্রুতার মুখে পড়েছিল। আজও সেই শত্রুতা অব্যাহত আছে। তবে বর্তমানে পশ্চিমা বলদর্পী শক্তিগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতার নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা এখন বিশ্বব্যাপী ইসলামভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা ইসলামকে যুদ্ধ ও সহিংসতার ধর্ম এবং মানবাধিকার উপেক্ষাকারী বলে প্রচার করার চেষ্টা করছে। এসব করে তারা বিশ্ববাসীকে ইসলাম বিমুখ করে রাখতে চায়। তবে নামসর্বস্ব কিছু মুসলমানের কাজকর্ম পশ্চিমাদের ঐসব প্রচারণার অনুকূলে গেছে। যেমন- আল কায়েদা ও তালেবান। এই গোষ্ঠিগুলো সহিংসতাকামী,নির্দয় এবং সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত থেকেও নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। এদিকে গণমাধ্যমগুলো তাদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ডগুলোকে ফলাও করে প্রচার করছে,যেসব দেখলে যে কোনো মানুষই মুসলমানদের ব্যাপারে ঘৃণ্য ও অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করবে। পশ্চিমাদের ব্যাপক অপপ্রচারণার ফলে যে-কোনো সাধারণ মানুষ বা অসচেতন মানুষ ঐসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ভুল করে ইসলাম এবং মুসলমানদের কার্যক্রম বলে ভাবতে পারে।
তবে সুখকর ব্যাপারটি হলো, বিশ্বের প্রকৃত মুসলমানদের বিশাল অংশটি মুসলিম নামধারী ঐসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠির কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং ঐসব গোষ্ঠিকে বিচ্যুত বলে মত দিয়েছেন। পশ্চিমারা যেহেতু ইসলামের শক্তিশালী ও উন্নত সংস্কৃতিকে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে সক্ষম নয় সেহেতু তারা ইসলামের অগ্রগতিতে শঙ্কিত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণার আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে যারা ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী তাদেরকে ফিরিয়ে রাখার স্বার্থে ইসলামকে সন্ত্রাসী বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। সেজন্যে এখন সবার মনেই একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে-ইসলাম কি আসলেই সন্ত্রাসী বা সহিংসতার ধর্ম? ধারাবাহিক এই আসরে আমরা এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো। সেইসাথে প্রেম ভালোবাসা স্নেহ ও কল্যাণ আর মানবতার মুক্তির ধর্ম ইসলামের বিশেষ কিছু দিক ও তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
পবিত্র কোরআন নিয়ে সামান্য পড়ালেখা করলেই অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে যা থেকে বোঝা যাবে ইসলাম একটি দয়া, অনুগ্রহ ও কল্যাণের ধর্ম।আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, করুণার কথা দয়ার কথায় কোরআন পরিপূর্ণ। কোরআনের প্রতিটি সূরা শুরু করতে হয় এমনকি মুসলমানদের প্রতিটি কাজ শুরু করতে হয় বিসমিল্লাহ বলে। এর অর্থই হলো সেই আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম করুণাময় এবং দয়াবান।কোরানের ১১৪ টি সূরার মধ্যে ১১৩ সূরা এই বিসমিল্লা বলে শুরু হয়েছে। কোরআনের অসংখ্য আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অসম্ভব দয়ালু, তিনি ক্ষমাকারী এবং মেহেরবান ইত্যাদি। তো যেই ধর্মের মূল গ্রন্থটির সূচনা হয়েছে আল্লাহর দয়া আর রহমতের ঘোষণা দিয়ে সেই ধর্ম কি সহিংস হতে পারে?
কোরআনের আয়াতগুলোর প্রতি মনোযোগী হলে দেখা যাবে আল্লাহর অনুগ্রহ, করুণা এবং দয়ার্দ্রতার বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সেখানে লক্ষ্য করা যাবে আল্লাহর এই দয়ার ব্যাপারটি কেবল যে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্যে তা নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্যেই প্রযোজ্য। এ কারণে ইসলাম ধর্মও কেবল মুসলমানদেরই নয় বরং সমগ্র মানব জাতির ধর্ম।সূরায়ে জাসিয়ার চৌদ্দ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে,যারা কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে না, যাতে তিনি কোন সম্প্রদায়কে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেন ।" আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই আয়াতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন তারা যেন অমুসলমানদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হয় এবং তাদের মন্দ দিকগুলোকে না দেখার ভান করে বা উপেক্ষা করে যায়। তো এরকম একটি ধর্মকে কী করে সহিংস বলা যায়!
আসলে আল্লাহর রহমত বা দয়ার ভাণ্ডার অফুরন্ত,অসীম। কিন্তু কিছু কিছু লোক বিচ্যুতির পথে পা বাড়িয়ে নিজেদের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে ফেলে আল্লাহর রহমতের ব্যাপার হতাশ কিংবা বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। তাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যেই আল্লাহ নবী রাসূলদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এরকমই একজন নবী হলেন ইব্রাহিম (আ)। তিনি লুতের কওমকে আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে ব্যাপক চেষ্টা চালান। আল্লাহর কাছে তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সাধারণত নবীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতিকে সুসংবাদ এবং সতর্কতা প্রদানকারী হিসেবেই আবির্ভূত হন। ঐ সতর্কতাও আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও অনুগ্রহ, যাতে তারা বিচ্যুতি থেকে সঠিক পথে ফিরে আসেন এবং সৌভাগ্যের প্রশস্ত পথে অগ্রসর হয়। এই সতর্কতাও অনুগ্রহ। সেজন্যেই রাসূলের পরিচয় সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছেঃ ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।' সেজন্যেই আমরা লক্ষ্য করবো মূর্তিপূজকরা পর্যন্ত যখন নবীজীকে বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ করতো তখনো তিনি ধৈর্যের সাথে বরণ করতেন কখনোই তাদেরকে পাল্টা গালি দেন নি, তাদেরকে অভিশাপ দেন নি। কোরআনে তাই বলা হয়েছে ‘নিশ্চয়ই আপনি সবোর্ত্তম চরিত্রের অধিকারী।'
সূরা আল-ইমরানের একশ' উনষাট নম্বর আয়াতে রাসূলের এই কোমল ও সহৃদয় হবার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো।' এটা ছিল সত্যিকারের এক অলৌকিক ব্যাপার। কেননা নবীজীর আবির্ভাবের আগে আরবের লোকেরা যেখানে খুনখারাবি ছাড়া কিছুই বুঝতো না, সেখানে নবীজীর আগমনের পর তাঁর এই ধৈর্যশীলতা ও কোমল হৃদয়ের আকর্ষণে মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়, ঝুকেঁ পড়ে। এ জন্যে অতি দ্রুত তিনি একটি শক্তিশালী উম্মাত গঠন করতে সক্ষম হন। অসম্ভব ভালোবাসা আর পারস্পরিক আন্তরিকতাপূর্ণ এই উম্মাত গঠনের পেছনে সহিংসতা কিংবা শক্তির বিন্দুমাত্র প্রয়োগ ছিল না। সেই ভালোবাসা আর আন্তরিক একতাপূর্ণ ধর্ম ইসলামকে কি সহিংসতার ধর্ম বলা যায়?
দ্বিতীয় পর্ব
কোরআনের শিক্ষাগুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব এবং শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার দুই শ' আট নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চিয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আল্লাহর আমাদের এই আয়াতের তাৎপর্য উপলব্ধি করার যোগ্যতা দিন।
যেই আয়াতটি আমরা উল্লেখ করেছি তাতে ‘ফিস সিল্মি' শব্দটি এসেছে। সাল্ম্ এবং সালামের আভিধানিক অর্থ হলো শান্তি,সমঝোতা ও স্বস্তি। কোরআনের আয়াত থেকে আমরা জানতে পারছি মানব সমাজে দৃঢ় সমঝোতা এবং স্বস্তি নিশ্চিত হতে পারে বা বাস্তবায়িত হতে পারে কেবল আল্লাহর প্রতি ইমান আনার মধ্য দিয়ে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে ভৌগোলিক, আঞ্চলিক, বর্ণ, গোত্র এবং ভাষাগত দিক থেকে হাজারো পার্থক্য বা ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে সামাজিক সংযোগের বৃত্তটি রচিত হতে পারে কেবল এই আল্লাহর প্রতি ইমানের ভিত্তিতে।
এই আয়াতটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কোরআনে মাজিদের বক্তব্য অনুযায়ী যারা এই শান্তি ও সমঝোতার পথ পরিহার করে যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ বেছে নিয়ে আগুণের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দেয়, তারা শয়তানের অনুসারী। তার মানে হলো সমঝোতা ও শান্তি হচ্ছে দয়াময় আল্লাহর কাজ আর সমাজে যুদ্ধ ও সংঘাতের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া বর্বর শয়তানের কাজ। সমঝোতা ও শান্তি সম্পর্কে কোরআনের আরেকটি আয়াতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন যদি শত্রুরা ন্যায়সঙ্গত সমঝোতা বা সন্ধি করতে চায় তাহলে তা গ্রহণ করো। তবে অন্যায়, অসত্যের কাছে মাথানত করে কিংবা সত্যকে বিসর্জন দিয়ে সমঝোতা করা যাবে না। ঔদাসীন্য, ভয় ও আপোসের মানসিকতা নিয়ে সমঝোতা করা হলে ইসলাম তা সমর্থন করে না। পবিত্র কোরআনে এ ধরনের সমঝোতাকে তিরস্কার করা হয়েছে। সেইসাথে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে যে, শত্রুদের সাথে সমঝোতা হতে হবে মুমিনদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে।
ইমাম আলী (আ) মালেক আশতারকে মিশরের গভর্নর করে পাঠানোর পর এক চিঠিতে লিখেছেনঃ ‘শত্রুরা যদি তোমাকে সমঝোতা বা সন্ধির দিকে আহ্বান জানায় এবং তাতে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করো না। কেননা সন্ধি হচ্ছে, তোমার সেনাদের প্রশান্তির কারণ এবং তোমার নিজের জন্যেও ঝামেলামুক্তির কারণ, অপরদিকে তোমার শাসিত অঞ্চলের নিরাপত্তাও তার মধ্যে নিহিত। তবে সমঝোতার পর শত্রুদের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবে। কারণ, হতে পারে শত্রুরা ঘনিষ্ট হয়ে বা তোমার কাছে ভিড়ে তোমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে বা বোকা বানিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে বসতে পারে।' ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে ইসলাম হচ্ছে ঔদার্য ও মহানুভবতার সমষ্টি।আর আল্লাহ এই দ্বীনকে ইসলামে দীক্ষিতদের জন্যে সুস্থতা ও সংহতির আধার হিসেবে দিয়েছেন।
কোরআনে উল্লেখিত একটি বিষয় হলো ‘বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা'। আল্লাহর বৈশিষ্ট্য হিসেবে এগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর এই মহান মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা রোমের একুশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন,যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।' এইসব বর্ণনা থেকে একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই চিন্তাশীলদের মাথায় আসবে তা হলোঃ যেই ধর্ম বা আদর্শ নিজেকে দয়া এবং প্রেমের ধর্ম বলে পরিচয় দেয় এবং তার অনুসারীদের মাঝে সেই প্রেম ও দয়ার বীজ রোপন করে, সেই ধর্ম বা সেই আদর্শ কি সহিংস হতে পারে?
বলছিলাম যে আল্লাহ হচ্ছেন রহমত ও দয়ার আধার। পবিত্র কোরআনে তাঁর গুণ ও মর্যাদার কথা খুবই সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। এদিক থেকে ইসলামের ভিত্তিটাই হলো রহমত ও দয়ার মূলে। এই দয়া এতো বেশি এবং এতো বিস্তৃত যে যুদ্ধ কিংবা সংঘর্ষের সময়ও এই দয়াশীলতার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের নবী (সা) মুশরিকদের সাথে মুখোমুখি হবার সময় তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন কিংবা তিনি চাইতেন তারা যেন মুসলমানদের ওপর আগ্রাসন বন্ধের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ সম্পর্কে নবীজী বলেছেন, তাদেরকে প্রথমে ইমানের দাওয়াত না দিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধে জড়াবে না। তারা যদি তা গ্রহণ না করে তবু তোমরা যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই যুদ্ধ শুরু না করে।
মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পরও শত্রুদের সাথে, শত্রু পক্ষীয় বন্দীদের সাথে, আহতদের সাথে এবং বেসামরিক লোকজনের সাথে যেন মানবীয় নীতি নৈতিকতাগুলো মেনে চলা হয় সেজন্যে নবীজী তাঁর অনুসারীদের লক্ষ্য করে আদেশ দিতেন। ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনায় যুদ্ধে কী ধরনের শিষ্টাচার এবং নীতি নৈতিকতা মেনে চলা উচিত সে সম্পর্কে চমৎকার কিছু দিক উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম সাদেক (আ) বলেনঃ ‘রাসূলে আকরাম (সা) যখন মুসলমান সেনাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতেন, তাদেরকে ডেকে পাঠাতেন এবং তাদেরকে স্পষ্টভাবে বলতেন,যুদ্ধের ময়দানের দিকে অগ্রসর হও তবে কামনা বাসনা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে নয় বরং আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে এবং তাঁরি সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামের নীতিমালা অনুযায়ী আমল করতে করতে আল্লাহর রাস্তায় পা বাড়াও।' যুদ্ধের ময়দানের আদব বা শিষ্টাচার বলতে নবীজী যেটা বুঝিয়েছেন তাহলো: যুদ্ধের ময়দানে কখনোই শিষ্টাচার লঙ্ঘন করা যাবে না, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা যাবে না। খেয়ানতের পথে পা মাড়ানো যাবে না, বিশেষ করে গনিমতের মালামাল বণ্টনের ব্যাপারে কোনোরকম খেয়ানত করা যাবে না।
কোরআনে বলা হয়েছে, যখন গনিমতের মালামাল হাতে আসে তখন নেতৃত্ব আর হুকুমাতের ব্যাপারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে থাকে না। তবে যা কিছু যোদ্ধাদের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো তাদের মাঝে বণ্টন করে ফেলা ভালো যাতে নিজেদের প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা যায় এবং গনিমতে কোনোরকম খেয়ানত করা না হয়। না কেবল যুদ্ধের গনিমতের ব্যাপারেই নয় বরং যুদ্ধের সকল দিক নিয়েও যেন কোনোরকম খেয়ানত করা না হয়। নবীজী তাঁর বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় আরো বলেনঃ অলা তুমাসসিলু। শত্রুদেরকে পরাস্ত করার পর তাদের নিষ্প্রাণ দেহগুলোর ওপর আক্রমণ করো না এবং লাশকে টুকরো টুকরো করো না। ‘অলা তাগদিরু' ষড়যন্ত্রকারী, প্রতারক কিংবা চুক্তিভঙ্গকারী হয়ো না।' আরো বলেছেন ‘অক্ষম, দুর্বল কিংবা যুদ্ধে যাদের কোনোরকম হাত নেই তাদের ওপর হামলা করো না। অক্ষম বৃদ্ধ, শিশু এবং নারীদের হত্যা করো না।' এমনকি তিনি বলেছেন একান্ত নিরুপায় না হলে ‘বৃক্ষ পর্যন্ত কাটবে না।' শত্রু পক্ষের বন্দীরা মুসলমানদের হাতে নিরাপদ। সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তো মুসলমানদের কাতারবন্দী হবে, আর যদি ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায় কিংবা চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ চায় তাহলে নিরাপত্তার সাথে তাকে তার স্বদেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে, তাকে কোনোরকম বিরক্ত করার অধিকার কারো নেই।' এই ইসলাম কি কখনো সহিংস হতে পারে?
তৃতীয় পর্ব
ইসলামের অনুগ্রহ কেবল সকল মানবজাতির জন্যেই নয় বরং অন্যান্য সৃষ্টি এবং প্রাণীকূলের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সেজন্যে প্রাণীকূলের অধিকার সম্পর্কেও বহু বর্ণনা রয়েছে। সে সম্পর্কে খানিকটা ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করবো আজকের আসরে।
গত আসরে আমরা রণাঙ্গনে ইসলামী শিষ্টাচার সম্পর্কে বলেছিলাম যে প্রকৃতি জগতের ক্ষতি করা এমনকি গাছগাছালি তথা উদ্ভিদরাজিও ধ্বংস করা যাবে না। রাসূলে খোদা (দ.) পোষা প্রাণীর অধিকার সম্পর্কে বলেছেনঃ কোনো পোষা প্রাণীর মালিক যখন বাসায় ফেরে, তখন তার উচিত প্রথমেই প্রাণীটির পানাহারের ব্যবস্থা করে তার ক্ষুধা মেটানো, তারপর নিজের খাবারের চিন্তা করা। সফরকালে পথিমধ্যে পানির সন্ধান পাওয়া গেলে পোষা প্রাণীদেরকে পানি খাওয়াতে হবে,তারপর প্রয়োজন হলে নিজের তৃষ্ণা মেটাতে হবে। প্রাণীটিকে যদি আরো দ্রুততার সাথে চালাতে হয় তাহলে তার মাথায় কিংবা মুখে চাবুক মারা যাবে না কেননা পশুরাও আল্লাহর জিকির-তাসবিহতে মশগুল থাকে। পশুর পিঠে তার সাধ্যের চেয়ে বেশি বোঝা চাপানো যাবে না। আজকের পৃথিবীতে প্রাণীদের ব্যাপারে এইসব শিষ্টাচার খুব কমই মেনে চলা হয়। অথচ মানবতার ধর্ম ইসলাম তার অনুসারীদেরকে এইসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ও মেনে চলার আহ্বান জানায়।
আমরা নামায পড়ার সময় কিংবা রোযা পালনের সময় বিপদাপদ মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহর দরবারে দু'হাত তুলে মুনাজাত করি। মুনাজাতে আমরা যেসব দোয়া করি তার কিছু অংশ লক্ষ্যণীয়ঃ "হে খোদা! সকল কবরবাসীর ওপর আনন্দ ও খুশি নাযিল করো! অভাবগ্রস্তদের সকল অভাব অভিযোগ দূর করে দাও! বিশ্বের সকল ক্ষুধার্তের ক্ষুধা তৃষ্ণা তুমি মিটিয়ে দাও!হে খোদা!সকল ঋণগ্রস্তকে ঋণমুক্ত করে দাও!শোকার্ত,বেদনার্তদের সকল কাজের জটিল গ্রন্থি তুমি খুলে দাও! হে আল্লাহ!স্বদেশ থেকে যারা দূরে রয়েছে তাদেরকে তুমি সুস্থতার সাথে নিজের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দাও!হে খোদা!বন্দীরা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের মুক্তি পাবার ব্যবস্থা করে দাও!হে আল্লাহ! সকল রোগগ্রস্তকে তুমি আরোগ্য লাভের ব্যবস্থা করে দাও!"
আচ্ছা! এই দোয়াগুলো কি ইসলামের মানবতা ও দয়াশীলতার নমুনা নয়!এইসব দোয়ায় কেবল মুসলমানরাই নয় বরং পৃথিবীর সকল মানুষই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মানব প্রেমের এই অপূর্ব নিদর্শন দেখে কে মুগ্ধ না হয়ে পারে!
নবীজীর আহলে বাইতের ইমামগণের জীবনীর মধ্যেও এই দয়াশীলতার নিদর্শন পাওয়া যাবে। ইমাম আলী (আ)র মাথায় বিষাক্ত তরবারির আঘাত হেনে তাকেঁ শহিদ করেছিল ইবনে মুলজাম মুরাদি। সেই মুরাদির সাথে সদয় আচরণ করার নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন ইমাম আলি। ইবনে মুলজামকে ধরার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার প্রতি সদয় আচরণ করা হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ "হে আমার সন্তানেরা!আমার হত্যাকারী শুধুমাত্র ইবনে মুলজাম। আমার পরে সুবিধাবাদী একটা দল তাদের তলোয়ার কোষমুক্ত করতে চাইবে,আমার হত্যাকারীর সাথে হাত থাকার অজুহাত দেখিয়ে কিংবা নিজেদের ব্যক্তিগত রেষারেষির ঝাল মেটাতে খুনাখুনি করতে পারে...এরকম যেন না হয়, সাবধান থেকো! আমার প্রিয় সন্তানেরা!আমার জন্যে যে খাবার তৈরি হবে,একই খাবার আমার হত্যাকারীকেও দেবে। আমি যদি বেঁচে থাকি,তাহলে কাতেলের সাথে যা করার আমিই করবো,আর যদি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাই তাহলে কেসাসের অধিকার তোমাদের রয়েছে। তবে যেভাবে সে আমার ওপর তরবারির একটিমাত্র আঘাত হেনেছে, তেমনি একটিমাত্র আঘাত হানবে তার ওপর, বেশি নয়।"
ইসলামের এরকম উদারতা আর দয়ার উদাহরণ সমগ্র পৃথিবীতে আর মিলবে!
অনেকে না জেনে ইসলামকে সহিংসতার ধর্ম বলে প্রমাণ করার জন্যে কেসাসের বিষয়টি উল্লেখ করে থাকে। পবিত্র কোরআনে কেসাস শব্দটি মাত্র চারবার এসেছে। কিন্তু রহমত শব্দটি এসেছে উনআশি বার, রাহমান শব্দটি এসেছে একশ' ষাট বার, রাহিম শব্দটি এসেছে একশ' আটানব্বুই বার। এতেই প্রমাণিত হয় যে ইসলামে রহমত এবং দয়ার পাল্লা অন্য সবকিছুর চেয়ে ভারি। সূরা বাকারার একশ' আটাত্তর নম্বর আয়াতে কেসাসের বিধান দেওয়ার পরপরই বলা হয়েছেঃ "অতঃপর তার দ্বীনী ভাইয়ের পক্ষ থেকে যদি মাফ করে দেয়া হয় অর্থাৎ কেসাসকে যদি রক্তমূল্যে রূপান্তরিত করা হয়,তবে গ্রহণযোগ্য নিয়মের অনুসরণ করবে এবং হত্যাকারীও রক্তমূল্যের অনুগ্রহকে মৃত ব্যক্তির অভিভাবককে প্রদান করবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে বিশেষ ছাড় এবং দয়া......।"
এই আয়াত অনুযায়ী কেসাস কিন্তু ফরজ নয় এমনকি মুস্তাহাবও নয়। তবে অপরাধ বিস্তার রোধকল্পে কিংবা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে মৃত ব্যক্তির অভিভাবককে কেসাসের অধিকার যেমন দেওয়া হয়েছে তেমনি রক্তমূল্যের বিনিময়ে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেওয়ারও অধিকার দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর সকল দেশেই অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ইসলামেরও নীতি আদর্শের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অপরাধ দমনের কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। ইসলামসহ প্রত্যেক ধর্মই চায় মানুষ যাতে পাপের পথে পা না বাড়ায়। ইরানের বিশিষ্ট আলেম আয়াতুল্লাহিল উজমা মাকারেম শিরাযি কেসাসের বিধান সম্পর্কে বলেছেনঃ সমাজে ফেৎনা ফাসাদ বন্ধ করার জন্যে এবং অন্যদের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে এটা এক ধরনের চিকিৎসা। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে কেসাসের ব্যবস্থাটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের রহমত। কেসাসের দর্শনকে কোরআনে জীবন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ "হে বুদ্ধিমানগণ! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে রয়েছে জীবন,যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পার।"
এ আয়াত থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, কেসাসের বিধানের মধ্যে প্রতিহিংসার লেশমাত্র নেই বরং এতে রয়েছে আল্লাহর রহমত, যাতে অন্যরা প্রশান্তিতে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে পারে। এদিক থেকে কেসাসের মধ্যে ঠিকই জীবন রয়েছে,একইভাবে মানুষ হত্যার মতো অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখার উপাদানও রয়েছে।
কোনো রোগীর আঙুলে যদি এমন কোনো রোগ হয় যা ঔষধ দিয়ে কোনোভাবেই সারিয়ে তোলা যায় না,একজন চিকিৎসক যখন নিরুপায় হয়ে ঐ আঙুলটি কেটে ফেলেন,তাকে কি তখন সহিংসতা বলা যায়,কিংবা ডাক্তারকে কি সহিংসতাকামী বলা যায়? একটি আঙুল কেটে ফেলার ফলে পুরো শরীরটা মুক্তি পায় অর্থাৎ জীবন পায়। বৃক্ষের যে শাখাটি নষ্ট হয়ে যায় ঐ শাখাটিকে কেটে ফেলে দিলে বৃক্ষ জীবন ফিরে পায়। সমাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কেননা সমাজটাও একটা দেহের মতো। সমাজদেহের কোনো অঙ্গে যদি প্রতিকার অযোগ্যরকমভাবে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সে অঙ্গ কেটে ফেলা হলে পুরো সমাজদেহ আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে যায়। সেজন্যেই আল্লাহ কেসাসের মধ্যে ‘জীবন' রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানবাধিকারের বুলি আওড়িয়ে যারা কেসাসের ব্যাপারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক কথা বলে, তারাই ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লেবানন, ইরাকসহ পৃথিবীর আরো বহু দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে টু-শব্দটিও করছে না। আল্লাহ কেসাসের বিধানটি দিয়েছেন বুদ্ধিমানদের সম্বোধন করে। তার মানে এর মধ্যে যে সামাজিক প্রাণ নিহিত রয়েছে তা বুদ্ধিমানরাই উপলব্ধি করতে পারে। আল্লাহ সবাইকে বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দান করুন, তাকওয়াবান হবার সুযোগ দিন।
৪র্থ পর্ব
গত আসরে আমরা ইসলামে কেসাসের বিধান নিয়ে আলোচনা করছিলাম। বলেছিলাম, আল্লাহ কেসাসের মধ্যে ‘জীবন' রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। সেইসাথে এও বলেছিলাম যে, কেসাসের বিধানটি দিয়েছেন বুদ্ধিমানদের সম্বোধন করে। তার মানে এর মধ্যে যে সামাজিক প্রাণ নিহিত রয়েছে তা বুদ্ধিমানরাই উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু মানবাধিকারের বুলি আওড়িয়ে যারা কেসাসের ব্যাপারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক কথা বলে, তারাই ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লেবানন, ইরাকসহ পৃথিবীর আরো বহু দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে ‘টু'-শব্দটিও করছে না। আল্লাহ তাদের শুভবুদ্ধি দান করুন-এ প্রত্যাশায় শুরু করছি আজকের আলোচনা।
পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের মধ্যেই একটি বিষয়ে সম্ভবত অভিন্নতা রয়েছে। তাহলো,প্রত্যেক দেশেরই সংবিধানের ভিত্তিতে আদালত সেই দেশের সমাজে যারা অন্যায় করে, অপরাধী কর্মকাণ্ড করে, তাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকে। অনেক প্রশ্নকর্তাই অনেক সময় প্রশ্ন করে থাকেন,ইসলামী বিধি-বিধানে যেসব শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলো কি ইসলামের স্বাভাবিক দয়াশীলতা,স্নেহময়তার মতো মানবিক গুণাবলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হবে ইসলামের বিধি বিধানগুলো এমনকি শাস্তির বিধানগুলোর মধ্যেও রয়েছে রহমত এবং দয়াশীলতা। বাস্তবে বা বলা ভালো বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও শাস্তিগুলোকে ভয়াবহ এবং নৃশংস বলে মনে হয় কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ঐ শাস্তির পেছনে রয়েছে ভিন্ন আরেকটি গুণ যা রহমত ও দয়াশীলতার শামিল। কিন্তু এই বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্যে একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে শাস্তি এবং তার ফলাফলগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।
শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন তথা শাস্তি প্রদানের ইসলামী বিধানগুলোর ব্যাপারে যেসব বর্ণনা রয়েছে সেগুলো ইসলামের এই বিধানগুলোর ব্যাপারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেনঃ ‘ইকামাতু হাদ্দান খাইরুম মিন আরবায়িনা সাবাহা' অর্থাৎ প্রতিটি শাস্তি কার্যকর করা চল্লিশ দিবারাত্রি বৃষ্টি বর্ষণের চেয়েও উত্তম। লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো এই হাদিসে শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন করাকে বৃষ্টি বর্ষণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। অপরাধীদের ব্যাপারে ঐ শাস্তি কার্যকর করাকে চল্লিশ দিবারাত্রির টানা বৃষ্টি বর্ষণের সাথে উপমিত করা হয়েছে। এর অর্থ হলো বৃষ্টি যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের অনুগ্রহ এবং তিনি তা পৃথিবীবাসীদের ওপর বর্ষণ করেন তেমনি ঐশী শাস্তিটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের রহমত বা অনুগ্রহ। ইসলামী বিধান মোতাবেক শাস্তি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বৃষ্টির মতোই সমাজটাকে ধুয়ে মুছে ফেলা হয়, যার ফলে সমস্ত পরিবেশ সর্বপ্রকার দূষণের হাত থেকে পূত পবিত্র থাকে।
অবশ্য ইসলামের বিধিবিধানগুলোর লক্ষ্য উদ্দেশ্যই হলো মানুষকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা এবং তাদের সার্বিক উন্নয়ন সাধন করা। মহান আল্লাহ কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলেছেন তিনি নবী রাসূলদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন মানুষকে আত্মার পবিত্রতা অর্জনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে। এই প্রশিক্ষণমূলক লক্ষ্যকে সামনে রেখেই নবী করিম (সা) ইসলামের একেবারে প্রাথমিক যুগে মূর্খ এবং সহিংস কওমকে সুবোধ এবং সভ্যতা সৃষ্টিকারী কওমে পরিবর্তন করেছিলেন। তবে এমন কিছু লোকও থাকে যাদের ওপর কোনো রকম শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের প্রভাব পড়ে না অর্থাৎ যতোই তাদেরকে সৎ পথে সত্যের পথে, আলোকিত পথে ডাকা হোক না কেন, তারা সৎ পথে আসে না। তারা আইন কানুন লঙ্ঘন করে কিংবা অন্যায় পাপাচারে লিপ্ত হয়ে সমাজের পবিত্রতা নষ্ট করে এবং সমাজের সকল শৃঙ্খলাকে এলোমেলো করে দেয়। সমাজের এই ক্ষতি মেরামত করার জন্যে শেষ পর্যন্ত শাস্তির বিধান না দিয়ে উপায় নেই। নিঃসন্দেহে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে সমাজে নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজ থেকে অস্থিরতা ও ভয়াবহতা দূর হয়ে যায়।
আমরা ইসলামের শাস্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছিলাম। নিঃসন্দেহে যেসব ব্যক্তি মাদক চোরাচালানী চক্রের সাথে সহযোগিতা করে এবং আফিম জাতীয় মাদকের ব্যবসা বা সেগুলোর বিস্তারের মধ্য দিয়ে যুব সমাজকে নষ্ট করে দেয় তারা এমন ধরনের পাপী বা অপরাধী যে, কোনো একটি সমাজ সেইসব লোকের উপস্থিতিতে পবিত্র থাকতে পারে না,পবিত্রতার জন্যে তাই সেই সমাজকে এই ধরনের অপরাধীদের থেকে মুক্ত থাকা খুবই জরুরি। ‘ইউহ্য়িল আরদা বাদি মাউতিহা' অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যমিন বা ভূপৃষ্ঠকে তার মৃত্যুর পর জীবিত করবেন-এই আয়াতাংশের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম কাজেম (আ) বলেছেনঃ এর অর্থ কেবল এই নয় যে, শুষ্ক এই যমিনকে বরকতপূর্ণ বৃষ্টির সাহায্যে জীবিত করবেন। বরং খোদাওয়ান্দ এমনসব ব্যক্তিত্ববর্গের আবির্ভাব ঘটান যাঁরা সমগ্র বিশ্বে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ঐ ন্যায় বিচার জীবিত হবার ফলে অর্থাৎ সর্বত্র কার্যকরী হবার ফলে যমিন বা ভূপৃষ্ঠ সপ্রাণ অর্থাৎ জীবিত হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে অন্যায়কারী বা অপরাধী ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করার ফলে যে কল্যাণ হবে তা চল্লিশ দিবারাত্র বৃষ্টি বর্ষণের চেয়েও অনেক বেশি উত্তম।
গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে শাস্তি কার্যকর করার দর্শন সংশ্লিষ্ট বর্ণনায় প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ পরায়ন কোনো বক্তব্য নেই। ইসলাম এমনভাবে শাস্তির শৃঙ্খলা বিধান করে যাতে অপরাধের মূলোৎপাটন ঘটে এবং মানুষ ঐ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেরাও পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে সমাজে আর ঐ ধরনের অন্যায় পাপাচার বা অপরাধী কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটে না। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে ইসলামে শাস্তির বিধানটা হলো প্রতিরোধমূলক, প্রতিকারমূলক নয়। অন্যদিকে ইসলামে কিছু কিছু অপরাধ প্রমাণ করার জন্যে এমন কিছু শর্তের কথা বলা হয়েছে যেগুলো বেশ জটিল, কষ্টকর তবে যথার্থ। কোনো কোনো শাস্তি অন্তত চারজন স্বাক্ষী কিংবা একজন অপরাধীর চার চারবার স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়। যেমন জ্বেনার শাস্তি কার্যকর করার জন্যে সুস্থ এবং ন্যায়নীতিবান চারজন ব্যক্তির সাক্ষ্য প্রয়োজন হয়, ঐ চারজন জ্বেনাকারী এবং জ্বেনাকারীনীকে পাপাচারে লিপ্ত অবস্থায় দেখেছে বলে সাক্ষ্য দিতে হবে। বলাই বাহুল্য এ ধরনের শাস্তি কার্যকর করাটা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এ কারণেই ইতিহাসে এ ধরনের শাস্তির উদাহরণ খুবই বিরল। ফলে এই শাস্তির বিধানটাও অনুগ্রহের মতোই।
জ্বেনাকারীর স্বীকারোক্তির বিষয়টিও বেশ জটিল। তাকে চার চারবার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে হবে অর্থাৎ তার অপরাধের কথা স্বীকার করতে হবে। প্রতিটি স্বীকারোক্তির জন্যে আলাদা আলাদা বৈঠকের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া অপরাধী যদি তার অপরাধ প্রমাণ করার আগে ন্যায়নিষ্ঠ কাজির সামনে গিয়ে তওবা করে এবং নিজের কাজের জন্যে অনুতপ্ত হয়,তাহলে তার ওপর শাস্তি কার্যকর করা হয় না। ইসলাম যদি নৃশংসতার ধর্ম হতো তাহলে কি একটা অপরাধ প্রমাণ করার জন্যে এরকম জটিলপন্থার বিধান দিতো? জ্বেনার শাস্তির কার্যকর করার ক্ষেত্রেও রয়েছে জটিলতা। এইসব জটিলতা কিন্তু এক ধরনের অনুগ্রহ। যেমন শীতকালের দিনের শুরু কিংবা শেষে যেহেতু একজন জ্বেনাকারীর জন্যে চাবুকের আঘাত বেশি পীড়াদায়ক হবে সেজন্যে ঐ সময় শাস্তি দেওয়া যাবে না। শাস্তি দিতে হবে দিনের মাঝামাঝিতে যে সময় আবহাওয়া থাকে সহনীয়। একইভাবে গরমের সময় দুপুরে যেহেতু আবহাওয়া থাকে অসহনীয় পর্যায়ে, তখণ এই শাস্তি দেওয়া যাবে না। অপরাধী যদি অসুস্থ থাকে তাহলে তাকে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া যাবে না। আর জ্বেনাকারিনী যদি অন্তসত্ত্বা হয়ে থাকে তাহলে অন্তসত্ত্বা অবস্থায় তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
এই হলো ইসলামে শাস্তির বিধান। এই বিধান থেকে কি মনে হয় ইসলাম একটি সহিংস ধর্ম, রুষ্ট কিংকা প্রতিহিংসা পরায়ন ধর্ম। নাকি মনে হয় দয়া ও অনুগ্রহের ধর্ম। এমনকি শাস্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রেও।
৫ম পর্ব
ইসলামে শাস্তির বিধান যে ইসলামের স্বাভাবিক দয়াশীলতা,স্নেহময়তার মতো মানবিক গুণাবলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গত আসরে আমরা সে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। আসলে ইসলামে শাস্তির বিধানটা হলো প্রতিরোধমূলক, প্রতিকারমূলক নয়। ইসলামে শাস্তি কার্যকর করার দর্শন প্রতিহিংসামূলক কিংবা প্রতিশোধ পরায়ন নয়। বরং ইসলামে শাস্তির বিধান হলো রহমতস্বরূপ। হাদিসে এসেছে, প্রতিটি শাস্তি কার্যকর করা চল্লিশ দিবারাত্রি বৃষ্টি বর্ষণের চেয়েও উত্তম। এ পর্বে আমরা ইসলামে জেহাদ এবং রহমতের সাথে জেহাদের সম্পর্ক নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইতিহাস পরিক্রমায় যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সবসময়ই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কলহলিপ্ত ছিল, কখনো কখনো তা অভ্যন্তরীণ পারিবারিক যুদ্ধের রূপ লাভ করে। দ্বন্দ্ব সংঘাতের পর যারাই ক্ষমতার মসনদে আরোহন করেছে তারা আবার বিভিন্ন দেশ এবং জাতির ওপর আক্রমণ করে ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করেছে। এরফলে জুলুম আর অন্যায় অত্যাচারে সারাটা বিশ্বই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলো ইসলাম একটি মানবতার ধর্ম,রহমতের ধর্ম হবার পরও কেন জেহাদের বিধান দিয়েছে? কেন অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অনুমতি দিয়েছে?
এই প্রশ্নের জবাবে ইসলামের শিক্ষা ও হুকুম আহকামগুলো পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলদর্পী শক্তিগুলোর ঔদ্ধত্য ও অবাধ সীমাতিক্রম প্রতিহত করার লক্ষ্যে যেসব মূল্যবান বিধি বিধান দিয়েছেন জেহাদ সেসবেরই অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনের সূরা আনফালের ষাট নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘আর যেটুকু শক্তি সামর্থই তোমাদের রয়েছে তাদেরকে (শত্রুদের) মোকাবেলা করার জন্যে প্রস্তুত কর! একইভাবে প্রস্তুত করো পালিত ঘোড়াগুলোকে যাতে সেসবের মাধ্যমে শত্রুদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারো!' কোরআনের এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, ইসলাম মুসলমানদের কাছে প্রত্যাশা করে তারা যেন সবসময় প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতি নিয়ে রাখে, যাতে শত্রুরা তাদের ওপর হামলা বা আক্রমণ করার ব্যাপারে চিন্তা করার সুযোগ না পায়।
তবে শত্রুরা যদি হামলা শুরু করে তাহলে মুসলমানদের শক্তিশালী সামরিক শক্তিসামর্থ তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে এবং শান্তির পতাকা ওড়াতে পারে।এরকম পরিস্থিতিতে মুসলমানরাও সন্ধিতে আবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে পারে। সূরা আনফালের একষট্টি নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ ‘আর যদি তারা সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে,তাহলে তুমিও সে দিকেই আগ্রহী হও এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিঃসন্দেহে তিনি শ্রবণকারী;পরিজ্ঞাত।' আসলে যুদ্ধ ও সন্ধি সম্পর্কে ইসলামের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো বিভিন্ন দেশ ও জাতির স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা এবং জালেম শক্তিগুলোর অত্যাচার রোধ করা। তবু যুদ্ধ যদি লেগেই যায় তাহলে ইসলামের পরামর্শ হলো যুদ্ধ বিরতি বা বন্ধ করার ব্যাপারে যথাযথ সুযোগগুলোকে কাজে লাগানো। ইসলাম কোনোভাবেই মুসলমানদেরকে বিনা কারণে দেশের সীমানা বিস্তারের লক্ষ্যে অপর কোনো দেশের ওপর হামলা বা আক্রমণ শুরু করা বা কোনো দেশ দখল করার অনুমতি দেয় না।
ইসলামে যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কোনো যুদ্ধেই মুসলমানরা আগে যুদ্ধ শুরু করে নি, শত্রুপক্ষই যুদ্ধ শুরু করেছে। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৯৪ নম্বর আয়াতে কেবলমাত্র হামলাকারীদের হামলার জবাবে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আয়াতটিতে এসেছেঃ ‘সামগ্রিকভাবে, যারা তোমাদের উপর জবরদস্তি করেছে,তোমরা তাদের উপর জবরদস্তি কর,যেমন জবরদস্তি তারা করেছে তোমাদের উপর। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ,যারা পরহেজগার,আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন।'
যুদ্ধকে ইসলাম কখনোই একটি মূল্যবোধ হিসেবে মূল্যায়ন করে নি। বরং যুদ্ধে যেহেতু জান-মাল,ধন-সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় সেজন্যে যুদ্ধকে মূল্যবোধ বিরোধী একটি বিষয় হিসেবে মনে করা হয়। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে তাই যুদ্ধকে বজ্র,ভূমিকম্প,ঐশী বিপদ কিংবা যমিনী বালা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে ইসলামে যতোটা সম্ভব যুদ্ধ এড়িয়ে চলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ঐশী ধর্মের অনুসারীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। তবে সহিংসতা আর সীমাহীন অত্যাচারের ফলে যদি কোনো একটি দেশ বা জাতিকে হুমকিগ্রস্ত করে তোলে কিংবা পবিত্র কোনো ধর্মের মূল্যবোধগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে জেহাদ ফি সাবিলিল্ল... হিসেবে গণ্য করা হয়।সেক্ষেত্রে কোনো দেশ, জাতি ও ধর্মকে রক্ষা করার স্বার্থে জেহাদ করাকে জ্ঞান ও বিবেকের দৃষ্টিতে অবশ্য করণীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।মুসলমানদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্যে অনুমতি দিয়ে সর্বপ্রথম যে কটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলো হলো সূরা হাজ্জের আটত্রিশ থেকে চল্লিশ নম্বর আয়াত।
মুসলমানদের ওপর যেসব অত্যাচার করা হয়েছে,অত্যাচারের ফলে মুসলমানরা যখন নিজেদের বাস্তুভিটা, নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে,কেবলমাত্র তখনি তাদেরকে জেহাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সূরা হাজ্জের চল্লিশ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ ‘আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন,তবে খ্রীষ্টানদের গির্জা,ইহুদীদের উপাসনালয় এবং মুসলমানদের মসজিদগুলো-যেখানে খোদার নাম বেশি বেশি স্মরণ করা হয়-বিধ্বস্ত হয়ে যেত। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন,যারা আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী এবং অবিনশ্বর।' এই আয়াত অনুযায়ী বলদর্পী এবং স্বৈরাচারী শক্তির ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপের কাছে বিশ্ববাসীর নতি স্বীকার করা উচিত নয়। বৃহৎ শক্তিগুলো অন্যদের ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্যে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে, তারা মানুষের অধিকার পদদলিত করছে।তারা জাগরণ এবং ইবাদাতের স্থান বা প্রার্থনালয়গুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। অথচ এ আয়াতের শিক্ষা অনুযায়ী ইসলামে জেহাদ কেবল মুসলমানদের মসজিদ রক্ষারই গ্যারান্টি নয় বরং অপরাপর ঐশী ধর্মের উপাসনালয়গুলোকেও সুরক্ষিত রাখার গ্যারান্টি দেয়।
প্রকৃত অর্থে ইসলামে জেহাদের অর্থ হচ্ছে জুলুম-অত্যাচার ও নিপীড়িত জনতার অধিকারের পক্ষে যৌক্তিক অবস্থান নেওয়া। এ জন্যেই ফেতনা ফাসাদ দূর করে মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিভিন্ন সরকার এবং অনৈসলামী সমাজের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে যাতে একত্ববাদের সম্প্রসারণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ইসলামে জেহাদের ব্যাপারে যেসব শিষ্টাচার অবশ্য পালনীয় সেগুলোর প্রতি নজর দিলেও জেহাদের লক্ষ্য সুস্পষ্ট হয়ে যায়।যেমন মুসলমানদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ শুরু করা যাবে না। যুদ্ধ এড়াবার লক্ষ্যে আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নারী-শিশু ও বৃদ্ধের ওপর আঘাত হানা যাবে না। বিবদমান পক্ষগুলোর মুখপাত্র বা কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শত্রুদের অধিকারের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান দেখানো। গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের ব্যবহার না করা।বন্দীদের সাথে সুন্দর আচরণ করা। চুক্তি ভঙ্গ না করা-ইত্যাদি ইসলামী প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য।
এ সব বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামী যুদ্ধে পার্থিব কোনো স্বার্থ নেই, সীমানা বিস্তারের কোনো লক্ষ্য নেই,নেই পদমর্যাদা কিংবা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা করার কোনো সুযোগ। বরং ইসলামের প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের লক্ষ্যই হলো মানুষকে জুলুম নির্যাতন ও মূর্খতা থেকে মুক্তি দেওয়া।
সূত্র: রেডিও তেহরান
সূচনালগ্ন থেকেই ইসলাম শত্রুতার মুখে পড়েছিল। আজও সেই শত্রুতা অব্যাহত আছে। তবে বর্তমানে পশ্চিমা বলদর্পী শক্তিগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতার নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা এখন বিশ্বব্যাপী ইসলামভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা ইসলামকে যুদ্ধ ও সহিংসতার ধর্ম এবং মানবাধিকার উপেক্ষাকারী বলে প্রচার করার চেষ্টা করছে। এসব করে তারা বিশ্ববাসীকে ইসলাম বিমুখ করে রাখতে চায়। তবে নামসর্বস্ব কিছু মুসলমানের কাজকর্ম পশ্চিমাদের ঐসব প্রচারণার অনুকূলে গেছে। যেমন- আল কায়েদা ও তালেবান। এই গোষ্ঠিগুলো সহিংসতাকামী,নির্দয় এবং সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত থেকেও নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। এদিকে গণমাধ্যমগুলো তাদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ডগুলোকে ফলাও করে প্রচার করছে,যেসব দেখলে যে কোনো মানুষই মুসলমানদের ব্যাপারে ঘৃণ্য ও অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করবে। পশ্চিমাদের ব্যাপক অপপ্রচারণার ফলে যে-কোনো সাধারণ মানুষ বা অসচেতন মানুষ ঐসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ভুল করে ইসলাম এবং মুসলমানদের কার্যক্রম বলে ভাবতে পারে।
তবে সুখকর ব্যাপারটি হলো, বিশ্বের প্রকৃত মুসলমানদের বিশাল অংশটি মুসলিম নামধারী ঐসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠির কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং ঐসব গোষ্ঠিকে বিচ্যুত বলে মত দিয়েছেন। পশ্চিমারা যেহেতু ইসলামের শক্তিশালী ও উন্নত সংস্কৃতিকে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে সক্ষম নয় সেহেতু তারা ইসলামের অগ্রগতিতে শঙ্কিত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণার আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে যারা ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী তাদেরকে ফিরিয়ে রাখার স্বার্থে ইসলামকে সন্ত্রাসী বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। সেজন্যে এখন সবার মনেই একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে-ইসলাম কি আসলেই সন্ত্রাসী বা সহিংসতার ধর্ম? ধারাবাহিক এই আসরে আমরা এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো। সেইসাথে প্রেম ভালোবাসা স্নেহ ও কল্যাণ আর মানবতার মুক্তির ধর্ম ইসলামের বিশেষ কিছু দিক ও তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
পবিত্র কোরআন নিয়ে সামান্য পড়ালেখা করলেই অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে যা থেকে বোঝা যাবে ইসলাম একটি দয়া, অনুগ্রহ ও কল্যাণের ধর্ম।আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, করুণার কথা দয়ার কথায় কোরআন পরিপূর্ণ। কোরআনের প্রতিটি সূরা শুরু করতে হয় এমনকি মুসলমানদের প্রতিটি কাজ শুরু করতে হয় বিসমিল্লাহ বলে। এর অর্থই হলো সেই আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম করুণাময় এবং দয়াবান।কোরানের ১১৪ টি সূরার মধ্যে ১১৩ সূরা এই বিসমিল্লা বলে শুরু হয়েছে। কোরআনের অসংখ্য আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অসম্ভব দয়ালু, তিনি ক্ষমাকারী এবং মেহেরবান ইত্যাদি। তো যেই ধর্মের মূল গ্রন্থটির সূচনা হয়েছে আল্লাহর দয়া আর রহমতের ঘোষণা দিয়ে সেই ধর্ম কি সহিংস হতে পারে?
কোরআনের আয়াতগুলোর প্রতি মনোযোগী হলে দেখা যাবে আল্লাহর অনুগ্রহ, করুণা এবং দয়ার্দ্রতার বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সেখানে লক্ষ্য করা যাবে আল্লাহর এই দয়ার ব্যাপারটি কেবল যে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্যে তা নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্যেই প্রযোজ্য। এ কারণে ইসলাম ধর্মও কেবল মুসলমানদেরই নয় বরং সমগ্র মানব জাতির ধর্ম।সূরায়ে জাসিয়ার চৌদ্দ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে,যারা কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে না, যাতে তিনি কোন সম্প্রদায়কে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেন ।" আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই আয়াতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন তারা যেন অমুসলমানদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হয় এবং তাদের মন্দ দিকগুলোকে না দেখার ভান করে বা উপেক্ষা করে যায়। তো এরকম একটি ধর্মকে কী করে সহিংস বলা যায়!
আসলে আল্লাহর রহমত বা দয়ার ভাণ্ডার অফুরন্ত,অসীম। কিন্তু কিছু কিছু লোক বিচ্যুতির পথে পা বাড়িয়ে নিজেদের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে ফেলে আল্লাহর রহমতের ব্যাপার হতাশ কিংবা বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। তাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যেই আল্লাহ নবী রাসূলদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এরকমই একজন নবী হলেন ইব্রাহিম (আ)। তিনি লুতের কওমকে আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে ব্যাপক চেষ্টা চালান। আল্লাহর কাছে তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সাধারণত নবীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতিকে সুসংবাদ এবং সতর্কতা প্রদানকারী হিসেবেই আবির্ভূত হন। ঐ সতর্কতাও আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও অনুগ্রহ, যাতে তারা বিচ্যুতি থেকে সঠিক পথে ফিরে আসেন এবং সৌভাগ্যের প্রশস্ত পথে অগ্রসর হয়। এই সতর্কতাও অনুগ্রহ। সেজন্যেই রাসূলের পরিচয় সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছেঃ ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।' সেজন্যেই আমরা লক্ষ্য করবো মূর্তিপূজকরা পর্যন্ত যখন নবীজীকে বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ করতো তখনো তিনি ধৈর্যের সাথে বরণ করতেন কখনোই তাদেরকে পাল্টা গালি দেন নি, তাদেরকে অভিশাপ দেন নি। কোরআনে তাই বলা হয়েছে ‘নিশ্চয়ই আপনি সবোর্ত্তম চরিত্রের অধিকারী।'
সূরা আল-ইমরানের একশ' উনষাট নম্বর আয়াতে রাসূলের এই কোমল ও সহৃদয় হবার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো।' এটা ছিল সত্যিকারের এক অলৌকিক ব্যাপার। কেননা নবীজীর আবির্ভাবের আগে আরবের লোকেরা যেখানে খুনখারাবি ছাড়া কিছুই বুঝতো না, সেখানে নবীজীর আগমনের পর তাঁর এই ধৈর্যশীলতা ও কোমল হৃদয়ের আকর্ষণে মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়, ঝুকেঁ পড়ে। এ জন্যে অতি দ্রুত তিনি একটি শক্তিশালী উম্মাত গঠন করতে সক্ষম হন। অসম্ভব ভালোবাসা আর পারস্পরিক আন্তরিকতাপূর্ণ এই উম্মাত গঠনের পেছনে সহিংসতা কিংবা শক্তির বিন্দুমাত্র প্রয়োগ ছিল না। সেই ভালোবাসা আর আন্তরিক একতাপূর্ণ ধর্ম ইসলামকে কি সহিংসতার ধর্ম বলা যায়?
দ্বিতীয় পর্ব
কোরআনের শিক্ষাগুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব এবং শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার দুই শ' আট নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চিয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আল্লাহর আমাদের এই আয়াতের তাৎপর্য উপলব্ধি করার যোগ্যতা দিন।
যেই আয়াতটি আমরা উল্লেখ করেছি তাতে ‘ফিস সিল্মি' শব্দটি এসেছে। সাল্ম্ এবং সালামের আভিধানিক অর্থ হলো শান্তি,সমঝোতা ও স্বস্তি। কোরআনের আয়াত থেকে আমরা জানতে পারছি মানব সমাজে দৃঢ় সমঝোতা এবং স্বস্তি নিশ্চিত হতে পারে বা বাস্তবায়িত হতে পারে কেবল আল্লাহর প্রতি ইমান আনার মধ্য দিয়ে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে ভৌগোলিক, আঞ্চলিক, বর্ণ, গোত্র এবং ভাষাগত দিক থেকে হাজারো পার্থক্য বা ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে সামাজিক সংযোগের বৃত্তটি রচিত হতে পারে কেবল এই আল্লাহর প্রতি ইমানের ভিত্তিতে।
এই আয়াতটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কোরআনে মাজিদের বক্তব্য অনুযায়ী যারা এই শান্তি ও সমঝোতার পথ পরিহার করে যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ বেছে নিয়ে আগুণের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দেয়, তারা শয়তানের অনুসারী। তার মানে হলো সমঝোতা ও শান্তি হচ্ছে দয়াময় আল্লাহর কাজ আর সমাজে যুদ্ধ ও সংঘাতের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া বর্বর শয়তানের কাজ। সমঝোতা ও শান্তি সম্পর্কে কোরআনের আরেকটি আয়াতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন যদি শত্রুরা ন্যায়সঙ্গত সমঝোতা বা সন্ধি করতে চায় তাহলে তা গ্রহণ করো। তবে অন্যায়, অসত্যের কাছে মাথানত করে কিংবা সত্যকে বিসর্জন দিয়ে সমঝোতা করা যাবে না। ঔদাসীন্য, ভয় ও আপোসের মানসিকতা নিয়ে সমঝোতা করা হলে ইসলাম তা সমর্থন করে না। পবিত্র কোরআনে এ ধরনের সমঝোতাকে তিরস্কার করা হয়েছে। সেইসাথে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে যে, শত্রুদের সাথে সমঝোতা হতে হবে মুমিনদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে।
ইমাম আলী (আ) মালেক আশতারকে মিশরের গভর্নর করে পাঠানোর পর এক চিঠিতে লিখেছেনঃ ‘শত্রুরা যদি তোমাকে সমঝোতা বা সন্ধির দিকে আহ্বান জানায় এবং তাতে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করো না। কেননা সন্ধি হচ্ছে, তোমার সেনাদের প্রশান্তির কারণ এবং তোমার নিজের জন্যেও ঝামেলামুক্তির কারণ, অপরদিকে তোমার শাসিত অঞ্চলের নিরাপত্তাও তার মধ্যে নিহিত। তবে সমঝোতার পর শত্রুদের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবে। কারণ, হতে পারে শত্রুরা ঘনিষ্ট হয়ে বা তোমার কাছে ভিড়ে তোমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে বা বোকা বানিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে বসতে পারে।' ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে ইসলাম হচ্ছে ঔদার্য ও মহানুভবতার সমষ্টি।আর আল্লাহ এই দ্বীনকে ইসলামে দীক্ষিতদের জন্যে সুস্থতা ও সংহতির আধার হিসেবে দিয়েছেন।
কোরআনে উল্লেখিত একটি বিষয় হলো ‘বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা'। আল্লাহর বৈশিষ্ট্য হিসেবে এগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর এই মহান মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা রোমের একুশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন,যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।' এইসব বর্ণনা থেকে একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই চিন্তাশীলদের মাথায় আসবে তা হলোঃ যেই ধর্ম বা আদর্শ নিজেকে দয়া এবং প্রেমের ধর্ম বলে পরিচয় দেয় এবং তার অনুসারীদের মাঝে সেই প্রেম ও দয়ার বীজ রোপন করে, সেই ধর্ম বা সেই আদর্শ কি সহিংস হতে পারে?
বলছিলাম যে আল্লাহ হচ্ছেন রহমত ও দয়ার আধার। পবিত্র কোরআনে তাঁর গুণ ও মর্যাদার কথা খুবই সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। এদিক থেকে ইসলামের ভিত্তিটাই হলো রহমত ও দয়ার মূলে। এই দয়া এতো বেশি এবং এতো বিস্তৃত যে যুদ্ধ কিংবা সংঘর্ষের সময়ও এই দয়াশীলতার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের নবী (সা) মুশরিকদের সাথে মুখোমুখি হবার সময় তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন কিংবা তিনি চাইতেন তারা যেন মুসলমানদের ওপর আগ্রাসন বন্ধের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ সম্পর্কে নবীজী বলেছেন, তাদেরকে প্রথমে ইমানের দাওয়াত না দিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধে জড়াবে না। তারা যদি তা গ্রহণ না করে তবু তোমরা যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই যুদ্ধ শুরু না করে।
মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পরও শত্রুদের সাথে, শত্রু পক্ষীয় বন্দীদের সাথে, আহতদের সাথে এবং বেসামরিক লোকজনের সাথে যেন মানবীয় নীতি নৈতিকতাগুলো মেনে চলা হয় সেজন্যে নবীজী তাঁর অনুসারীদের লক্ষ্য করে আদেশ দিতেন। ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনায় যুদ্ধে কী ধরনের শিষ্টাচার এবং নীতি নৈতিকতা মেনে চলা উচিত সে সম্পর্কে চমৎকার কিছু দিক উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম সাদেক (আ) বলেনঃ ‘রাসূলে আকরাম (সা) যখন মুসলমান সেনাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতেন, তাদেরকে ডেকে পাঠাতেন এবং তাদেরকে স্পষ্টভাবে বলতেন,যুদ্ধের ময়দানের দিকে অগ্রসর হও তবে কামনা বাসনা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে নয় বরং আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে এবং তাঁরি সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামের নীতিমালা অনুযায়ী আমল করতে করতে আল্লাহর রাস্তায় পা বাড়াও।' যুদ্ধের ময়দানের আদব বা শিষ্টাচার বলতে নবীজী যেটা বুঝিয়েছেন তাহলো: যুদ্ধের ময়দানে কখনোই শিষ্টাচার লঙ্ঘন করা যাবে না, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা যাবে না। খেয়ানতের পথে পা মাড়ানো যাবে না, বিশেষ করে গনিমতের মালামাল বণ্টনের ব্যাপারে কোনোরকম খেয়ানত করা যাবে না।
কোরআনে বলা হয়েছে, যখন গনিমতের মালামাল হাতে আসে তখন নেতৃত্ব আর হুকুমাতের ব্যাপারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে থাকে না। তবে যা কিছু যোদ্ধাদের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো তাদের মাঝে বণ্টন করে ফেলা ভালো যাতে নিজেদের প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা যায় এবং গনিমতে কোনোরকম খেয়ানত করা না হয়। না কেবল যুদ্ধের গনিমতের ব্যাপারেই নয় বরং যুদ্ধের সকল দিক নিয়েও যেন কোনোরকম খেয়ানত করা না হয়। নবীজী তাঁর বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় আরো বলেনঃ অলা তুমাসসিলু। শত্রুদেরকে পরাস্ত করার পর তাদের নিষ্প্রাণ দেহগুলোর ওপর আক্রমণ করো না এবং লাশকে টুকরো টুকরো করো না। ‘অলা তাগদিরু' ষড়যন্ত্রকারী, প্রতারক কিংবা চুক্তিভঙ্গকারী হয়ো না।' আরো বলেছেন ‘অক্ষম, দুর্বল কিংবা যুদ্ধে যাদের কোনোরকম হাত নেই তাদের ওপর হামলা করো না। অক্ষম বৃদ্ধ, শিশু এবং নারীদের হত্যা করো না।' এমনকি তিনি বলেছেন একান্ত নিরুপায় না হলে ‘বৃক্ষ পর্যন্ত কাটবে না।' শত্রু পক্ষের বন্দীরা মুসলমানদের হাতে নিরাপদ। সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তো মুসলমানদের কাতারবন্দী হবে, আর যদি ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায় কিংবা চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ চায় তাহলে নিরাপত্তার সাথে তাকে তার স্বদেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে, তাকে কোনোরকম বিরক্ত করার অধিকার কারো নেই।' এই ইসলাম কি কখনো সহিংস হতে পারে?
তৃতীয় পর্ব
ইসলামের অনুগ্রহ কেবল সকল মানবজাতির জন্যেই নয় বরং অন্যান্য সৃষ্টি এবং প্রাণীকূলের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সেজন্যে প্রাণীকূলের অধিকার সম্পর্কেও বহু বর্ণনা রয়েছে। সে সম্পর্কে খানিকটা ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করবো আজকের আসরে।
গত আসরে আমরা রণাঙ্গনে ইসলামী শিষ্টাচার সম্পর্কে বলেছিলাম যে প্রকৃতি জগতের ক্ষতি করা এমনকি গাছগাছালি তথা উদ্ভিদরাজিও ধ্বংস করা যাবে না। রাসূলে খোদা (দ.) পোষা প্রাণীর অধিকার সম্পর্কে বলেছেনঃ কোনো পোষা প্রাণীর মালিক যখন বাসায় ফেরে, তখন তার উচিত প্রথমেই প্রাণীটির পানাহারের ব্যবস্থা করে তার ক্ষুধা মেটানো, তারপর নিজের খাবারের চিন্তা করা। সফরকালে পথিমধ্যে পানির সন্ধান পাওয়া গেলে পোষা প্রাণীদেরকে পানি খাওয়াতে হবে,তারপর প্রয়োজন হলে নিজের তৃষ্ণা মেটাতে হবে। প্রাণীটিকে যদি আরো দ্রুততার সাথে চালাতে হয় তাহলে তার মাথায় কিংবা মুখে চাবুক মারা যাবে না কেননা পশুরাও আল্লাহর জিকির-তাসবিহতে মশগুল থাকে। পশুর পিঠে তার সাধ্যের চেয়ে বেশি বোঝা চাপানো যাবে না। আজকের পৃথিবীতে প্রাণীদের ব্যাপারে এইসব শিষ্টাচার খুব কমই মেনে চলা হয়। অথচ মানবতার ধর্ম ইসলাম তার অনুসারীদেরকে এইসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ও মেনে চলার আহ্বান জানায়।
আমরা নামায পড়ার সময় কিংবা রোযা পালনের সময় বিপদাপদ মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহর দরবারে দু'হাত তুলে মুনাজাত করি। মুনাজাতে আমরা যেসব দোয়া করি তার কিছু অংশ লক্ষ্যণীয়ঃ "হে খোদা! সকল কবরবাসীর ওপর আনন্দ ও খুশি নাযিল করো! অভাবগ্রস্তদের সকল অভাব অভিযোগ দূর করে দাও! বিশ্বের সকল ক্ষুধার্তের ক্ষুধা তৃষ্ণা তুমি মিটিয়ে দাও!হে খোদা!সকল ঋণগ্রস্তকে ঋণমুক্ত করে দাও!শোকার্ত,বেদনার্তদের সকল কাজের জটিল গ্রন্থি তুমি খুলে দাও! হে আল্লাহ!স্বদেশ থেকে যারা দূরে রয়েছে তাদেরকে তুমি সুস্থতার সাথে নিজের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দাও!হে খোদা!বন্দীরা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের মুক্তি পাবার ব্যবস্থা করে দাও!হে আল্লাহ! সকল রোগগ্রস্তকে তুমি আরোগ্য লাভের ব্যবস্থা করে দাও!"
আচ্ছা! এই দোয়াগুলো কি ইসলামের মানবতা ও দয়াশীলতার নমুনা নয়!এইসব দোয়ায় কেবল মুসলমানরাই নয় বরং পৃথিবীর সকল মানুষই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মানব প্রেমের এই অপূর্ব নিদর্শন দেখে কে মুগ্ধ না হয়ে পারে!
নবীজীর আহলে বাইতের ইমামগণের জীবনীর মধ্যেও এই দয়াশীলতার নিদর্শন পাওয়া যাবে। ইমাম আলী (আ)র মাথায় বিষাক্ত তরবারির আঘাত হেনে তাকেঁ শহিদ করেছিল ইবনে মুলজাম মুরাদি। সেই মুরাদির সাথে সদয় আচরণ করার নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন ইমাম আলি। ইবনে মুলজামকে ধরার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার প্রতি সদয় আচরণ করা হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ "হে আমার সন্তানেরা!আমার হত্যাকারী শুধুমাত্র ইবনে মুলজাম। আমার পরে সুবিধাবাদী একটা দল তাদের তলোয়ার কোষমুক্ত করতে চাইবে,আমার হত্যাকারীর সাথে হাত থাকার অজুহাত দেখিয়ে কিংবা নিজেদের ব্যক্তিগত রেষারেষির ঝাল মেটাতে খুনাখুনি করতে পারে...এরকম যেন না হয়, সাবধান থেকো! আমার প্রিয় সন্তানেরা!আমার জন্যে যে খাবার তৈরি হবে,একই খাবার আমার হত্যাকারীকেও দেবে। আমি যদি বেঁচে থাকি,তাহলে কাতেলের সাথে যা করার আমিই করবো,আর যদি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাই তাহলে কেসাসের অধিকার তোমাদের রয়েছে। তবে যেভাবে সে আমার ওপর তরবারির একটিমাত্র আঘাত হেনেছে, তেমনি একটিমাত্র আঘাত হানবে তার ওপর, বেশি নয়।"
ইসলামের এরকম উদারতা আর দয়ার উদাহরণ সমগ্র পৃথিবীতে আর মিলবে!
অনেকে না জেনে ইসলামকে সহিংসতার ধর্ম বলে প্রমাণ করার জন্যে কেসাসের বিষয়টি উল্লেখ করে থাকে। পবিত্র কোরআনে কেসাস শব্দটি মাত্র চারবার এসেছে। কিন্তু রহমত শব্দটি এসেছে উনআশি বার, রাহমান শব্দটি এসেছে একশ' ষাট বার, রাহিম শব্দটি এসেছে একশ' আটানব্বুই বার। এতেই প্রমাণিত হয় যে ইসলামে রহমত এবং দয়ার পাল্লা অন্য সবকিছুর চেয়ে ভারি। সূরা বাকারার একশ' আটাত্তর নম্বর আয়াতে কেসাসের বিধান দেওয়ার পরপরই বলা হয়েছেঃ "অতঃপর তার দ্বীনী ভাইয়ের পক্ষ থেকে যদি মাফ করে দেয়া হয় অর্থাৎ কেসাসকে যদি রক্তমূল্যে রূপান্তরিত করা হয়,তবে গ্রহণযোগ্য নিয়মের অনুসরণ করবে এবং হত্যাকারীও রক্তমূল্যের অনুগ্রহকে মৃত ব্যক্তির অভিভাবককে প্রদান করবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে বিশেষ ছাড় এবং দয়া......।"
এই আয়াত অনুযায়ী কেসাস কিন্তু ফরজ নয় এমনকি মুস্তাহাবও নয়। তবে অপরাধ বিস্তার রোধকল্পে কিংবা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে মৃত ব্যক্তির অভিভাবককে কেসাসের অধিকার যেমন দেওয়া হয়েছে তেমনি রক্তমূল্যের বিনিময়ে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেওয়ারও অধিকার দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর সকল দেশেই অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ইসলামেরও নীতি আদর্শের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অপরাধ দমনের কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। ইসলামসহ প্রত্যেক ধর্মই চায় মানুষ যাতে পাপের পথে পা না বাড়ায়। ইরানের বিশিষ্ট আলেম আয়াতুল্লাহিল উজমা মাকারেম শিরাযি কেসাসের বিধান সম্পর্কে বলেছেনঃ সমাজে ফেৎনা ফাসাদ বন্ধ করার জন্যে এবং অন্যদের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে এটা এক ধরনের চিকিৎসা। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে কেসাসের ব্যবস্থাটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের রহমত। কেসাসের দর্শনকে কোরআনে জীবন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ "হে বুদ্ধিমানগণ! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে রয়েছে জীবন,যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পার।"
এ আয়াত থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, কেসাসের বিধানের মধ্যে প্রতিহিংসার লেশমাত্র নেই বরং এতে রয়েছে আল্লাহর রহমত, যাতে অন্যরা প্রশান্তিতে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে পারে। এদিক থেকে কেসাসের মধ্যে ঠিকই জীবন রয়েছে,একইভাবে মানুষ হত্যার মতো অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখার উপাদানও রয়েছে।
কোনো রোগীর আঙুলে যদি এমন কোনো রোগ হয় যা ঔষধ দিয়ে কোনোভাবেই সারিয়ে তোলা যায় না,একজন চিকিৎসক যখন নিরুপায় হয়ে ঐ আঙুলটি কেটে ফেলেন,তাকে কি তখন সহিংসতা বলা যায়,কিংবা ডাক্তারকে কি সহিংসতাকামী বলা যায়? একটি আঙুল কেটে ফেলার ফলে পুরো শরীরটা মুক্তি পায় অর্থাৎ জীবন পায়। বৃক্ষের যে শাখাটি নষ্ট হয়ে যায় ঐ শাখাটিকে কেটে ফেলে দিলে বৃক্ষ জীবন ফিরে পায়। সমাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কেননা সমাজটাও একটা দেহের মতো। সমাজদেহের কোনো অঙ্গে যদি প্রতিকার অযোগ্যরকমভাবে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সে অঙ্গ কেটে ফেলা হলে পুরো সমাজদেহ আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে যায়। সেজন্যেই আল্লাহ কেসাসের মধ্যে ‘জীবন' রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানবাধিকারের বুলি আওড়িয়ে যারা কেসাসের ব্যাপারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক কথা বলে, তারাই ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লেবানন, ইরাকসহ পৃথিবীর আরো বহু দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে টু-শব্দটিও করছে না। আল্লাহ কেসাসের বিধানটি দিয়েছেন বুদ্ধিমানদের সম্বোধন করে। তার মানে এর মধ্যে যে সামাজিক প্রাণ নিহিত রয়েছে তা বুদ্ধিমানরাই উপলব্ধি করতে পারে। আল্লাহ সবাইকে বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দান করুন, তাকওয়াবান হবার সুযোগ দিন।
৪র্থ পর্ব
গত আসরে আমরা ইসলামে কেসাসের বিধান নিয়ে আলোচনা করছিলাম। বলেছিলাম, আল্লাহ কেসাসের মধ্যে ‘জীবন' রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। সেইসাথে এও বলেছিলাম যে, কেসাসের বিধানটি দিয়েছেন বুদ্ধিমানদের সম্বোধন করে। তার মানে এর মধ্যে যে সামাজিক প্রাণ নিহিত রয়েছে তা বুদ্ধিমানরাই উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু মানবাধিকারের বুলি আওড়িয়ে যারা কেসাসের ব্যাপারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক কথা বলে, তারাই ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লেবানন, ইরাকসহ পৃথিবীর আরো বহু দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে ‘টু'-শব্দটিও করছে না। আল্লাহ তাদের শুভবুদ্ধি দান করুন-এ প্রত্যাশায় শুরু করছি আজকের আলোচনা।
পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের মধ্যেই একটি বিষয়ে সম্ভবত অভিন্নতা রয়েছে। তাহলো,প্রত্যেক দেশেরই সংবিধানের ভিত্তিতে আদালত সেই দেশের সমাজে যারা অন্যায় করে, অপরাধী কর্মকাণ্ড করে, তাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকে। অনেক প্রশ্নকর্তাই অনেক সময় প্রশ্ন করে থাকেন,ইসলামী বিধি-বিধানে যেসব শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলো কি ইসলামের স্বাভাবিক দয়াশীলতা,স্নেহময়তার মতো মানবিক গুণাবলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হবে ইসলামের বিধি বিধানগুলো এমনকি শাস্তির বিধানগুলোর মধ্যেও রয়েছে রহমত এবং দয়াশীলতা। বাস্তবে বা বলা ভালো বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও শাস্তিগুলোকে ভয়াবহ এবং নৃশংস বলে মনে হয় কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ঐ শাস্তির পেছনে রয়েছে ভিন্ন আরেকটি গুণ যা রহমত ও দয়াশীলতার শামিল। কিন্তু এই বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্যে একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে শাস্তি এবং তার ফলাফলগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।
শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন তথা শাস্তি প্রদানের ইসলামী বিধানগুলোর ব্যাপারে যেসব বর্ণনা রয়েছে সেগুলো ইসলামের এই বিধানগুলোর ব্যাপারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেনঃ ‘ইকামাতু হাদ্দান খাইরুম মিন আরবায়িনা সাবাহা' অর্থাৎ প্রতিটি শাস্তি কার্যকর করা চল্লিশ দিবারাত্রি বৃষ্টি বর্ষণের চেয়েও উত্তম। লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো এই হাদিসে শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন করাকে বৃষ্টি বর্ষণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। অপরাধীদের ব্যাপারে ঐ শাস্তি কার্যকর করাকে চল্লিশ দিবারাত্রির টানা বৃষ্টি বর্ষণের সাথে উপমিত করা হয়েছে। এর অর্থ হলো বৃষ্টি যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের অনুগ্রহ এবং তিনি তা পৃথিবীবাসীদের ওপর বর্ষণ করেন তেমনি ঐশী শাস্তিটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের রহমত বা অনুগ্রহ। ইসলামী বিধান মোতাবেক শাস্তি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বৃষ্টির মতোই সমাজটাকে ধুয়ে মুছে ফেলা হয়, যার ফলে সমস্ত পরিবেশ সর্বপ্রকার দূষণের হাত থেকে পূত পবিত্র থাকে।
অবশ্য ইসলামের বিধিবিধানগুলোর লক্ষ্য উদ্দেশ্যই হলো মানুষকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা এবং তাদের সার্বিক উন্নয়ন সাধন করা। মহান আল্লাহ কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলেছেন তিনি নবী রাসূলদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন মানুষকে আত্মার পবিত্রতা অর্জনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে। এই প্রশিক্ষণমূলক লক্ষ্যকে সামনে রেখেই নবী করিম (সা) ইসলামের একেবারে প্রাথমিক যুগে মূর্খ এবং সহিংস কওমকে সুবোধ এবং সভ্যতা সৃষ্টিকারী কওমে পরিবর্তন করেছিলেন। তবে এমন কিছু লোকও থাকে যাদের ওপর কোনো রকম শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের প্রভাব পড়ে না অর্থাৎ যতোই তাদেরকে সৎ পথে সত্যের পথে, আলোকিত পথে ডাকা হোক না কেন, তারা সৎ পথে আসে না। তারা আইন কানুন লঙ্ঘন করে কিংবা অন্যায় পাপাচারে লিপ্ত হয়ে সমাজের পবিত্রতা নষ্ট করে এবং সমাজের সকল শৃঙ্খলাকে এলোমেলো করে দেয়। সমাজের এই ক্ষতি মেরামত করার জন্যে শেষ পর্যন্ত শাস্তির বিধান না দিয়ে উপায় নেই। নিঃসন্দেহে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে সমাজে নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজ থেকে অস্থিরতা ও ভয়াবহতা দূর হয়ে যায়।
আমরা ইসলামের শাস্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছিলাম। নিঃসন্দেহে যেসব ব্যক্তি মাদক চোরাচালানী চক্রের সাথে সহযোগিতা করে এবং আফিম জাতীয় মাদকের ব্যবসা বা সেগুলোর বিস্তারের মধ্য দিয়ে যুব সমাজকে নষ্ট করে দেয় তারা এমন ধরনের পাপী বা অপরাধী যে, কোনো একটি সমাজ সেইসব লোকের উপস্থিতিতে পবিত্র থাকতে পারে না,পবিত্রতার জন্যে তাই সেই সমাজকে এই ধরনের অপরাধীদের থেকে মুক্ত থাকা খুবই জরুরি। ‘ইউহ্য়িল আরদা বাদি মাউতিহা' অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যমিন বা ভূপৃষ্ঠকে তার মৃত্যুর পর জীবিত করবেন-এই আয়াতাংশের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম কাজেম (আ) বলেছেনঃ এর অর্থ কেবল এই নয় যে, শুষ্ক এই যমিনকে বরকতপূর্ণ বৃষ্টির সাহায্যে জীবিত করবেন। বরং খোদাওয়ান্দ এমনসব ব্যক্তিত্ববর্গের আবির্ভাব ঘটান যাঁরা সমগ্র বিশ্বে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ঐ ন্যায় বিচার জীবিত হবার ফলে অর্থাৎ সর্বত্র কার্যকরী হবার ফলে যমিন বা ভূপৃষ্ঠ সপ্রাণ অর্থাৎ জীবিত হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে অন্যায়কারী বা অপরাধী ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করার ফলে যে কল্যাণ হবে তা চল্লিশ দিবারাত্র বৃষ্টি বর্ষণের চেয়েও অনেক বেশি উত্তম।
গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে শাস্তি কার্যকর করার দর্শন সংশ্লিষ্ট বর্ণনায় প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ পরায়ন কোনো বক্তব্য নেই। ইসলাম এমনভাবে শাস্তির শৃঙ্খলা বিধান করে যাতে অপরাধের মূলোৎপাটন ঘটে এবং মানুষ ঐ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেরাও পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে সমাজে আর ঐ ধরনের অন্যায় পাপাচার বা অপরাধী কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটে না। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে ইসলামে শাস্তির বিধানটা হলো প্রতিরোধমূলক, প্রতিকারমূলক নয়। অন্যদিকে ইসলামে কিছু কিছু অপরাধ প্রমাণ করার জন্যে এমন কিছু শর্তের কথা বলা হয়েছে যেগুলো বেশ জটিল, কষ্টকর তবে যথার্থ। কোনো কোনো শাস্তি অন্তত চারজন স্বাক্ষী কিংবা একজন অপরাধীর চার চারবার স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়। যেমন জ্বেনার শাস্তি কার্যকর করার জন্যে সুস্থ এবং ন্যায়নীতিবান চারজন ব্যক্তির সাক্ষ্য প্রয়োজন হয়, ঐ চারজন জ্বেনাকারী এবং জ্বেনাকারীনীকে পাপাচারে লিপ্ত অবস্থায় দেখেছে বলে সাক্ষ্য দিতে হবে। বলাই বাহুল্য এ ধরনের শাস্তি কার্যকর করাটা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এ কারণেই ইতিহাসে এ ধরনের শাস্তির উদাহরণ খুবই বিরল। ফলে এই শাস্তির বিধানটাও অনুগ্রহের মতোই।
জ্বেনাকারীর স্বীকারোক্তির বিষয়টিও বেশ জটিল। তাকে চার চারবার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে হবে অর্থাৎ তার অপরাধের কথা স্বীকার করতে হবে। প্রতিটি স্বীকারোক্তির জন্যে আলাদা আলাদা বৈঠকের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া অপরাধী যদি তার অপরাধ প্রমাণ করার আগে ন্যায়নিষ্ঠ কাজির সামনে গিয়ে তওবা করে এবং নিজের কাজের জন্যে অনুতপ্ত হয়,তাহলে তার ওপর শাস্তি কার্যকর করা হয় না। ইসলাম যদি নৃশংসতার ধর্ম হতো তাহলে কি একটা অপরাধ প্রমাণ করার জন্যে এরকম জটিলপন্থার বিধান দিতো? জ্বেনার শাস্তির কার্যকর করার ক্ষেত্রেও রয়েছে জটিলতা। এইসব জটিলতা কিন্তু এক ধরনের অনুগ্রহ। যেমন শীতকালের দিনের শুরু কিংবা শেষে যেহেতু একজন জ্বেনাকারীর জন্যে চাবুকের আঘাত বেশি পীড়াদায়ক হবে সেজন্যে ঐ সময় শাস্তি দেওয়া যাবে না। শাস্তি দিতে হবে দিনের মাঝামাঝিতে যে সময় আবহাওয়া থাকে সহনীয়। একইভাবে গরমের সময় দুপুরে যেহেতু আবহাওয়া থাকে অসহনীয় পর্যায়ে, তখণ এই শাস্তি দেওয়া যাবে না। অপরাধী যদি অসুস্থ থাকে তাহলে তাকে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া যাবে না। আর জ্বেনাকারিনী যদি অন্তসত্ত্বা হয়ে থাকে তাহলে অন্তসত্ত্বা অবস্থায় তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
এই হলো ইসলামে শাস্তির বিধান। এই বিধান থেকে কি মনে হয় ইসলাম একটি সহিংস ধর্ম, রুষ্ট কিংকা প্রতিহিংসা পরায়ন ধর্ম। নাকি মনে হয় দয়া ও অনুগ্রহের ধর্ম। এমনকি শাস্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রেও।
৫ম পর্ব
ইসলামে শাস্তির বিধান যে ইসলামের স্বাভাবিক দয়াশীলতা,স্নেহময়তার মতো মানবিক গুণাবলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গত আসরে আমরা সে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। আসলে ইসলামে শাস্তির বিধানটা হলো প্রতিরোধমূলক, প্রতিকারমূলক নয়। ইসলামে শাস্তি কার্যকর করার দর্শন প্রতিহিংসামূলক কিংবা প্রতিশোধ পরায়ন নয়। বরং ইসলামে শাস্তির বিধান হলো রহমতস্বরূপ। হাদিসে এসেছে, প্রতিটি শাস্তি কার্যকর করা চল্লিশ দিবারাত্রি বৃষ্টি বর্ষণের চেয়েও উত্তম। এ পর্বে আমরা ইসলামে জেহাদ এবং রহমতের সাথে জেহাদের সম্পর্ক নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইতিহাস পরিক্রমায় যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সবসময়ই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কলহলিপ্ত ছিল, কখনো কখনো তা অভ্যন্তরীণ পারিবারিক যুদ্ধের রূপ লাভ করে। দ্বন্দ্ব সংঘাতের পর যারাই ক্ষমতার মসনদে আরোহন করেছে তারা আবার বিভিন্ন দেশ এবং জাতির ওপর আক্রমণ করে ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করেছে। এরফলে জুলুম আর অন্যায় অত্যাচারে সারাটা বিশ্বই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলো ইসলাম একটি মানবতার ধর্ম,রহমতের ধর্ম হবার পরও কেন জেহাদের বিধান দিয়েছে? কেন অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অনুমতি দিয়েছে?
এই প্রশ্নের জবাবে ইসলামের শিক্ষা ও হুকুম আহকামগুলো পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলদর্পী শক্তিগুলোর ঔদ্ধত্য ও অবাধ সীমাতিক্রম প্রতিহত করার লক্ষ্যে যেসব মূল্যবান বিধি বিধান দিয়েছেন জেহাদ সেসবেরই অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনের সূরা আনফালের ষাট নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘আর যেটুকু শক্তি সামর্থই তোমাদের রয়েছে তাদেরকে (শত্রুদের) মোকাবেলা করার জন্যে প্রস্তুত কর! একইভাবে প্রস্তুত করো পালিত ঘোড়াগুলোকে যাতে সেসবের মাধ্যমে শত্রুদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারো!' কোরআনের এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, ইসলাম মুসলমানদের কাছে প্রত্যাশা করে তারা যেন সবসময় প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতি নিয়ে রাখে, যাতে শত্রুরা তাদের ওপর হামলা বা আক্রমণ করার ব্যাপারে চিন্তা করার সুযোগ না পায়।
তবে শত্রুরা যদি হামলা শুরু করে তাহলে মুসলমানদের শক্তিশালী সামরিক শক্তিসামর্থ তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে এবং শান্তির পতাকা ওড়াতে পারে।এরকম পরিস্থিতিতে মুসলমানরাও সন্ধিতে আবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে পারে। সূরা আনফালের একষট্টি নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ ‘আর যদি তারা সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে,তাহলে তুমিও সে দিকেই আগ্রহী হও এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর। নিঃসন্দেহে তিনি শ্রবণকারী;পরিজ্ঞাত।' আসলে যুদ্ধ ও সন্ধি সম্পর্কে ইসলামের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো বিভিন্ন দেশ ও জাতির স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা এবং জালেম শক্তিগুলোর অত্যাচার রোধ করা। তবু যুদ্ধ যদি লেগেই যায় তাহলে ইসলামের পরামর্শ হলো যুদ্ধ বিরতি বা বন্ধ করার ব্যাপারে যথাযথ সুযোগগুলোকে কাজে লাগানো। ইসলাম কোনোভাবেই মুসলমানদেরকে বিনা কারণে দেশের সীমানা বিস্তারের লক্ষ্যে অপর কোনো দেশের ওপর হামলা বা আক্রমণ শুরু করা বা কোনো দেশ দখল করার অনুমতি দেয় না।
ইসলামে যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কোনো যুদ্ধেই মুসলমানরা আগে যুদ্ধ শুরু করে নি, শত্রুপক্ষই যুদ্ধ শুরু করেছে। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৯৪ নম্বর আয়াতে কেবলমাত্র হামলাকারীদের হামলার জবাবে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আয়াতটিতে এসেছেঃ ‘সামগ্রিকভাবে, যারা তোমাদের উপর জবরদস্তি করেছে,তোমরা তাদের উপর জবরদস্তি কর,যেমন জবরদস্তি তারা করেছে তোমাদের উপর। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ,যারা পরহেজগার,আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন।'
যুদ্ধকে ইসলাম কখনোই একটি মূল্যবোধ হিসেবে মূল্যায়ন করে নি। বরং যুদ্ধে যেহেতু জান-মাল,ধন-সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় সেজন্যে যুদ্ধকে মূল্যবোধ বিরোধী একটি বিষয় হিসেবে মনে করা হয়। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে তাই যুদ্ধকে বজ্র,ভূমিকম্প,ঐশী বিপদ কিংবা যমিনী বালা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে ইসলামে যতোটা সম্ভব যুদ্ধ এড়িয়ে চলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ঐশী ধর্মের অনুসারীদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। তবে সহিংসতা আর সীমাহীন অত্যাচারের ফলে যদি কোনো একটি দেশ বা জাতিকে হুমকিগ্রস্ত করে তোলে কিংবা পবিত্র কোনো ধর্মের মূল্যবোধগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে জেহাদ ফি সাবিলিল্ল... হিসেবে গণ্য করা হয়।সেক্ষেত্রে কোনো দেশ, জাতি ও ধর্মকে রক্ষা করার স্বার্থে জেহাদ করাকে জ্ঞান ও বিবেকের দৃষ্টিতে অবশ্য করণীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।মুসলমানদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্যে অনুমতি দিয়ে সর্বপ্রথম যে কটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলো হলো সূরা হাজ্জের আটত্রিশ থেকে চল্লিশ নম্বর আয়াত।
মুসলমানদের ওপর যেসব অত্যাচার করা হয়েছে,অত্যাচারের ফলে মুসলমানরা যখন নিজেদের বাস্তুভিটা, নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে,কেবলমাত্র তখনি তাদেরকে জেহাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সূরা হাজ্জের চল্লিশ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ ‘আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন,তবে খ্রীষ্টানদের গির্জা,ইহুদীদের উপাসনালয় এবং মুসলমানদের মসজিদগুলো-যেখানে খোদার নাম বেশি বেশি স্মরণ করা হয়-বিধ্বস্ত হয়ে যেত। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন,যারা আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী এবং অবিনশ্বর।' এই আয়াত অনুযায়ী বলদর্পী এবং স্বৈরাচারী শক্তির ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপের কাছে বিশ্ববাসীর নতি স্বীকার করা উচিত নয়। বৃহৎ শক্তিগুলো অন্যদের ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্যে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে, তারা মানুষের অধিকার পদদলিত করছে।তারা জাগরণ এবং ইবাদাতের স্থান বা প্রার্থনালয়গুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। অথচ এ আয়াতের শিক্ষা অনুযায়ী ইসলামে জেহাদ কেবল মুসলমানদের মসজিদ রক্ষারই গ্যারান্টি নয় বরং অপরাপর ঐশী ধর্মের উপাসনালয়গুলোকেও সুরক্ষিত রাখার গ্যারান্টি দেয়।
প্রকৃত অর্থে ইসলামে জেহাদের অর্থ হচ্ছে জুলুম-অত্যাচার ও নিপীড়িত জনতার অধিকারের পক্ষে যৌক্তিক অবস্থান নেওয়া। এ জন্যেই ফেতনা ফাসাদ দূর করে মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিভিন্ন সরকার এবং অনৈসলামী সমাজের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে যাতে একত্ববাদের সম্প্রসারণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ইসলামে জেহাদের ব্যাপারে যেসব শিষ্টাচার অবশ্য পালনীয় সেগুলোর প্রতি নজর দিলেও জেহাদের লক্ষ্য সুস্পষ্ট হয়ে যায়।যেমন মুসলমানদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ শুরু করা যাবে না। যুদ্ধ এড়াবার লক্ষ্যে আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নারী-শিশু ও বৃদ্ধের ওপর আঘাত হানা যাবে না। বিবদমান পক্ষগুলোর মুখপাত্র বা কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শত্রুদের অধিকারের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান দেখানো। গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের ব্যবহার না করা।বন্দীদের সাথে সুন্দর আচরণ করা। চুক্তি ভঙ্গ না করা-ইত্যাদি ইসলামী প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য।
এ সব বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামী যুদ্ধে পার্থিব কোনো স্বার্থ নেই, সীমানা বিস্তারের কোনো লক্ষ্য নেই,নেই পদমর্যাদা কিংবা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা করার কোনো সুযোগ। বরং ইসলামের প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের লক্ষ্যই হলো মানুষকে জুলুম নির্যাতন ও মূর্খতা থেকে মুক্তি দেওয়া।
সূত্র: রেডিও তেহরান