বাঙ্গালী
Monday 25th of November 2024
0
نفر 0

অসাধারণ মানুষ ইমাম আলী (আ.)

অসাধারণ মানুষ ইমাম আলী (আ.)

বিশ্বের বুকে আল্লাহর দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশীগ্রন্থ আল-কোরআনের বসন্তকাল মাহে রমযানের কল্যাণপূর্ণ দিনগুলো আমরা অতিক্রম করছি এখন ৷ এই দিনগুলো যে কতো বরকতময়,কতো পূণ্যময় তা আমরা কোরআনের ভাষ্য থেকেই জানতে পারি ৷ নবী করীম ( সা ) থেকে উদ্ধৃত যে এ মাসের সর্বোত্তম দোয়া হচেছ এসতেগফার ৷ এসতেগফার মানে হলো ক্ষমা প্রার্থনা করা,দোয়া করা ৷ কেননা আন্তরিকতার সাথে কায়-মনোবাক্যে যদি আল্লাহর দরবারে তওবা এসতেগফার করা হয় তাহলে তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়৷ সারা বছর আমরা যেসব অসৎ গুণাবলী বা অন্যায়ের চর্চা করি , সেগুলো থেকে মুক্তি পাবার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে এই মাসে ৷ এমাসের মধ্যে রয়েছে সহস্র মাসের থেকেও উত্তম এক রাত ৷ লাইলাতুল ক্বদর ৷ মহিমান্বিত রাত ৷ এই রাতের এতো মহিমা কিংবা এই মাসের এতো মর্যাদার কারণ হলো পবিত্র কোরআন নাযিল হয়েছিল এই মাসেই লাইলাতুল কদরে৷ এ রকম একটি মাসের সাক্ষাৎ লাভ নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের ৷ কিন্তু যারা এ মাসকে পেয়েও নিজেদের গুনাহ-খাতা থেকে মুক্তি লাভে সমর্থ হলো না,তারা নিশ্চিতই দুর্ভাগা ৷ আল্লাহ আমাদেরকে সৌভাগ্যবানদের কাতারে শামিল করুন ৷
ইতিহাসের উজ্জ্বল পাতায় লক্ষ্য করা যায় যে বিশ্বের বহু সৌভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব এ মাসে মর্যাদাবান হয়েছেন বিভিন্নভাবে ৷ যেমন আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী ( আ ) শাহাদাতলাভ করেন এ মাসেরই ২১ তারিখে,৪০ হিজরীতে ৷ তাঁর শাহাদাত বার্ষিকীতে আপনাদের সবার প্রতি রইলো আন্তরিক সমবেদনা ৷ আলী ইবনে আবি তালিবের মতো ব্যক্তিত্ব খুবই বিরল ৷ তাঁর প্রশংসা যতো করা হবে , তার চেয়ে অনেক বেশি অনুল্লেখ্য থেকে যাবে ৷
এমন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে আছেন যিনি আল্লাহর ঘর কাবা শরীফের ভেতরে জন্মলাভ করেছেন,আবার আল্লাহর ঘরেই শত্রুর ঘায়ে আহত হয়ে শাহাদাত লাভ করেন ৷ তাঁর নৈতিক গুণাবলী ছিল নবী করিম (সা) এর মতোই ৷ নবুয়্যতির দায়িত্ব পাবার আগে নবীজী যেসব কিছু অপছন্দ করতেন আলী ( আ ) ও সেইসব বস্তু পরিহার করে চলতেন ৷ তিনি এই বিশ্বের হাকিকত কিংবা রহস্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন ৷ কী শত্রু, কী মিত্র সবাই একটি বিষয়ে বিশ্বাস করে যে,রাসূলে খোদা ( সা ) এর পর সবচে জ্ঞানী ব্যক্তি ,ন্যায়বান এবং তাকওয়াবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন হযরত আলী ( আ ) ৷ তাঁর চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস যখন ‘পণ্ডিত' উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো,আলীর জ্ঞানের সাথে তোমার জ্ঞানের পরিমাপ কীরকম ? উত্তরে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস বলেছিলেন বিশাল সমুদ্রের তুলনায় এক ফোঁটা বৃষ্টির পানির মতো ৷
হযরত আলী ( আ ) ছিলেন একাধারে আল্লাহর অসম্ভব অনুরাগী,খোদাপ্রেমিক, অলি এবং সৎ ও সচেতন রাজনীতিক ৷ তবে তাঁর রাজনীতি অপরাপর রাজনীতিবিদ কিংবা শাসকদের রাজনীতি থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ৷ আজকাল যারা রাজনীতি করেন,তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে অনৈতিক কিংবা অমানবিক যে-কোনো মাধ্যম ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না ৷ কারণ রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিল করার জন্যে তারা যে-কোনো কৌশলকেই বৈধ বলে মনে করেন ৷ যেমনটি বর্তমান বিশ্বে আমরা লক্ষ্য করছি যে,আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো অত্যন্ত নির্দয়-নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে অপর দেশের নারী-শিশুসহ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার ওপর নৃশংস হামলা চালিয়ে, গণহত্যা চালিয়ে সেই দেশ দখল করে নিচ্ছে ৷ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর মুক্তির অজুহাত দেখিয়ে মানবিকতা বা নীতি-নৈতিকতাকে পদদলিত করছে ৷ এই প্রক্রিয়াটিকে তারা আনুষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রীয় রূপ দিয়েছে ৷
চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত তার এক বইতে লিখতে গিয়ে বলেছেন,যখন দুই ব্যক্তির মাঝে কোনো বিষয়ে কথা হয় বা তারা পরস্পরে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়,তখন ঐ প্রতিশ্রুতি পালন করতে হয় ৷ কিন্তু রাজনীতিতে যদি কোনো দেশ বা জাতির স্বার্থের বিষয়টি এসে যায় তখন এই প্রতিশ্রুতি পালন জরুরী নয় ৷" কিন্তু হযরত আলী ( আ ) এর নীতি-নৈতিকতা,কথাবার্তা আচার-ব্যবহার এতো পূত-পবিত্র ও নিষ্কলুষ ছিল যে,আজ পর্যন্ত কোনো গবেষক বা ইতিহাসবিদ হযরত আলী ( আ ) এর জীবন চরিতের মাঝে কোনো দুর্বল দিক খুঁজে পান নি ৷ রাজনীতির ক্ষেত্রেও কেউ বলতে পারেন নি যে তিনি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে কোনোরকম অমানবিক বা অনৈতিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন ৷ উল্টো বরং নৈতিক ভিত্তির ওপর অটল থাকার কারণে তিনি যে বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন-তার অনেক দৃষ্টান্ত ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায় ৷
ইসলামের কল্যাণচিন্তা এবং মুসলমানদের ঐক্য রক্ষা করার স্বার্থে তিনি ২৫ বছর নিরব ছিলেন ৷ শত্রুরা তাঁকে যতোগুলো যুদ্ধে জড়িয়েছে,তার কোনোটিতেই তিনি যুদ্ধের সূচনাকারী ছিলেন না ৷ যুদ্ধের সময় তিনি শত্রু বাহিনীর জন্যেও পানি সরবরাহ করার আদেশ দিয়েছিলেন ৷ হযরত আলী (আ) রাজনৈতিক বিচিত্র ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতেন,কিন্তু তিনি তা পছন্দ করতেন না ৷ তিনি নিজেই বলেছেন-‘খোদার শপথ! যদি ষড়যন্ত্র অপছন্দনীয় ব্যাপার না হতো,তাহলে আমি হতাম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ চতুর লোক ৷ কিন্তু প্রত্যেক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাই পাপ ৷ আর প্রতিটি পাপই হলো অকৃতজ্ঞতা ৷ আর প্রতিটি হঠকারিতা বা চাতুর্য এমন এক পতাকার মতো যেই পতাকার মাধ্যমে কেয়ামতে তা চিনতে পারা যাবে৷ খোদার শপথ ! আমি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নতজানু হবো না, কিংবা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও অক্ষম হবো না ৷"
হযরত আলী ( আ ) কখনোই তথাকথিত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মতো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণকে চমকে দিতে চান নি, তিনি চেয়েছেন সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে ৷ তিনি যখন কোনো এলাকার জনগণ তাঁকে স্বাগত জানাবার জন্যে তাঁর অনুসরণ করতেন, তিনি তখন তাদের বলতেন যে,তোমরা আমাকে অপরাপর অত্যাচারীর মতো শক্তিমান ভেবেছো ৷ এ কাজ করে তোমরা নিজেদের অপমান করো না, তোমাদের সম্মানকে পদদলিত করো না ৷
হযরত আলী ( আ ) তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্বের ব্যাপারে এতো বেশি সচেতন ছিলেন যে তিনি সর্বাবস্থায় ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে সকল বিষয় আঞ্জাম দিতেন ৷ মানুষের অধিকারের ব্যাপারে তাঁর সচেতনতা ও আন্তরিকতা সর্বজনবিদিত৷ তিনি নিজে দিনের পর দিন একেকটি এলাকায় গিয়ে জনগণের সমস্যার কথা কোনো মাধ্যম ছাড়া সরাসরি তাদের মুখ থেকে শুনতেন এবং সমস্যার সমাধান দিতেন ৷
পাঠক ! মহান এই ব্যক্তিত্বের শাহাদাত বার্ষিকীতে আমাদের প্রাণঢালা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তাঁর প্রতি বর্ষণ করছি ৷ তাঁর মতো একজন অলিআল্লাহ, একজন খোদাপ্রেমিক, নবীজীর সান্নিধ্য লাভকারী, কাবা শরীফে জন্মলাভকারী, প্রথম ইসলামগ্রহণকারী, যথাযথ ন্যায় বিচারকারী, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, বীর এবং রাসূলের ভাষায় জ্ঞানের নগরী হবার মতো সৌভাগ্যবানের অভাব বিশ্ববাসী আজ উপলব্ধি করছে৷ তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে আমরা যেন লাভবান হতে পারি এইটাই তাঁর শাহাদাত বার্ষিকীতে আমাদের প্রত্যাশা ৷ এই আলোচনা শেষ করবো বিখ্যাত খ্রিষ্টান কবি কারু'র বক্তব্য দিয়ে ৷ তিনি বলেছেন-
হে আলী! তুমি ইতিহাসের সবচে ভয়াবহ সময়ে মানব জাতিকে জুলুমের অন্ধকার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে এবং খোদা বিমুখ মানুষের মুক্তির জন্যে তাদেরকে তোমার বুকের যমিনে আশ্রয় দিয়েছো ৷ বাস্তবতার কঠিন বেদিতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছো ৷ আমি কায়-মনোবাক্যে বলছি, হে মহান ব্যক্তিত্ব! আমার মতো একজন খ্রিষ্টানের অশেষ দরুদ তুমি গ্রহণ করো ৷ তোমার সম্মানিত আত্মার সামনে আমি সশ্রদ্ধচিত্তে আমার জানু নত করছি ৷ আমি খ্রিষ্টের শপথ করে বলছি,এবং বিশ্বাস করি যে যিশুখ্রিষ্ট যদি জীবিত থাকতেন তাহলে আন্তরিকতার সাথে তোমার মানবীয় মর্যাদা এবং তোমার পবিত্র আত্মার প্রতি দরুদ পাঠাতেন ৷ (রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

হাসনাইন (ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন) ...
খেলাফত তথা রাসূল (সা.)-এর ...
নবী (সা.) কিভাবে উম্মী ছিলেন বা কেন ...
আল কোরআনের অলৌকিকতা (১ম পর্ব)
Protest einer Antikriegsgruppe gegen Luftangriff Amerikas auf ein Krankenhaus
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র মাথা ...
১০ ই মহররমের স্মরণীয় কিছু ঘটনা ও ...
আত্মগঠনের মাস : রমযান
দুঃখ-কষ্ট মোকাবেলার উপায়
পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত

 
user comment