মদীনা থেকে কারবালা পর্যন্ত)
মীনায় মদীনার আলেমদের সাথে বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণ
আমীর মু‘আবিয়ার জীবনের শেষ বছরে তথা কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার এক বছর আগে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) পবিত্র মক্কা নগরীর পার্শ্ববর্তী মীনায় মদীনার আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে তিনি নিম্নোক্ত ভাষণ প্রদান করেন :
‘হে লোকসকল! আল্লাহ্ তা‘আলা (বনি ইসরাইলের) আলেমদের যে তিরস্কার করেছেন ও উপদেশ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ কর। তিনি এরশাদ করেছেন : ‘‘কেন (তাদের মধ্যকার) রাব্বানিগণ (আরেফ ও দরবেশগণ) ও আলেমগণ তাদের পাপ-কথা বলতে ও হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করল না?’’- সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৬৩
আল্লাহ্ আরও এরশাদ করেছেন : ‘‘বনি ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছিল তাদেরকে দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের কণ্ঠে অভিসম্পাত করা হয়। কারণ, তারা নাফরমানী করত ও (আল্লাহ্র নির্ধারিত) সীমা লঙ্ঘন করত। তারা যে সব মন্দ কাজ করত তা থেকে তারা পরস্পরকে নিষেধ করত না; তারা যা করত তা কতই না নিকৃষ্ট কর্ম!’’-সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৭৮-৭৯
কেন আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের এভাবে তিরস্কার করলেন? কারণ, তারা যালেমদের- পাপাচারীদের যুলুম ও পাপ কাজ করতে এবং ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করতে দেখত, কিন্তু তাদের কাছ থেকে পার্থিব সুযোগ-সুবিধা লাভ ও যুলুমের হাত থেকে নিরাপদ থাকার উদ্দেশ্যে তাদের এ সব থেকে নিষেধ করত না। অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন : ‘‘…তোমরা লোকদের ভয় কর না, কেবল আমাকেই ভয় কর…।’’-সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৪৪
আমীর মু‘আবিয়ার মৃত্যু ও ইয়াযীদের বাই‘আত্ দাবি
৬০ হিজরির রজব মাসে মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের মৃত্যুর পর ইয়াযীদ (তার ওপর আল্লাহর লা‘নত) দামেশকের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়। সে ক্ষমতায় বসেই মদীনার প্রশাসক ওয়ালীদকে এক পত্র মারফত মদীনাবাসীর, বিশেষ করে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বাই‘আত্ আদায়ের জন্য নির্দেশ দেয়। ওয়ালীদ হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ডেকে আনার জন্য লোক পাঠায়। ইমাম হুসাইন (আ.) বনি হাশিমের ত্রিশ জন লোক ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের সাথে নিয়ে ওয়ালীদের কাছে এলেন। ওয়ালীদ তাঁকে আমীর মু‘আবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ জানাল এবং তাঁকে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ হওয়ার জন্য বলল। ইমাম হুসাইন (আ.) জবাব দিলেন : ‘হে আমীর (প্রশাসক)! বাই‘আত্ তো আর গোপনে হয় না। তুমি যখন জনসাধারণকে বাই‘আতের জন্য ডাকবে তখন তাদের সাথে আমাকেও ডেক।’… তিনি আরো বলেন : ‘হে আমীর! আমরা নবুওয়াতের আহলে বাইত এবং রিসালাতের খনি যাদের কাছে ফেরেশতারা আসা-যাওয়া করে। আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টিলোকের অস্তিত্বদান আমাদের মাধ্যমে শুরু করেছেন এবং আমাদের মাধ্যমেই একে সমাপ্তিতে পৌঁছাবেন। অন্যদিকে ইয়াযীদ হচ্ছে এক ফাসেক লোক; সে মদ্যপায়ী এবং সম্মানিত লোকদের হত্যাকারী। সে প্রকাশ্যেই পাপ কাজ করে থাকে। সে এ পদের (খেলাফতের) জন্য উপযুক্ত নয়। আমার মত ব্যক্তি এ ধরনের কোন লোকের অনুকূলে বাই‘আত হতে পারে না। তবে আমি আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব যাতে এ ব্যাপারে তুমিও চিন্তা করে দেখতে পার এবং আমরা সকলেও চিন্তা করে দেখতে পারি যে, আমাদের মধ্য থেকে কোন্ ব্যক্তি খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার ও বাই‘আত লাভের জন্য অধিকতর উপযুক্ত।’
মক্কাত্যাগকালীন ভাষণ
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে পরিবার-পরিজন ও ভক্ত-অনুরক্তদের নিয়ে মদীনা ছেড়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে চলে যান এবং মসজিদে হারামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে থাকাকালে তাঁকে কুফায় গিয়ে বিপ্লবে নেতৃত্বদানের জন্য কুফাবাসীর পক্ষ থেকে দাওয়াত আসতে থাকে। ইতিমধ্যে যখন তিনি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পারলেন যে, ইয়াযীদ হজ্বের সময় লোকজনের ভীড়ের মধ্যে তাঁকে হত্যা করার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠিয়েছে, তখন পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে তিনি হজ্বের আগের দিন আটই যিলহজ্ব প্রত্যুষে কুফার উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করেন। এর আগের রাতে তিনি তাঁর কাছে সমবেত তাঁর কতক বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য, সঙ্গীসাথী, অনুসারী ও উপস্থিত জনতার উদ্দেশে নিম্নোক্ত ভাষণ প্রদান করেন : ‘সকল প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্য। তিনি যা চাইবেন তা-ই হবে। তাঁর সম্মতি ছাড়া কারও পক্ষেই কোন কাজ সম্পাদন করা সম্ভব নয়। প্রশংসা আল্লাহর এবং তাঁর রাসূলের ওপর দরূদ বর্ষিত হোক।
আদম-সন্তানদের গলায় মৃত্যুর দাগ কেটে দেওয়া হয়েছে (অবধারিত করে দেওয়া হয়েছে) যেভাবে যুবতীদের গলায় হারের দাগ কেটে থাকে। ইয়াকুব (আ.) যেভাবে ইউসুফ (আ.)-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ঠিক সেভাবেই আমি আমার পূর্ববর্তী পুণ্যবানদের সাথে সাক্ষাতের আশা পোষণ করি। আর যে জায়গা আমার শাহাদাগাহ্ (শাহাদতের স্থান) হবে এবং আমার লাশ গ্রহণ করবে সে জায়গা আমার জন্য পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাকে এখন সেখানে পৌঁছতে হবে। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, কারবালার নাওয়াভীসে মরুভূমির নেকড়েরা আমার শরীর ছিন্নভিন্ন করছে এবং তাদের শূন্য উদর ভর্তি করছে। আর কোন মানুষের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা যাতে সন্তুষ্ট, আমরা রিসালাতের পরিবারও তাতেই সন্তুষ্ট। এ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে পরীক্ষা; আমি এ পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করব। আর ধৈর্যশীলদের প্রতিদান পরম দাতা আল্লাহ্ তা‘আলার হাতে। যারা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক রাখে তারা তাঁর থেকে পৃথক হবে না এবং বেহেশ্তে তাঁর সমীপে থাকবে, আর তাদের দর্শনে আল্লাহ্ তা‘আলার মহান রাসূলের নয়নদ্বয় উজ্জল হবে। আমি প্রত্যুষে রওনা হব, ইনশা আল্লাহ্। (ক্বেচ্ছেয়ে কারবালা, পৃ. ১৪৮; আল্-লুহূফ্, পৃ. ২৫)
আশুরার রাতের ভাষণ
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) আশুরার রাতে অর্থাৎ ৬১ হিজরির নয়ই মুহররম দিবাগত রাতে কারবালা প্রান্তরে তাঁর সঙ্গীসাথীদের এক জায়গায় সমবেত করেন এবং তাঁদের উদ্দেশে নিম্নোক্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণ প্রদান করেন : ‘সর্বোত্তম প্রশংসা সহকারে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং আনন্দ ও দুঃখ-কষ্ট উভয় অবস্থায়ই তাঁর প্রশংসা করছি। হে আমার রব! যেহেতু তুমি আমাদের নবুওয়াতের দ্বারা সম্মানিত করেছ, কুরআন ও দীনের জ্ঞান দ্বারা মর্যাদামন্ডিত করেছ এবং আমাকে শোনার মতো কান, দেখার মতো চোখ ও সচেতন অন্তঃকরণ প্রদান করেছ সেজন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। হে আল্লাহ্! আমাকে তোমার প্রশংসাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও।
আমার সঙ্গীসাথীদের তুলনায় আন্তরিক ও একনিষ্ঠ সঙ্গীসাথী (আর কারও) ছিল বা আছে বলে আমার জানা নেই। আর আমার আহলে বাইতের (পরিবারের) তুলনায় অধিকতর অনুগত আহলে বাইতের কথাও আমার জানা নেই। তেমনি আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজখবর নেওয়ার ক্ষেত্রেও আমার আহলে বাইতের তুলনায় নিষ্ঠাবান আহলে বাইত আছে বলে জানি না। আমাকে সাহায্য-সহায়তা করার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।
আমি জানি যে, আগামীকাল তাদের (ইয়াযীদী পক্ষের) সাথে আমাদের ব্যাপারটা যুদ্ধে পর্যবসিত হবে। তাই আমি আমার অনুকূলে তোমাদের কৃত বাই‘আত তুলে নিচ্ছি। আমি তোমাদের অনুমতি দিচ্ছি, তোমরা পথ চলার জন্য ও এখান থেকে দূরে চলে যাওয়ার জন্য রাতের অন্ধকারকে ব্যবহার কর এবং বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাও যাতে আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার পথ বের করে দেন এবং তোমরা মুক্তি লাভ করতে পার। ঐ লোকগুলো আমাকে চায়। অতএব, তারা আমাকে পেলে তোমাদের সাথে তাদের কোন কাজ নেই।’- (কিতাবুল ইরশাদ : শেখ মুফীদ, পৃ. ৯৩ )
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর সঙ্গীসাথীদের ওপর থেকে বাই‘আতের দায় তুলে নেওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মধ্য থেকে কেউই তাঁকে ত্যাগ করে চলে যাননি।
আশুরার দিনে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ভাষণ
আশুরার দিন ইমাম হুসাইন (আ.) প্রতিপক্ষের কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম ধরে উচ্চৈঃস্বরে সম্বোধন করে বললেন : ‘হে শাবাছ্ বিন্ রাব্‘ঈ! হে হাজ্জার্ বিন্ আব্জার্! হে কায়স্ বিন্ আশ্‘আছ! হে ইয়াযীদ বিন্ হারেছ্! তোমরা কি আমাকে এ বলে পত্র লিখনি যে, ‘ফল পেকে গেছে এবং যমিন সবুজে ঢেকে গেছে; আপনি যদি আসেন, তাহলে আপনার খেদমতে একটি সুসজ্জিত বাহিনী দেখতে পাবেন?’
…‘তোমরা আমার নসবের (বংশ পরম্পরার) বিষয়টি স্মরণ কর, ভেবে দেখ, আমি কে। তোমাদের হুঁশ হোক; তোমরা নিজেদের ধিক্কার দাও এবং ভেবে দেখ যে, আমাকে হত্যা করা এবং আমার মর্যাদা বিনষ্ট করা কি তোমাদের জন্য জায়েয? আমি কি তোমাদের রাসূলের কন্যার পুত্র নই? আমি কি তাঁর (রাসূলের) স্থলাভিষিক্ত ও চাচাত ভাইয়ের পুত্র নই- যিনি সকলের আগে ঈমান এনেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যা এনেছিলেন তার সত্যতা স্বীকার করেছিলেন?’ ‘সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা হামযাহ্ কি আমার চাচা নন?’ ‘জা‘ফর তাইয়ার- আল্লাহ্ তা‘আলা যাঁকে কারামতস্বরূপ দু’টি পাখা দিয়েছেন যাতে তিনি তা দিয়ে বেহেশ্তের ভিতরে উড়তে পারেন, তিনি কি আমার চাচা নন?’ ‘তোমরা কি জান না যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে এরশাদ করেছেন : ‘এ দু’জন হচ্ছে বেহেশ্তে যুবকদের নেতা।’?’…-(হায়াতুল ইমামিল হুসাইন, ৩য় খন্ড, পৃ. ১৮৪)
ইমাম হুসাইন শিমারকে বললেন : ‘তোমার কি এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহ আছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কন্যার সন্তান? আল্লাহর শপথ, এ বিশ্বে পূর্ব ও পশ্চিমের দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী ভূখন্ডে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কন্যার পুত্র আমি ছাড়া আর কেউ নয়। তোমার জন্য পরিতাপ! আমি কি তোমার কাউকে হত্যা করেছি যে, আমার কাছ থেকে তার রক্তের বদলা আদায় করতে চাচ্ছ? আমি কি তোমার কোন সম্পদ বিনষ্ট করেছি, নাকি আমার কাঁধে কারও কেসাসের দায় রয়েছে যা তুমি কার্যকর করতে চাচ্ছ?’
ইমাম হুসাইন (আ.) এরপর ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সম্বন্ধে বলতে লাগলেন : ‘হে কুফাবাসী! তোমাদের মায়েরা তোমাদের শোকে ক্রন্দন করুক। তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার এ নেক বান্দাহ্কে দাওয়াত করেছিলে এবং বলেছিলে : আমরা আপনার পথে জীবন বিলিয়ে দেব। কিন্তু এখন তোমরা তার বিরুদ্ধে তোমাদের তলোয়ারগুলোকে উন্মুক্ত করেছ এবং তাকে সকল দিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছ। তোমরা তাকে এ বিশাল পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা চলে যাবার জন্য সুযোগ দিচ্ছ না। এখন সে বন্দীর মতো তোমাদের হাতে আটকা পড়ে আছে। তোমরা তাকে এবং তার পরিবারের নারী ও কন্যাদের ফোরাতের পানি পান করতে বাধা দিয়েছ, অথচ ইহুদী ও খ্রিস্টান গোত্রসমূহের লোকেরাও সেখান থেকে পানি পান করছে। এমনকি পিপাসায় আমাদের পশুগুলোর প্রাণও ওষ্ঠাগত হয়েছে এবং সেগুলো ছটফট করছে ও গড়াগড়ি দিচ্ছে। তোমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বংশধরদের ব্যাপারে তাঁর বর্ণিত মর্যাদার সীমারেখাকেও রক্ষা করনি। মহাপিপাসার দিনে আল্লাহ্ তোমাদের পরিতৃপ্ত না করুন।’ (কিতাবুল ইরশাদ : শেখ মুফিদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৯৭)
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাদেরকে সম্বোধন করে পুনরায় বলেন : ‘হে লোকসকল! ধ্বংস ও দুঃখ তোমাদের ঘিরে ফেলুক; কারণ, (মনে করে দেখ,) কেমন বর্ণনাতীত আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস সহকারে তোমরা আমাকে দাওয়াত করেছিলে! আর এ কারণেই আমি এখানে এসেছি। আমি খুব দ্রুত তোমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছি। কিন্তু আমরা তোমাদের হাতে যে তলোয়ার অর্পণ করেছিলাম তা-ই আমাদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত করেছ। আর আমরা আমাদের দুশমন ও তোমাদের দুশমনদের বিরুদ্ধে যে অগ্নি প্রজ্বলিত করেছিলাম তোমরা তাকেই আমাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ডতর করে তুলেছ। তোমরা তোমাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে ও দুশমনদের সপক্ষে যুদ্ধের জন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছ, যদিও তারা না তোমাদের সাথে ইনসাফ ও সুবিচারের সাথে আচরণ করেছে, না তাদের দ্বারা তোমাদের কোন কল্যাণ হবে বলে আশা করা যায়, আর না আমরা এমন কোন কাজ করেছি যে কারণে আমাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের শত্রুতা ও আগ্রাসনের সঙ্গত কারণ থাকতে পারে।
…আমি বলছি, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে হত্যা কর না। কারণ, আমাকে হত্যা করা বা অবমাননা করা তোমাদের জন্য জায়েয নয়। আমি তোমাদের রাসূলের কন্যার সন্তান, আর আমার নানী খাদীজাহ্ তোমাদের রাসূলের স্ত্রী। হয়ত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সেই কথা তোমাদের কাছে পৌঁছে থাকবে যে, তিনি এরশাদ করেছেন : ‘হাসান ও হুসাইন হচ্ছে বেহেশতবাসী যুবকদের দুই নেতা।’ হ্যঁা, আল্লাহর শপথ, ওয়াদা ভঙ্গ করা, বিশ্বাসঘাতকতা ও চুক্তি ভঙ্গ করা তোমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তোমাদের (তোমরা হচ্ছ এমন বৃক্ষতুল্য যার) মূল ধোঁকা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার সাথে মিশে গেছে। তোমাদের শাখা-প্রশাখাসমূহ এর ওপর ভিত্তি করেই প্রসারিত হয়েছে। তোমরা হচ্ছ সর্বাধিক নোংরা- নিকৃষ্টতম ফল; তাই তোমরা স্বীয় বাগান-মালিকের গলায় আটকে যাও এবং আত্মসাৎকারী ও লুণ্ঠনকারীদের জন্য সুস্বাদু ও সুখাদ্য হয়ে যাও। (তুহাফুল উকূল, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ১৭৪; আল-ইহতিজাজ, ২য় খন্ড, পৃ. ৯৯; মাকতালুল হুসাইন : খারাযমী, ২য় খন্ড, পৃ. ৬)
…আমাদের রব অত্যন্ত মহান। কিন্তু তোমরা অত্যন্ত খারাপ বান্দাহ্। তাই তাঁর আনুগত্যের অঙ্গীকার করেও এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনলেও রাসূলের পরিবার-পরিজন ও বংশধরদের ওপর চড়াও হয়েছ এবং তাদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। শয়তান তোমাদের ওপর বিজয়ী হয়েছে, তাই তোমরা মহান আল্লাহ্র কথা ভুলে গিয়েছ। তোমরা ধ্বংস হও। তোমরা যা চাচ্ছ সে ব্যাপারে আমি বলছি : ইনণা লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘উন্। এরা হচ্ছে এমন একটি জনগোষ্ঠী যারা ঈমান আনার পরে কাফের হয়েছে। দূর হোক আল্লাহ্র রহমত যালেমদের কাছ থেকে।’ (বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খন্ড, পৃ. ৫)
মদীনা থেকে কারবালা : ইমাম হুসাইন (আ.)-এর স্লোগান
১. ‘উম্মাহ্ যখন ইয়াযীদের ন্যায় শাসকের কবলে পড়েছে তখন ইসলামকে বিদায়!’- (মাওসূ‘আতু কালামাতিল্ ইমাম আল্-হুসাইন, পৃ. ২৮৪ )
২. ‘অবশ্যই আমি মৃত্যুকে সৌভাগ্য এবং যালেমদের সাথে বেঁচে থাকাকে দুর্ভাগ্য ব্যতীত অন্য কিছু মনে করি না।’- (বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খন্ড, পৃ. ৩৮১)
৩. ‘তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে, সত্যের ভিত্তিতে কাজ করা হয় না এবং বাতিল থেকে বিরত থাকা হচ্ছে না? অতএব, (এহেন পরিস্থিতিতে) যথার্থভাবেই মু’মিনের উচিত তার রবের সাথে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হওয়া।’- (মানাক্বিব : ইবনে শাহ্র আশূব, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৬৮)
৪. ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কৃত হারামকে হালালকারী, তাঁর (আল্লাহর গৃহীত) অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ও রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সুন্নাতের বিরোধিতাকারী কোন নিপীড়ক শাসককে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে পাপাচার ও দুর্বৃত্তপনা করতে দেখে, সে যদি তার কাজ বা কথার মাধ্যমে তাকে প্রতিহত না করে, তাহলে আল্লাহর জন্য দায়িত্ব হয়ে যায় যে, তাকে (প্রতিহত করণে বিরত ব্যক্তিকে) তার (নিপীড়ক শাসকের) প্রবেশদ্বার দিয়ে (জাহান্নামে) প্রবেশ করাবেন।’- (ওয়াক্ব‘আতু আল্তাফ্, পৃ. ১৭২; মাওসূ‘আতু কালামাতিল ইমাম আল্-হুসাইন, পৃ. ৩৬১)
৫. ‘আল্লাহর সন্তুষ্টিতেই আমাদের আহর বাইতের সন্তুষ্টি; আমরা তাঁর পক্ষ থেকে আগত পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করব এবং তিনি অবশ্যই আমাদের তাঁর নেক বান্দাদের জন্য প্রতিশ্রুত পুরস্কার প্রদান করবেন।’- (বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খন্ড, পৃ. ৩৬৬; আ‘ইয়ানুশ্ শি‘আহ্, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৩৯ )
৬. ‘অবশ্যই আমি কেবল আমার নানার উম্মাতের সংশোধনের উদ্দেশ্যে বের হয়েছি।’- (মানাক্বিব : ইবনে শাহরে আশূব্, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৮৯)
৭. ‘দূর হোক লাঞ্ছনা আমাদের থেকে; আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও মু’মিনগণ এটা আমাদের জন্য অপছন্দ করেন।’- (নাফাসুল মাহমুম, পৃ. ১৩১; মাক্বতাল : খারাযমী, ২য় খন্ড, পৃ. ৭)
৮. ‘লাঞ্ছনার জীবনের চেয়ে সম্মান সহকারে মৃত্যুই শ্রেয়।’- (বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খন্ড, পৃ. ১৯২)
৯. ‘তোমাদের কোন দীন নেই এবং তোমরা পরকালকে ভয় করছ না, সুতরাং তোমরা তোমাদের দীনের ব্যাপারে স্বাধীন হয়ে যাও।’- (প্রাগুক্ত, ৪৫তম খন্ড, পৃ. ৫১)
১০. ‘আমি একগুঁয়েমির বশবর্তী হয়ে বা পার্থিব আরাম-আয়েশের জন্য বা বিশৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে অথবা যুলুম-অত্যাচারের উদ্দেশ্যে বহির্গত হইনি; বরং আমি আমার নানার উম্মাতের সংশোধনের চেষ্টা চালানোর উদ্দেশ্যে বের হয়েছি; আমি ভাল কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ প্রতিহত করতে এবং আমার নানার ও আমার পিতা আলী বিন্ আবি তালিবের জীবনাচরণের অনুসরণ করতে চাই।’- (মাক্বতাল্ : খারাযমী, ১ম খন্ড, পৃ. ১৮৮।)
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী