বাঙ্গালী
Thursday 26th of December 2024
0
نفر 0

বিচারবুদ্ধির আলোকে জাবর্ ও এখতিয়ার

বিচারবুদ্ধির আলোকে জাবর্ ও এখতিয়ার

জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারায় নীতিগতভাব মনে করা হয় যে, বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) বা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সত্যে উপনীত হওয়া যায় না, বিশেষ করে আল্লাহ্ তা‘আলার গুণাবলী ও কার্যাবলী সম্বন্ধে সঠিক ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। আর মজার ব্যাপার হলো, তাঁরা তাঁদের এ মত প্রমাণের জন্যই যুক্তিতর্কের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন।

জাবারীয়াহ্ মতের একটি যুক্তি হচ্ছে এই যে, মানুষকে স্বাধীন এখতিয়ারের (স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতার) অধিকারী মনে করা মানে আল্লাহ্ তা‘আলাকে অক্ষম গণ্য করা এবং মানুষকে ছোট ছোট খোদা রূপে গণ্য করা।

তাঁদের এ যুক্তি একেবারেই ভিত্তিহীন। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতা যেখানে তাঁর নিজস্ব, বরং তাঁর সত্তার বহিঃপ্রকাশ অর্থাৎ তাঁর সত্তা, ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা স্বতন্ত্র নয়, সেখানে মানুষের সত্তা, ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা পরস্পর স্বতন্ত্র এবং তিনটিই আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টি; তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ও তাকে এ দু’টি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। তার স্বাধীনতা ও এখতিয়ার আল্লাহ্ তা‘আলারই দান। আল্লাহ্ তা‘আলা চাইলেই তার এখতিয়ার কেড়ে নিতে পারেন বা তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন (যদিও সৃষ্টির কল্যাণার্থে অপরিহার্য না হলে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না)। অতএব, মানুষকে এখতিয়ারের অধিকারী গণ্য করা মানে তাদেরকে ছোট ছোট খোদা গণ্য করা-এরূপ যুক্তি অপযুক্তি বৈ নয়। অন্যদিকে আল্লাহ্ তা‘আলা সব সময় ও মানুষের সব কাজে হস্তক্ষেপ করেন না মনে করা মানে আল্লাহ্ তা‘আলাকে অক্ষম গণ্য করা-এ-ও একটি অপযুক্তি। কারণ, তিনি সর্বাবস্থায় ও সব সময় হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় এ থেকে বিরত থাকেন।

মানুষের সকল কাজই আল্লাহ্ করান (সৃষ্টিকর্মের আদি সূচনাকালীন পূর্বনির্ধারণের মাধ্যমেই হোক, বা প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির জন্মের সূচনাকালীন ভাগ্য নির্ধারণের মাধ্যমেই হোক, বা প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই হোক, অথবা বার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমেই হোক)-এ দাবীর মানে হচ্ছে, মানুষ যতো খারাপ কাজ করে (চুরি, ডাকাতি, মিথ্যাচার, হত্যা ও যেনা-ব্যভিচার সহ) তার সবই আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে দিয়ে করিয়ে নেন। এভাবে আল্লাহ্ তা‘আলাকে সকল প্রকার পাপাচারের কর্তা গণ্য করা হয় যা অত্যন্ত মারাত্মক ও জঘন্য ধারণা। কিন্তু যে কোনো পাপ কাজ, এমনকি যে কোনো নিরর্থক কাজের কারণ হচ্ছে কর্তার কোনো না কোনো দুর্বলতা। আর পরম পূর্ণতার (کمال مطلق) অধিকারী আল্লাহ্ তা‘আলা সকল প্রকার দুর্বলতা থেকে প্রমুক্ত (سبحان)।

সৃষ্টিজগতে আমরা সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার পূর্ণতা লক্ষ্য করি। কিন্তু খুটিনাটি ক্ষেত্রে পূর্ণতার পাশাপাশি অপূর্ণতাও দেখেতে পাই। আল্লাহ্ তা‘আলা পরম পূর্ণতার অধিকারী, তাই তাঁর কাজের ফলে অপূর্ণতা বা ত্রুটি অকল্পনীয়। এমতাবস্থায় অপূর্ণতার একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। তা হচ্ছে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্ম ও ব্যবস্থাপনার আওতায় তাঁরই সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিধান এবং বস্তুগত ও প্রাণশীল সৃষ্টিনিচয়ের ক্রিয়াশীলতার সুযোগ রেখেছেন। ফলে এসব কারণের প্রভাবে বিভিন্ন মাত্রার পূর্ণতা ও অপূর্ণতার সংমিশ্রিত প্রতিক্রিয়া থেকে অপূর্ণতা ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার পক্ষ থেকে উপস্থাপিত এক বড় ধরনের বিভ্রান্তিকর যুক্তি হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার জ্ঞানের যুক্তি। তাদের যুক্তি হচ্ছে এই যে, যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলার জ্ঞান অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে আয়ত্ত করে আছে সেহেতু তিনি জানেন ভবিষ্যতে কী হবে। আর আল্লাহ্ যা জানেন তার অন্যথা হতে পারে না। অর্থাৎ সৃষ্টির সিদ্ধান্তের মুহূর্তেই তিনি নির্ধারণ করে রেখেছেন যে, ক্বিয়ামত পর্যন্ত কী কী ঘটবে এবং এমনকি তার পরেও কী কী ঘটবে অর্থাৎ কে বেহেশতে যাবে আর কে দোযখে যাবে।

তাঁরা আল্লাহ্ তা‘আলার জ্ঞানের যুক্তিটি যেভাবে উপস্থাপন করছেন তার মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। তা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলার জ্ঞানকে শুধু ইতিবাচক বা নেতিবাচক তথ্য হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও জ্ঞানের বিরাট বিরাট ক্ষেত্র রয়েছে। তা হচ্ছে শর্তাধীন ঘটনাবলীর জ্ঞান।

আল্লাহ্ তা‘আলা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও এখতিয়ারে অধিকারী সৃষ্টির ভবিষ্যতের অনেক বিষয়কে এভাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন যে, সৃষ্টি স্বেচ্ছায় অমুক কাজ করলে অমুক ফল হবে এবং না করলে বা তার বিপরীত কাজ করলে সে ফল হবে না বা তার বিপরীত ফল হবে। ভবিষ্যতের এ অংশটি এভাবেই আল্লাহর জ্ঞানে নিহিত রয়েছে। তবে সৃষ্টির পক্ষ থেকে যখন এরূপ কোনো শর্তযুক্ত কাজের ক্ষেত্রে এমন পূর্বপ্রস্তুতিমূলক কাজ (مقدمات) সম্পাদন করা হয় যখন কাজটির দুই সম্ভাবনার মধ্য থেকে একটি সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়ে যায় ও অপরটি নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন আর তা শর্তাধীন থাকে না এবং তা এভাবেই আল্লাহ্ তা‘আলার জ্ঞানের আওতায় ইতিবাচক বা নেতিবাচক নিশ্চিত ভবিষ্যত রূপে স্থানলাভ করে।

বলা হয়, আল্লাহ্ কি আগেই জানতেন না যে, তাঁর সৃষ্টি দুই সম্ভাবনাযুক্ত ভবিষ্যত কর্মের ব্যাপারে কোন্ সম্ভাবনার পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করবে? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টির এ ভবিষ্যত পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের বিষয়টিকেও দুই বা বহু সম্ভাবনা বিশিষ্ট রূপে নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং এ রূপেই জানেন।

জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার দাবী অনুযায়ী আল্লাহ্ তা‘আলা সব কিছুই সৃষ্টির সূচনার পূর্বেই নির্ধারণ করে রেখেছেন, অতঃপর তা পর্যায়ক্রমে সংঘটিত হচ্ছে এবং তার কোনোই অন্যথা হচ্ছে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে বলতে হবে যে, একবার সব কিছু নির্ধারণ করে দেয়ার পর আল্লাহ্ তা‘আলার আর কোনো করণীয় নেই। এমনকি তাঁকে ঘটনাবলীর নীরব পর্যবেক্ষকও বলা যাবে না। কারণ, সব কিছু পূর্বনির্ধারিত হলে তিনি তো জানেনই যে, কী হতে যাচ্ছে; নতুন কিছু হচ্ছে না। অতএব, এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের কোনোই গুরুত্ব নেই; বরং এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ কথাটি আদৌ প্রযোজ্য নয়। বস্তুতঃ অসীম সৃষ্টিক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে এ কথা ভাবাই যায় না যে, তিনি একবার সৃষ্টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের (সব কিছু পূর্বনির্ধারণ করে দেয়ার) পর আর কিছুই করছেন না।

এ ক্ষেত্রে জাবারীয়াহ্ ও মু‘তাযিলী চিন্তাধারার মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। কারণ, উভয় চিন্তাধারাই আল্লাহ্ তা‘আলাকে সৃষ্টি সম্পর্কে মাত্র একবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে গণ্য করে, অনবরত নব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মনে করে না। তবে পার্থক্য এই যে, জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারায় প্রাণীকুলের কর্মকেও পূর্বনির্ধারিত গণ্য করা হয়, কিন্তু মু‘তাযিলী চিন্তাধারায় তা গণ্য করা হয় না। [ইয়াহূদীরা যে দাবী করতো يد الله مغلولة – “আল্লাহর হাত সংবদ্ধ (অকর্মণ্য)।” (সূরাহ্ আল্-মায়েদাহ্: ৬৪), তখন সম্ভবতঃ তারা এটাই বুঝাতে চাইতো যে, আল্লাহ্ তা‘আলা একবার সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সব কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে এবং সেই সাথে মানুষ ও প্রাণীকুল স্বাধীনভাবে যার যার কাজ করছে, অতঃপর আর তাঁর কিছুই (দান করণও যার অন্যতম) করণীয় নেই।]

অন্যদিকে জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার যে সব প্রবক্তা দাবী করেন যে, কারণবিধি [অর্থাৎ যে কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়া বা যে কোনো কিছু সৃষ্টি বা উদ্ভূত হওয়ার পিছনেই কারণ নিহিত রয়েছে-এই প্রাকৃতিক বিধি। ইংরেজীতে একে বলা হয় cause and effect, বাংলা ভাষায় সাধারণতঃ এর অনুবাদ করা হয় ‘কার্যকারণ বিধি’ । কিন্তু একে ‘কারণবিধি’ বা ‘কারণ ও ফলাফল বিধি’ বলাই শ্রেয়।] বলতে কিছুই নেই অর্থাৎ, তাঁদের মতে, আল্লাহ্ তা‘আলা কারণবিধি সৃষ্টি করেন নি, বরং যে কোনো কাজের প্রতিটি পর্যায়ই আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক সরাসরি সম্পাদিত হয়, তখন তা প্রকৃত পক্ষে জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার মূল দাবী অর্থাৎ “আল্লাহ্ তা‘আলার পূর্বনির্ধারণ”-এর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সম্পাদিত হতে বাধ্য। এমতাবস্থায়, প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি কাজ আল্লাহ্ করেন বা করান-এ দাবী গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারার প্রবক্তারা তা-ই দাবী করে থাকেন। যেমন: তাঁরা বলেন, আমরা যখন দেখি যে, এক ব্যক্তি একটি কাগজ পোড়াচ্ছে তখন প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্ তা‘আলাই তার মনে কাগজ পোড়ানোর ইচ্ছা জাগ্রত করে দেন, নয়তো তার মনে কাগজ পোড়াবার ইচ্ছা সৃষ্টি হতো না। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা তার হাতকে আগুন লাগাবার জন্য সক্রিয় করে দেন, নয়তো তার ইচ্ছার কারণে তার হাত সক্রিয় হতো না। অতঃপর আল্লাহ্ তার হাতের মাধ্যমে কাগজে আগুন লাগিয়ে দেন, নয়তো (ধরুন) ম্যাচের কাঠির খোঁচায় আগুন জ্বলতো না। অতঃপর তিনি আগুনে দহনক্ষমতা সৃষ্টি করে দেন, নয়তো আগুনের দহনক্ষমতা নেই।

তাদের এ দাবী একজন প্রাথমিক স্তরের ও স্বল্প পরিমাণ দ্রব্যের উৎপাদকের জন্য প্রযোজ্য, মহাজ্ঞানী স্রষ্টার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একজন প্রাথমিক স্তরের উৎপাদক একটি ধাতব পাত্র তৈরীর জন্য আকরিক বা খনিজ ধাতবকে হাপরে গলিয়ে ঢালাই করে, এরপর তা হাতুড়ী দিয়ে পিটিয়ে বিশেষ আকৃতি প্রদান করে, অতঃপর করাত বা বাটালী দ্বারা অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলে, রেত দিয়ে ঘষে মসৃণ করে এবং অন্য যন্ত্রপাতি দ্বারা তাতে তার নাম ও নকশা খোদাই করে। কিন্তু বহুমুখী ও ব্যাপক ভিত্তিক উৎপাদনকার্যে মশগুল একজন বিজ্ঞানী মালিক-উৎপাদক প্রথমে একটি স্বয়ংক্রিয় ও জটিল কারখানা নির্মাণ করেন, অতঃপর তার উৎপাদন কার্যের জন্য বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক ও পরিচালক এবং বিভিন্ন অংশের পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ করেন। এরপর সেখানে যন্ত্রের নির্ধারিত দিকসমূহ দিয়ে তাতে বিভিন্ন ধরনের আকরিক ধাতব প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় এবং নির্ধারিত দিকসমূহ দিয়ে বিভিন্ন কাঙ্ক্ষিত ধরনের, ডিজাইনের, মানের ও মাপের ধাতবপাত্র সমূহ বেরিয়ে আসে।

সর্বোপরি জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারাকে সঠিক গণ্য করা হলে বলতে হবে যে, নাউযুবিল্লাহ্, তিনি একজন খামখেয়ালী স্রষ্টা যে কারণে তিনি অযথাই সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একজন যালেম স্রষ্টা যে কারণে তিনি প্রাণশীল সৃষ্টির ভাগ্যে দুঃখ-কষ্ট লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। এরূপ চিন্তা সঠিক হলে পাপ-পুণ্য বলতে কিছুই নেই; যার ভাগ্যে যা লেখা আছে তার জন্য তা-ই ঘটবে; পাপ লেখা থাকলে সে পাপ কাজ করবে, পুণ্য লেখা থাকলে সে পুণ্য কাজ করবে। অথচ কী পরিহাস (!), তিনিই যে পাপ করালেন সে পাপের জন্য তিনি বান্দাহকে শাস্তি দেবেন এবং তিনিই যে পুণ্য কাজ করালেন সে পুণ্য কাজের জন্য বান্দাহকে পুরস্কার দেবেন!! পরম প্রমুক্ত আল্লাহ্ তা‘আলা সম্বন্ধে এরূপ জঘন্য ধারণা পোষণ অত্যন্ত মারাত্মক ব্যাপার।

এ প্রসঙ্গে জাবারীয়াহ্ চিন্তাধারায় একটি উদ্ভট অভিমত ব্যক্ত করা হয়। তা হচ্ছে এই যে, মানুষের দায়িত্ব আমল করা (কাজ করা); যার ভাগ্যে জান্নাত লেখা আছে সে জান্নাতে যাবার উপযোগী কাজের সুযোগ পাবে এবং যার ভাগ্যে জাহান্নাম লেখা আছে সে জাহান্নামে যাবার উপযোগী কাজের সুযোগ পাবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সব কিছুই যদি পূর্বনির্ধারিত হবে এবং সব কিছু যদি আল্লাহ্ই করেন বা করান, তাহলে দায়িত্ব, কর্তব্য, উচিত, অনুচিত, ধর্ম, আমল, সুযোগ পাওয়া ইত্যাদি কথার কোনোই অর্থ হয় না।

আবার পাপ-পুণ্যের শাস্তি ও পুরষ্কার সম্বন্ধে স্ববিরোধী ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, যদিও আল্লাহ্ তার ভাগ্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন তথাপি যেহেতু সে স্বেচ্ছায় এ কাজ করে তাই তাকে শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভাগ্যে নির্ধারিত থাকলে অতঃপর ‘স্বেচ্ছায়’ বলতে কিছু থাকে কি? সে ক্ষেত্রে এ ইচ্ছাও তো পূর্বনির্ধারিত। ব্যক্তির ওপর যদি ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়া হয়ে থাকে তাহলে সে ইচ্ছার জন্য তাকে শাস্তি বা পুরষ্কার দেয়া চলে কি?

আবার গোঁজামিল দিয়ে বলা হয়, আল্লাহ্ জানেন, অমুক ব্যক্তি স্বেচ্ছায় এ কাজ করবে। কিন্তু ব্যক্তির সৃষ্টির পূর্বেই যখন আল্লাহ্ তা জানতেন তখন তা (সরাসরিই হোক বা কারণবিধির মাধ্যমেই হোক) অবশ্যই আল্লাহ্ কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত, সুতরাং এখানে ‘স্বেচ্ছায়’ কথাটি প্রযোজ্য নয়।

মোদ্দা কথা, বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে জাবারীয়াহ্ মতবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ যা আল্লাহ্ তা‘আলা সম্বন্ধে অত্যন্ত ঘৃণ্য ধরনের ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে এ চিন্তাধারায় বিশ্বাসী হবার দাবীদার লোকদের বাস্তব কর্মে এ চিন্তাধরার প্রতিফলন ঘটে না, বরং সে ক্ষেত্রে এখতিয়ারিয়্যাহ্ চিন্তাধরারই প্রতিফলন ঘটে। তারা যখন লোকদের সাথে কথা বলে, বিতর্ক করে, ঝগড়া করে, বিরোধ-বিসম্বাদে লিপ্ত হয় এবং আরো অনেক কাজ সম্পাদন করে তখন এটা সুস্পষ্ট ধরা পড়ে যে, তারা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তিতে বিশ্বাসী। এরূপ ব্যক্তিকে কেউ আঘাত করলে সে প্রত্যাঘাত করে বা অন্ততঃ প্রতিবাদ করে, নিদেন পক্ষে আঘাতকারীকে অন্তরে ঘৃণা করে; বলে না যে, আল্লাহ্ তা‘আলাই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন যে, ঐ ব্যক্তি তাকে আঘাত করবে বা আল্লাহ্ই ঐ ব্যক্তির হাত দিয়ে তাকে আঘাত করেছেন।

এর বিপরীতে বিভিন্ন এখতিয়ারিয়্যাহ্ চিন্তাধারার মধ্যে যারা মানুষের ইচ্ছা ও কর্মশক্তির পরিপূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তাদের চিন্তাধারাও ভারসাম্যহীন ও প্রান্তিক। যদিও মানুষের বিচারবুদ্ধি স্বীয় ইচ্ছা ও কর্মশক্তির স্বাধীনতা অনুভব করে ও প্রত্যক্ষ করে, অতএব, তার যে ইচ্ছা ও কর্মশক্তির স্বাধীনতা রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ ও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়া সম্ভব নয়।

এটা অনস্বীকার্য যে, মানুষের ইচ্ছা ও চিন্তাচেতনার ওপর পারিপার্শ্বিকতা সহ কতক প্রাকৃতিক কারণের নেতিবাচক প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। আর বলা বাহুল্য যে, এসব কারণের পিছনে নিহিত সর্বজনীন কারণবিধি সমূহ আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকেই নির্ধারিত। অতএব, এ ব্যাপারে মানুষের প্রতি আল্লাহ্ তা‘আলার দায়িত্ব রয়েছে। এ কারণেই মানুষের বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্)কে জাগ্রতকরণ এবং তার ওপর থেকে নেতিবাচক প্রভাবের আবরণ সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা‘আলা যুগে যুগে নবী-রাসূল (আঃ) প্রেরণ করেন। এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না থাকলে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে নবী-রাসূল প্রেরণের প্রয়োজনই হতো না।

দ্বিতীয়তঃ মানুষ শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হলেও তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। তাই তাকে ইচ্ছা ও কর্মের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা প্রদানকে বিচারবুদ্ধি সমর্থন করে না। বরং তাকে স্বাধীনতা প্রদানের পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে নিয়ন্ত্রণ করাও অপরিহার্য। একটি ছোট শিশুকে যেভাবে তার পিতা বা মাতা উন্মুক্ত স্থানে স্বাধীনভাবে খেলাধুলা করতে দিলেও তার প্রতি দৃষ্টি রাখে যাতে সে নিজের বা কোনো কিছুর বড় ধরনের ক্ষতি করে না বসে; এজন্য সে কখনো তাকে সতর্ক করে দেয়, কখনোবা জোর করে ধরে কোনো ঝুঁকি থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে, অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা‘আলাও মানুষকে স্বাধীনতা প্রদানের পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং তার কাজে হস্তক্ষেপ করবেন এটাই দুর্বলতা বিশিষ্ট মানব প্রকৃতির দাবী। অতএব, মানুষের ইচ্ছা ও কর্মশক্তির নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা একটি অসম্ভব ব্যাপার।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ করা জরুরী মনে করছি। তা হচ্ছে, যেহেতু মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুল সহ সমগ্র সৃষ্টিলোক আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক সৃষ্ট এবং সৃষ্ট হওয়ার পরে স্বীয় অস্তিত্ব অব্যাহত রাখার ব্যাপারেও আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর নির্ভরশীল, আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিধি-বিধান ও পরিবেশ এবং তাঁরই ইচ্ছা ক্রমে অব্যাহত থাকা মানবিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত, আর তার ইচ্ছা ও কর্মশক্তিও তাঁরই সৃষ্টি এবং তিনি তাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন বলেই তা স্বাধীনভাবে তৎপরতা চালায়-যা প্রয়োজন বোধে তিনি কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণ করেন, সেহেতু এক হিসেবে বলা চলে যে, সমগ্র সৃষ্টিলোকের সকল কাজই আল্লাহ্ তা‘আলার। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যেহেতু মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও আংশিকভাবে স্বাধীন, সেহেতু যে সব কাজ সে বাধ্য হয়ে নয়, বরং স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে সম্পাদন করে তার ভালোমন্দ ও দায়-দায়িত্ব তার নিজের ওপরে বর্তাবে-এটাই স্বাভাবিক।

এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয়। তা হচ্ছে, যদিও মানুষের কর্মক্ষমতা বিভিন্ন কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ, কিন্তু তার বিচারবুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি এতখানি শক্তিশালী যে, যে সব কাজ তার পক্ষে করা ‘সম্ভব’ তা করা বা না-করার ব্যাপারে সে পুরোপুরি স্বাধীন।

কথাটা আরেকটু পরিস্কার করে বললে বলতে হয়, কতগুলো কাজ সে ইচ্ছা করলেও তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। কারণ, বিভিন্ন কারণ তার জন্য ঐসব কাজ সম্পাদন অসম্ভব করে রেখেছে। উদাহরণ স্বরূপ, সে ইচ্ছা করতে পারে যে, একটি বিশালায়তন ভবন নির্মাণ করবে বা তার গ্রামের সকল দরিদ্র পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে দেবে, কিন্তু প্রয়োজনীয় আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় সে তা করতে পারছে না। অথবা সে ইচ্ছা করছে যে, প্রতিবেশীর প্রাসাদোপম বাড়ীটা দখল করে নেবে, কিন্তু এ জন্য প্রয়োজনীয় জবরদস্তী ক্ষমতা ও শক্তি তার নেই। এসব ক্ষেত্রে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে ঐসব কর্ম সম্পাদনে অক্ষম অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সে স্বাধীনতার অধিকারী নয়। কিন্তু ব্যক্তি অন্যের মালিকানাধীন অরক্ষিত কোনো বস্তু ইচ্ছা করলে নিতে পারে, আবার না-ও নিতে পারে। এমনকি চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও অন্যের মালিকানাধীন অরক্ষিত খাদ্যবস্তু (যেমন: কোনো বাগানের ফল) খেতে পারে, আবার তা খাওয়া থেকে বিরত থাকতেও পারে। তেমনি সে তার স্বোপার্জিত ধন-সম্পদ থেকে দরিদ্রদেরকে দান করতে পারে, আবার না-ও করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায় সে তার নিজের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাবার (যার অতিরিক্ত নেই) নিজে যেমন খেতে পারে, তেমনি চাইলে অন্যকেও দিয়ে দিতে পারে। এমনকি মানুষ চাইলে বৈধ বা নিজস্ব খাদ্য-পানীয় সামনে থাকা সত্ত্বেও অনশন করে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে।

এ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষের ইচ্ছা ও কর্মশক্তির ক্ষেত্র সীমিত হলেও সে ঐ সীমিত ক্ষেত্রে কোনো কাজ করা বা না-করার ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীন।

কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে

কোরআন মজীদে এমন কতক আয়াত রয়েছে যা থেকে মনে হতে পারে যে, আল্লাহ্ তা‘আলাই সব কিছু করেন। অদৃষ্টবাদীরা তাদের দাবীর সপক্ষে এসব আয়াতকে দলীল হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। অন্যদিকে কোরআন মজীদে এমন আয়াতের সংখ্যা অনেক যা থেকে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার স্বাধীনতা প্রমাণিত হয়। নিরঙ্কুশ এখতিয়ারবাদে বিশ্বাসীরা এসব আয়াতকে তাদের মতের সপক্ষে দলীল হিসেবে ব্যবহার করেন। এ উভয় ধরনের ভূমিকাই একদেশদর্শী। কারণ, উভয় পক্ষই নিজ নিজ মতের সপক্ষে উপস্থাপনযোগ্য আয়াতগুলোকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং অপর মতের সপক্ষে উপস্থাপনযোগ্য আয়াতগুলোকে এড়িয়ে যান। এভাবে তাঁরা পরস্পর বিরোধী দুই প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। অথচ কোরআন মজীদের তাৎপর্য গ্রহণ ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে অন্যতম সর্বসম্মত মূলনীতি হচ্ছে এই যে, একই বিষয়ের বিভিন্ন আয়াতকে পরস্পরের পরিপূরক বা সম্পূরক হিসেবে গণ্য করে অর্থ গ্রহণ বা ব্যাখ্যা করতে হবে।

এখানে আমরা দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক, ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার স্বাধীনতা নির্দেশক এবং শর্তাধীন সম্ভাবনা জ্ঞাপক আয়াত সমূহ থেকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ কতক আয়াত উদ্ধৃত করবো এবং উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে অর্থাৎ একই বিষয়ের আয়াত সমূহ পরস্পরের পরিপূরক বা সম্পূরক-এ মূলনীতির আলোকে আলোচনা করে উপসংহারে উপনীত হবো।

দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক আয়াত

আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন:

وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ

(১) “ধরণীর বুকে এমন কোনো বিচরণশীল নেই যার রিযক্বের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নয়, আর তিনি তার অবস্থানস্থল ও তার (সাময়িক) বিশ্রামস্থল সম্বন্ধে অবগত; প্রতিটি (বিষয়)ই এ সুবর্ণনাকারী গ্রন্থে নিহিত রয়েছে।” (সূরাহ্ হূদ: ৬)

অনেকে এ আয়াতে উল্লিখিত مستودعها (তার সাময়িক বিশ্রামস্থল-যেখানে বিশ্রামের পর পুনরায় চারণ বা পথচলা শুরু করে) কথাটির অর্থ গ্রহণ করেছেন “তার শেষ বিশ্রামস্থল” বা “যেখানে তার মৃত্যু হবে বা কবর হবে”। এর ভিত্তিতে তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা প্রাণীর মৃত্যুস্থল সম্বন্ধে আগেই জানেন এবং তা কিতাবুম্ মুবীনে লিপিবদ্ধ আছে সেহেতু নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা‘আলা তা পূর্ব থেকে নির্ধারণ করে রেখেছেন।

প্রায় অনুরূপ অর্থজ্ঞাপক আরেকটি আয়াত:

وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ

(২) “আর তাঁর (আল্লাহ্ তা‘আলার) নিকট রয়েছে “গ্বায়ব্”-এর চাবি সমূহ যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ অবগত নয়। আর তিনি জানেন যা রয়েছে স্থলে ও জলে। আর এমন কোনো পাতাও ঝরে পড়ে না যা তিনি অবগত নন; আর না মৃত্তিকার অন্ধকারে কোনো শস্যদানা, না কোনো আর্দ্র বস্তু, না কোনো শুষ্ক বস্তু আছে যা সুবর্ণনাকারী গ্রন্থে নিহিত নেই।” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আম্: ৫৯)

يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ

(৩) “তিনি জানেন যা আছে তাদের সামনে (বর্তমানে ও ভবিষ্যতে) এবং যা আছে তাদের পিছনে (অতীতে)।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ২৫৫)

لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُحْيِي وَيُمِيتُ

(৪) “আসমান সমূহ ও ধরণীর রাজত্ব তাঁর (আল্লাহ্ তা‘আলার); তিনি প্রাণদান করেন এবং তিনিই মৃত্যু প্রদান করেন।” (সূরাহ্ আল্-হাদীদ: ২)

اللَّهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ

(৫) “আল্লাহ্ তাঁর বান্দাহদের মধ্য থেকে যার জন্য চান রিযক্ব্ প্রসারিত করে দেন এবং তাকে পরিমাপ করে দেন।” (সূরাহ্ আল্-‘আনকাবুত্: ৬২)

مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ

(৬) “ধরণীর বুকে এবং তোমাদের সত্তার মধ্যে এতদ্ব্যতীত কোনো বিপদ আপতিত হয় না যা আমরা পূর্বেই তা কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রাখি নি। নিঃসন্দেহে আল্লাহর জন্যে তা সহজ।” (সূরাহ্ আল্-হাদীদ: ২২)

وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ

(৭) “আর আল্লাহ্ যখন কোনো জনগোষ্ঠীর অকল্যাণ চান তখন আর তার প্রতিরোধকারী থাকে না।” (সূরাহ্ আর-রা‘দ্: ১১)

لِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ إِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ فَلَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ

(৮) “প্রতিটি উম্মাহর জন্যে একটি শেষ সময় (আজাল্) রয়েছে; যখন তাদের শেষ সময় এসে যাবে তখন তারা না এক দণ্ড পিছিয়ে যেতে পারবে, না এগিয়ে আসতে পারবে।” (সূরাহ্ ইউনুস: ৪৯)

وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ

(৯) “আর তোমরা ইচ্ছা করছো না (বা করবে না) যদি না আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন।” (সূরাহ্ আদ্-দাহর্: ৩০)

يُدْخِلُ مَنْ يَشَاءُ فِي رَحْمَتِه

(১০) “তিনি যাকে চান (বা চাইবেন) স্বীয় রহমতে প্রবেশ করান (বা করাবেন)।” (সূরাহ্ আদ্-দাহর্: ৩০)

فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى

(১১) “অতএব, (হে মুসলমানগণ!) তোমরা তাদেরকে হত্যা করো নি, বরং আল্লাহ্ই তাদেরকে হত্যা করেছেন। আর (হে রাসূল!) আপনি যখন নিক্ষেপ করলেন তখন আপনি নিক্ষেপ করেন নি, বরং আল্লাহ্ই নিক্ষেপ করেছেন।” (সূরাহ্ আল্-আনফাল্: ১৭)

وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ

(১২) “আর আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোনো পথপ্রদর্শক নেই।” (সূরাহ্ আয্-যুমার্: ২৩)

خَتَمَ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَعَلَى سَمْعِهِمْ وَعَلَى أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ

(১৩) “আল্লাহ্ তাদের অন্তর সমূহের ওপর ও তাদের শ্রবণশক্তির (অনুধাবন ক্ষমতার) ওপর মোহর করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টিশক্তির ওপর পর্দা রয়েছে।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৭)

قُلْنَا يَانَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ

(১৪) “বললাম: হে অগ্নি! ইবরাহীমের ওপর শীতল হয়ে যাও।” (সূরাহ্ আল্-আম্বিয়া’: ৬৯)

বলা হয়, এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আগুনের কোনো দহনক্ষমতা নেই, বরং আল্লাহ্ যখন চান তখন আগুন দহন করতে পারে এবং আল্লাহ্ না চাইলে তখন আগুনের পক্ষে দহন করা সম্ভব হয় না। অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ

(১৫) “(হে রাসূল!) বলুন, হে আল্লাহ্-(সকল) রাজ্যের অধিপতি! আপনি যাকে চান রাজ্য দান করেন ও যার কাছ থেকে চান রাজ্য ছিনিয়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন ও যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন।” (সূরাহ্ আালে ‘ইমরান্: ২৬)

فِي أَيِّ صُورَةٍ مَا شَاءَ رَكَّبَكَ

(১৬) “তিনি তোমাকে যেমন আকৃতিতে ইচ্ছা সৃষ্টি করেছেন।” (সূরাহ্ আল্-ইনফিতার্: ৮)

هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ

(১৭) “তিনিই (আল্লাহ্) যিনি যেভাবে চান তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভে আকৃতি প্রদান করেন।” (সূরাহ্ আালে ‘ইমরান্: ৬)

يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ

(১৮) “তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র দান করেন।” (সূরাহ্ আশ্-শূরা: ৪২)

আমরা দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক উপরোল্লিখিত আয়াত সমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে মানুষের এখতিয়ার নির্দেশক কতক আয়াত উল্লেখ করবো। কারণ, এসব আয়াতের উল্লেখ থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, উপরোল্লিখিত আয়াত সমূহ দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে তা নয়। অতঃপর বিষয়টিকে অধিকতর সুস্পষ্ট করার লক্ষ্যে পরে তা নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করবো।

মানুষের এখতিয়ার নির্দেশকারী আয়াত

মানুষকে যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে কোরআন মজীদের শত শত আয়াত থেকে তা প্রমাণিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ এখানে তা থেকে কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করা হলো:

أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى

(১) “নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের মধ্যকার কোনো কর্মসম্পাদনকারীর কর্মকে বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষই হোক, অথবা হোক নারী।” (সূরাহ্ আালে ‘ইমরান্: ১৯৫)

এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা সুস্পষ্টতঃই মানুষকে কর্মসম্পাদনকারী বলে গণ্য করেছেন; তিনি বলেননি, “আমি যার মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করি” বা “যাকে দিয়ে কর্ম সম্পাদন করাই”।

وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى

(২) “আর এই যে, মানুষ যে জন্য চেষ্টা করে তার জন্য তদ্ব্যতীত কিছু নেই।” (সূরাহ্ আন্-নাজম্: ৩৯)

এখানে সুস্পষ্ট যে, মানুষ চেষ্টা-সাধনার ক্ষমতা রাখে।

مِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الدُّنْيَا وَمِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الْآخِرَةَ

(৩) “তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে দুনিয়ার ইচ্ছা করে (দুনিয়ার সুখ-সম্পদ পেতে চায়) এবং তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে আখেরাতের ইচ্ছা করে (আখেরাতের সুখ-সম্পদ পেতে চায়)।” (সূরাহ্ আালে ‘ইমরান্: ১৫২)

وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا

(৪) “যে ব্যক্তি আখেরাতের ইচ্ছা করলো (আখেরাতের সাফল্য কামনা করলো) এবং সে জন্য ঠিক সেভাবে চেষ্টা-সাধনা করলো যেরূপ চেষ্টা-সাধনা করা প্রয়োজন, আর সে যদি ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে তাদের (এ ধরনের লোকদের) চেষ্টা-সাধনার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো হবে (এর উপযুক্ত প্রতিদান প্রদান করা হবে)।” (সূরাহ্ ইস রা’/ বানী ইসরাঈল্: ১৯)

এখানে ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টা-সাধনা উভয়ই মানুষের ওপর আরোপ করা হয়েছে।

إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ

(৫) “নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ কোনো জনগোষ্ঠীর অবস্থাকে পরিবর্তিত করে দেন না যতক্ষণ না তারা (নিজেরাই) তাদের নিজেদের ভিতরের অবস্থার পরিবর্তন সাধন করে।” (সূরাহ্ আর্-রা‘দ্: ১১)

অর্থাৎ কোনো জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিবর্তনের জন্য স্বয়ং সে জনগোষ্ঠীকে এ পরিবর্তনের জন্য ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে এবং তাকে এজন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَتَقَدَّمَ أَوْ يَتَأَخَّرَ كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ

(৬) “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি চায় সে এগিয়ে যাবে অথবা (যে চায়) সে পিছিয়ে যাবে। প্রতিটি ব্যক্তিই সে যা অর্জন করেছে সে জন্য দায়ী।” (সূরাহ্ আল্-মুদ্দাছছির্: ৩৭-৩৮)

অর্থাৎ ভালো কাজ বা মন্দ কাজ করা ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাধীন বিষয় এবং এ কারণে তার কর্মের সুফল ও কুফলের জন্য সে নিজেই দায়ী।

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

(৭) “আর সে জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনয়ন করতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বরকত সমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা (ঈমান ও তাক্বওয়ার পথকে) প্রত্যাখ্যান করলো। অতএব, তারা যা অর্জন করলো সে কারণে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম।” (সূরাহ্ আল্-আ‘রাফ্: ৯৬)

অর্থাৎ ঈমান আনয়ন ও তাক্বওয়া অবলম্বন করা অথবা কুফরীর পথ অবলম্বন করা উভয়ই ব্যক্তির ইচ্ছাধীন ব্যাপার।

إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا

(৮) “অবশ্যই আমি তাকে পথপ্রদর্শন করেছি; (অতএব,) হয় সে কৃতজ্ঞতাপ্রকাশকারী হবে, অথবা অকৃতজ্ঞ হবে।” (সূরাহ্ আদ্-দাহর্: ৩)

এমনকি বালা-মুছ্বীবত্ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্যও মানুষের এখতিয়ারাধীন কর্মকাণ্ডই (নেতিবাচক কর্মকাণ্ড) দায়ী।

وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ

(৯) তোমাদের ওপর যে সব বালা-মুছ্বীবত্ আপতিত হয় তা তোমাদের নিজেদের অর্জনের কারণেই; অবশ্য তিনি (আল্লাহ্) অনেকগুলোই ক্ষমা করে দেন।” (সূরাহ্ আশ্-শূরা: ৩০)

ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

 (১০) “মানুষের কৃতকর্মের কারণে স্থলভাগে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে-যাতে তিনি (আল্লাহ্) তাদেরকে তাদের কতক কৃতকর্ম (-এর প্রতিক্রিয়া) আস্বাদন করান; হয়তো তারা (তাদের বিপর্যয়কর কর্মকাণ্ড থেকে) ফিরে আসবে।” (সূরাহ্ আর্-রূম্: ৪১)

কোরআন মজীদে ছ্বালাত্‌, ছ্বাওম্, জিহাদ্, যুদ্ধ ইত্যাদির আদেশ সম্বলিত বিপুল সংখ্যক আয়াত রয়েছে এবং আল্লাহ্ তা‘আলার অপসন্দনীয় কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত আরো অনেক আয়াত রয়েছে। এসব আদেশ ও নিষেধ মানুষের ইচ্ছাশক্তি, কর্মক্ষমতা ও স্বাধীনতা নির্দেশ করে। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা না থাকলে এসব আদেশ-নিষেধ অর্থহীন হয়ে যায়। আর আল্লাহ্ তা‘আলা অর্থহীন কাজ সম্পাদনের ন্যায় ত্রুটি ও দুর্বলতা হতে প্রমুক্ত।

দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক আয়াতের ব্যাখ্যা

কোরআন মজীদের যে সব আয়াত থেকে দৃশ্যতঃ প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলাই সব কিছু করেন বা করান অথবা পূর্ব থেকেই সব কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং তদনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব কিছু সংঘটিত হচ্ছে, সে সব আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কারণেই এরূপ প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু এটা কোরআন মজীদের আয়াতের তাৎপর্য গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি নয়। বরং সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে এসব আয়াতের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট সামনে রেখে এবং কোরআন মজীদকে একটি একক ও অবিভাজ্য পথনির্দেশ গণ্য করে অর্থ গ্রহণ করা। নচেৎ কোরআন মজীদে যেখানে দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ ও এখতিয়ারবাদ নির্দেশক উভয় ধরনের আয়াত রয়েছে তখন একে স্ববিরোধী বলে মনে হবে। কিন্তু কোরআন মজীদ যে কোনো ধরনের স্ববিরোধিতারূপ দুর্বলতা থেকে মুক্ত। স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা কাফেরদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন:

أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا

“তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? আর তা (কোরআন) যদি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে হতো (কোনো মানুষের রচিত হতো) তাহলে তাতে বহু স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব থাকতো।” (সূরাহ্ আন্-নিসা’: ৮২)

কিন্তু কোরআন মজীদে দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ ও এখতিয়ারবাদ নির্দেশক ডজন ডজন আয়াত থাকা সত্ত্বেও কোরআন নাযিল কালীন বা তদপরবর্তী কালীন আরব মুশরিক, ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে কোরআন মজীদে স্ববিরোধিতার একটি দৃষ্টান্তও নির্দেশ করা হয় নি। আশ্চর্যের বিষয় যে, তারা কোরআন মজীদকে মানুষের রচিত গ্রন্থ বলে দাবী করা সত্ত্বেও উক্ত চ্যালেঞ্জের মুখেও কোরআন মজীদে এমন দু’টি আয়াতও খুঁজে পায় নি যাকে পরস্পর বিরোধী বলে দাবী করা যেতে পারে। কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের পর এক শতাব্দী কালেরও কম সময়ে কতক মুসলিম মনীষী কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতকে প্রেক্ষাপট ও সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমন অর্থ গ্রহণ করতে থাকেন যার ফলে ডজন ডজন আয়াত পরস্পর বিরোধী বলে প্রতিভাত হয়। এখানে আমরা উদাহরণ স্বরূপ, দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক আয়াত সমূহের মধ্য থেকে ইতিপূর্বে উল্লিখিত আয়াত সমূহ নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখবো যে, এসব আয়াত আদৌ অদৃষ্টবাদ প্রমাণ করে না।

(১) আল্লাহ্ তা‘আলা প্রতিটি প্রাণীর অবস্থানস্থল ও সাময়িক বিশ্রামস্থল (অথবা, বেশীর ভাগ অনুবাদকের গৃহীত অর্থ অনুযায়ী, মৃত্যুস্থল) সম্বন্ধে অবগত (সূরাহ্ হূদ্: ৬)। এমন কোনো পাতাও ঝরে পড়ে না যা তিনি জানেন না (সূরাহ্ আল্-আন্‘আম্: ৫৯)। তিনি জানেন যা আছে লোকদের বর্তমানে ও ভবিষ্যতে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ২৫৫)।

কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার জানা থাকা মানেই যে তা তাঁর পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিত-এরূপ মনে করা ঠিক নয়। কারণ, প্রথমতঃ মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণে অতীতে যে সব কারণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের ভবিষ্যত সম্বন্ধে সম্যক অবগত। ব্যক্তির ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণের কারণ সমূহের মধ্যে প্রাকৃতিক বিধিবিধান, জেনেটিক কারণ, ব্যক্তির নিজের স্বাধীন ইচ্ছা, এখতিয়ার, মন-মেজাজ ও প্রবণতা এবং তার সাথে অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টির অতীত ও বর্তমান সম্পর্ক সহ সব ধরনের কারণ সম্বন্ধেই তিনি পুরোপুরি অবগত। তাই বলে এজন্য তিনিই দায়ী এরূপ দাবী করা ঠিক নয়। অনুরূপভাবে প্রাকৃতিক বিধিবিধান, জেনেটিক কারণ এবং ব্যক্তির সাথে অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টির অতীত ও বর্তমান সম্পর্ক তার ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকার অধিকারী হওয়ার মানে কখনোই এটা হতে পারে না যে, এর ফলে তার স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতা একেবারেই অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং এ ব্যাপারে কোনোই ভূমিকার অধিকারী নয়।

এ প্রসঙ্গে মানবিক জগতের দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। যেমন: একজন শিক্ষক স্বীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একজন ছাত্র সম্বন্ধে জানেন যে, সে পরীক্ষায় প্রথম হবে এবং আরেক জন ছাত্র সম্বন্ধে জানেন যে, সে অকৃতকার্য হবে। তাই বলে তাদের প্রথম হওয়া ও অকৃতকার্য হওয়ার জন্য ঐ শিক্ষককে দায়ী করা চলে না। তেমনি একটি রাস্তার মোড়ে অবস্থিত একটি উঁচু ভবনের ছাদে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তি যদি মোড়ের দুই দিক থেকে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে আগত দু’টি গাড়ী দেখে, গাড়ী দু’টির চালকদ্বয় রাস্তার পাশের বাড়ীঘরের কারণে একে অপরের গাড়ীকে দেখতে পাচ্ছে না লক্ষ্য করে এবং গাড়ী দু’টির গতিবেগ ও রাস্তার মোড় থেকে উভয়ের দূরত্বের ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, দুই মিনিট পর গাড়ী দু’টির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটবে, আর সত্যিই যদি দুই মিনিট পর গাড়ী দু’টির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে, তাহলে ঐ সংঘর্ষের জন্য কিছুতেই ভবিষ্যদ্বাণীকারী ব্যক্তিকে দায়ী করা যাবে না। স্মর্তব্য, এ ক্ষেত্রে গাড়ী দু’টির ভিতর ও বাইরের অবস্থা, চালকদ্বয়ের শারীরিক-মানসিক অবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট পথের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে ঐ ব্যক্তির জ্ঞান যত বেশী হবে তার পক্ষে তত বেশী নির্ভুলভাবে ও তত আগে এ দুর্ঘটনা সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই এ দুর্ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করা যাবে না।

দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টি সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা‘আলার ভবিষ্যত জ্ঞানের মধ্যে এমন কতক বিষয় রয়েছে যা দু’টি ভিন্ন ভিন্ন বা পরস্পর বিরোধী সমান সম্ভাবনার অধিকারী। এমনকি কিছু বিষয় বহু সম্ভাবনার অধিকারী থাকাও স্বাভাবিক। (এ সম্পর্কে পরে প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।)

আর ‘কিতাবুম্ মুবীন্’ (সুস্পষ্ট/ সুবর্ণনাকারী গ্রন্থ) সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তাকে প্রতীকী বর্ণমালায় কালির হরফে কাগজের বুকে লেখা আমাদের পঠনীয় গ্রন্থ মনে করলে ভুল করা হবে। বরং এ হচ্ছে মানুষের অভিজ্ঞতা ও বস্তুলোকের উর্ধস্থিত বিষয় (মুতাশাবেহ্)। অতএব, এতে সব কিছু কী অবস্থায় নিহিত রয়েছে তা আমাদের জানা নেই। তবে এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এতে নিহিত তথ্যবিলীর মধ্যে সমান দুই সম্ভাবনা বা বহু-সম্ভাবনা বিশিষ্ট বিষয়াদিও অন্যতম।

(২) আল্লাহ্ তা‘আলা প্রাণ দান করেন এবং মৃত্যু প্রদান করেন (আল্-হাদীদ্: ২)। এর মানে হচ্ছে, তিনিই জীবনের সূচনা করেন ও মৃত্যুর অমোঘ প্রাকৃতিক বিধান নির্ধারণ করেন। এছাড়া জীবনের উদ্ভব ও বিকাশের এবং মৃত্যু ঘটার কারণ সমূহ (কারণ-বিধি) তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অধিকন্তু তিনি জীবন ও মৃত্যুর প্রতি সদা দৃষ্টি রাখেন এবং গোটা সৃষ্টিলোক, বা মানব প্রজাতি, বা কোনো জনগোষ্ঠী অথবা কোনো ব্যক্তির কল্যাণের জন্যে যদি চান যখন ইচ্ছা তাতে হস্তক্ষেপ করেন। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, জীবন ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টি ও মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা এবং অন্যান্য কারণের কোনোই ভূমিকা নেই। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাই মানুষের এ ধরনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার থাকার কথা বলেছেন। যেমন, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন:

مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا

“যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ বা ধরণীর বুকে বিপর্যয় সৃষ্টির দায়ে ব্যতীত কাউকে হত্যা করলো সে যেন সমগ্র মানব মণ্ডলীকে হত্যা করলো এবং যে তাকে জীবিত রাখলো (তার জীবন রক্ষা করলো) সে যেন সমগ্র মানব মণ্ডলীকে জীবন দান করলো।” (সূরাহ্ আল্-মায়েদাহ্: ৩২)

এ ছাড়াও কোরআন মজীদে এমন বহু আয়াত রয়েছে যাতে মানুষের হত্যা করার ক্ষমতা প্রমাণিত হয়। অতএব, মানুষের মৃত্যুর দিন-ক্ষণ, স্থান ও কারণ পূর্ব থেকে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে নির্ধারিত বলে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে তা ঠিক নয়। কারণ, তাহলে বলতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলাই তার ভাগ্যে তা নির্ধারণ করে রেখে ছিলেন। যদি তা-ই হতো তাহলে হত্যার জন্য ঘাতককে অপরাধী ও গুনাহ্গার গণ্য করা ঠিক হতো না। বস্তুতঃ এটা বড়ই অন্যায় ধারণা যে, আল্লাহ্ তা‘আলা একজনকে দিয়ে আরেক জনকে হত্যা করাবেন, অথচ হত্যার অপরাধে হত্যাকারীকে (যে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের যান্ত্রিক হাতিয়ার বৈ নয়) শাস্তি দেবেন; তিনি এরূপ অন্যায় নীতি ও আচরণ থেকে প্রমুক্ত।

(৩) আল্লাহ্ যাকে চান রিযক্ব্ প্রসারিত করে দেন (সূরাহ্ আল্-‘আনকাবুত্: ৬২)। এ আয়াত থেকে এরূপ অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করার পূর্বেই তার জন্য রিযক্বের ধরন, পরিমাণ, সময় ও মাধ্যম নির্ধারণ করে রেখেছেন। কারণ, এ আয়াতে বর্তমান ও ভবিষ্যত কালের ক্রিয়ারূপ (ছ্বীগাহ্) ব্যবহার করা হয়েছে। ‘প্রসারিত করে দেন’ কথাটি থেকেও প্রমাণিত হয় যে, তিনি তা পূর্ব থেকে নির্ধারিত করে রাখেন নি। কারণ, পূর্বনির্ধারণের পর তাতে পরিবর্তন সাধন সীমিত জ্ঞানের অধিকারী দুর্বলমনা মানুষের বৈশিষ্ট্য; পরম জ্ঞানময় আল্লাহ্ তা‘আলা এরূপ দুর্বলতা থেকে প্রমুক্ত। বরং এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, কারণ-বিধির আওতায় ব্যক্তির জন্য রিযক্ব্ নির্ধারিত হয়ে যায়, তবে তিনি চাইলে তাকে তা সম্প্রসারিত করে দেন, নয়তো কারণ-বিধির আওতায় তার যা প্রাপ্য তাকে তা-ই (পরিমাপ করে) প্রদান করেন।

(৪) প্রতিটি উম্মাহরই একটি শেষ সময় (আজাল্) রয়েছে যা এসে গেলে আর অগ্র-পশ্চাত হয় না (সূরাহ্ ইউনুস: ৪৯)। এখানে “আজাল্” শব্দের অর্থ করা হয় আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিত শেষ সময়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কোরআন মজীদের এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য তা নয়। বরং এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, কোনো জনগোষ্ঠী বা জাতির আয়ুষ্কাল অব্যাহত থাকা ও ধ্বংসের জন্য সুনির্দিষ্ট শর্তাবলী রয়েছে; যখন তার ধ্বংসের উপযোগী সকল শর্ত পূর্ণ হয়ে যায় তখন তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন:

ذَلِكَ أَنْ لَمْ يَكُنْ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا غَافِلُون

“এটা এজন্য যে, (হে রাসূল!) আপনার রব কোনো জনপদকে তার অধিবাসীরা অসচেতন থাকা অবস্থায় অন্যায়ভাবে তাকে ধ্বংস করেন নি।” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আম্: ১৩১)

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো এরশাদ করেন:

وَمَا كَانَ رَبُّكَ لِيُهْلِكَ الْقُرَى بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا مُصْلِحُون

“(হে রাসূল!) আপনার রব এমন নন যে, কোনো জনপদের অধিবাসীরা যথোচিত কর্ম সম্পাদনকারী হওয়া সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে সে জনপদকে ধ্বংস করে দেবেন।” (সূরাহ্ হূদ্: ১১৭)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

يَدْعُوكُمْ لِيَغْفِرَ لَكُمْ مِنْ ذُنُوبِكُمْ وَيُؤَخِّرَكُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى

“তিনি (আল্লাহ্) তোমাদেরকে আহবান করছেন যাতে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের গুনাহ্ সমূহ মাফ করে দেন এবং তোমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় (আজালে মুসাম্মা) পর্যন্ত অবকাশ প্রদান করেন।” (সূরাহ্ ইবরাহীম্: ১০)

এ আয়াতে নবী (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনয়নের শর্তে আজালে মুসাম্মা পর্যন্ত শাস্তি বা ধ্বংস পিছিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ, يوخرکم (তোমাদেরকে অবকাশ প্রদান করেন) কথাটির ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য (مصدر) হচ্ছে تأخير-যার অর্থ পিছিয়ে দেয়া। তাছাড়া এ আয়াতে যে আযাব্ বা ধ্বংস পিছিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে তা পূর্বাপর আয়াতের ধারাবাহিকতা থেকেই প্রমাণিত হয়। কারণ, কাফেররা নবী (আঃ)-কে প্রত্যাখ্যান করার পর আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। এরশাদ হয়েছে:

فَأَوْحَى إِلَيْهِمْ رَبُّهُمْ لَنُهْلِكَنَّ الظَّالِمِين

“অতঃপর তাদের রব তাদের নিকট ওয়াহী করলেন যে, অবশ্যই আমরা যালেমদেরকে ধ্বংস করে দেবো।” (সূরাহ্ ইবরাহীম্: ১৩)

বলা বাহুল্য যে, কোনো জাতির ধ্বংসের দিনক্ষণ ও প্রেক্ষাপট যদি সৃষ্টির সূচনায়ই নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে তাদেরকে ঈমান আনলে ধ্বংস পিছিয়ে দেয়া হবে বলে জানানোর কোনো অর্থ হয় না। তাছাড়া কারো ঈমান বা কুফরী যদি পূর্ব নির্ধারিত হয় তাহলে তার জন্যে ঈমান আনার শর্ত আরোপ করাও অর্থহীন। আর আল্লাহ্ তা‘আলা অর্থহীন কথা ও কাজ রূপ দুর্বলতা থেকে প্রমুক্ত।

উপরোক্ত প্রথম আয়াতে (সূরাহ্ ইবরাহীম্: ১০) “আজালে মুসাম্মা” মানে যে পূর্বনির্ধারিত দিন-তারিখ নয়, বরং যদ্দিন তারা নিজেদেরকে পুনরায় ধ্বংসের উপযুক্ত না করে তদ্দিন পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেয়া হবে-তা-ও সুস্পষ্ট। কারণ, পূর্বনির্ধারিত সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ পর্যন্ত ঈমান আনার শর্তে অবকাশ প্রদানের কথা বলা স্ববিরোধিতা বৈ নয়। কেননা, অবকাশটি পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকলে সে অবকাশ অনিবার্য হয়ে যায়, ফলে তাকে আর ‘অবকাশ’ নামে অভিহিত করা চলে না।

অবশ্য এখানে “আজালে মুসাম্মা” বলতে ক্বিয়ামতের দিনকে বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রেও এ সত্যই প্রমাণিত হয় যে, কোনো জাতির ধ্বংসের জন্য দিনক্ষণ পূর্বনির্ধারিত নেই, বরং তার ধ্বংসের শর্তাবলী নির্ধারিত হয়ে আছে-যা পূর্ণ হলে তাকে ধ্বংস করে দেয়া হবে, আর পূর্ণ না হলে তার অস্তিত্ব অব্যাহত থাকবে এবং তাকে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হবে।

অন্য একটি আয়াত থেকেও মনে হয় যে, “আজালে মুসাম্মা” মানে ক্বিয়ামত দিবস। এরশাদ হয়েছে:

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِينٍ ثُمَّ قَضَى أَجَلًا وَأَجَلٌ مُسَمًّى

“তিনিই (আল্লাহ্) যিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর (তোমাদের জন্য) “আজাল্”-এর অমোঘ বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তাঁর নিকটে রয়েছে “আজালে মুসাম্মা”।” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আম্: ২)

এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, প্রথমোক্ত “আজাল্” মানে ‘শেষ সময়’ বা ‘মৃত্যু’র ‘অমোঘ বিধান’ এবং দ্বিতীয়োক্ত “আজালে মুসাম্মা” মানে ‘ক্বিয়ামত দিবস’। এ আয়াতের বক্তব্য থেকে এ-ও সুস্পষ্ট যে, মানুষের জন্য “আজাল”-এর ফয়সালা বলতে ‘শেষ সময়’ বা ‘মৃত্যু’র অনিবার্যতা বুঝানোই এখানে লক্ষ্য, সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বুঝানো লক্ষ্য নয়। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের (এবং অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টির) জন্য মৃত্যুর বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক কারণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, অতঃপর যখন কোনো না কোনো কারণে কারো জন্য মৃত্যু অবধারিত হয়ে যায় তখনই তার মৃত্যু ঘটে।

অবশ্য মৃত্যুর জন্য এই প্রাকৃতিক কারণ সমূহ ছাড়াও একটি ব্যতিক্রমী কারণও রয়েছে, তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার প্রত্যক্ষ ফয়সালা। অর্থাৎ সৃষ্টিলোক, মানব প্রজাতি, কোনো জনগোষ্ঠী বা স্বয়ং ব্যক্তির কল্যাণের লক্ষ্যে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মৃত্যু বা ধ্বংস আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় হয় তখন মৃত্যু বা ধ্বংসের জন্য প্রাকৃতিক কারণ বিদ্যমান না থাকলেও আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছায় তার মৃত্যু বা ধ্বংস অনিবার্য। (অনুরূপভাবে প্রাকৃতিক কারণে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মৃত্যু বা ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠলেও সৃষ্টিলোক, মানব প্রজাতি, উক্ত জনগোষ্ঠী বা স্বয়ং ব্যক্তির কল্যাণের লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা‘আলা তা পিছিয়ে দিতে পারেন।) আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছাক্রমে হযরত খিযির (আঃ) কর্তৃক একটি শিশুকে হত্যার ঘটনা (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্: ৭৪) এ পর্যায়ের-যা শিশুটি ও তার পিতামাতার জন্য কল্যাণকর বিবেচিত হয়। এ ঘটনা থেকে এ-ও প্রমাণিত হয় যে, শিশুটির মৃত্যু আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে (তার জন্মের পূর্ব থেকেই) পূর্বনির্ধারিত ও অনিবার্য ছিলো না। কারণ, তাহলে সে বড় হয়ে অবাধ্যতা ও কুফর্ দ্বারা পিতামাতাকে প্রভাবিত করবে বলে আল্লাহ্ তা‘আলা ও হযরত খিযির (আঃ)-এর পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করার (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্: ৮০) কোনো কারণ থাকতো না এবং তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়ারও প্রয়োজন হতো না।

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাধারণভাবে মানুষদের মৃত্যুর দিনক্ষণ তার জন্মের পূর্বে নির্ধারিত নয় (তবে কতক ব্যতিক্রম থাকা স্বাভাবিক)।

এখানে বিচারবুদ্ধির আলোকে মানুষের ‘আয়ুষ্কাল ও প্রতিভা’র সম্ভাবনার ওপর দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। বিচারবুদ্ধির পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পাই যে, একটি মানবসন্তান জন্মগ্রহণের সময় ‘আয়ুষ্কাল ও প্রতিভা’র বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আসে। কিন্তু জন্মের পর বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণ তার আয়ুষ্কাল ও প্রতিভার ‘সম্ভাবনা’র বৃত্ত দু’টির আয়তনকে ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত করতে থাকে। আমরা যদি তার বয়সকে একটি ক্রমপ্রসারমান নেতিবাচক বৃত্ত হিসেবে এবং তার আয়ুষ্কাল ও প্রতিভার ‘সম্ভাবনা’র বৃত্ত দু’টিকে ক্রমসঙ্কোচনরত ইতিবাচক বৃত্ত হিসেবে ধরে নেই, তাহলে তার বয়সবৃত্তের বৃদ্ধি এবং আয়ুষ্কাল ও প্রতিভার সম্ভাবনার বৃত্তদ্বয়ের সঙ্কোচন অব্যাহত থাকায় যখন তার বয়সবৃত্ত ও প্রতিভা সম্ভাবনাবৃত্ত পরস্পর মিলে যাবে তখন তার প্রতিভার বিকাশধারা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে এবং যখন তার বয়সবৃত্ত ও আয়ুষ্কাল সম্ভাবনাবৃত্ত পরস্পর মিলে যাবে তখনই তার মৃত্যু ঘটবে। এর ব্যতিক্রম কেবল তখনই সম্ভব যদি আল্লাহ্ তা‘আলা তার প্রতিভাসম্ভাবনাবৃত্ত বা আয়ুষ্কালসম্ভাবনাবৃত্ত সঙ্কুচিত হয়ে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা সেখান থেকে পিছিয়ে দেন তথা তার সঙ্কোচনকে (আংশিকভাবে হলেও) দূর করে দেন তথা হারিয়ে যাওয়া প্রসারতাকে (আংশিকভাবে হলেও) ফিরিয়ে দেন।

অনুরূপভাবে ব্যক্তির বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণে তার প্রতিভাসম্ভাবনার অনেকগুলো দিক বা শাখার বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় বা তার বিকাশের গতি শ্লথ হয়ে যায়, যদি না কোনো কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাতে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ সংঘটিত হয়।

(৫) এমন কোনো মুছ্বীবত্ আপতিত হয় না যা পূর্ব থেকেই কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই (সূরাহ্ আল্-হাদীদ: ২২) এবং আল্লাহ্ যখন কোনো জনগোষ্ঠীর অকল্যাণ চান তখন তা কেউ রোধ করতে পারে না (সূরাহ্ আর্-রা‘দ্: ১১)।

এখানে কিতাবে মুছ্বীবত্ লিপিবদ্ধ থাকা মানে প্রতিটি ব্যক্তির ওপর কবে কখন কী ধরনের মুছ্বীবত্ আপতিত হবে তা সৃষ্টির সূচনার পূর্বেই বা সূচনার মুহূর্তেই লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো-এমন নয়। বরং এ আয়াতে “আজাল্”-এর লক্ষ্য দু’টি সম্ভাবনার একটি। হয় এর লক্ষ্য এই যে, মুছ্বীবত্ সমূহের ধরন সুনির্দিষ্ট এবং তার শর্তাবলী কারণবিধি দ্বারা সুনির্দিষ্ট রয়েছে। অতএব, এর বাইরে নতুন ধরনের কোনো মুছ্বীবত্ হতে পারে না (যা আল্লাহ্ তা‘আলার জানা থাকবে না এবং তিনি চাইলে যা রোধ করতে পারবেন না)। অথবা এর লক্ষ্য এই যে, ‘বিভিন্ন কারণে’ (মানবিক, প্রাকৃতিক ও অন্যবিধ) ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য যে মুছ্বীবত্ অবধারিত হয়ে গেছে যথাসময়ে তার বাস্তবায়িত হওয়া অনিবার্য; তা থেকে কেউ কিছুতেই পালাতে পারবে না।

সূরাহ্ আর্-রা‘দ্-এর ১১ নং আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয় যে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর স্থান ও কালের আওতায় যে বিপদ আপতিত হয় তা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে বা সূচনাকালে বা ব্যক্তির অস্তিত্বের সূচনাকালে নির্ধারিত করে রাখা হয় নি। কারণ, “আল্লাহ্ যখন চান বা চাইবেন” থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি তা সৃষ্টিলোকের সৃষ্টির বা ব্যক্তির অস্তিত্বলাভের সূচনাকালে বা তার পূর্বে নির্ধারণ করে রাখেন নি।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র ...
সমাজ কল্যাণে আল-কুরআনের ভূমিকা
মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৪০টি হাদীস (২)
প্রকৃতি ও মানুষের সত্তায় পরকালীন ...
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত-পূর্ব ...
১৯ রমজান হযরত আলী (আ.) শত্রু কর্তৃক ...
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...
শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন (আ.)'র ...
সূরা আ'রাফ;(২৫তম পর্ব)
দুঃখ-কষ্ট মোকাবেলার উপায়

 
user comment