ভূমিকা
কালামশাস্ত্রবিদগণের দু’সম্প্রদায়ের (আশআরী ও মো’তাজেলী) মধ্যে মতবিরোধপূর্ণ একটি বিষয় হল আল্লাহ্র ন্যায় পরায়ণতা (عدل الهى)। উল্লেখ্য এ বিষয়টির ক্ষেত্রে শিয়া মাযহাবের মতামত মো’তাজেলীদের অনুরূপ। আশআরীদের প্রতিকুলে এ দু’সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে আদলিয়াহ (عدلية) নামকরণ করা হয়ে থাকে। কালামশাস্ত্রে এ বিষয়টির উপর এতই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, মুখ্য বিষয়সমূহের মধ্যে পরিগণিত হয়েছে। এমনকি একে আক্বা’য়েদের মূলনীতি এবং শিয়া ও মো’তাজেলী মাযহাবের কালামশাস্ত্রের বিশেষত্ব বলেও মনে করা হয়েছে।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, আশআরী চিন্তার অনুসারীরা আল্লাহর আদল বা ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করেন না অর্থাৎ এমন নয় যে, আল্লাহকে অত্যাচারী (এমন কথা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই) মনে করেন -যেখানে কোরানের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ আল্লাহর ন্যায়বিচারের প্রমাণ বহন করে এবং যে কোন প্রকারের জুলুম ও অত্যাচারের অপবাদ থেকে প্রভুসত্তাকে পবিত্ররূপে প্রকাশ করে। বরং বিতর্কের বিষয় হল এটা যে, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি কি শরীয়ত, কিতাব ও সুন্নতের সাহায্য ব্যতীত কোন কর্ম, বিশেষ করে ঐশী কর্মকারে মানদ– নিরূপণে সক্ষম যার উপর ভিত্তি করে কোন কর্মের গ্রহণ বা বর্জনের অপরিহার্যতা সম্পর্কে মন্তব্য করা যাবে? যেমনঃ বলবে যে, মু’মেনদেরকে বেহেস্তে আর কাফেরদেরকে দোযখে প্রেরণ করা মহান আল্লাহ্র জন্যে অপরিহার্য। না কি, এ ধরণের সিদ্ধান্তদান কেবলমাত্র ওহীর ভিত্তিতে রূপ পরিগ্রহ করে, যা ব্যতীত বুদ্ধিবৃত্তি কোন প্রকার সিদ্ধান্ত দিতে অপারগ?
অতএব বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হল তাতেই, যাকে ‘বুদ্ধিবৃত্তির ভাল-মন্দ ভাল-মন্দ বিচার ক্ষমতা’ (الحسن والقبح العقلى) বলা হয়ে থাকে। আশআরীরা একে অস্বীকার করে এবং সৃষ্টিগত সুনির্ধারিত বিষয়ে (امور تكوينى) বিশ্বাস স্থাপন করে, অর্থাৎ যা মহান আল্লাহ সম্পাদন করেন তা-ই সুকর্ম, আর (বিধিগত বিষয়ে) তিনি যা আদেশ করেন তা-ই ভাল এমন নয় যে, যেহেতু কর্মটি ভাল, তাই তিনি এটা সম্পাদন করেন বা সম্পাদন করার আদেশ প্রদান করেন।
কিন্তু, আদলিয়াহগণ বিশ্বাস করেন যে, কর্মকাণ্ডসমূহ সুনির্ধারিত ও বিধিগত হিসেবে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্কিতকরণ ব্যতীতই, ভাল অথবা মন্দ নামে অভিষিক্ত হয়ে থাকে এবং মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিও একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ভাল-মন্দকে অনুধাবন করতে ও প্রভুসত্তাকে সকল প্রকার মন্দকর্ম সম্পাদন করা থেকে পবিত্র ভাবতে সক্ষম। তবে তা মহান আল্লাহর প্রতি আদেশ-নিষেধ করা (মহান আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন) অর্থে নয়। বরং এ অর্থে যে, কোন কর্ম মহান আল্লাহ্র কামালিয়াতের সাথে সম্পর্কিত কি-না। আর এর উপর ভিত্তি করেই মহান আল্লাহ কর্তৃক মন্দকর্ম সম্পাদনকে অসম্ভব বলে মনে করা হয়।
এটা অনস্বীকার্য যে, এ বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা এবং আশআরীদের পক্ষ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাল-মন্দের ধারণার অস্বীকৃতি ও অবশেষে যা তাদেরকে আদলিয়াহদের বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে, তার জবাব প্রদান, এ প্রবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে অসম্ভব। অনুরূপ এ ব্যাপারে মো’তাযেলীদের বক্তব্যেরও অনেক দুর্বলতা থাকতে পারে, যে সম্পর্কে যথাস্থানে আলোচনা করা উচিৎ। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ভাল-মন্দের মূলভাষ্য শিয়া সম্প্রদায় কর্তৃক গৃহীত, কিতাব ও সুন্নতের উৎস থেকে অনুমোদিত ও মাসুমগণ (আ.) কর্তৃক গুরুত্বারোপকৃত হয়েছে।
ফলে আমরা এখানে সর্বপ্রথমে আদলের ধারণা সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করব। অতঃপর মহান আল্লাহর এ ক্রিয়াগত গুণের স্বপক্ষে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের উল্লেখ করব। সর্বশেষে এ বিষয়টি সম্পর্কে বিদ্যমান ভ্রান্ত ধারণাসমূহের জবাব প্রদানে সচেষ্ট হব।
আদলের (ন্যায়পরায়ণতার) তাৎপর্য
আদলের (عدل) আভিধানিক অর্থ হল বরাবর বা সমমান সম্পন্ন করা এবং সাধারণের ভাষায় অত্যাচারের (অপরের অধিকার হরণ) বিরুদ্ধে অপরের অধিকার সংরক্ষণার্থে ব্যবহৃত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আদলকে নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
«اعطاء كلّ ذى حق حقّه» ‘যার যার অধিকার তাকে প্রদান করা।’
অতএব সর্বাগ্রে এমন এক অস্তিত্বকে বিবেচনা করতে হবে যার অধিকার আছে; অতঃপর তার সংরক্ষণকে ন্যায়বিচার বা আদল (عدل), আর তার লংঘনকে অত্যাচার বা জুলুম (ظلم) নামকরণ করা যায়। কিন্তু কখনো কখনো আদলের ধারণার সম্প্রসারণে বলা হয়ে থাকে:
«وضع كلّ شيء فى موضعه»‘প্রত্যেক বস্তুকেই তাদের নিজ নিজ স্থানে স্থাপিত।’
অর্থাৎ সকল কিছুকে যথাস্থানে সংস্থাপন অথবা সকল কর্মকে উপযুক্তরূপে সম্পন্ন করণই হল ‘আদল’ বা ন্যায়কর্ম। আর এ সংজ্ঞানুসারে আদল, প্রজ্ঞা (حكمت) ও ন্যায়ভিত্তিক কর্মের সমার্থবোধক অর্থ বা প্রজ্ঞাপূর্ণ কর্ম অর্থে রূপ পরিগ্রহ করে। তবে কিরূপে ‘অধিকারীর অধিকার’ এবং সকল কিছুর যথোপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করা হয় –এ সম্পর্কে বক্তব্য অনেক– যা ‘আখলাক্বের দর্শন’ ও ‘অধিকারের দর্শন’ রূপে গুরুত্বপূর্ণ শাখা সৃষ্টি করেছে। স্বভাবতঃই এখানে আমরা এ বিষয়ের উপর আলোচনা করতে পারব না।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলঃ সকল বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই অনুধাবন করতে পারে যে, যদি কেউ কোন কারণ ছাড়াই কোন অনাথ শিশুর হাত থেকে এক টুকরা রুটিও ছিনিয়ে নেয় অথবা নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরায়, তবে সে জুলুম করেছে এবং অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। আবার বিপরীতক্রমে, যদি কেউ ছিনতাইকারীর নিকট থেকে ছিনতাইকৃত রুটির টুকরা উদ্ধার করে, ঐ অনাথ শিশুকে ফিরিয়ে দেয় অথবা অপরাধী ঘাতককে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে, তবে সে ন্যায়বিচার করেছে বা সঠিক কর্ম সম্পাদন করেছে। এ সিদ্ধান্তগুলো প্রভু কর্তৃক নির্ধারিত বিধি-নিষেধের উপর নির্ভরশীল নয়। এমনকি যদি কেউ খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নাও হয়ে থাকে, তবে সেও এ ধরনের সিদ্ধান্তই নিবে।
কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্তের গুঢ় রহস্য কী বা কোন সে শক্তির মাধ্যমে মানুষ ভাল-মন্দকে অনুধাবন করে ইত্যাদি বিষয়গুলোকে দর্শনের একাধিক শাখায় আলোচনা করতে হবে।
সিদ্ধান্তঃ আদলের জন্যে বিশেষ ও সাধারণ এ দু’ধরনের ভাবার্থকে বিবেচনা করা যেতে পারে। এদের একটি হল ‘অন্যের অধিকার সংরক্ষণ’ এবং অপরটি হল ‘প্রজ্ঞাপূর্ণ কর্ম সম্পাদন’ যেখানে ‘অন্যের অধিকার সংরক্ষণ’ এর একটি দৃষ্টান্তরূপে পরিগণিত হবে।
অতএব আদলের অবিচ্ছেদ্য অর্থ, সকল মানুষকে বা সকল কিছুকে এক বরাবর বা এক রেখায় স্থাপন নয়। যেমনঃ ন্যায়পরায়ণ শিক্ষক তিনিই নন যিনি পরিশ্রমী বা অলস নির্বিশেষে সকল ছাত্রকেই একরূপ প্রশংসা বা ভর্ৎসনা করবেন। অনুরূপ ন্যায়বিচারক তিনিই নন যিনি বিবাদপূর্ণ কোন সম্পদকে, কলহে লিপ্ত দু’পক্ষের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করবেন। বরং ন্যায়পরায়ণ শিক্ষক তিনিই যিনি সকল ছাত্রকে তাদের যোগ্যতানুসারে পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত করবেন। তদনুরূপ ন্যায়বিচারক তিনিই যিনি বিবাদপূর্ণ সম্পদকে এর প্রকৃত মালিকের নিকট অর্পণ করবেন।
একইভাবে প্রভুর প্রজ্ঞা ও আদলের দাবী এটা নয় যে, সৃষ্টির সবকিছুকেই সমানভাবে সৃষ্টি করবেন। যেমনঃ মানুষকেও শিং, কেশর বা পাখা ইত্যাদি দিবেন। বরং সৃষ্টিকর্তার প্রজ্ঞার দাবী হল এই যে, বিশ্বকে তিনি এরূপে সৃষ্টি করবেন যাতে সর্বাধিক কল্যাণ ও উৎকর্ষ অর্পিত হয় এবং বিভিন্ন সৃষ্ট বিষয় যেগুলো এ জগতের সুসংহত অংশসমূহ রূপে পরিগণিত, সে গুলোকে এমনভাবে সৃষ্টি করবেন, যেন ঐ চূড়ান্ত উদ্দেশ্যের (উৎকর্ষ ও কল্যাণ) সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়। অনুরূপ প্রভুর আদল ও প্রজ্ঞার দাবী হল এই যে, সকল মানুষকেই তার যোগ্যতানুসারে দায়িত্ব প্রদান। অতঃপর তার স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা ও প্রচেষ্টার আলোকে তার বিচার করণ এবং পরিশেষে তার কর্মফলস্বরূপ তাকে পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত করা।
﴿لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا﴾ "আল্লাহ কারও উপর এমন কোন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা তার সাধ্যাতীত।” (সূরা বাকারা-২৮৬)
﴿وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ﴾ "তাদের মীমাংসা ন্যায়বিচারের সাথে করা হবে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।” (সূরা ইউনু-৫৪)
﴿فَالْيَوْمَ لَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَلَا تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ﴾ "আজ কারও প্রতি জুলুম করা হবে না এবং তোমরা যা করেছ কেবল তারই প্রতিফল দেয়া হবে।” (সুরা ইয়াসীন-৫৪)
আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতার প্রমাণ
ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, প্রভুর ন্যায়পরায়ণতা এক দৃষ্টিকোণ থেকে মহান আল্লাহ্র হিকমাত বা প্রজ্ঞাধীন এবং অপর দৃষ্টিকোণ থেকে প্রজ্ঞারই অভিন্ন রূপ। স্বভাবতঃই এর প্রমাণও সে যুক্তির মাধ্যমেই করা হবে যা প্রভুর প্রজ্ঞাকে প্রতিপাদন করার ক্ষেত্রে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এখানে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করার চেষ্টা করব।
আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে, মহান আল্লাহ চূড়ান্ত স্বাধীনতা ও ক্ষমতার অধিকারী। সম্ভাব্য অস্তিত্বের জন্যে কোন কর্ম সম্পাদন করার বা না করার ক্ষেত্রে তিনি কোন শক্তি কর্তৃক প্রভাবিত বা কোন শক্তির নিকটই পরাভূত নন। বরং তিনি ইচ্ছে করলে কোন কিছু নাও করতে পারেন এবং যা তিনি সম্পাদনের ইচ্ছে করবেন তাই করবেন।
অনুরূপ তিনি কোন অর্থহীন ও অহেতুক ইচ্ছা পোষণ করেন না। বরং যা কিছু তাঁর পূর্ণতম গুণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই তিনি ইচ্ছা করেন। যদি তাঁর পূর্ণতম গুণ কোন কর্মকে দাবি না করে, তবে তিনি কখনোই তা সম্পাদন করেন না। যেহেতু মহান আল্লাহ চূড়ান্ত পূর্ণতার অধিকারী, সেহেতু তাঁর ইরাদাও (ইচ্ছাও) মূলতঃ সৃষ্টির কল্যাণ ও পূর্ণতার দিকেই হয়ে থাকে এবং যদি কোন অস্তিত্বশীলের অস্তিত্ব বিশ্বে অনিবার্য অকল্যাণ ও অভিসম্পাতের কারণ হয়, তবে তা (মৌলিক নয় বরং) প্রসঙ্গক্রমে ও আনুষঙ্গিকভাবে (অর্থাৎ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে) হয়ে থাকে। অর্থাৎ যেহেতু ঐ অকল্যাণ সর্বাধিক কল্যাণের অবিচ্ছেদ্য বিষয়, সেহেতু প্রভুর ইরাদা বা ইচ্ছা উক্ত সর্বাধিক কল্যাণের অনুগামী হয়ে থাকে।
অতএব প্রভুর পূর্ণতম গুণের দাবি এই যে, বিশ্ব এমনভাবে সৃষ্টি হবে যাতে সম্মিলিতভাবে সম্ভাব্য সর্বাধিক পূর্ণতা ও কল্যাণ অর্জিত হয়। আর এখানেই মহান আল্লাহর জন্যে প্রজ্ঞা (حكمت) বা কল্যাণচিন্তার ভিত্তিতে কর্ম সম্পাদন নামক গুণটি প্রতিপন্ন হয়।
এর ভিত্তিতে যেখানেই মানুষের অস্তিত্বলাভের সম্ভাবনা বিদ্যমান ও তার অস্তিত্ব সর্বাধিক কল্যাণের উৎস, সেখানেই মানুষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রভুর ইচ্ছার সমাপতন ঘটেছে। মানুষের একটি মৌলিক বিশেষত্ব হল এখ্তিয়ার ও স্বাধীন ইচ্ছা এবং নিঃসন্দেহে স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতার অধিকার মানুষের একটি অস্তিত্বগত পূর্ণতা বলে পরিগণিত। আর যে অস্তিত্বশীল এ পূর্ণতার অধিকারী, সে অস্তিত্বশীল অপর কোন অস্তিত্বশীল, যা এর অধিকারী নয়, তা অপেক্ষা পূর্ণতর বলে পরিগণিত হবে। কিন্তু স্বাধীনতার অধিকারী হওয়ার জন্যে অপরিহার্য হলঃ মানুষ যেমনি সুকর্ম ও যথোপযুক্ত কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে অনন্ত ও চূড়ান্ত পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হতে পারবে তেমনি কুকর্ম ও অপছন্দনীয় কর্মে লিপ্ত হয়ে অনন্ত দুর্দশা ও ক্ষতির পথে পতিত হতে পারবে। তবে প্রভুর ইরাদার বিষয় হল মূলতঃ মানুষের পূর্ণতা প্রাপ্তি। কিন্তু মানুষের স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা থাকার বৈশিষ্ট্যটি তার পূর্ণতার একটি বৈশিষ্ট্য হলেও তার অন্যতম অবিচ্ছেদ্য (لازمه) দিক হল তা অধঃপতনের সম্ভাবনাযুক্ত, যা পাশবিক কামনা ও শয়তানী প্রবণতার অনুসরণে অর্জিত হয়, সেহেতু এ ধরনের স্বাধীন নির্বাচনাধীন অধঃপতনও সঙ্গত কারণেই প্রভুর ইরাদার বিষয়ে পরিণত হয়।
আবার যেহেতু সচেতনভাবে নির্বাচন করার জন্যে ভাল ও মন্দ পথগুলোর সঠিক পরিচিত প্রয়োজন সেহেতু মহান আল্লাহ্ মানুষকে যা কিছু তার কল্যাণ ও সৌভাগ্যের কারণ, তার প্রতি আহ্বান করেছেন এবং যা কিছু অধঃপতন ও অকল্যাণের কারণ, তা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে পূর্ণতার পথ সুগম হয়। অনুরূপ যেহেতু আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব মানুষকে তার কর্মফলে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছে এবং তা মহান আল্লাহর জন্যে কোন কল্যাণ (বা অকল্যাণ) বয়ে আনে না, সেহেতু প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল বান্দার ক্ষমতানুযায়ী দায়িত্ব প্রদান করা। কারণ যে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব, সে দায়িত্ব অর্পণ করাটা হবে অনর্থক ও অহেতুক কর্ম।
অতএব আদলের প্রথম পর্যায় (বিশেষ অর্থে) অর্থাৎ দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা, এ যুক্তিতে প্রতিপাদিত হয় যে, যদি মহান আল্লাহ বান্দাগণের ক্ষমতাতিরিক্ত দায়িত্ব তাদেরকে প্রদান করেন, তবে ঐ দায়িত্ব সম্পাদন অসম্ভব হবে এবং এটি একটি অনর্থক কর্ম বলে পরিগণিত হবে। (অথচ মহান আল্লাহ্র প্রজ্ঞার দাবি হল তিনি অনর্থক কোন কর্ম সম্পাদন করেন না)।
আবার বান্দাগণের মধ্যে বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা, এর উপর ভিত্তি করে প্রমাণিত হয় যে, এ বিচারকর্ম বিভিন্ন প্রকার পুরস্কার ও শাস্তির ক্ষেত্রে বান্দাগণের অধিকার নির্ধারণের জন্যে সম্পাদিত হয়। যদি এ কর্ম ন্যায়নীতির পরিপন্থি হয় তবে উদ্দেশ্যহীন কর্ম বলে পরিগণিত হবে। (অথচ প্রজ্ঞাবান আল্লাহর পক্ষে উদ্দেশ্যহীন কর্ম সম্পাদন অসম্ভব, কারণ সেটা তাঁর প্রজ্ঞার পরিপন্থী)।
অবশেষে পুরস্কার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা, সৃষ্টির চূড়ান্ত উদ্দেশ্যের আলোকে প্রমাণিত হয়। কারণ যিনি মানুষকে তার সুকর্ম ও কুকর্মের প্রতিফল প্রদানের জন্যে সৃষ্টি করেছেন, যদি তিনি তাদেরকে তাদের লভ্য ও প্রাপ্তির ব্যতিক্রম কোন পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করেন তবে তা তাঁরই উদ্দেশ্যকে ব্যহত করবে।
অতএব প্রভুর ন্যায়পরায়ণতার সর্বজনস্বীকৃত ও সঠিক দলিল হল এই যে, তাঁর সত্তাগত গুণই প্রজ্ঞাপূর্ণ ও ন্যায়পরায়ণ কর্মের কারণ এবং অত্যাচার, অবিচার অথবা অনর্থক ও অহেতুক কর্মের দাবিদার কোন গুণই তাঁর অস্তিত্বে বিরাজ করে না।
মূল: আয়াতুল্লাহ মিসবাহ ইয়ায্দি
অনুবাদ: মোহাম্মাদ মাঈন উদ্দীন
সম্পাদনা ও সঙ্কলন: আবুল কাসেম