(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
প্রথম মৌলনীতি : স্বাধীনতা এবং ইসলামী সমাজের মর্যাদা
আমাদেরকে কয়েকটি মৌলনীতির প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমে আমাদের দেখা উচিত যে, ইসলাম কোন্ ধরনের সমাজ চায়? ইসলাম এমন একটি সমাজ চায় যা হবে মর্যাদাসম্পন্ন, স্বাধীন এবং আত্মনির্ভরশীল। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম এমন অবস্থাকে মেনে নেয় না যে, মুসলিম জাতি কোন অমুসলিম জাতির অধীনে থাকবে : ‘এবং আল্লাহ্ অবিশ্বাসীদের জন্য বিশ্বাসীদের ওপর (আধিপত্যের) কোন পথ দেন না।’ (সূরা নিসা : ১৪১)
ইসলাম এও মেনে নেয় না যে, মুসলিম জাতি অন্য কোন জাতির কাছে সবসময় সাহায্যের জন্য আবেদন জানাবে। উপরন্তু তা এরও অনুমতি দেয় না যে, ইসলামী সমাজের কোনরূপ অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা থাকবে না। ইসলাম কখনই এটি মেনে নিতে পারে না যে, মুসলমানরা ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে অথচ কোন মুসলিম ডাক্তার থাকবে না অথবা মুসলমানদের নিজস্ব চিকিৎসা সেবা থাকবে না; অথবা তারা অসুস্থতায় ভুগবে এবং অমুসলিমদের শরণাপন্ন হবে। আর এ বিষয়গুলোই একটি মৌলনীতিকে প্রতিপাদন করে।
দ্বিতীয় মৌলনীতি : সকল মর্যাদার ভিত্তি হবে জ্ঞান এবং অনির্ভরশীলতা
আরেকটি মৌলনীতি হলো, বিশ্বে একটি বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তাই সকল বিষয় জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই সম্পাদিত হচ্ছে এবং জ্ঞানের ওপর নির্ভর করেই জীবন টিকে আছে। মানব জীবনের সকল দিক জ্ঞানের ওপরই নির্ভর করে এবং এগুলোর কোন কিছুই জ্ঞান ছাড়া সম্পন্ন হতে পারে না।
তৃতীয় মৌলনীতি : অন্যান্য ফরয পালনের চাবিকাঠি হিসাবে জ্ঞান
অন্যান্য আবশ্যিক দায়িত্ব এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক ইসলামী দায়িত্ব পালন নির্ভর করে জ্ঞান অর্জনের ওপর। জ্ঞান অর্জন অন্যান্য আবশ্যিক দায়িত্ব ও ইসলামী বিষয় সম্পাদন করার চাবিকাঠি হিসাবে পরিচিত-ইসলামী আইনশাস্ত্রে যাকে ‘প্রাথমিক বাধ্যবাধকতা’ বলা হয়েছে। সুতরাং যদি মুসলমানদের অবস্থার উন্নতি হয় এবং বিজ্ঞান থেকে তারা আরও অধিক লাভবান হয় তাহলে জ্ঞান অর্জন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এবং এর ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত করবে।
জ্ঞান অর্জনের বিষয়টি আইনশাস্ত্রে এবং এর মৌলনীতির অনেক জায়গায় আলোচিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আইনশাস্ত্রের নীতিমালায় (উসূলে ফিক্হ) যখন ‘দায়মোচন’ (আল বারাআহ) সংক্রান্ত নীতিমালা আলোচনা করা হয় তখন তাঁরা কারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন। এখানে তাঁরা জ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা করেন। আইনশাস্ত্রে (আল ফিক্হ) যখন ‘ব্যবসায়ের ব্যবহারিক নীতি সম্পর্কিত শরীয়তের আইন-কানুন জানার গুরুত্ব (তাকীদ) বা বাধ্যবাধকতা’ নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন আইনজ্ঞরা জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন। যখন আইনজ্ঞরা ফরয কাজ সম্পাদনের জন্য পারিশ্রমিক নেওয়ার অনুমোদনের বিষয়টি অধ্যয়ন করেন তখনও জ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা করেন।
ধর্মীয় এবং ইহজাগতিক জ্ঞান
এটি আমাদের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে, বিজ্ঞানের কতিপয় বিষয়কে ধর্মীয় এবং অপর কতিপয় বিষয়কে ইহজাগতিক হিসাবে গণ্য করা। ধর্মীয় বিজ্ঞান হলো যেগুলো সরাসরি ধর্মতত্ত্ব, নৈতিকতা অথবা ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত অথবা যেগুলো ইসলামী জ্ঞান, ফরয বিষয়াদি এবং বিধিবিধান শিক্ষা করার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রয়োজনীয়। যেমন আরবি সাহিত্য এবং যুক্তিবিদ্যা। কিছু সংখ্যক ব্যক্তি চিন্তা করতে পারে যে, অন্যান্য জ্ঞানের সাথে ধর্মের তেমন কোন সম্পর্ক নেই এবং ইসলাম জ্ঞানের মর্যাদা সম্পর্কে এবং জ্ঞান অর্জনের পুরস্কার সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে তা কেবল ধর্মীয় জ্ঞান সম্পর্কিত এবং ‘জ্ঞান অর্জন করা ফরয’ দ্বারা মহানবী (সা.) সেই জ্ঞানকেই বুঝিয়েছেন যাকে ‘ধর্মীয় জ্ঞান’ বলা হয়।
আসলে এটি একটি মোড়ক ছাড়া আর কিছুই নয়। একটি দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মীয় জ্ঞান হলো কেবল প্রাথমিক মূল গ্রন্থ অর্থাৎ কুরআন এবং মহানবী (সা.) অথবা তাঁর প্রসিদ্ধ সাহাবীদের সহীহ হাদীস। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যখন মানুষ এর সাথে পরিচিত ছিল না, তখন এটি সবার জন্য ফরয ছিল যে, সবচেয়ে আগে উল্লিখিত প্রাথমিক বিষয়গুলো সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করবে। সে সময়ে ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, ইসলামের ইতিহাস অথবা অন্য কোন বিষয় ছিল না। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘প্রকৃতপক্ষে, জ্ঞান তিন প্রকার : (কুরআনের) সুস্পষ্ট আয়াত, ন্যায়ানুগ ফরযসমূহ এবং সরল হাদীস।১ অর্থাৎ জ্ঞান হলো কেবলই কুরআনের আয়াতসমূহ, মহানবী (সা.)-এর হাদীসসমূহ এবং ব্যবহারিক নিয়মকানুন শিক্ষা করা। পরবর্তীকালে মুসলমানরা কুরআন ও হাদীসের সেসব প্রাথমিক বিষয়ের সাথে পরিচিতি লাভ করে যেসব হলো ইসলামের সংবিধানসদৃশ; আর এগুলোর নির্দেশ অনুসারেই জ্ঞান অর্জনকে বাধ্যতামূলক মনে করে এবং ধীরে ধীরে কতিপয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রতিটি জ্ঞান যা মুসলমানদের জন্য উপকারী এবং মুসলমানদের সমস্যার সমাধান করে তা ধর্ম অনুসারে অবশ্যই অর্জন করতে হবে এবং এটি একটি ধর্মীয় জ্ঞান। কেন আমরা আরবি ব্যাকরণ এবং শব্দমালাকে ধর্মীয় জ্ঞান হিসাবে মনে করি? এটি কি এজন্য যে, এসব ইসলামের উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে উপকারী? কেন আমরা ইমরুল কায়েসের রোমান্টিক কবিতা এবং মদ্যপ আবু নুওয়াসের কবিতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করি? নিশ্চয়ই এগুলো আমাদেরকে আরবি ভাষা বুঝতে সাহায্য করে যে ভাষা হলো কুরআনেরই ভাষা।
সুতরাং যে কোন জ্ঞান যা ইসলামের জন্য উপকারী এবং প্রয়োজনীয় তাকে অবশ্যই ধর্মীয় জ্ঞান হিসাবে বিবেচনা করতে হবে এবং যদি কারও পবিত্র অভিপ্রায় থাকে এবং ইসলামের সেবা করার উদ্দেশ্যে সেই জ্ঞান অর্জন করে তাহলে জ্ঞান অর্জন সম্পর্কিত হাদীসে উল্লিখিত পুরস্কারগুলো সে পাবে : ‘নিশ্চয়ই, ফেরেশতারা জ্ঞান অন্বেষণকারীদের (পায়ের) নিচে তাদের ডানাগুলো বিছিয়ে দেয়।’২ কিন্তু বিশুদ্ধ অভিপ্রায় ছাড়া কুরআনের আয়াত শিক্ষা করলেও কোন পুরস্কার পাওয়া যাবে না।
সর্বোপরি, এটি ঠিক নয় যে, আমরা সকল জ্ঞানকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে ফেলব : ধর্মীয় এবং ইহজাগতিক-যা কোন কোন মানুষকে এটি ভাবতে বাধ্য করবে যে, ইহজাগতিক জ্ঞানগুলো ইসলামের বহির্ভূত বিষয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হলো মহান আল্লাহর ব্যাপক এবং চূড়ান্ত বাণী যা দাবি করে যে, ইসলামী সমাজের জন্য উপকারী ও প্রয়োজনীয় সকল জ্ঞানকে অবশ্যই ধর্মীয় জ্ঞান বলে বিবেচনা করতে হবে।
নারী শিক্ষা
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, জ্ঞান অর্জন কেবল পুরুষের জন্যই নয়। যেহেতু মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব’ এবং এখানে যে ‘মুসলিম’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে তা একটি পুরুষবাচক শব্দ, তাই কেউ কেউ মনে করতে পারে যে, জ্ঞান অর্জন কেবল পুরুষের জন্যই বাধ্যতামূলক।
প্রথমত, শিয়া সূত্রে এ হাদীসের অন্যান্য বর্ণনায় ‘ওয়া মুসলিমাহ’ (এবং মুসলিম নারী) শব্দগুলোও যুক্ত রয়েছে। দ্বিতীয়ত এমন শব্দের ব্যবহার কোন নির্দিষ্ট লিঙ্গের জন্যই প্রযোজ্য হওয়াকে বোঝায় না। আরবিতে যখন ‘মুসলিমাহ’ শব্দের বিপরীতে ব্যবহার ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধারণভাবে শুধুই ‘মুসলিম’ শব্দটির ব্যবহার করা হয় তখন এটি মুসলিম নর এবং মুসলিম নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি হাদীসে বলা হয়েছে : ‘মুসলিম হলো সে-ই ব্যক্তি যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্যান্য মুসলিম নিরাপদ,’৩ নিশ্চয়ই এর অর্থ এ নয় যে, কেবল পুরুষ মুসলমানরাই এমন বৈশিষ্ট্যের হবে। অন্যত্র মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘মুসলমানরা একে অপরের ভাই।’৪ এখানে কেউ বলতে পারবে না যে, এ হাদীসটি কেবল পুরুষদের সম্পর্কে; কারণ, তিনি বলেননি যে, ‘মুসলমান নারীরা একে অপরের বোন।’
আরবিতে ‘মুসলিম’ পরিভাষাটির দু’টি ব্যবহার রয়েছে : মুসলমান হওয়া এবং পুরুষ হওয়া। প্রত্যেকেই জানে যে, এমন ক্ষেত্রে লিঙ্গের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং মুসলমান হওয়াটি গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি ‘মুসলিম’ শব্দের পরিবর্তে ‘রাজুল’ (আরবিতে যার অর্থ পুরুষ) শব্দটি ব্যবহৃত হলেও লিঙ্গের ব্যাপারটি উপেক্ষা করা যেতে পারে। এটিকেই আইনজ্ঞরা বলেন, ‘ইলগা আল খুসুসিয়্যাহ্’ (বিশেষত্বকে বিবেচনা না করা)। বিচারিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে কতিপয় হাদীস রয়েছে যেখানে পুরুষকে সম্বোধন করা হয়েছে; যেমন কোন একজন ইমামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, একজন পুরুষ এমন একটি কাজ করেছে এবং এমন একটি ঘটনা ঘটেছে; এখন সে কী করবে? ইমাম সেই প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। আইনজ্ঞরা বলেন যে, যদিও হাদীসে ‘পুরুষ’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু এমন ক্ষেত্রে বিশেষত্বের ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করতে হবে। কারণ, এটি নিশ্চিত যে, উপসংহারে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে লিঙ্গ কোনই প্রভাব ফেলবে না।
উপরন্তু আইনশাস্ত্রে একটি নিয়ম রয়েছে যে, সাধারণভাবে বলা কোন বিষয়ে কোন প্রতিবন্ধকতা বা পরিবর্তন থাকে না। উদাহরণ স্বরূপ, জ্ঞান সম্পর্কে উল্লেখ করা বিষয়ের মতো একই রকম একটি বিষয় কুরআনে এসেছে তাকওয়া (খোদাভীতি বা দায়িত্বসচেতনতা) সম্পর্কে। জ্ঞান সম্পর্কে কুরআন বলে : ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান? কেবল বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই উপদেশ গ্রহণ করে।’
তাকওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘যারা বিশ্বাস করেছে এবং সৎকর্ম করেছে আমরা কি তাদেরকে যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তাদের সমান গণ্য করব? অথবা তাকওয়ার অধিকারীদের অবাধ্যদের সমান গণ্য করব?’ (সূরা সাদ : ২৮) এবং আরও বলা হয়েছে : ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত যে অধিক সাবধানী (আত্মসংযমী)’ (সূরা হুজুরাত : ১৩) এ সকল উদাহরণে সর্বনামগুলো পুরুষবাচক এবং এটি বলা হয়নি যে, আমরা কি তাকওয়ার অধিকারী পুরুষ এবং তাকওয়ার অধিকারিণী নারীকে এমন গণ্য করব এবং এটিও বলেনি : আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সেই নারী যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়ার অধিকারিণী। কেউ কি এই দাবি করতে পারে যে, যেহেতু আয়াতে পুরুষ সর্বনাম ব্যবহার করা হয়েছে, তাই তাকওয়া সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা কেবল পুরুষের সাথেই সম্পর্কিত, নারীর সাথে নয়?
ইসলাম জ্ঞানকে আলো এবং অজ্ঞতাকে অন্ধকার মনে করে, যেমনটি কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে : ‘বল, চক্ষুষ্মান ও দৃষ্টিমান কি সমান? অথবা অন্ধকার ও আলো কি সমান?’ (সূরা রাদ : ১৬) অতএব, যখন মহানবী (সা.) বলেন : ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব’৫ তখন তা সকল মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক। কেউ কি এটি ধারণা করতে পারে যে, ইসলামে কেবল পুরুষেরই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এবং আলোতে আসার অনুমতি আছে, কিন্তু নারীরা অন্ধকারেই অবস্থান করবে? অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসা কেবল পুরুষের জন্যই বাধ্যতামূলক, কিন্তু নারীরা এমন অন্ধকারেই অবস্থান করবে?
সূরা যুমারের ৯ নং আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে : ‘কেবল বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই উপদেশ গ্রহণ করে।’ এর অর্থ হলো যারা জ্ঞানের অধিকারী তাঁরাই এমন বিষয় সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞাত। বস্তুত, কুরআন বলতে চাচ্ছে যে, এমন বিষয় হলো স্পষ্ট এবং প্রত্যেকেই তা বুঝতে পারে। মহানবী (সা.) সম্পর্কে অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে : ‘...যে তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং গ্রন্থ (শরীয়তের বিধান) ও প্রজ্ঞা শিক্ষাদান করে... (সূরা জুমুআ : ২)। এ আয়াতে পরিশুদ্ধ করা এবং শিক্ষাদান একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর সবগুলোই পুরুষবাচক নির্দেশক। যদি ‘তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে’ বাক্যটি কেবল পুরুষের জন্যই প্রযোজ্য হতো, তাহলে ‘তাদের শিক্ষা দেয়’ বাক্যটিও কেবল পুরুষের জন্যই নির্দিষ্ট হতো।
এটি কার ভুল?
এসব মন্তব্য শুনে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি এ কথা বলতে পারে যে, ‘তাহলে কি তুমি বলছ যে, আমাদের কন্যারা বর্তমানে যেসব স্কুল রয়েছে সেসব স্কুলে যাবে এবং এই (বিধর্মী) সংস্কৃতি শিখবে?’ এর উত্তর হলো : যদি এসব স্কুল এবং সংস্কৃতি নিয়ে কোন সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে এটি জনসাধারণের দোষ; কারণ, তারা সেগুলোকে সংস্কার করেনি। ইসলাম ধর্ম জ্ঞান অর্জন বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের জন্য প্রস্তুতিকেও বাধ্যতামূলক বিবেচনা করেছে এবং মানুষকে বাড়িতে বসে থাকা এবং অপেক্ষা করার অনুমতি দেয়নি যে, কখন স্কুলগুলো তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য শতভাগ উত্তম হবে এবং তারপর তারা তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠাবে। ইসলাম মানুষকে বর্তমান অবস্থাকে উন্নীত করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া ব্যতিরেকে সমালোচনা করার অনুমতি দেয় না। আমরা উন্নত সংস্কৃতিসম্পন্ন স্কুল তৈরি করতে বাধ্য। বস্তুত যে ব্যক্তি সংস্কৃতি নির্মাণে ছোটখাটো পদক্ষেপও নেয়নি, যে ব্যক্তি একটি সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজ প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করেনি এবং যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের আবশ্যিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একটি পদক্ষেপও নেয়নি, তার বসে বসে সমালোচনা করার কোন অধিকারই নেই। সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে যখন এমন সমালোচকরা সংস্কৃতি সম্পর্কিত তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেনি।
এটি লক্ষ্য করা প্রয়োজন যে, বিশেষায়ণের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীদেরকে সেই বিষয়গুলোতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে যেগুলো তাদের সামর্থ্য ও মেধার সাথে সবচেয়ে বেশি সামঞ্জস্যশীল হয় এবং সমাজকে তারা অধিক সেবা দিতে পারে। কেউ কি বলতে পারে যে, সমাজের কোন মহিলা ডাক্তার অথবা সার্জন অথবা ধাত্রীর প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যখন নারী শিক্ষার বিষয়টি আলোচিত হয় তখন কেউ কেউ এর সমালোচনা করে, কিন্তু প্রয়োজনের মুহূর্তে নারীদেরকে পুরুষ চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হয়, এমনকি চিকিৎসা বা অপারেশনের জন্য বিধর্মীদেরও শরণাপন্ন হতে হয়।
পবিত্র সংগ্রাম
উপরোল্লিখিত সকল বিষয়ের ফলাফল হলো এই যে, বর্তমানে বাধ্যতামূলক সকল বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাধারণ শিক্ষায় অংশগ্রহণ করা। এই বাধ্যবাধকতা যারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত কেবল তাদেরই দায়িত্ব নয়; বরং প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব এবং যে মুসলমান হওয়ার দাবি করে তারও-সে সরকারের সদস্য হোক অথবা জাতির। এমন দায়িত্ব একটি পবিত্র সংগ্রাম হিসাবে এবং ধর্মীয় ভাবে আঞ্জাম দেয়া উচিত। তাই ধর্মীয় পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গকে অবশ্যই এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মুমিনদের এবং ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিদের স্কুল ও বিজ্ঞানকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই এবং এমন চিন্তা করারও কোন কারণ নেই যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবির্ভাবে ধর্ম বিলীন হয়ে যাবে। এ ধারণা ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতিকে প্রকাশ করে। কিন্তু ইসলাম হলো এমন একটি ধর্ম যা অজ্ঞতা নয়; বরং বৈজ্ঞানিক পরিবেশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। যদি আমরা জানতাম যে, অজ্ঞতা আমাদের এবং ইসলামের প্রতি কী করেছে, তাহলে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও স্কুলের চেয়ে অজ্ঞতা ও অশিক্ষাকেই বেশি ভয় করতাম।
যখন আপনি জ্ঞান অর্জন করবেন
কখনও কখনও আমরা লক্ষ্য করি যে, কিছু সংখ্যক মানুষ জ্ঞানের ভীতিকে গোপন করার জন্য সানাঈর কবিতা পাঠ করে। সেই কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি হলো :
‘তুমি জ্ঞান অর্জন করেছ যখন
ভয় কর রাত্রিতে তখন
যদি আলো নিয়ে আসে কোন তস্কর
অধিকতর উত্তম জিনিস করে নির্বাচন।’
এরপর তারা বলে : ‘দেখ! দেশের জন্য এসব স্কুলের লোকদের ক্ষতি করার পরিমাণ অশিক্ষিত লোকদের ক্ষতির চেয়ে শতগুণ বেশি। অশিক্ষিত লোকজন মূল্যহীন জিনিস চুরি করতে পারে, কিন্তু এসব স্কুলের লোকেরা লক্ষ লক্ষ তুমান (ইরানী মুদ্রা) চুরি করে।
এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, বিজ্ঞান নিজেই একটি সমৃদ্ধ সমাজের গ্যারান্টি নয়। একটি সমাজের জন্য ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসেরও প্রয়োজন। যদি ধর্মবিশ্বাস জ্ঞান দ্বারা সমর্থিত না হয়, তাহলে এটি উপকারে আসবে না; বরং এটি একটি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘দু’ধরনের লোক আমার পৃষ্ঠ ভেঙে দিয়েছে : শিক্ষিত লোক-যাদের কোন ধর্ম নেই এবং ধার্মিক লোক-যাদের কোন জ্ঞান নেই।’৬ ইসলাম অধার্মিক পণ্ডিত ব্যক্তিও চায় না আবার মূর্খ ধার্মিকও চায় না।
‘যদি চোর আলো নিয়ে আসে, তাহলে অধিকতর উত্তম জিনিস নির্বাচন করে’-ধর্মবিশ্বাসহীন শিক্ষিতজনের ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে এই বাক্য ব্যবহার করে এ উপসংহারে উপনীত হওয়া যে, মূর্খতার চেয়ে জ্ঞান আরও বেশি বিপজ্জনক-এটি একটি মিথ্যা বিশ্বাস। কারণ, যে চোর আলো হাতে আসে এবং উত্তম জিনিস চুরি করে সে রাতের বেলায় আসে, দিনে নয়। সে রাতে আসে যখন গৃহকর্তা ঘুমিয়ে থাকে। সে দিনের বেলায় অথবা যখন গৃহকর্তা জেগে থাকে তখন চুরি করতে পারে না। ধর্মবিশ্বাসহীন শিক্ষিতজন অন্যের অজ্ঞতা এবং ঘুমন্ত অবস্থাকে চুরির জন্য ব্যবহার করে। সর্বসাধারণ অজ্ঞতাই এমন বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী। তাই আপনাদের দেশকে জ্ঞানের আলো দ্বারা আলোকিত করুন, প্রতিটি বাড়িকে দিনের মতো আলোকিত করুন, সবাইকে জাগ্রত করুন, সকল জায়গা আলোকিত করুন এবং বিশ্বাসের খুঁটিগুলোকে শক্তিশালী করুন। আর তাহলে সেই চোর চুরি করতে সক্ষম হবে না। যে কারণগুলো চোরের কাজকে সহজতর করে দেয় সেগুলো হলো চোরের জ্ঞান, তার ধর্মবিশ্বাসহীনতা এবং সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অজ্ঞতাও দায়ী।
যা হোক, যদি আমরা একটি খাঁটি ধর্ম চাই, দারিদ্র্য ও অসুস্থতা থেকে মুক্তি চাই, নিজেদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা আনয়ন এবং সামাজিক বিষয়াদিতে আমাদের সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে চাই, তাহলে কেবল একটি পথই রয়েছে, আর সেটি হলো জ্ঞান অর্জন-যা অবশ্যই সর্বব্যাপী হবে এবং আগাগোড়া ধর্মের একটি পবিত্র সংগ্রাম হবে।
যদি আমরা এ পবিত্র সংগ্রাম শুরু না করি, তাহলে বিশ্ব করবে এবং এর দ্বারা উপকৃত হবে। অন্যেরা আমাদের জাতিকে শিক্ষিত করার জন্য আসবে এবং আল্লাহ্ জানেন যে, আমাদের অবহেলা ইসলামের জন্য কী ক্ষতিই না ডেকে আনবে!
অজ্ঞতার বিরুদ্ধে মানুষ
‘অজ্ঞতার বিরুদ্ধে মানুষ’৭ গ্রন্থটি অনুন্নত দেশগুলোর লোকজনকে শিক্ষিত করার জন্য ইউনেস্কোর কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন দিয়েছে। যদিও এটি দেখে ভাল লাগছে যে, মুসলিম সমাজ থেকে ধীরে ধীরে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য এবং শিক্ষার উন্নয়নে মুসলমানদের মধ্যে নানা উপায়-উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে, কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমরা মুসলমানরা আমাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছি এবং অন্যরা বিদেশ থেকে আসছে এবং আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে তারা সচেষ্ট হচ্ছে এবং তারা কেবল সাধারণ শিক্ষারই উন্নয়ন ঘটাচ্ছে না; বরং সেবামূলক ও স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে; মানুষকে অসুস্থতা থেকে সারিয়ে তুলছে, জলাভূমিগুলোকে ভরাট করছে, ম্যালেরিয়ার মূলোৎপাটন করছে এবং শহর ও গ্রামগুলোকে পুনর্গঠিত করছে। তারা এমন সব জায়গায় যাচ্ছে যেখানে আমরা কখনই যাইনি। যেমন পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মতো দেশে দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে তারা যাচ্ছে এবং সেবা প্রদান করছে।
গ্রন্থটিতে যে পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কয়েক বছর আগেও শতকরা ৯৬ ভাগ মুসলিম দেশ অশিক্ষিত ছিল। অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং নিরক্ষরতার হার কমে এসেছে। গত দুই বছরে এশিয়া মহাদেশের ইউনেস্কোর প্রতিনিধিরা করাচিতে সম্মেলনে মিলিত হন এবং এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি বিশসালা শিক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করেন। এ পরিকল্পনা তৈরি করা হয় নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এবং সম্ভাব্য সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধাকে বিবেচনায় রেখে। তাঁরা জনগণের মধ্যে এ ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছেন।
তাদের এ কর্মকাণ্ডের পেছনে কী অভিপ্রায় রয়েছে সে আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। হতে পারে এর পেছনে তাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা কাজ করছে! আমাদের জন্য আফসোস! যদি এমন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তি অনুপ্রবেশ করে তাহলে আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে যাবে! যদিও আমরা তাদের সত্যিকার অভিপ্রায় জানি না, কিন্তু হতাশা প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের ভুলের ওপর একটি কালো পোশাক পরানোর কোন প্রয়োজন নেই। নিজেদের দোষ-ত্রুটি ঢাকার জন্য অন্যের কর্মকাণ্ড ও অভিপ্রায়কে অমঙ্গলজনক হিসাবে ব্যাখ্যা করার একটি বদ অভ্যাস আমাদের রয়েছে। ইউনেস্কো কর্তৃক প্রকাশিত এই গ্রন্থে লেখা হয়েছে যে, একটি আফ্রিকান দেশে, একটি গোঁড়া জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী তাদেরকে এই বলে অভিযুক্ত করেছে যে, তোমরা ইউরোপীয়রা অনুধাবন করেছ যে, তোমাদের ঔপনিবেশিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং তোমাদের রাজনৈতিক শক্তিও হ্রাস পেয়েছে, আর তাই তোমরা দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সেবার পেছনে তোমাদের আসল চেহারা লুকিয়ে রেখে কাজ করছ।
তাদের অভিপ্রায় যা-ই হোক না কেন, এটি আমাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক। আমাদের কাছে যেটি বিবেচ্য সেটি হলো, আমরা বুঝি যে, যদি গত বিশটি বছরে তারা ইসলামী দেশগুলোর জনগণকে শিক্ষিত করার ব্যাপারে সফল হয় এবং তাদেরকে অজ্ঞতা, দারিদ্র্য ও রোগ থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম হয়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম ইসলাম সম্পর্কে এবং নিজেদের মুসলমান হওয়া সম্পর্কে কী অনুভব করবে? তারা কি আমাদের বলবে না যে, আমরা মুসলমান ছিলাম এবং চৌদ্দশ বছর যাবৎ আমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর ধর্মের অনুসারী ছিলাম এবং অজ্ঞতা ও দুরবস্থার মধ্যে ছিলাম যতক্ষণ না বিশ্বের অপর প্রান্ত থেকে অন্যরা হাত বাড়িয়ে দেয় এবং আমাদের উদ্ধার করে? তখন ইসলামের সুনামের কতটুকুই আর অবশিষ্ট থাকবে? আর আমরাই বা কী জবাব দেব যদি মুহাম্মাদ (সা.) আমাদের এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন : ‘তোমরা কি আমার এ আদেশ পালন করেছিলে : প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরয?’৮
এটি একটি স্বাভাবিক এবং আধ্যাত্মিক নীতি যে, ‘মানুষ বদান্যতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে।’ মহানবীও বলেছেন : ‘যদি কেউ একটি পতিত যমিনকে পুনরুজ্জীবিত ও আবাদ করে, এটা তার হবে।’ যদিও এটি যমিন সংক্রান্ত একটি আইন, কিন্তু অন্যান্য বিষয় সম্পর্কেও এটি সত্য। যে কেউ আবির্ভূত হয়ে একটি জাতিকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং তাদেরকে বিপর্যয়, দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা থেকে উদ্ধার করে, সে তাদের হৃদয়, আত্মা ও বিশ্বাস জয় করে নেয়।
তাই বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে আমরা নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে, আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকারী নই। কেউ হয়ত বলতে পারে যে, একজন মুসলমান কখনই অন্য ধর্ম গ্রহণ করবে না, বিশেষ করে যদি লোকজন শিক্ষিত হয়, তাহলে সে কখনই একেশ্বরবাদী থেকে অন্য কিছুতে পরিবর্তিত হবে না। আমি বলছি যে, এটি এমন হতে পারে, কিন্তু যে বিষয়টি নিশ্চিত তা হলো যদি তারা ধর্মান্তরিত নাও হয়, তবু তারা ইসলামের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে এবং সম্ভবত কমিউনিস্টরা এ থেকে লাভবান হবে।
যদি মুসলিম দেশগুলোতে যুবকরা ইসলামের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে, তাহলে কেবল কমিউনিস্টরা এ থেকে লাভবান হবে। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই এ বিপদকে এড়িয়ে যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে? এটি কি সব সময়ের মতো একইভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে অথবা একটি শোরগোল তুলে এবং চিৎকার করে যে, মুসলমানদের শিক্ষা দেওয়ার কোন অধিকার ইউনেস্কোর নেই অথবা এজন্য সংগ্রাম ও অর্থ খরচ করে? তাহলে তাদের সাথে কী করতে হবে?
আপনি কি মনে করেন যে, এমন আচরণ করা যথাযথ হবে? আমরা কি বর্তমান যুগে এমনটি গ্রহণ করব? মুসলিম জাতি কি আমাদের কাছ থেকে এটি গ্রহণ করবে? নাকি সমাধানের পথ হলো এই যে, আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করব এবং একটি পবিত্র সংগ্রাম শুরু করব এবং আমাদের দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে পালন করব? সেই গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে যে, সবচেয়ে মুসলিম জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ায় সাধারণ শিক্ষাকে একটি পবিত্র সংগ্রাম হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং জনগণ ধর্মের অন্যান্য দায়িত্বের মতো এটিও আঞ্জাম দেয়। ইন্দোনেশিয়াতে যে কেউ কোন কাজ সম্পর্কে জানে এবং একটি চাকুরি করে, সে এটি তার দায়িত্ব মনে করে যে, সে কোন স্কুলে যাবে এবং ঐ কাজটি শিক্ষা দেবে। কারণ, সেখানে সকল স্কুলের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষক নেই। এটিই ইসলামের নির্দেশ যা জ্ঞান অর্জনকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করেছে। সেই নির্দেশেরই বর্তমান রূপ ইন্দোনেশিয়াতে এভাবে পালন করা হচ্ছে।
সেবা প্রদান এবং উত্তম হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা
সূরা মায়েদার ৪৮ নং আয়াতে পবিত্র কুরআন, পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থসমূহ এবং ঐশী ধর্মের বর্ণনা দেওয়ার পর বলা হয়েছে :
‘... আমরা তোমাদের প্রত্যেকের জন্য (কালের দাবি অনুযায়ী) পৃথক পৃথক শরীয়ত ও বিশেষ পথ নির্ধারণ করেছি; আর যদি আল্লাহ্ চাইতেন তবে তোমাদের সকলকে এক জাতির অন্তর্ভুক্ত করে দিতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের (স্বীয় বিধান থেকে) যা দিয়েছেন তার মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করতে চান। সুতরাং তোমরা কল্যাণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী হও...’
মনে হয় যে, এই আয়াত এটিকে বুদ্ধিদীপ্ত মনে করে যে, জাতিসমূহ একে অপর থেকে ভিন্নরূপ হয় এবং এর অর্থ এটি হতে পারে যে, যেন এক জাতি অন্য জাতির সাথে আরও উত্তম কাজ এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করে এবং এভাবে চেষ্টা করে যাতে উপযুক্ত জাতি প্রতিযোগিতায় বিজয় লাভ করে। আর এই আয়াত মুসলমানদেরকে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ পদক্ষেপ নিতে এবং উত্তম কাজের জন্য প্রতিযোগিতা করে জয় লাভ করতে নির্দেশ দেয়।
সুতরাং ইউনেস্কোকে পরিহার করা উল্লিখিত বিপদকে এড়িয়ে চলার পথ নয়। সেই বিপদকে পরিহার করার পথ হলো আমরা কাজের সূচনা করব এবং জয়ী হব। আর আমি পুনরায় বলছি যে, যতক্ষণ না আমরা এটিকে একটি পবত্রি সংগ্রাম হিসাবে বিবেচনা করব এবং ধর্মীয় পণ্ডিতরা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন না করবেন এবং অন্য সকল বিষয় অপেক্ষা একে অগ্রাধিকার না দেবেন ততক্ষণ পর্যন্ত এটি ফলপ্রসূ হবে না।
জ্ঞানের মর্যাদা সম্পর্কে ইসলাম যা বলেছে সে ব্যাপারে আমি আলোচনা করতে পারতাম এবং ইসলাম সম্পর্কে কিছু প্রচারণা চালাতে পারতাম, কিন্তু আমি শুরুতেই বলেছি যে, আমি এমন প্রচারণায় বিশ্বাসী নই এবং আমি মনে করি, সেগুলো কোন কাজে আসে না; বরং আমি আমাদের বর্তমান অবস্থা এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি। এক ব্যক্তি কেবল তখনই গর্বভরে বলতে পারে যে, ইসলাম বলেছে : ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা বাধ্যতামূলক’,৯ যখন আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কিছু করতে পারব এবং এই পবিত্র সংগ্রাম ও অগ্রগতিতে অংশীদার হতে পারব।
অনুবাদ : মিকদাদ আহমেদ
তথ্যসূত্র :
১. উসূলে কাফী, শেখ মুহাম্মাদ কুলাইনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২
২. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪
৩. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৪
৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৬
৫. উসূলে কাফী, শেখ মুহাম্মাদ কুলাইনী
৬. বিহারুল আনওয়ার, আল্লামা মাজলিসী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১১
৭. রিচী কালদার, প্যারিস, ইউনেস্কো (সোলিউর, গাসম্যান কর্তৃক প্রকাশিত)
৮. উসূলে কাফী, শেখ মুহাম্মাদ কুলাইনী
৯. প্রাগুক্ত
(প্রত্যাশা,২য় বর্ষ,৪র্থ সংখ্যা)