কোন সমাজের সত্য পথের পথিকরা যখন আলোকিত মানুষের কথা বলেন,ন্যায়-ইনসাফপূর্ণ সমাজের কথা ভাবেন তখন তাঁরা মানবেতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল উত্থানের মাঝে উপমা দেখতে চান। আর তা থেকে শিক্ষা নিতে চান। ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনগুলোর মাঝে শীর্ষে যে আন্দোলনের অবস্থান তার অন্যতম হলো শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইনের আন্দোলন যার বহুমাত্রিক আবেদন এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম কারবালা ভূমিতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইনের এই মহান ত্যাগ ও কোরবানী কি পূর্বাপর সম্পর্কহীন নিছক একটি দুর্ঘটনা;নাকি ভাগ্যের অপব্যাখ্যাকারী পাপিষ্ঠ ইয়াযীদের ভাষায় ‘অদৃষ্টের লিখন’;নাকি বেহেশতের দুর্নিবার লোভে লোভাতুর ও শহীদের মর্যাদা পিয়াসী একদল আত্মাহুতিদানকারীর কর্মকৌশলবিহীন আত্মদান;নাকি খৃস্টবাদের ইসলামী সংস্করণবাদীদের মত অনুযায়ী ইমাম হুসাইন তাঁর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর প্রেমিকদের পাপ মোচন করে দিয়েছেন। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে জ্ঞানী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি কি সত্যিই কাহিনীকারদের মত অনুযায়ী পথ ভুলতে ভুলতে কারবালা প্রান্তরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন? আর সত্যিই কি দু’দল মুসলমানের ভুল বোঝাবোঝির মাঝেই কারবালার মহা ঘটনার পটভূমি লুকায়িত? ইমাম হুসাইন কি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্যই ইয়াযীদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন? ‘ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনকে বাইয়াত বা আনুগত্যের জন্য চাপ দিচ্ছিল’-এজন্যই কি ইমাম তার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন? বাইয়াতের জন্য চাপ দেয়ার পূর্বে কি ইমাম ইয়াযীদী শাসন সম্পর্কে কিছু না বলে চুপচাপ ইবাদতে মশগুল ছিলেন? কি কারণেই বা তিনি আসন্ন হজ্বের মাত্র কিছুদিন পূর্বে মক্কা ত্যাগ করে কুফাভিমুখে রওয়ানা হলেন? সর্বোপরি মহানবী (সা.)-এর ওফাতের মাত্র ৫৩ বছর পর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাহাবীর জীবদ্দশায় কিভাবে ইয়াযীদের বিচ্যুত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো? কিভাবেই বা মহানবীর প্রিয় দৌহিত্র নির্মমভাবে মজলুম অবস্থায় শহীদ হলেন। কেনই বা এই মহামানবের এতো বড় আত্মত্যাগের ঘটনাটির ওপর নানা ধুম্রজাল তৈরি করে আজো তাঁকে মজলুম করে রাখা হয়েছে?
কারবালার মহাবিপ্লবকে ধামাচাপা দেয়ার ইয়াযীদী অপকৌশল ও অপপ্রচার এসব হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এসব প্রশ্নের বিশেষণধর্মী জবাব পেতে হলে আমাদের জানতে হবে ইমাম হুসাইন কে? তাঁর পরিচয় ও অবস্থান কি? জানতে হবে তৎকালীন সমাজ-পরিস্থিতি ও ঐ সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কারবালা ট্রাজেডির ঘটনাপ্রবাহ। আশুরার পূর্বের ও পরের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব। আর পরবর্তী প্রজন্মের সাথে এ ঘটনার সম্পর্ক। আলোকিত সমাজ বিনির্মাণকামীদের জন্য প্রয়োজন এই মহাবিপ্লবের নেতা ইমাম হুসাইনের জীবনের প্রামাণ্য সূত্রভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ জীবন ইতিহাসের সাথে পরিচিত হওয়া।
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নবজাতকের নাম রাখা
আজান ও ইকামতের পর্ব সমাপ্ত হলে নবজাতকের নাম রাখার পালা আসে। মহানবী (সা.) তখন হযরত আলী (আ.)-কে সম্বোধন করে বললেন,‘‘তোমার সন্তানের নাম কি রেখেছো?’’ হযরত আলী অত্যন্ত বিনয় সহকারে বললেন,‘‘এ নবজাতকের নাম রাখার ব্যাপারে তার নানা মহানবী (সা.)-কে উপেক্ষা করতে পারব না।” মহানবীও বললেন,‘‘আমিও এ নবজাতকের নাম রাখার ব্যাপারে মহান আল্লাহকে উপেক্ষা করতে পারব না।” অতঃপর জিবরাঈল (আ.) এসে বললেন,‘‘হে মুহাম্মদ,মহান আল্লাহ্ আপনাকে সালাম জানাচ্ছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন : হারুন যেমন মূসার কাছে তদ্রূপ আলীও আপনার কাছে। অতঃপর আপনি আপনার সন্তানদের নাম হারুনের সন্তানদের নামে রাখুন।” মহানবী জিজ্ঞেস করলেন,‘‘হারুনের সন্তানদের নাম কি ছিল?” জিবরাঈল উত্তর দিলেন,‘‘শাব্বীর।’’ মহানবী জিবরাঈলকে বললেন,‘‘তবে আমার ভাষা আরবী।” তখন জিবরাঈল বললেন,‘‘এ নবজাতকটির নাম হুসাইন রাখুন।” অতঃপর মহানবী এ নামটি নবজাতক দৌহিত্রের জন্য নির্বাচিত করলেন।১
ইমাম হুসাইনের নাম রাখার ব্যাপারে আরো কিছু বর্ণনা রয়েছে। তবে এসব বর্ণনা নির্ভরযোগ্য নয়। যেমন বর্ণিত আছে : ইমাম হাসান যখন জন্মগ্রহণ করেন,তখন হযরত আলী তাঁর নাম রাখেন হারব (حرب)। অতঃপর মহানবী (সঃ) যখন আলী ও ফাতেমার গৃহে প্রবেশ করে তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘‘তোমরা আমার দৌহিত্রের নাম কি রেখেছো?’’ তখন হযরত আলী বললেন,‘‘তার নাম হারব রেখেছি।” কিন্তু একথা শুনে মহানবী বললেন,‘‘ওর নাম হাসান।” একইভাবে হুসাইন (আ.) যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন আলী তাঁর নামও হারব রাখলেন। কিন্তু মহানবী এবারও তাঁর এ ‘হারব’ নামটি পরিবর্তন করে হুসাইন রাখলেন। মুহসিনের ক্ষেত্রেও একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। কতিপয় বর্ণনায় রয়েছে,হযরত আলী বলেছেন,‘‘ইচ্ছা করেছিলাম হাসান,হুসাইন ও মুহসিনের নাম হারব রাখব। কিন্তু মহানবী তাদের এ নামগুলো (হাসান,হুসাইন ও মুহসিন) রাখেন।”২
গবেষণার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে,এসব হাদীস বানোয়াট। কারণ :
ক) জাহেলিয়াতের যুগে প্রচলিত যেসব নামে জাহেলিয়াতের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে সেগুলো অনুসারে সন্তানের নামকরণ করা ইসলামে স্বীকৃত হয়নি। আর হারবও ঠিক এ ধরনের একটি নাম এবং আহলে বাইত সর্বক্ষেত্রেই ইসলামী বিধি-বিধান পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করতেন। অতএব,জাহেলিয়াতের যুগের নামানুসারে স্বীয় সন্তানদের নাম রাখা তাঁদের পক্ষে মোটেও শোভা পায় না এবং সম্ভবও নয়।
খ) ইমাম হাসানের নাম হারব রাখার ব্যাপারে মহানবীর আপত্তি ও বিরোধিতা কি যথেষ্ট ছিল না? অর্থাৎ যেখানে মহানবী (সা.) ইমাম হাসানের ঐ নাম রাখার ব্যাপারে আপত্তি করলেন সেখানে হযরত আলী আবার কিভাবে ইমাম হুসাইনের নামও হারব রাখতে চাইবেন?
গ) সব ঐতিহাসিকই ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে,মুহসিনের জন্ম মহানবীর জীবদ্দশায় হয়নি। ঘ) বনু উমাইয়্যার পূর্বপুরুষের নাম ‘হারব’। আর এরাই মহানবী (সা.) ও ইসলামের ওপর সবচেয়ে বেশী আঘাত হেনেছিল। এ ধরনের হাদীস বা বর্ণনা জাল করে প্রচার করার পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে জনমনে এ বিভ্রান্তিকর ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যে,বনু উমাইয়্যাও আহলে বাইতের কাছে প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য।
ঙ) সম্ভবত বনু উমাইয়্যা এভাবে হযরত আলীকে রক্তপিপাসু ও যুদ্ধবাজ হিসেবে জনগণের কাছে পরিচিত ও চিহ্নিত করতে চেয়েছিল। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের নামকরণ সংক্রান্ত আরো কিছু বর্ণনা প্রচলিত আছে। যেমন- যখন ইমাম হাসান ভূমিষ্ঠ হলেন তখন হযরত আলী তাঁর চাচার নামানুসারে হামযাহ্ রাখলেন। আর ইমাম হুসাইন ভূমিষ্ঠ হলে তাঁর নামও নিজ ভাইয়ের নামানুসারে জাফর রাখলেন। তবে কিছুদিন পর মহানবী আলীকে ডেকে বললেন,‘‘মহান আল্লাহ্ আমার এ দৌহিত্রদ্বয়ের নাম পরিবর্তন করার আদেশ দিয়েছেন।” অতঃপর তিনি তাঁদের নাম হাসান ও হুসাইন রাখলেন।
আসলে এ বর্ণনাটি ঐসব বর্ণনার পরিপন্থী যাতে বর্ণিত হয়েছে,মহানবীর দৌহিত্রদ্বয়ের নাম ‘হাসান’ ও ‘হুসাইন’ তাঁদের জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথেই রাখা হয়েছিল। কিছুদিন পরে তাঁদের নাম পরিবর্তন করে হাসান ও হুসাইন রাখা হয়েছিল- এ বিষয়টি কেউ উল্লেখ করেননি।
হাসান ও হুসাইন-এ দু’টি বেহেশতী নাম এবং মহানবীর দৌহিত্রদ্বয়ের আগে আর কারো নাম হাসান ও হুসাইন রাখা হয়নি
এ প্রসঙ্গে উসদুল গাবাহ্ গ্রন্থে বর্ণিত আছে : হাসান ও হুসাইন-এ দু’টি নাম জাহেলিয়াতের যুগে কারো পরিচিত ছিল না। মহানবীর দৌহিত্রদ্বয়ের নাম হাসান ও হুসাইন রাখার পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ্ এ দু’টি নাম সবার থেকে গুপ্ত রেখেছিলেন। জাহেলিয়াতের যুগে হাসন্ (حسن) ও হাসীন্ (حسین)-এ দু’টি নাম প্রচলিত ছিল।৩
জন্মোত্তর অন্যান্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান
যখন ইমাম হুসাইনের বয়স ৭ দিন তখন মহানবী (সা.) নবজাতক হুসাইনের মাথার চুল কামিয়ে সেই চুলের পরিমাণে রূপা দান করেন এবং নবজাতকের আকীকাহ্ উপলক্ষে একটি দুম্বা জবেহ করেন। যে ধাত্রী ইমাম হুসাইনের জন্মের সময় হযরত ফাতেমার কাছে ছিলেন দুম্বার একটি রান তাঁর কাছে পাঠানো হয়।
ইমাম হুসাইন যে গৃহে জন্মগ্রহণ করেন
মহানবীর গৃহের পাশেই হযরত আলী ও ফাতেমার গৃহ তৈরি করা হলে তাঁরা বনু নাজ্জার এলাকায় অবস্থিত হারেসাহ্ বিন্ নূ’মানের বাড়ী থেকে সেখানে চলে আসেন এবং হযরত ফাতেমার মৃত্যু পর্যন্ত সেখানে বসবাস করতে থাকেন। আর এ ঘরেই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন।৪ এখানে উল্লেখ্য,মাটি দ্বারা নির্মিত এক কামরাবিশিষ্ট এ গৃহটি অত্যন্ত সাদামাটা ছিল। ছাদটি খেজুর গাছের তক্তা ও মাদুর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে হাত বাড়ালেই ছাদ স্পর্শ করা যেত। এ গৃহে কোন পার্থিব আড়ম্বর ও জাঁকজমক ছিল না। তাই এ ধরনের গৃহই তো বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইনের জন্মস্থান হওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। মহান আল্লাহ্ এ ধরনের গৃহের মর্যাদা উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে বলেছেন : .
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّـهُ أَن تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ
মহান আল্লাহ্ কতিপয় গৃহ (নবীদের গৃহ ও আবাসস্থল) উন্নীত করা,সেখানে তাঁর নাম স্মরণ ও সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর প্রশংসা কীর্তন করার অনুমতি দিয়েছেন।৫
এ আয়াতটি অবর্তীণ হওয়ার পর হযরত আবু বকর মহানবীকে জিজ্ঞেস করলেন,“আলী ও ফাতেমার গৃহও কি এ আয়াতে বর্ণিত গৃহসমূহের অন্তর্ভুক্ত?” মহানবী বললেন,“হ্যাঁ,আলী ও ফাতেমার গৃহটি এসব গৃহের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট।”৬
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,মহানবীর এ উক্তি থেকে হযরত আলী ও ফাতেমার অনাড়ম্বর গৃহের মর্যাদা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে যায়।
আরেকটি বর্ণনা এখানে উল্লেখ করা হল : হযরত আলী ও ফাতেমার গৃহ মসজিদে নববীর পাশে অবস্থিত হওয়ায় এ ঘরের দরজা সরাসরি মসজিদের দিকে উন্মুক্ত হত। মহানবীর আরো কিছু সংখ্যক সাহাবীর ঘরের দরজাও মসজিদের দিকে উন্মুক্ত হত। একদিন মহানবী (সা.) একমাত্র আলী ও ফাতেমার গৃহের দরজা ছাড়া আর যেসব দরজা মসজিদের দিকে উন্মুক্ত হত তা বন্ধ করার আদেশ দিলেন। আলী ও ফাতেমার গৃহের দরজা মহানবীর নির্দেশে খোলা রাখা হল। যখন কিছু সাহাবী মহানবীকে জিজ্ঞেস করলেন,“হে রাসূলাল্লাহ! আমাদের ঘরের দরজাগুলো কেন বন্ধ করলেন? আর আলীর ঘরের দরজা খোলা রাখলেন,কেন বন্ধ করলেন না?” তখন মহানবী তাঁদেরকে বলেছিলেন,“আমি নিজে এ দরজাগুলো বন্ধ করিনি,বরং মহান আল্লাহর আদেশেই এ দরজাগুলো বন্ধ করা হয়েছে।”৭ ওপরের দু’টি বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয়,মহান আল্লাহর কাছে আলী ও ফাতেমার গৃহের অত্যন্ত মর্যাদা রয়েছে।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর উচ্চ মর্যাদা
রবীয়াহ্ সা’দী থেকে বর্ণিত আছে : কোন্ কোন্ সাহাবীর মর্যাদা সবচেয়ে বেশী-এ ব্যাপারে জনগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে আমি মদীনায় সাহাবী হুযাইফা বিন ইয়ামানের কাছে (প্রকৃত ব্যাপারটি জানার জন্য) গমন করলাম। হুযাইফা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি কোথাকার অধিবাসী?” আমি বললাম,“আমি একজন কুফাবাসী।” এ কথা শুনে হুযায়ফা আমাকে স্বাগত জানালেন। আমি বললাম,“সাহাবীদের ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে যে মতভেদ হয়েছে সে ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞেস করার জন্য মদীনায় এসেছি।” হুযায়ফা বললেন,“তুমি এমন এক ব্যক্তির কাছে এসেছ যার এ ব্যাপারে জ্ঞান রয়েছে। আর তুমি জেনে রাখ,আমি যা শুনেছি,দেখেছি এবং যা আমার অন্তরে আছে কেবল তাই তোমার কাছে বর্ণনা করব।” অতঃপর হুযায়ফা বলতে লাগলেন,“একদিন মহানবী আমাদের কাছে আসলেন। আমি তোমাকে যেমনভাবে দেখতে পাচ্ছি ঠিক তেমনিভাবে আমি মহানবীকে দেখতে পাচ্ছিলাম,তিনি হুসাইন ইবনে আলীকে কাঁধে বসিয়ে হাত দিয়ে তাঁর পা বুকের সাথে লাগিয়ে যেন বলছেন,“জনগণ,আমি ভালভাবেই অবগত আছি,আমার ওফাতের পরে আমার মনোনীত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে মতপার্থক্য হবে। (তাই শুনে রাখো) এই হুসাইন ইবনে আলীর মাতামহ ও মাতামহী সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তার মাতামহ হচ্ছে মুহাম্মদ,যে মহান আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত (রাসূল) এবং সর্বশেষ নবী। আর তার মতামহী হচ্ছেন খাদীজাহ্ বিন খুওয়াইলিদ,যিনি পৃথিবীর সমস্ত মহিলার আগেই মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছেন।
এই হুসাইন ইবনে আলীর পিতামাতা সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তার পিতা আলী ইবনে আবি তালিব রাসূলুল্লাহর ভাই,সাহায্যকারী,পিতৃব্য পুত্র এবং পৃথিবীর সকল পুরুষের চেয়ে আগে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে। আর তার মা ফাতেমা যিনি মুহাম্মদের কন্যা এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারী। এই হুসাইন ইবনে আলী চাচা ও ফুফুর দিক থেকে সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তার চাচা আবু তালিবের পুত্র জাফর যাকে দু’টি ডানা দেয়া হয়েছে এবং ঐ দু’টি ডানা দিয়ে বেহেশতের মধ্যে যেখানে ইচ্ছা সেখানে তিনি উড়ে বেড়ান। আর তার ফুফু আবু তালিবের কন্যা উম্মে হানী। এই হুসাইনই শ্রেষ্ঠ মামা ও খালার অধিকারী। তার মামা কাসিম বিন মুহাম্মদ ও খালা যয়নাব বিনতে মুহাম্মদ।
(মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণের মাঝে তাঁর আহলে বাইতের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার কারণে আহলে বাইতপন্থী লেখকগণ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত আলেম আল্লামাহ্ আবু বকর জাস্সাস তাঁর ‘আহকামুল কোরআন’ গ্রন্থে এবং শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী তাঁর ‘রাহাতুল কুলুব’ গ্রন্থে মহানবীর (সা.) আহলে বাইতের সদস্যগণের নামের পাশে ‘আঃ’ এবং অন্যান্য সাহাবীগণের নামের পাশে ‘রাঃ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অনুরূপভাবে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে হযরত ঈসার (আ.) মাতা হযরত মরিয়ম,হযরত আদমের (আ.) স্ত্রী হযরত হাওয়ার নামের পাশে এবং বিশেষ বিশেষ ফেরেশতাগণের নামের পাশেও ‘আঃ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। লেখক এখানে এ রীতিটিকেই অনুসরণ করেছেন।)
অতঃপর মহানবী হুসাইনকে কাঁধ থেকে মাটিতে নামিয়ে দিলেন। আর হুসাইন তখন মহানবীর আগে আগে হাঁটছিলেন এবং কখনো কখনো মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলেন। মহানবী আবার বললেন,“হে জনগণ,এই হুসাইন ইবনে আলীর মাতামহ,মাতামহী,চাচা,ফুফু,মামা ও খালা বেহেশতে প্রবেশ করবে। আসলে হুসাইনকে যা (যে গুণাবলী ও মর্যাদা) দেয়া হয়েছে তা একমাত্র নবী ইয়াকুবের পুত্র নবী ইউসুফ ব্যতীত আর কোন নবীর সন্তানকেই দেয়া হয়নি।”৮
ঠিক এ রকম আরেকটি হাদীস আল্লামাহ্ মুহিব্বুদ্দীন আল্লামাহ বিন আব্দুল্লাহ আত্-তাবারী প্রণীত যাখায়িরুল উকবা ফী মানাকিব-ই যাভীল কুরবা গ্রন্থে (পৃঃ ১৩০) রয়েছে। এ বর্ণনাটির শেষে আরো সংযোজিত হয়েছে,“হে আল্লাহ্,নিশ্চয় তুমি জানো,হাসান,হুসাইন বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং তাদের চাচা ও ফুফুও বেহেশতে প্রবেশ করবেন। আর যারা তাদের দু’জনকে ভালবাসবে তারাও বেহেশতী হবে। আর যারা তাদের সাথে শত্রুতা করবে তারা দোযখে প্রবেশ করবে।”
ইমাম হুসাইন কারবালার প্রান্তরে তাঁর নিজের ও নিজ বংশ ও পূর্বপুরুষদের পরিচয় স্বরচিত বীরত্বগাথায় বর্ণনা করেছিলেন
আশুরা অর্থাৎ ১০ মুহররমে কারবালার যুদ্ধে সকল সঙ্গী-সাথী শাহাদাত বরণ করার পর ইমাম হুসাইন যখন একাকী হয়ে পড়লেন তখন তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বীরত্বগাথা রচনা করে পিতৃ ও পূর্বপুরুষদের পরিচিতি তুলে ধরেন। আর এভাবে তিনি নিজের পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এখানে উক্ত বীরত্বগাথার কতিপয় পঙতি উল্লেখ করা হল :
দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলোকচ্ছটার বদৌলতেই তো আমার সব গৌরব
এ উজ্জ্বল নক্ষত্রদ্বয়ের একজন আলী যিনি নবীর পরেই সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ
আর অপরজন মহানবী যিনি কুরাইশ বংশোদ্ভূত
তাই আমা ব্যতীত আর কারইবা আছে এ গৌরব!!
আমার পিতামাতাকে মানব জাতির মধ্য থেকে মহান আল্লাহ্ করেছেন মনোনীত
আর আমি এ দুই মনোনীত মানব-মানবীর সন্তান।
স্বর্ণোদ্ভূত রৌপ্য (আমি এমন ব্যক্তিদ্বয়ের সন্তান যাঁরা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ)আমি,আমিই তো স্বর্ণদ্বয়ের সন্তান
এ সৃষ্টিজগতে কারইবা আছে আমার মাতামহসম মাতামহ
আমিই তো দুই চন্দ্রের সন্তান
নবী-দুলালী ফাতেমা যাহরা আমার জননী
বদর ও হুনাইনের যুদ্ধে কাফের সেনাদলকে পরাস্ত করেছিলেন আমার পিতা
আমার পিতা আলী আল-মুরতাযা ধর্মের দৃঢ় স্তম্ভ
তিনিই বিদ্রোহী কাফের শক্তিকে ধ্বংস করেছিলেন
তিনি দুই কিবলার দিকে (মসজিদুল আকসা ও কা’বা) নামায পড়েছেন
উহুদের দিবসে তাঁর ক্ষেত্রেই সূচিত হয় এক গুরুত্বপূর্ণ মহাঘটনা
আর দুই সেনাদলের সম্মিলনের ফলে তাঁর হৃদয়ের সকল ব্যথার হয় উপশম।
তিনি বাল্যকালেই মহান আল্লাহর উপাসনা করেছেন
আর কুরাইশ তখন পৌত্তলিকতার বেড়াজালে ছিল আবদ্ধ
আমার পিতা উজ্জ্বল সূর্য আর আমার মাতা স্নিগ্ধ চন্দ্র
আর সেই সূর্য ও শশীর সন্তান উজ্জ্বল নক্ষত্র আমি।৯
আহলে বাইতের সুমহান মর্যাদা ও অত্যধিক গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য করে সংগত কারণেই মহানবী ভবিষ্যতে তাঁর অবর্তমানে এতদ্সংক্রান্ত ক্ষেত্রে উদ্ভূত মতপার্থক্য নিরসন করার প্রচেষ্টাস্বরূপ মসজিদে নববীতে হুসাইন সর্ম্পকে উক্ত বক্তব্য রেখেছিলেন। আর কারবালার প্রান্তরে অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অন্তিম মুহর্তে ইমাম হুসাইন চিরন্তন বাণী ও শাশ্বত আহ্বান হিসেবে এ বীরত্বগাথাটি বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়ে গেছেন।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ভাই ও বোনেরা
মুহসিনসহ হযরত আলীর সর্বমোট সন্তান সংখ্যা ২৮ জন। তবে কেউ কেউ ২৫ অথবা ৩৫ বলেও উল্লেখ করেছেন। এ সন্তানগণ হযরত আলীর বিভিন্ন স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ক) হযরত ফাতেমার গর্ভে যাঁরা জন্মগ্রহণ করেন
১। ইমাম হাসান (আ.)
২। ইমাম হুসাইন (আ.)
৩। যয়নাব
৪। উম্মে কুলসুম
৫। মুহসিন (জন্মের পূর্বেই গর্ভপাতে মৃত্যুবরণ করেন)।
খ) খাওলা বিনতে জাফর বিন কায়েসের গর্ভে
৬। মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়াহ্
গ) উম্মুল বানীনের গর্ভে (যাঁরা সকলেই কারবালায় শহীদ হন) :
৭। আবুল ফযল আল-আব্বাস
৮। জাফর
৯। উসমান
১০। আব্দুল্লাহ
ঘ) আসমা বিনতে উমাইসের গর্ভে
১১। ইয়াহ্ইয়া বিন আলী
ঙ) লায়লা বিনতে মাসউদ আরমিয়াহর গর্ভে
১২। মুহাম্মদ (আসগার)
১৩। উবায়দুল্লাহ্
চ) উম্মে হাবীবাহ্ বিনতে যবীয়াহর গর্ভে
১৪। উমর আতরাফ
১৫। রুকাইয়াহ
ছ) উম্মে সাঈদ বিনতে উরওয়াহ্ ইবনে মাসউদ সাকাফীর গর্ভে
১৬। উম্মুল হাসান
১৭। রামলাহ্
জ) অন্যান্য স্ত্রীর গর্ভে
১৮। নাফীসাহ্
১৯। যয়নাব আস্-সুগরা
২০। রুকাইয়াহ্ আস্-সুগরা
২১। উম্মে হানী
২২। উম্মে কেরাম
২৩। যামানাহ্
২৪। উমামাহ্
২৫। উম্মে সালামাহ্
২৬। মায়মুনাহ্
২৭। খাদীজাহ্
২৮। ফাতেমা
হযরত আলীর বংশধারা কেবল তাঁর পাঁচ পুত্র-সন্তান ইমাম হাসান,ইমাম হুসাইন,মুহাম্মদ হানাফীয়াহ্,আবুল ফযল আল-আব্বাস ও উমর আতরাফের মাধ্যমে পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছে। তাঁর অপর কোন পুত্র-সন্তানদের বংশধর আজ পৃথিবীতে বিদ্যমান নেই।
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর দৈহিক গঠন
মহানবীর পবিত্র মুখমণ্ডল ও দৈহিক গঠনের সাথে ইমাম ভ্রাতৃদ্বয়েরই বেশী সাদৃশ্য ছিল। মহানবীর মুখমণ্ডলের সাথে ইমাম হাসানের মুখমণ্ডল এবং তাঁর দৈহিক গঠনের সাথে ইমাম হুসাইনের দৈহিক গঠনের সাদৃশ্য ছিল। এজন্য হযরত আলী বলেছেন,“কেউ যদি মহানবীকে দেখে খুশী হতে চায় তাহলে তার উচিত হাসান ও হুসাইনকে দেখা। কারণ মহানবীর সাথে এ দু’জনেরই সবচেয়ে বেশী দৈহিক ও আকৃতিগত সাদৃশ্য রয়েছে।”১০
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কুনিয়াহ্সমূহ
ইমাম হুসাইনের কুনিয়াহ্ : আবু আবদিল্লাহ্। মহানবী (সা.) ইমাম হুসাইনের জন্য এ কুনিয়াহটি পছন্দ করেছিলেন। এছাড়া ‘আবাল আয়িম্মাহ্’ (ইমামগণের পিতা),‘আবাল মাসাকিন’ (দুঃস্থ-নিঃসম্বলদের পিতা) ও ‘আবাশ্ শুহাদা’ (শহীদগণের পিতা) ইমাম হুসাইনের প্রসিদ্ধ কুনিয়াহ্সমূহের অন্তর্ভুক্ত।১১
ইমাম হুসাইনের উপাধিসমূহ
ইমাম হুসাইনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উপাধি হচ্ছে আয্-যাকী (الزکی) অর্থাৎ পবিত্র। তবে মহানবী তাঁকে শ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যথা: বেহেশতের যুবকদের নেতা (سیّد شباب اهل الجنّة) এবং সৎ কাজের ক্ষেত্রে যেন নিজেই একটি জাতি (سبط من الاسباط)। এছাড়া তাঁর আরো কতিপয় উপাধি রয়েছে। যথা: শহীদ (الشهید),পবিত্র (الطیب),সুপথপ্রাপ্ত (الرشید),আল-ওয়াফী (الوفی),বরকত ও কল্যাণময় এবং আশীর্বাদপ্রাপ্ত (المبارک),আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসারী (التابع لمرضة الله) ও পবিত্র (المطهّر)।ﻬ
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্মগ্রহণ করার পর যেসব ঘটনা ঘটেছিল
ইমাম হুসাইনের দুধ পান করা সংক্রান্ত বর্ণনা : ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর মায়ের দুধ পান করার মাধ্যমে দৈহিকভাবে বিকশিত হয়েছিলেন কি-না এক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন,হুসাইন কোন মহিলা,এমন কি নিজের মায়ের দুধও পান করেননি,বরং তিনি মহানবীর হাত ও মুখনিঃসৃত অমিয় নির্যাস থেকে খাদ্য গ্রহণ করেছেন।
তবে কতিপয় গবেষকের মতে ইমাম হুসাইন অবশ্যই দুধ পান করেছিলেন। এক্ষেত্রে অনেক নির্ভরযোগ্য বর্ণনা রয়েছে যাতে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে,তিনি নিজ মা ফাতেমা অথবা ধাত্রী,যেমন উম্মে হানীর দুধ পান করেছিলেন। তবে হযরত ফাতেমা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই ইমাম হুসাইনের জন্য নিজ মায়ের দুধ পান করাতে যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
মহান আল্লাহর সুন্নাহ্ বা রীতি হচ্ছে,গুটিকতক ক্ষেত্র ব্যতীত নবী ও ইমামগণের ক্ষেত্রেও প্রকৃতির নিয়ম ও নিখিল-বিশ্বে বিদ্যমান কার্যকারণের পরিবর্তন করেন না। তাই সীমিত ও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও মোজেযা সংঘটিত হতে দেখা যায় না। সব কিছুই মহান আল্লাহ্প্রদত্ত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ামাবলীর মধ্যেই ঘটে থাকে। আর অন্য শিশুদের মতই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় ইমাম হুসাইনের দৈহিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।১২
জিবরাঈল ও ফেরেশতাগণ ইমাম হুসাইনকে দোলনায় দোলা দিতেন
একদিন জিবরাঈল (আ.) অবতীর্ণ হয়ে দেখতে পেলেন,ইমাম হুসাইন দোলনায় কাঁদছেন এবং তাঁর মা হযরত ফাতেমা ঘুমিয়ে আছেন। জিবরাঈল তখন দোলনা নাড়িয়ে হুসাইনকে শান্ত করলেন। হযরত ফাতেমা যখন জাগলেন তখন মহানবী (সা.) তাঁকে বললেন,“জিবরাঈল হুসাইনকে শান্ত করেছেন।” এ ঘটনাটি কয়েকবার ঘটেছিল এবং এ প্রসঙ্গে অন্য ফেরেশতাগণের কথাও বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম হুসাইন (আ.) থেকে বর্ণিত আছে : জিবরাইল দোলনায় আমার সাথে কথা বলতেন এবং ইসরাফীল ফেরেশতা আমার সাথে সাক্ষাৎ করতেন।১৩
ইমাম হুসাইনের বাল্যকাল
ফেরেশতাগণ ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন
ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে : একদল সাহাবীর সাথে আমিও একদিন মহানবীর কাছে উপস্থিত ছিলাম এবং তাঁর কথা শুনছিলাম। এমতাবস্থায় অত্যন্ত ব্যাকুল ও চিন্তিত অবস্থায় হযরত ফাতেমা মহানবীর কাছে আসলেন। মহানবী এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,“হে পিতা! হাসান ও হুসাইন বাড়ি থেকে বের হয়েছে,অথচ জানি না তারা কোথায় গেছে;ওদের জন্য আমি উদ্বিগ্ন।” মহানবী বললেন,“চিন্তা করো না। মহান আল্লাহ্ আমার ও তোমার চেয়ে ওদের প্রতি বেশী দয়ালু।” অতঃপর মহানবী হাসান ও হুসাইনকে খুঁজে বের করে আনার জন্য সালমান ও জাবের (রাঃ)-কে পাঠালেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে সালমান ও জাবের ফিরে এসে জানালেন,“আমরা হাসান ও হুসাইনকে খুঁজে পেলাম না।” এ কথা শোনার পর মহানবী হাত উঠিয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন,“হে খোদা,ওরা দু’জন (হাসান ও হুসাইন) আমার নয়নমণি এবং আমার সারা জীবনের ফসল। ওদেরকে সর্বাবস্থায়,জলে-স্থলে সর্বত্র রক্ষা কর এবং নিরাপদে রাখ। ওরা কোথায় থাকতে পারে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই তুমি আমাদের চেয়ে অধিকতর জ্ঞাত। আর দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সব কিছুই তো তোমার জানা।” মহানবীর এ প্রার্থনা শেষ হওয়ার পর জিবরাঈল (আ.) অবতীর্ণ হয়ে বললেন,“হে মুহাম্মদ,আপনি উদ্বিগ্ন ও দুঃখিত হবেন না। আপনাকে সুসংবাদ দেয়া হচ্ছে এ কারণে যে,আপনার সন্তানগণ ইহলোক ও পরলোকে অত্যন্ত সম্মানিত হবেন। আর তাঁদের পিতাও এ দু’জন হতে শ্রেষ্ঠ। তাঁরা (হাসান ও হুসাইন) বনু নাজ্জারের বাগানে ঘুমিয়ে আছেন এবং মহান আল্লাহ্ তাঁদেরকে দেখাশোনা করার জন্য একজন ফেরেশতাকে নিয়োগ করেছেন।” মহানবী ও তাঁর সাহাবীগণ বনু নাজ্জারের বাগানে আসলেন এবং দেখতে পেলেন,দু’ভাই ঘুমিয়ে আছে এবং একজন ফেরেশতা তাঁদের দু’জনকে দেখাশোনা করছেন। মহানবী (সা.) হাসান ও হুসাইনের নিকটে গিয়ে জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত ওদেরকে চুমো খেতে লাগলেন। ঘুম থেকে জাগার পর ইমাম হাসানকে ডান কাঁধে ও ইমাম হুসাইনকে বাম কাঁধে বসিয়ে সঙ্গী-সাথীসহ মসজিদ পানে রওয়ানা হলেন।
সাহাবী আবু আউয়ুব আনসারী মহানবীকে বললেন,“হে রাসূলাল্লাহ,এ দু’জনের একজনকে কাঁধে বসিয়ে মসজিদে আনার জন্য আমাকে অনুমতি দিন।” মহানবী তখন বললেন,“এ দু’জনের বাহন কতই না সুন্দর! আর এরাও কত সুন্দর আরোহী! আর এদের পিতাও (আলী) এ দু’জন হতে উত্তম।”
মহানবী (সা.) মসজিদে পৌঁছলে হযরত বিলাল (রাঃ) তাঁদের দিকে দৌড়ে আসলেন। মহানবী বিলালকে বললেন,“শীঘ্র লোকজনকে মসজিদে জড়ো কর।” সকলে মসজিদে একত্র হলে মহানবী দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বললেন,“হে মুসলিম জনতা,এমন সব ব্যক্তির দিকে তোমাদেরকে কি ইঙ্গিত করব যাদের মাতামহ ও মাতামহী সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ?” তখন সবাই বলল,“জী,হে রাসূলাল্লাহ,(আপনি আমাদেরকে তাঁদের প্রতি ইঙ্গিত করুন)।” মহানবী বললেন,“এই হাসান ও হুসাইনের মাতামহ হচ্ছে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। আর তাদের মাতামহী খাদীজাহ্ বিনতে খুওয়াইলিদ বেহেশতের শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন। আমি তোমাদেরকে এমন ব্যক্তিদের প্রতি ইঙ্গিত করব কি যাদের পিতা-মাতা সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ?” তখন সকলেই বলল,“জী,হে রাসূলাল্লাহ ...।” মহানবী তখন বললেন,“এরা হচ্ছে হাসান ও হুসাইন,এদের পিতামাতা সকল মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাদের পিতা আলী ইবনে আবি তালিব এবং মা নবীকন্যা ফাতেমা। অতঃপর তোমাদেরকে কি ঐ ব্যক্তিদের প্রতি ইঙ্গিত করব যাদের শ্রেষ্ঠ চাচা ও ফুফু রয়েছে? তখন সবাই বলল,“জী,হে রাসূলাল্লাহ!” মহানবী তখন বললেন,“এরা হচ্ছে হাসান ও হুসাইন। এদের চাচা জাফর ইবনে আবি তালিব এবং ফুফু উম্মে হানী বিনতে আবি তালিব। তোমাদেরকে এমন ব্যক্তিদের প্রতি ইঙ্গিত করব কি যাদের শ্রেষ্ঠ মামা ও খালা রয়েছে?” তখন সকলে বলল,“জী,হে রাসূলাল্লাহ!” মহানবী (সা.) বললেন,“এরাই হাসান ও হুসাইন। এদের মামা কাসেম বিন মুহাম্মদ এবং খালা যয়নাব বিনতে মুহাম্মদ।” অতঃপর মহানবী আরো বললেন,“হে খোদা,তুমি জান,হাসান,হুসাইন ও তাদের পিতা-মাতা,মাতামহ-মাতামহী,মামা-খালা ও চাচা-ফুফু সবাই বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং যারা এদেরকে ভালবাসবে তারাও বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং যারা এদের সাথে শত্রুতা করবে তারা দোযখে প্রবেশ করবে।”১৪
মহানবী (সা.) হুসাইন (আ.)-কে বিশেষভাবে স্নেহ করতেন
ইমরান বিন হাসীন থেকে বর্ণিত আছে,মহানবী আমাকে বললেন,“ইমরান,জেনে রাখো,সবার অন্তরেই প্রতিটি জিনিসের জন্য স্ব স্ব অবস্থান রয়েছে। আর উক্ত অবস্থান অনুযায়ী ঐ জিনিসের মর্যাদা হয়ে থাকে,তবে আমি হাসান ও হুসাইনের জন্য আমার অন্তরে এমন ভালবাসা পোষণ করি যার কোন সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নেই।”
জাবির বিন আব্দুল্লাহ আল-আনসারী থেকে বর্ণিত : মহানবী (সা.) একদিন বললেন,“যে ব্যক্তি ঈমানের দৃঢ় রজ্জু ধারণ করতে ইচ্ছুক সে যেন আলী,হাসান ও হুসাইনকে ভালবাসে। কারণ মহান আল্লাহ্ এদেরকে অবশ্যই ভালবাসেন।”
মহানবী ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল হওয়ার কারণে তাঁদের দু’জনের সাথে খেলা করতেন এবং তাঁদের সাথে শিশুদের ভাষায় কথা বলতেন। বিভিন্ন সময় মহানবী হাসান ও হুসাইনের হাত ওপরে উঠিয়ে বলতেন,“যারা এ দু’জনকে ও এদের পিতামাতাকে ভালবাসবে তারা বেহেশতে আমার সাথে বসবাস করবে এবং যে ব্যক্তি এদের সাথে শত্রুতা পোষণ করবে কিয়ামত দিবসে সে শাস্তি প্রাপ্ত হবে এবং আমি তার জন্য শাফায়াত করব না।”১৫
মহানবী (সা.) নিজ পুত্র ইবরাহীমকে হুসাইনের জন্য উৎসর্গ করেন
একদিন মহানবী (সঃ) কতিপয় সাহাবীর সাথে বসেছিলেন। এ সময় ইবরাহীম ও হুসাইন মহানবীর পায়ের ওপর বসেছিলেন। মহানবী কখনো কখনো ইবরাহীম আবার কখনো কখনো হুসাইনকে ঊরুর ওপর উঠিয়ে চুমো খাচ্ছিলেন। ঠিক সে সময় জিবরাঈল মহানবীর ওপর অবতীর্ণ হলেন এবং মহান আল্লাহর বার্তা তাঁর কাছে পৌঁছে দিলেন। জিবরাঈল (আ.) চলে গেলে মহানবী (সা.) উপস্থিত সাহাবীদের উদ্দেশে বললেন,“মহান আল্লাহর কাছ থেকে বার্তা এনে জিবরাঈল (আ.) আমাকে বললেন,“হে মুহাম্মদ,মহান আল্লাহ্ আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং বলেছেন,আপনার উভয় সন্তান ইবরাহীম ও হুসাইনকে জীবিত রাখবেন না। অতঃপর এ দু’জনের মধ্যে যে কোন একজনকে অপরের জন্য উৎসর্গ করুন।”
মহানবী ইবরাহীমের দিকে তাকিয়ে বললেন,“ইবরাহীমের মৃত্যু হলে আমি ব্যতীত আর কেউ ব্যথিত হবে না। কিন্তু হুসাইনের মৃত্যু হলে তার মা ফাতেমা,পিতা আলী ও আমি অর্থাৎ আমরা এ তিনজনই ব্যথিত ও শোকাচ্ছন্ন হব;অবশেষে আমি আমার সকল শোক ও দুঃখকে এ দু’জনের শোক ও দুঃখের ওপর প্রাধান্য দিলাম এবং ইবরাহীমকে হুসাইনের জন্য উৎসর্গ করলাম।”
এ ঘটনা ঘটার তিনদিন পরেই নবীপুত্র ইবরাহীম মৃত্যুবরণ করলেন। এরপর মহানবী যখনই হুসাইনকে দেখতেন তখনই তাঁকে চুমো দিতেন এবং বুকে জড়িয়ে বলতেন,“আমি এমন একজনের জন্য নিজকে উৎসর্গ করলাম যার জন্য আমার পুত্র ইবরাহীমকে উৎসর্গ করেছি।”১৬
হুসাইন (আ.)-এর কান্নায় মহানবী (সা.) বিচলিত ও ব্যথিত হতেন
মহানবীর ঘর হযরত ফাতেমার ঘরের পাশেই ছিল। একদিন মহানবী ঘর থেকে বের হয়ে ফাতেমার ঘরের দরজায় আসলেন। মহানবী হুসাইনের কান্নার শব্দ শুনলেন। এমতাবস্থায় রাসূলের পক্ষে হযরত ফাতেমার ঘর অতিক্রম করা সম্ভব হলো না। তিনি কিছুক্ষণের জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং হযরত ফাতেমার ঘরের দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলেন। শব্দ শুনে হযরত ফাতেমা ঘরের ভেতর থেকে বাইরে আসলেন। বাইরে এসেই তিনি মহানবী দেখতে পেলেন। আর ভাবলেন,হয়তোবা মহানবী তাঁকে দেখতে এসেছেন। তাই তিনি পূর্ব অভ্যাস অনুযায়ী মহানবীকে অভ্যর্থনা জানালেন। মহানবী হযরত ফাতেমার ভক্তিপূর্ণ এ অভ্যর্থনার প্রত্যুত্তরে বললেন,“তুমি কি জানো না,হুসাইনের কান্নায় আমি ব্যথিত হই?”১৭
মহানবী (সা.) মিম্বর থেকে নেমে আসেন
একদা মহানবী (সা.) মসজিদে নববীর মিম্বরে দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে উপদেশ ও বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আর জনগণও একাগ্রতার সাথে তাঁর অমিয় বাণী শ্রবণ করছিল। হঠাৎ করেই মহানবীর ভাষণ বন্ধ হয়ে গেল এবং তিনি ব্যথিত মনে মিম্বর থেকে নীচে নেমে আসলেন। তখন সবাই লক্ষ্য করল,শিশু হুসাইন মসজিদে আসার সময় পায়ের সাথে কাপড় জড়িয়ে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছেন আর কান্নাকাটি করছেন। মহানবী তখন হুসাইনকে মাটি থেকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং নিজের সাথে মিম্বরের ওপর নিয়ে আসলেন।
মহানবী (সা.) সিজদা দীর্ঘায়িত করেন
একদিন মসজিদে নববীতে জামাতে নামায আদায় করার সময় মহানবীর পাশেই শিশু ইমাম হুসাইন বসেছিলেন। কোন এক রাকাতে মহানবী সিজদা করার জন্য মাটিতে মাথা রাখলেন। আর তিনি এত বেশী সময় ধরে ঐ সিজদায় ছিলেন যে,মুসল্লীরা মনে করলেন সম্ভবত মহানবীর কিছু হয়েছে অথবা তাঁর ওপর মহান আল্লাহর তরফ থেকে ওহী অবতীর্ণ হচ্ছে। নামায শেষে মহানবীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন,“না,আমার ওপর ওহী অবতীর্ণ হয়নি। তবে আমার দৌহিত্র (হুসাইন) আমার পিঠের ওপর চড়ে বসেছিল এবং আমি তাকে পিঠ থেকে নামাতে চাচ্ছিলাম না। কারণ আমার ইচ্ছা ছিল,সে নিজেই পিঠ থেকে নেমে আসুক।”১৮
মহানবীর কাঁধে হুসাইন
মদীনাবাসীরা বহুবার দেখেছে,মহানবী তাঁর দুই দৌহিত্রকে দু’কাঁধে বসিয়ে তাঁদের মন খুশী করার জন্য মদীনার অলিতে-গলিতে হাঁটছেন। অনেকে বহুবার চেষ্টা করেও তাঁদের একজনকেও মহানবীর কাঁধ থেকে নামাতে পারেনি। মহানবী কাউকে তা করার অনুমতি দেননি।
কোন কোন সাহাবী এ দৃশ্য দেখে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে বলতেন,“কতই না উত্তম বাহনের ওপর তোমরা দু’জন চড়েছো!”
মহানবীও ঐ সাহাবীদের উদ্দেশে বলতেন,“আর এ দু’জনও কতই না উত্তম আরোহী!”
আর এভাবে মহানবী তাঁর দুই দৌহিত্রের উচ্চ মর্যাদা,সম্মান ও তাঁদের দু’জনের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা ও আত্মিক টানের কথা বর্ণনা করতেন।১৯
হুসাইন আমা হতে আমিও হুসাইন হতে
ইয়ালী বিন মুররাহ্ বলেন,“একবার মহানবী (সা.) আমাদেরকে দাওয়াত করলেন এবং আমরা ঐ দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করার জন্য রওয়ানা হলাম। চলার পথে আমরা একটি ময়দানে এসে উপস্থিত হলাম। সেখানে শিশুরা খেলাধুলা করছিল আর তাদের মধ্যে ইমাম হুসাইনও ছিল। শিশুরা আমাদেরকে দেখা মাত্রই আমরা সেখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত খেলাধুলা বন্ধ করে দিল। মহানবী আমাদের সামনাসামনি হাঁটছিলেন। তিনি যখন হুসাইনকে ঐ শিশুদের মাঝে দেখতে পেলেন তখন তাকে দেখে চুমো না দিয়ে থাকতে পারলেন না। তাঁর সাথে লোকজন থাকা সত্ত্বেও সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে হুসাইনের দিকে গেলেন এবং তাকে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়ালেন। কিন্তু হুসাইন এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে লাগল। আর এতে মহানবী হাসলেন। অবশেষে তিনি হুসাইনকে ধরে এক হাত তাঁর চিবুকে ও অপর হাত তাঁর মাথায় রাখলেন। এরপর তিনি নিজের গাল হুসাইনের গালের সাথে মিশিয়ে বললেন,
حسین منی و انا من حسین، احبّ الله من احبّ حسینا. الحسین سبط من الاسباط
“হুসাইন আমা হতে আমিও হুসাইন হতে। যে হুসাইনকে ভালবাসবে আল্লাহ্ও তাকে ভালবাসবেন। হুসাইন সৎ কাজের ক্ষেত্রে যেন নিজেই একটি জাতি।”২০
মহানবী থেকে বর্ণিত সিব্ত্ (سبط) শব্দের একাধিক অর্থ করা যেতে পারে :
১। হুসাইন সৎ কাজের ক্ষেত্রে যেন নিজেই একটি জাতি অর্থাৎ একটি গোত্র বা জাতির সমান।২১
২। সিব্ত্ শব্দের অপর অর্থ বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত বৃক্ষ। আর হুসাইনকে সিব্ত্ বলার অর্থ হচ্ছে,মহানবীর বংশধরগণ হুসাইনের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করবে।
৩। এ হাদীসটির অর্থ এও হতে পারে,উচ্চ সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে একটি জাতি যেমন সুউচ্চ আসনের অধিকারী এক্ষেত্রে হুসাইনেরও ঠিক এমনি আসন রয়েছে।
৪। এ হাদীসের অর্থ এমনও হতে পারে,একটি জাতি যেমন পুণ্য ও প্রতিদান পেয়ে থাকে ঠিক তেমনিভাবে ইমাম হুসাইনও মহান আল্লাহর কাছে পুণ্য ও প্রতিদান পাবেন।২২
মহানবী (সা.) ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে সর্বদা চুমো দিতেন এবং তাঁদের শরীরের ঘ্রাণ নিতেন
মহানবী (সা.) ইমাম হুসাইনকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। আর এ ভালবাসা,স্নেহ ও মমতা প্রকাশ করার জন্য তিনি হুসাইনকে চুমো দিতেন এবং এভাবে তিনি আত্মিক প্রশান্তি লাভ করতেন। মহানবী প্রায়ই হযরত ফাতেমাকে বলতেন,“আমার দৌহিত্রদ্বয়কে ডেকে আন,আমি তাদেরকে জাড়িয়ে ধরে তাদের শরীরের ঘ্রাণ নেব।”
কখনো কখনো হুসাইন মহানবীর কাছে আসতেন। তখন তিনি হযরত আলীকে বলতেন,“হে আলী,ওকে ধরো এবং আমার কাছে নিয়ে এসো।” হযরত আলী হুসাইনকে ধরে মহানবীর কাছে নিয়ে আসতেন এবং মহানবী তাঁকে ধরে চুমো খেতেন।
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগেও মহানবী (সা.) ইমাম ভ্রাতৃদ্বয়কে বুকে জড়িয়ে চুমো দিয়েছিলেন এবং তাঁদের শরীরের ঘ্রাণ নিয়েছিলেন। আর এ সময় তাঁর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল।২৩ কী হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল তখন!!!
মহানবীর কোলে শিশু হুসাইন
উসামা বিন যায়েদ থেকে বর্ণিত : এক রাতে মহানবীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য বের হলাম। আমার খুব জরুরী কাজ ছিল তাঁর সাথে। মহানবীর কাছে আমার প্রয়োজনের কথা বর্ণনা করলে তিনি আমার আবেদন গ্রহণ করলেন। কথা বলার সময় আমি দেখতে পেলাম,তাঁর দেহের দু’পাশ ফোলা যেন তাতে কিছু আছে। আমি ভাবছিলাম,কখন তিনি তাঁর চাদর খুলে ফেলেন। কিন্তু তিনি চাদর খুললেন না। তাই কথাবার্তা শেষ হলে আমি নিজেই তাঁকে প্রশ্ন করলাম,“হে রাসূলাল্লাহ,আপনার চাদরের নীচে কি লুকিয়ে রেখেছেন?” তিনি স্মিত হেসে চাদরটি একটু সরালেন। অমনি আমি দেখতে পেলাম,হাসান ও হুসাইন নানার ঊরুর ওপরে নির্বিঘ্নে শুয়ে আছে যেন তারা শান্তির মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছে। মহানবী এমতাবস্থায় বললেন,
هذان ابنای و ابنا ابنتی، اللهم انی احبهما فاحبّهما و احبّ من یحبهما
“এরা দু’জন আমার দৌহিত্র এবং আমার কন্যার সন্তান। হে আল্লাহ্,আমি এ দু’জনকে ভালবাসি। অতএব,তুমি তাদেরকে ভালবাস যারা এ দু’জনকে ভালবাসবে।”২৪
হযরত সালমান কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে ইমাম হুসাইনের মর্যাদা
একদিন হুসাইন (আ.) মহানবীর পবিত্র ঊরুর ওপর বসেছিলেন। তিনি তাঁকে চুমো দিচ্ছিলেন এবং তাঁকে বলছিলেন,
انت السیّد ابن السیّد ابو السادة- انت الامام ابن الامام ابو الائمة- انت الحجة ابن الحجة ابو الحجج تسعة من صلبک و تاسعهم قائمهم (حجّ)
“তুমি নেতা,নেতার সন্তান ও নেতাদের পিতা,তুমি ইমাম,ইমাম-পুত্র ও ইমামদের পিতা;তুমি মহান আল্লাহর নিদর্শন পুরুষ,নিদর্শন পুরুষের সন্তান এবং নয়জন নিদর্শন পুরুষের পিতা। আর এদের মধ্যে নবম নিদর্শন পুরুষই হচ্ছে ইমাম মাহ্দী।”২৫
হাসান ও হুসাইন মহানবী (সা.)-এর দু’টি সুগন্ধি ফুল
মহানবী প্রায়ই ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে বুকে টেনে নিয়ে বলতেন,“সন্তান সুগন্ধি ফুলের মত;হাসান ও হুসাইন আমার দু’টি সুগন্ধি ফুল। তাই এ দু’জনের সুঘ্রাণ গ্রহণ করি।”
আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) বলেন,“একদিন মহানবীর কাছে গেলাম। হাসান ও হুসাইন তাঁর বগলের নীচে ছিল এবং খেলা করছিল। মহানবীকে বললাম,“আপনি কি এ দু’জনকে ভালবাসেন?” তিনি বললেন,“কিভাবে এ দু’জনকে না ভালবেসে থাকতে পারি আর এরাই তো এ পৃথিবীর বুকে আমার সুগন্ধি ফুল! আর আমি এ দু’জনের সুঘ্রাণ নিয়ে থাকি।”২৬
হুসাইনের তৃষ্ণায় মহানবী বিচলিত হয়ে পড়েন
একদিন মহানবী বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই শিশু হাসান ও হুসাইনের কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। মহানবী হযরত ফাতেমার দিকে দ্রূত অগ্রসর হয়ে বললেন,“আমার দৌহিত্রদ্বয় কাঁদছে কেন?” তখন হযরত ফাতেমা তাঁকে বললেন,“ওরা তৃষ্ণার্ত,তাই পানি চাচ্ছে।” মহানবী এ কথা শুনে পানির খোঁজে গেলেন। কিন্তু পানি পেলেন না। তাই তিনি নিজের পবিত্র জিহ্বা হাসান ও হুসাইনের মুখের ভেতর রাখলেন এবং এর ফলে শিশু ভ্রাতৃদ্বয় কান্না থামালেন। আরো অনেক সময় মহানবী ইমাম হাসান ও হুসাইনের মুখের ভেতর জিহ্বা রেখেছেন এবং তাঁরাও তাঁর জিহ্বা চুষে তৃষ্ণা মিটিয়েছেন।২৭
তথ্যসূত্র
১. আল্লামাহ্ মুহিব্বুদ্দীন আল্লামাহ বিন আব্দুল্লাহ আত্-তাবারী প্রণীত যাখায়িরুল উকবা ফী মানাকিব-ই যাভিল কুরবা,পৃঃ ১২০,দার আল মারেফাহ্,বৈরুত,লেবানন থেকে মুদ্রিত।
২. তাহযিব আত্-তাহযিব,২য় খণ্ড,পৃঃ ২৯৬;ইহ্কাকুল হক,১০ম খণ্ড,পৃঃ ৪৯১;উসদুল গাবাহ্,২য় খণ্ড,পৃঃ ১০;মানাকিব,৩য় খণ্ড,পৃঃ ১৬৬;আনসাবুল আশরাফ,৩য় খণ্ড,পৃঃ ১৪৪।
৩. উসদুল গাবাহ্,২য় খণ্ড,পৃঃ ৯;মানাকিব,৩য় খণ্ড,পৃঃ ১৬৬ ও ১৬৭।
৪. তাবাকাতুল কুবরা,৮ম খণ্ড,পৃঃ ১৪।
৫. সূরা নূর : ৩৬।
৬. তাবাকাত আল-কুবরা,৮ম খণ্ড,পৃঃ ১৪।
৭. তাবাকাত আল-কুবরা,১ম খণ্ড,পৃঃ ৪৯৯।
৮. মুলহাকাতু ইহ্কাক আল-হক,১১শ খণ্ড,পৃঃ ২৮২;আল্লামাহ্ গাঞ্জী আশ্-শাফেয়ী প্রণীত কিফায়াতুত তালিব গ্রন্থ,পৃঃ ২৭২;রাসূলী মাহাল্লাতী প্রণীত যিন্দেগানী-ই ইমাম হুসাইন (আ.),১ম খণ্ড,পৃঃ ১৬।
৯. ইহতিজাজ্ আত্-তাবারসী,২য় খণ্ড,পৃঃ ২৫;আল-ইমাম আল-হুসাইন ইবনে আলী,পৃঃ ৭৫।
১০. আনসাবুল আশরাফ,৩য় খণ্ড,পৃঃ ১৪২;হাবীবুস্ সীয়ার,২য় খণ্ড,পৃঃ ৩৪;মানাকিব,৩য় খণ্ড,পৃঃ ৩০।
১১. মানাকিব,৩য় খণ্ড,পৃঃ ২৩২;যিন্দিগানীয়ে ইমাম হুসাইন,সাইয়্যেদ হাশেম রাসূলী মাহাল্লাতী কর্তৃক প্রণীত,১ম খণ্ড,পৃঃ ২৩।
১২. আল-ইসাবাহ্,৮ম খণ্ড,পৃঃ ২৮১;তাযকিরাতুল খাওয়াস্,পৃঃ ২৪৩।
১৩. মানাকিব,৩য় খণ্ড,পৃঃ ২২৯।
১৪. হাবীবুস্ সিয়ার,২য় খণ্ড,পৃঃ ২৭;মানাকিবে খাওয়ারিয্মী,পৃঃ ১১২;খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হুসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ১৪৬।
১৫. ফাযায়েলুল খামসাহ্,২য় খণ্ড,পৃঃ ২০১-২০৮;মানাকিব,৩য় খণ্ড,পৃঃ ১৫৮।
১৬. আল্লামাহ্ খতীব আল-বাগদাদী প্রণীত তারীখে বাগদাদ,২য় খণ্ড,পৃঃ ২০৪;ফাযায়িলুল খামসাহ্,৩য় খণ্ড,পৃঃ ২৩৪।
১৭. ফাযায়েলুল খামসাহ্,৩য় খণ্ড,পৃঃ ২৫৬;তাবরানী প্রণীত আল-মু’জাম আল-কাবীর গ্রন্থে ইয়াযীদ বিন আবি যিয়াদের সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।
১৮. ইবনে হাজর আল-আসকালানী প্রণীত তাহযিব আত্-তাহযিব,২য় খণ্ড,পৃঃ ৩৪৬;ফাযায়েলে খামসাহ্,৩য় খণ্ড,পৃঃ ১৯৩।
১৯. মানাকিবে খাওয়ারিয্মী,পৃঃ ১১১।
২০. শেখ সুলায়মান আল-হানাফী আল-কুন্দুযী প্রণীত ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ্,পৃঃ ২৬৪;আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হুসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ১৪৬;ইবনে আসীর প্রণীত আন্-নিহায়াহ্ ফী গারীবিল হাদীস,২য় খণ্ড,পৃঃ ২৩৪।
২১. ইবনে আসীর প্রণীত আন্-নিহায়াহ্ ফী গারীবিল হাদীস,২য় খণ্ড,পৃঃ ২৩৪।
২২. পারতাভী আয-আযামাতে হুসাইন,পৃঃ ৩৩।
২৩. আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হুসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ১০২।
২৪. আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হুসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ৯২।
২৫. মানাকিব,৩য় খণ্ড,পৃঃ ২২৬;আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হুসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ১৪৬।
২৬. উসদুল গাবাহ্,২য় খণ্ড,পৃঃ ১৮।
২৭. আল্লামাহ্ ইবনে হাজার আসকালানী প্রণীত তাহযিব আত্-তাহযিব,২য় খণ্ড,পৃঃ ২৯৮;আল-খাওয়ারিয্মী প্রণীত মাকতালুল হুসাইন,১ম খণ্ড,পৃঃ ১৫২;ফাযায়েলুল খামসাহ্,৩য় খণ্ড,পৃঃ ১৭৯।
( সূত্র:জ্যোতি, বর্ষ ১, সংখ্যা ২)