সূরা ইউনুস; আয়াত ২৪-২৭
সূরা ইউনুসের ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّمَا مَثَلُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ مِمَّا يَأْكُلُ النَّاسُ وَالْأَنْعَامُ حَتَّى إِذَا أَخَذَتِ الْأَرْضُ زُخْرُفَهَا وَازَّيَّنَتْ وَظَنَّ أَهْلُهَا أَنَّهُمْ قَادِرُونَ عَلَيْهَا أَتَاهَا أَمْرُنَا لَيْلًا أَوْ نَهَارًا فَجَعَلْنَاهَا حَصِيدًا كَأَنْ لَمْ تَغْنَ بِالْأَمْسِ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
“পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত বৃষ্টির ন্যায় যা আমি আকাশ হতে বর্ষণ করি এবং যা দিয়ে ভূমিজ উদ্ভিদ উতপন্ন হয় এবং মানুষ ও জীবজন্তু তা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে ও নয়নাভিরাম হয় এবং এর অধিবাসীরা মনে করে এসবই তাদের আয়ত্বাধীন। তখন দিনে অথবা রাতে আমার নির্দেশ এসে পড়ে এবং আমি তা এমনভাবে নির্মূল করে দেই যেন ইতিপূর্বে তার অস্তিত্বই ছিল না। এভাবে আমি চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী বিশদভাবে বিবৃত করি।"(১০:২৪)
জগতের এমন অনেক বাস্তবতা আছে যাতে মানুষের পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ হয়, সেজন্য মহান প্রতিপালক আল্লাহ পবিত্র কুরআনে অনেক ক্ষেত্রে উপমা ব্যবহার করেছেন। এ আয়াতেও তেমনি পার্থিব জগতের নশ্বরতা বোঝানোর জন্য উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, বৃষ্টির পর মাটি যেমন সতেজ হয়ে ওঠে এবং শস্য ও গাছ-পালায় চারদিক সবুজে -শ্যামলে ছেয়ে যায়, কিন্তু অসময়ে অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প- বন্যা বা ঝড় তুফান ক্ষণিকের মধ্যেই তাকে বিরান ভূমিতে পরিণত করে। দুনিয়ার জীবনও তেমনি ক্ষণস্থায়ী এবং অতি দ্রুত তা ফুরিয়ে যায়।
সত্যিই মানুষের জীবন প্রকৃতির সৌন্দর্যের মত ক্ষণস্থায়ী। এ জীবনের স্থায়িত্বকাল অনিশ্চিত এবং অল্প কালের মধ্যেই এর অবসান ঘটে। কাজেই দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়া কিংবা এর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলা উচিত নয়।
সূরা ইউনুসের ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى دَارِ السَّلَامِ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
"আল্লাহ মানুষকে শান্তির আবাসের দিকে আহ্বান করেন এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।"(১০:২৫)
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানুষকে ক্ষণস্থায়ী জীবনের পরিবর্তে চিরস্থায়ী জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করতে বলেছেন যাতে মানুষ অনন্তকালের ও চির শান্তির আবাস লাভ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। আর সেজন্য দিক নির্দেশনাসহ যুগে যুগে তিনি নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। ফলে যারা ঐশী দিক নির্দেশনা গ্রহণ করে আল্লাহও তাদেরকে সাহায্য করেন এবং তারা তাদের সতকর্মের কারণেই সত্য থেকে বিচ্যুত হয় না।
পার্থিব শান্তি সীমিত ও ক্ষণিকের কিন্তু পরকালের শান্তি অফুরন্ত ও চিরস্থায়ী। কাজেই চিরস্থায়ী শান্তি নিশ্চত করতে হলে ঐশী বিধানের দিকে ফিরে আসতে হবে, যাকে পবিত্র কুরআনে সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথ বলা হয়েছে। সরল পথের যাত্রীরা দুনিয়াতে যেমন আত্মিক প্রশান্তি পাবে, তেমনি পরকালেও তারা বেহশত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করবে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই সূরার ২৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ وَلَا يَرْهَقُ وُجُوهَهُمْ قَتَرٌ وَلَا ذِلَّةٌ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
“যারা মঙ্গল কাজে করে, তাদের জন্য রয়েছে উত্তম পুরস্কার এবং আরো কিছু। কালিমা ও হীনতা তাদের মুখমণ্ডলকে আচ্ছন্ন করবে না, তারাই হবে বেহেশত বা স্বর্গের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।” (১০:২৬)
আগের আয়াতে বেহেশত বা জান্নাতের ব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়ার পর এখানে বলা হয়েছে, চিরস্থায়ী বেহেশত আল্লাহতায়ালা শুধুমাত্র সতকর্মশীলদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। আর সতকর্মশীলরা বেহেশতে যে পুরস্কার পাবেন তা হবে পরিমাণ ও গুণগত দিক থেকে তাদের কর্মের চেয়ে অনেক উত্তম। অন্য এক আয়াতে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে- যারা সতকর্ম করবে তারা দশগুণ বেশি প্রতিদান লাভ করবে।
এই আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ চান মানুষ সত্যকে গ্রহণ করুক। এজন্য তিনি নবী রাসূলদের পাঠিয়েছেন, যারা পয়গম্বরদের কথা মান্য করে সত্যকে গ্রহণ করবে তিনি তাদের জন্য উত্তম পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন।
সূরা ইউনুসের ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَالَّذِينَ كَسَبُوا السَّيِّئَاتِ جَزَاءُ سَيِّئَةٍ بِمِثْلِهَا وَتَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ مَا لَهُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ عَاصِمٍ كَأَنَّمَا أُغْشِيَتْ وُجُوهُهُمْ قِطَعًا مِنَ اللَّيْلِ مُظْلِمًا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
"যারা মন্দ কাজ করে তাদের প্রতিফলও অনুরূপ মন্দ এবং তাদেরকে হীনতা আচ্ছন্ন করবে। আল্লাহর প্রকোপ থেকে ওদের কোন রক্ষাকারী নেই। তাদের মুখমণ্ডল যেন অন্ধকার নিশীথের আস্তরণে আচ্ছাদিত, তারা দোযখ বা অগ্নির অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।"(১০:২৭)
যারা সতকর্ম করবে তারা অনুরূপ উত্তম পুরস্কার লাভ করবে, কিন্তু যারা অন্যায় করবে এবং অসত কাজে লিপ্ত হবে তাদের জন্য শাস্তি নির্ধরিত রয়েছে। এই শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার কোন পথ তাদের নেই। আল্লাহর নিয়ম হচ্ছে, তিনি পাপাচারীকে তার অন্যায়ের অনুপাতে শাস্তি দেন কিন্তু ন্যায়বান, সতকর্মশীলদেরকে তাদের প্রাপ্যের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিদান প্রদান করেন।
এই আয়াত থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, মহান আল্লাহ মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন। কাজেই যারা ভালোকে গ্রহণ করবে পরিণতিতে তারা হবে সতকর্মশীল, এর বিপরীতে অন্য আরেক দল মানুষের অস্তিত্ব থাকবে যারা হবে অন্যায় ও অসত্যের ধ্বজাধারী।