আবনা ডেস্ক: “যারা মনোযোগ দিয়ে নানা বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি শুনে, অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে। তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান।”(সুরা জুমার-১৭)
পবিত্র কুরআনের এই আহ্বান প্রমাণ করে যে, ইসলাম মানুষকে যুক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেকের অনুসরণ করতে বলে। জোর করে কাউকে মুসলমান বানানো ইসলামের নীতি নয়। মার্কিন নও-মুসলিম খাদিজা ইভান্সও ব্যাপক গবেষণার পর স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে ইসলামকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন।
সাবেক ববি ইভান্স নিজের জন্য রাসূল (সা.)’র স্ত্রী হযরত খাদিজা (সা.)’র নাম বেছে নিয়েছেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন স্রস্টা ও সত্য সম্পর্কে কৌতুহলী। মিসেস ববি ইভান্সের বাবা মা ছিলেন খ্রিস্টান। শৈশবে ৭ বা ৮ বছর বয়সে স্রস্টার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেছিলেন ইভান্স, যদিও খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি সে সময় নিশ্চিত ছিলেন না। প্রায় দশ বছর বয়সে আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে ঘরের ফায়ার-প্লেসের কোনায় লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তার আশা ছিল এই চিঠির জবাব আসবে। কিন্তু কোনো জবাব আসেনি। তাই স্রস্টার অস্তিত্ব ও গির্জার শিক্ষা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেন। বাবা-মা ধার্মিক না হওয়া সত্ত্বেও ইভান্স ও তার দুই ভাইকে মাঝে মধ্যে বাবা-মায়ের নির্দেশে গির্জায় যেতে হতো। এভাবে কেটে গেছে ইভান্সের জীবনের ১৩টি বসন্ত। তিনি বলেছেন:
"সে বছর আমরা বাসা বদল করে একটি ছোট্ট শহরে গিয়েছিলাম। এই বাসার কাছে কোনো গির্জা ছিল না। আর বাবা-মাও সকালের ঘুমও ছাড়তে পারছিলেন না। ফলে আমাদের খ্রিস্ট ধর্ম শিক্ষা থেমে যায় এখানেই। কিন্তু দুই বছর পর আমার মা হঠাৎ করে করে আবারও গির্জায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মাঝে মধ্যে বাবাকেও সেখানে নিয়ে যেতেন। আর আমিও যেতাম সেখানে মাঝে মধ্যে। সে সময় থেকেই আমার মধ্যে শুরু হয়েছিল আল্লাহকে খুঁজে পাওয়ার অনুভূতি। এই অনুসন্ধান অব্যাহত থাকে ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত।"
মার্কিন নও-মুসলিম খাদিজা ইভান্স ক্যাথলিক গ্রুপসহ খ্রিস্ট ধর্মের নানা গ্রুপের সঙ্গে মিশেছেন। কিন্তু কোথাও পাননি কাঙ্ক্ষিত প্রশান্তি এবং জীবন, জগত ও ধর্ম সম্পর্কিত নানা জরুরি প্রশ্নের উত্তর। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন এমন একজন খ্রিস্টানকে যিনি ক্যাথলিক ছিলেন না। এভাবে গির্জাও যাওয়া আবারও বন্ধ করে দেন। কিন্তু তার মনের মধ্যে সত্যকে পাওয়ার সে আকুতি কখনও নিভে যায় নি, যে সত্যের আকর্ষণ পার্থিব বিষয়ের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। মৃত্যুর পরের জীবন বা পরকালীন জীবনে উপনীত হওয়ার পথ- এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন জাগত সাবেক ববি ইভান্সের জীবনে।
এ অবস্থায় আরো একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন মিসেস ইভান্স। কিন্তু কয়েক মাসে ধরে তাদের কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পর এই সম্প্রদায়ের ব্যাপারেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন ইভান্স। এভাবে কোনো সম্প্রদায়ের কাছেই নতুন কোনো বক্তব্য খুঁজে পাননি তিনি। ইভান্সের মতে, প্রকৃত বিশ্বাস বা ঈমান ও এইসব সম্প্রদায়ের শিক্ষার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান বা দূরত্ব ছিল। আর এইসব শিক্ষাকে কোনো যুক্তি ছাড়াই মেনে নিতে বলা হয়। কিন্তু ইভান্স তার বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে কোনো একটি বইয়ের কিছু অযৌক্তিক বাক্যের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে চাননি।
বাইবেল অধ্যয়নের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মার্কিন নও-মুসলিম খাদিজা ইভান্স বলেছেন:
“আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ খুঁজে পাব, এই আশা নিয়ে বাইবেল পড়ছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে কিছু কথা ছিল আমার বুদ্ধিবৃত্তির উপলব্ধির সাধ্যাতীত এবং এ বইয়ের অনেক অদ্ভুত কথারই কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। তাই কিছু অধ্যায় পড়ার পর তা পড়া ছেড়ে দেই। এভাবে আল্লাহকে জানার প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে গবেষণা করা বন্ধ করে দেই এবং ধর্ম সম্পর্কে পুরোপুরি উদাসীন বা নির্লিপ্ত হয়ে পড়ি।”
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম প্রধান স্মরণীয় ও রহস্যময় সন্ত্রাসী ঘটনা। মার্কিন সরকার এই হামলার ঘটনাকে মুসলমানদের কাজ বলে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। ওই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা অত্যন্ত কঠিন চাপের মুখে রয়েছে। সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম-আতঙ্কও জোরদার হয়েছে। মুসলমানদের ওপর বেড়েছে নির্যাতন ও হয়রানি।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন-আসলে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছিল বিশ্বব্যাপী ইসলাম-বিদ্বেষী ততপরতা ও ইসলাম-আতঙ্ক জোরদারের জন্য। এ ঘটনার পর থেকে গৃহীত মার্কিন ও ইসরাইলি পদক্ষেপগুলোই এই ধারণার অত্যন্ত জোরালো ভিত্তি। কিন্তু তাদের এ পদক্ষেপ বরং বুমেরাং হয়েছে ও হচ্ছে। ১১ সেপ্টেম্বরের রহস্যময় ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের প্রতি মানুষের আগ্রহ জোরদার হয়েছে। ফলে অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে জানতে গিয়ে মুসলমান হচ্ছেন। খাদিজা ইভান্সও সেই সৌভাগ্যবান নও-মুসলিমদের মধ্যে একজন। অন্য কথায় ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনা ইভান্সের জন্য সৌভাগ্যের পথ খুলে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন:
"২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সকাল বেলায় কম্পিউটারের সামনে বসেছিলাম। তখনও নয়টা বাজেনি। আমার ডানদিকে থাকা টেলিভিশনটিও খোলা ছিল। হঠাত শুনলাম বিশেষ জরুরি খবর, একটি বিমান বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ারে আঘাত হেনেছে। তখনও খ্রিস্টান ছিলাম। কিন্তু এই ঘটনাগুলো আমাকে পুরোপুরি হ-য-ব-র-ল অবস্থায় ফেলে দেয়। গণমাধ্যমগুলো ইসলামকেই এইসব সন্ত্রাসী হামলার কারণ ও হোতা বলে প্রচার করছিল। আমার কাছে এটা খুবই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল যে একটা ধর্ম কিভাবে সহিংসতার বিস্তারকারী হতে পারে? এটা আমার বুদ্ধিমত্তা বা বিবেকের সঙ্গে মিল খাচ্ছিল না। তাই আমি নিজেই এ ব্যাপারে তদন্তের ও গবেষণার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইসলাম বিষয়ক ওয়েব সাইটগুলো ভিজিট করতে লাগলাম এবং মুসলিম মহিলাদের ওয়েব-ভিত্তিক বিশেষ কিছু গ্রুপের সদস্য হলাম। আমার নানা প্রশ্ন তুলে ধরলাম ই-মেইলে। যেসব জবাব পেলাম সেগুলো নিয়ে গবেষণা করে দেখলাম উত্তরগুলো পুরোপুরি সঠিক।"
নও-মুসলিম খাদিজা ইভান্সও আরও বলেন:
"আমি সাধারণত কোনো বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সে বিষয়ে কোনো মত গ্রহণ করি না। মানুষের কথা শুনেই কোনো কিছু বিশ্বাস করি না আমি। বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে তা যাচাই করতে থাকি। গবেষণা করে দেখলাম যে মুসলমাদের খোদা তথা আল্লাহ খ্রিস্টান ও ইহুদিদেরই খোদা একই এবং তিনিই হযরত মুসা (আ.) ও ইব্রাহিম (আ.)’র খোদা। এটাও বুঝলাম যে ইসলাম অমুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ছড়ায় না। এ ধরনের কাজকে সহ্যও করে না এবং নিরপরাধ মানুষ হত্যা করাকেও সহজেই মেনে নেয় না। আমার এ গবেষণায় ইসলাম সম্পর্কে এমন চিত্র পেলাম যে গণমাধ্যমে তার কোনো ইশারাও দেখা যায় না এবং এ সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে ইসলামই সত্য ধর্ম। এ ব্যাপারে অনেক দলিল প্রমাণও পেলাম। মজার ব্যাপার হল, এইসব দলিল-প্রমাণই পবিত্র কুরআনেই পেলাম। এ মহাগ্রন্থে যেসব বৈজ্ঞানিক সত্য তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো বিজ্ঞানীরা কেবল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবিষ্কার করেছেন। কেবল মহান আল্লাহই ১৪০০ বছর আগে এইসব বৈজ্ঞানিক সত্য বা তথ্যের খবর দিতে সক্ষম।"
নও-মুসলিম খাদিজা ইভান্স নানা যুক্তি প্রমাণ ও আন্তরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে মুসলমান হন। তার মতে, ইসলাম গ্রহণই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। কালেমায়ে শাহাদাতাইন পাঠের স্মরণীয় দিনটিতেই তিনি স্বীকার করেন যে, ইসলাম মুক্তির ধর্ম ও বেহেশত লাভের পথ। ইভান্স এর মাধ্যমে ইসলাম অনুযায়ী কাজ করারও সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেছেন,
“মুসলমান হওয়ার পর আমার জীবন এখন লক্ষ্য ও অর্থপূর্ণ। আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, পৃথিবীর জীবন মাত্র কয়েক দিনের। পরকালের পুরস্কার দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী আনন্দের চেয়ে অনেক গুণ বেশি ও ব্যাপক। আমি এখন মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে প্রশান্তি অনুভব করছি যে অনুভূতি আমার অতীতে কখনও ছিল না। এখন আমি বুঝতে পেরেছি যে, আগে আমি যেসব সমস্যাকে খুব বড় মনে করতাম সেগুলো ছিল আমাকে ওপরে তোলার মঞ্চ মাত্র। আমার যা ছিল না ও বর্তমানে যা আছে তার জন্য আমি আল্লাহর কাছে শোকর করছি।”#
source : abna24