বিশ্বের নানা জাতির মধ্যে রয়েছে বিচিত্রময় রনস রেওয়াজ বা প্রথা ও সংস্কৃতি। আবার প্রত্যেক জাতিই নিজস্ব ইচ্ছা বা অভিরুচি অনুযায়ী গড়ে তোলে নানা হুকুম বা বিধান। আর এইসব বিধানের ভিত্তিতে কোনো কোনো জাতি কিছু জরুরি বা কল্যাণকর বিষয়কে করে নিষিদ্ধ ও কোনো কোনো অপকারি ও নোংরা বিষয়কে করে বৈধ। এ ধরনের পদক্ষেপ সমাজের জন্য খুবই ধ্বংসাত্মক। দৃষ্টান্ত হিসেবে আধুনিক পাশ্চাত্যে সমকামিদের বিয়ে এবং বিয়ে ছাড়াই নারী ও পুরুষের সম্মিলিত যৌন জীবন বা লিভ-টুগেদারের কথা উল্লেখ করা যায়। আর এ জন্যই ধর্মপন্থী চিন্তাবিদরা বলেন, একমাত্র আল্লাহই মানুষের জন্য উপকারী আইন প্রণয়ন করতে পারেন। কারণ, একমাত্র তিনিই মানুষের ভালো ও মন্দের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্ত দিকের খবর রাখেন এবং খেয়ালিপনা থেকে পবিত্র।
মহান আল্লাহ সব জীবকেই বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতিতে তাদের সবারই রয়েছে সুনির্দিষ্ট ও উপকারী ভূমিকা। কুরআনের মতে সব সৃষ্টিই মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত। প্রত্যেক জীবের নানা বৈশিষ্ট্য ও সৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয় সৃষ্টি জগতের কথা। কুরআনের এই দৃষ্টিভঙ্গি বহু চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বকেও অভিভূত করে।
মহান আল্লাহর দয়ার একটি বড় দিক হল তিনি মানুষের মধ্য থেকেই একদল নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন যাতে তাঁরা মানুষকে বিভ্রান্তি ও অজ্ঞতা থেকে রক্ষা এবং সুপথ দেখাতে পারেন। সুরা আনআম কুরআনের এই আলো দানকারী ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষকে।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) বহু নবী-রাসূলের পূর্বপুরুষ ছিলেন। তিনি শিরক ও মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করেছিলেন এবং যুক্তি ও তর্কের মাধ্যমে একত্ববাদের সত্যতা আর সত্যের পথ তুলে ধরেন নিজ জাতির কাছে। হযরত ইব্রাহিম (আ.)'র ঘটনাটি সুরা আনআমের ৭৫ থেকে ৭৯ নম্বর আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে এভাবে,
كَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَلِيَكُونَ مِنَ الْمُوقِنِي، فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ اللَّيْلُ رَأَى كَوْكَبًا قَالَ هَـذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لا أُحِبُّ الآفِلِي، فَلَمَّا رَأَى الْقَمَرَ بَازِغًا قَالَ هَـذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَئِن لَّمْ يَهْدِنِي رَبِّي لأكُونَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّالِّينَ، فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَـذَا رَبِّي هَـذَآ أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ، إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ،
'আমি এভাবেই ইব্রাহীমকে আকাশ ও ভূমণ্ডলের বিস্ময়কর বস্তুগুলো দেখাতে লাগলাম-যাতে সে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে যায়। এরপর যখন রাতের অন্ধকার তার উপর নেমে এল, তখন সে একটি তারা দেখতে পেল, বলল, এটা আমার রব বা প্রতিপালক। এরপর যখন তা অস্তমিত হল তখন বলল, আমি অস্তগামীদের ভালবাসি না। এরপর যখন চাঁদকে ঝলমল করতে দেখল, বলল, এটি আমার প্রতিপালক। এরপর যখন তা অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন বলল যদি আমার রব বা প্রতিপালক আমাকে পথ- না দেখান, তবে অবশ্যই আমি বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। এরপর যখন সূর্যকে চকচক করতে দেখল, বলল, এটি আমার রব বা পালনকর্তা,এটি বৃহত্তর। এরপর যখন তা ডুবে গেল, তখন বলল হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা যেসব বিষয়কে শরিক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত।
আমি একমুখী হয়ে নিজ মুখ ঐ সত্তার দিকে করেছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিক নই।"
নিঃসন্দেহে ইব্রাহিম (আ.) তাঁর ফিতরাত বা জন্মগত প্রকৃতি ও বিবেকের মাধ্যমে মহান আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস রাখতেন। কিন্তু তিনি সৃষ্টি জগতের রহস্যময় নানা বিষয়ের ওপর গবেষণা চালিয়ে তাওহিদ বা আল্লাহর ওই একত্বের বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ মাত্রায় উন্নীত করেন।
মহান আল্লাহ সুরা আনআমের ১৬১ নম্বর আয়াতে ইব্রাহিম (আ.)'র একত্ববাদী ধর্মের সত্যতা এবং এর ওপর এই মহান নবীর অবিচলতার স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন: "হে নবী! আপনি বলুন, আমাকে আমার প্রতিপালক সরল পথের দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, যা এক প্রতিষ্ঠিত ধর্ম এবং সত্যপন্থী ইব্রাহিমের ধর্মপথ, আর তিনি অংশীবাদীদের দলভুক্ত ছিলেন না।"
সুরা আনআমের ৭৪ নম্বর আয়াতে ইব্রাহিম (আ.)'র পালনকারী পিতা আযরকে মূর্তিপূজারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে কেউ কেউ মনে করেন যে, আযর ছিল এই মহান নবীর পিতা। অথচ আযর ছিল ইব্রাহিম (আ.)'র চাচা বা নানা। আরবদের বক্তব্যের রীতি ও সাহিত্যেও অনেক সময় দেখা যায় যে চাচা বোঝাতে বাবা শব্দটি ব্যবহার করা হয়। সুরা ইব্রাহিমের ৩৫ থেকে ৪১ নম্বর আয়াত লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেখানে ইব্রাহিম (আ.) বৃদ্ধ অবস্থায় নিজের বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করেছেন এবং তাঁদের জন্য 'ওয়ালিদ' বা জন্মদাতা শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
এ ছাড়াও আযর যদি তাঁর জন্মদাতা বাবা হতেন তাহলে তাঁর জাতি একত্ববাদের দাওয়াত পেয়ে প্রথমেই এটাই বলতো যে, আমরা তো তোমার মুশরিক বাবারই অনুসারী! কিন্তু তারা মূর্তিপূজার বিষয়টিকে নিজ পিতৃ-পুরুষদের ওপরই আরোপ করেছে, ইব্রাহিম (আ.)'র পিতৃ-পুরুষদের ওপর নয়। (সুরা আম্বিয়ার ৫২ নম্বর আয়াত দ্রষ্টব্য)। উল্লেখ্য, কোনো নবীর পিতাই কখনও কাফির ছিলেন না ও কাফির হতে পারেন না।
সুরা আনআমের ৭৫ থেকে ৭৯ নম্বর আয়াতে তারকা, চাঁদ ও সূর্যকে প্রতিপালক বলা ছিল ইব্রাহিম (আ.)'র দাওয়াতি কৌশল মাত্র যাতে বিরোধীদের ভুল ধারণাগুলো দূর করা যায়। আর এ পদ্ধতিটি যে স্বয়ং মহান আল্লাহ তাঁকে শিখিয়েছিলেন তা এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় স্বয়ং আল্লাহই উল্লেখ করেছেন ৮৩ নম্বর আয়াতে। যেহেতু সেযুগে মুশরিকরা কেউ তারকা, কেউ চাঁদ ও কেউ সূর্যের প্রভু হওয়ার ধারণায় বিশ্বাসী ছিল তাই ইব্রাহিম (আ.) নানা যুক্তি দিয়ে আল্লাহর একত্ববাদ প্রমাণের মাধ্যমে তাদের নিরুত্তর করতে চেয়েছেন। তাই তিনি ওইসব বক্তব্যের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ওইসব বস্তুর মধ্যে নশ্বরতা ও অনস্তিত্বের সম্ভাব্যতার চিহ্ন রয়েছে। কারণ, পরিবর্তনধর্মী ও চলমানতা সৃষ্টিরই বৈশিষ্ট্য। তাই এমন কোনো স্রষ্টা প্রয়োজন যার মধ্যে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই নেই এবং সে কোনো কিছুরই কাছে নতজানু হবে না ও তার রাজত্বও সীমিত হবে না, যেমনটি নত বা অস্তমিত হয় নক্ষত্র। আর নমরুদের রাজত্বও ছিল সীমিত সময়ের জন্য। তাই এমনটি ভাবার সুযোগ নেই যে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন প্রথমে মুশরিক বা অংশীবাদী (নাউজুবিল্লাহ), বরং প্রথমে তিনি মুশরিকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তাদের উপাস্যদের অস্থায়ীত্ব ও দুর্বলতা তাদের সামনে তুলে ধরেছেন এবং পরে তাদের বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করেছেন। #
source : abna