পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর কুফার জনগণ ইমাম হাসানের হাতে বাইয়াত করে। যেহেতু মুয়াবিয়া ইমাম আলী (আ.)-এর খিলাফতকালেই বিদ্রোহ করেছিল সেহেতু সে ইমাম আলীর শাহাদতের পর ‘খিলাফত’ দাবী করে এবং ইমাম হাসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়। কয়েক দিন অতিবাহিত হলে ইমাম হাসান একটি সেনাবাহিনীকে তাঁর চাচা উবাইদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের নেতৃত্বে শামের দিকে প্রেরণ করেন। কিন্তু সেনাপতি উবাইদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস মুয়াবিয়ার প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে ও পাঁচ লক্ষ দিরহাম নগদ পেয়ে এবং ইমাম হাসানের পক্ষ ত্যাগ করে মুয়াবিয়ার শিবিরে যোগ দিলে আরো পাঁচ লক্ষ দিরহাম পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে রাতের আঁধারে ইমামের শিবির ত্যাগ করে আট হাজার সৈনিকসহ মুয়াবিযার দলে যোগ দেয়। এর ফলে ইমামের বাহিনী সেনাপতি ও নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে।
কেবল উবাইদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস-ই দুনিয়ার বিনিময়ে নিজ ধর্ম বিক্রি করেনি,বরং ইমাম হাসানের অনেক সেনাপতি এবং উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা যারা আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর সময়ের যুদ্ধগুলোতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং দৃঢ় ঈমানের অধিকারী ছিল না তারাও মুয়াবিয়ার দলে যোগদানের ইচ্ছা পোষণ করত এবং মুয়াবিয়ার কাছ থেকে অপরিমিত অবৈধ অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেতে চাইত। অবশ্য ইমাম হাসানের সেনাদলের অধিকাংশ লোকই এ ধরনের দুনিয়ালোভী এবং বনু উমাইয়্যার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। রণাঙ্গনেই এদের অনেকে ইমাম হাসানের বিরোধিতা করতে থাকে এবং তাঁকে হত্যা করা বৈধ বলে মনে করতে থাকে। তিনবার ইমাম হাসানের প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছিল।
ইরাকী গোত্রপতি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ প্রদান করে মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের পক্ষ থেকে নিজ পক্ষে নিয়ে আসে। এভাবে মুয়াবিয়া তাদের সংকল্পকে সম্পূর্ণরূপে ধুলিস্মাৎ করে দেয়। তাদের চিত্তও দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা মুয়াবিয়ার প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করে পত্র প্রেরণ করতে থাকে এবং যুদ্ধ বেঁধে গেলে ইমাম হাসানকে বন্দী করে মুয়াবিয়ার হাতে সোপর্দ করারও প্রতিজ্ঞা করে। শত্রুপক্ষীয় সেনাদলে চমৎকার শৃঙ্খলা,আনুগত্য ও নিয়মানুবর্তিতা বিরাজ করছিল,অথচ ইরাকীদের মধ্যে বিভেদ,অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলাকে চরম আকার দেয়ার জন্যই মুয়াবিয়া ব্যাপক মিথ্যা গুজব ও প্রচারণামূলক যুদ্ধ চালাতে থাকে। ইমাম হাসানের পক্ষ থেকে সন্ধিচুক্তি মেনে নেয়ার আগেই ইমামের সেনাদলের বিভিন্ন অংশে মুয়াবিয়ার পক্ষ হতে অনুপ্রবেশকারী গুপ্তচররা ইমাম কর্তৃক সন্ধি মেনে নেয়ার মিথ্যা গুজব রটিয়ে দেয়। এরফলে ইতোমধ্যে ইমাম সেনাদলের যারা হতোদ্দ্যম হয়ে পড়েছিল তারা এ সন্ধি সমর্থন করে বসে। ধীরে ধীরে ইমাম সেনাদলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই সন্ধির সমর্থক হয়ে যায।
এমতাবস্থায় ইমাম হাসান তদানীন্তন মুসলিম উম্মাহকে ভীষণ বিচ্যুত এবং বনি উমাইয়্যা,বিশেষ করে মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও বাস্তবতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অমনোযোগী ও উদাসীন দেখতে পেলেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে,মুসলিম উম্মাহ্ সত্য প্রতিষ্ঠা ও মিথ্যার বিলুপ্তির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে। তাই ইমাম ফিতনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিচ্যুতি,সন্ধি চুক্তির অবমাননা এবং তাদের ক্ষমতার লোভ সঠিকভাবে উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন। তিনি অসচেতন মুসলিম উম্মাহকে উম্মাতের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এবং ইসলামী শরীয়তের আইন-কানুন উপেক্ষা করার ব্যাপারে বনি উমাইয়্যা ও মুয়াবিয়ার মানসিকতা প্রমাণ করে দেখাতে চেয়েছিলেন। আর তাই তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতি ও মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্রের মুখে তার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর সেই সাথে তিনি সেদিন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ঐতিহাসিক অমর কারবালা বিপ্লব ও আন্দোলনের পটভূমি ও ভিত্ রচনা করেন। সন্ধি চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা যেগুলো নিচে বর্ণিত হলো সেগুলোর দিকে দৃকপাত করলে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করা যায়। ধারাগুলো হলো :
১. আল কোরআন ও মহানবী (সা.)-এর পবিত্র সুন্নাহ্ অনুসরণ করার শর্তে মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান শাসনকর্তৃত্ব গ্রহণ ও শাসনকার্য পরিচালনা করবে।
২. মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইমাম হাসান উম্মাহর নেতৃত্বভার গ্রহণ করবেন। আর তিনি যদি জীবিত না থাকেন তাহলে তাঁর ভ্রাতা ইমাম হুসাইন শাসনকর্তৃত্ব গ্রহণ কররেন।
৩. আরবই হোক বা অনারবই হোক,সিরিয়াবাসী বা ইরাকী হোক,জনগণ সবাই সমানভাবে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ভোগ করবে। তাদেরকে তাদের উমাইয়্যা শাসনবিরোধী অতীত কর্মতৎপরতা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য শাস্তি দেয়া যাবে না।
নিঃসন্দেহে এ চুক্তি মুসলিম উম্মাহ্ এবং ইসলামের স্বার্থে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। এহেন পরিস্থিতিতে ইমাম হাসানের পক্ষে যা সম্ভব ছিল তিনি তা-ই করেছেন। আর এর চেয়ে উত্তম কোন বিকল্প থাকলে তিনি তা-ই করতেন। যারা তাঁর সন্ধিচুক্তির বিপক্ষে অভিমত ব্যক্ত ও বিরুদ্ধাচরণ করেছিল,ইমাম হাসান সঠিক যুক্তি প্রদর্শন করে তাদের অভিমত খণ্ডন করেছিলেন।
ইমাম হাসান (আ.) মালিক বিন যামারাকে লক্ষ্য করে এ সন্ধিচুক্তি প্রসঙ্গে বলেছিলেন,“পৃথিবীর বুকে মুসলমানদের অস্তিত্ব মুছে যাওয়ার আশংকা করেছিলাম। তাই এ সন্ধির মাধ্যমে ধর্মের জন্য অন্তত একজন প্রচারকারীও বেঁচে থাকুক-এটিই আমি আশা করেছি।”
ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে এ চুক্তির ইতিবাচক প্রভাব ও ফলাফল বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.) বলেছেন :
و الله للّذي صنعه الحسن بن علي (ع) كان خيرا لهذه الأمّة ممّا طلعت عليه الشّمس
“খোদার শপথ,হাসান ইবনে আলী (আ.) যা করেছেন আসলে তা ছিল এ উম্মাহর জন্য যা কিছুর ওপর সূর্যোদয় হয়েছে সে সব কিছুর চেয়ে (অর্থাৎ এ পৃথিবী এবং এতে যা কিছু আছে তার চেয়ে) শ্রেষ্ঠতর ও অধিকতর কল্যাণকর।”
ইমাম হাসান (আ.)-এর সন্ধিচুক্তি প্রসঙ্গে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নীতি অবস্থান
কতিপয় রেওয়ায়েত যেগুলো সর্ম্পকে গবেষণা ও অধ্যয়ন করার পর ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় সেগুলোর ভিত্তিতে কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন যে,ইমাম হুসাইনও ঐ সব ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা মুয়াবিয়ার সাথে তাঁর ভাই ইমাম হাসানের সন্ধিচুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিল এবং তিনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে তাঁর বিরোধিতাও প্রকাশ করেছিলেন।
এ ব্যাপারে যে সব রেওয়ায়েত প্রমাণ হিসাবে দাঁড় করানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ইবনে আসীর প্রণীত ‘উসদুল গাবাহ্’ গ্রন্থে উল্লিখিত একটি হাদীস আছে এবং আরও অনেকে এ রেওয়ায়তটি উল্লেখ করে বলেছে যে,যে সব ব্যক্তি সন্ধিচুক্তির বিরোধী ছিল এবং এ ব্যাপারে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করতো তাদের মধ্যে হুসাইন ইবনে আলীও ছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রাতা ইমাম হাসান (আ.)-কে বলেছিলেন,
أنشدك الله أن تصدق أحدوثة معاوية و تكذب أحدوثة أبيك
“আপনাকে মহান আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি যে,আপনি মুয়াবিয়ার কথা গ্রহণ করেছেন এবং আপনার পিতার কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন।”
ইমাম হাসান এ কথার জবাবে বলেছিলেন,أسكت أنا أعلم بهذا الأمر منك “চুপ কর। আমি এ ব্যাপারে তোমার চেয়ে অধিকতর জ্ঞানী।”
ইবনে আসাকিরের ইতিহাস গ্রন্থেও উপরিউক্ত কথোপকথন সামান্য একটু পার্থক্য সমেত বর্ণিত হয়েছে এবং এর পরই তিনি বলেছেন : “যখন হুসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করার ব্যাপারে ভ্রাতা ইমাম হাসানের ক্রোধ ও সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষ করলেন তখন বিরোধিতা করা থেকে হাত গুটিয়ে নেন এবং তিনিও তা মেনে নেন। তিনি ইমাম হাসানকে বলেছিলেন :
أنت أكبر ولد علي و أنت خليفتي أمرنا لأمورك متّبع فافعل ما بدالك
আপনি হযরত আলীর সকল সন্তানের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। আপনি আমার খলীফা। আমাদের যাবতীয় বিষয় আপনার যাবতীয় বিষয়ের অনুবর্তী ও অনুগত। আপনার কাছে যা প্রকাশিত হয়েছে তা-ই করুন (অর্থাৎ আপনি আপনার অভিমতানুযায়ী কাজ করুন)।”১
যারা এ দুই ইমামকে তাঁদের সম্মান,মর্যাদা,নেতৃত্ব (ইমামত) ও নিষ্পাপত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন ছিলেন ঠিক সেভাবে চিনে এবং জানে তাদের কাছে উপরিউক্ত রেওয়ায়েতগুলো বানোয়াট হবার বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। কারণ এ দুই ইমামের নিষ্পাপত্ব সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত। আর এ কারণেই এ ইমামদ্বয়ের আনুগত্য করা অবশ্য কর্তব্য। তাই তাঁরা যা আঞ্জাম দেন সেটাই আসলে মহান আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত দায়িত্ব। তাঁরা মহান আল্লাহর ঐশী পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য আঞ্জাম দেন। আর এ বিষয়টি তাঁরা খুব ভালোভাবেই জানতেন। আর তাঁদের আনুগত্য সকল মুসলমানদের ওপর ফরয। তাই এ ধরনের ভিত্তিহীন হাদীস ও আলোচনার কোন অবকাশই নেই। আমাদের এ বক্তব্যের সমর্থনে অনেক রেওয়ায়েত আছে যেগুলো বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত এবং এ সব রেওয়ায়েত অপেক্ষা নির্ভরযোগ্য। যেমন-
১. ঐ মশহুর (প্রসিদ্ধ) রেওয়ায়েত যার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে এই যে,আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণ যে কোন কাজই মহান আল্লাহর নির্দেশে আঞ্জাম দেন।
২. ঐ রেওয়ায়ত যা ইমাম হাসানের প্রতি ইমাম হুসাইনের অসাধারণ সম্মান করার ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে তা। আর হযরত ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন :
ما تكلم الحسين بين يدي الحسن اعظاما له
ইমাম হুসাইন (আ.) ইমাম হাসানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে কখনই তাঁর সামনে কথা বলবেন না (অর্থাৎ ইমাম হাসানের কথার ওপর কথা বলতেন না)।২
৩. আরো একটি রেওয়ায়েত যার সারসংক্ষেপ : যে মজলিসে (সভায়) মুয়াবিয়া ইমাম হাসান,ইমাম হুসাইন এবং হযরত আমীরুল মুমিনীনের কতিপয় সঙ্গী-সাথীকে উপস্থিত করিয়ে তাঁদের কাছে আনুগত্য করার দাবী জানিয়েছিল সেই মজলিসে মুয়াবিয়া যখন কাইস ইবনে সাদের কাছে বাইয়াত করার আহ্বান জানায় তখন তিনি এ ক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ব কী তা জানার জন্য ইমাম হুসাইন (আ.)-এর দিকে তাকালে তিনি তাঁকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন,হে কাইস! তিনি (হাসান) আমার ইমাম (তাই তাঁর অভিমতানুসারে তোমাকে কাজ করতে হবে)।
৪. ইমাম হাসান (আ.) ৪৯ অথবা ৫০ হিজরীতে শাহাদাত বরণ করেন। তখন থেকে ৬০ হিজরীতে মুয়াবিয়ার মৃত্যু এবং কারবালার আন্দোলন পর্যন্ত প্রায় দশ বছর বা এর সামান্য একটু বেশি সময় ধরে ইমাম হুসাইন নেতৃত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তখন তাঁর ওপর অন্য কারো আনুগত্য অপরিহার্য ছিল না। কিন্তু তিনি ইমাম হাসান (আ.)-এর সন্ধিচুক্তির মর্যাদা রক্ষা করার জন্য এ সন্ধিচুক্তির বিরোধী যে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছেন। এমনকি কতিপয় অনুসারী তাঁকে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহ্বান জানালেও তিনি তাদেরকে ধৈর্য অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাদের কাছে লিখেছিলেন,“মুয়াবিয়ার সাথে আমাদের একটি সন্ধিচুক্তি আছে এবং আমরা তা মেনে চলতে বাধ্য। আর মুয়াবিয়া যখনই মৃত্যুবরণ করবে তখন আমরা আমাদের দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করব।”
পরিবেশ-পরিস্থিতি,জনগণকে মুয়াবিয়ার ধোঁকা দেয়া,সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুদ্ধ করার ব্যাপারে জনগণের নিস্পৃহা,যুদ্ধ চলতে থাকলে মহানবী (সা.)-এর বংশধরদের শক্তি ও রক্ত (জীবন) বৃথা নিঃশেষ হওয়া এবং আরো নানাবিধ কারণে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে,ইমাম হুসাইন (আ.) যদি ইমাম হাসানের স্থলে থাকতেন তাহলে পিতা আমীরুল মুমিনীন হযরত আলীর শহাদাতের পরে ইমামত ও নেতৃত্ব দানের দায়িত্ব লাভ করার পর মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তি করা ব্যতীত তাঁরও অন্য কোন উপায় বিদ্যমান থাকত না (অর্থাৎ তিনিও ঐ পথই অনুসরণ করতেন যা ইমাম হাসান অনুসরণ করেছেন।) ঠিক একইভাবে ইমাম হাসানও যদি ইয়াযীদের খিলাফতকালে জীবিত থাকতেন তাহলে ইমাম হুসাইন যে পথ অবলম্বন করে কারবালায় শাহাদাত বরণ করেছেন তিনিও ঠিক সে পথই অনুসরণ করতেন।
প্রখ্যাত আলেম আল্লামাহ্ সাইয়্যেদ শারাফুদ্দীনের ভাষায় : এ ইমাম ভ্রাতৃদ্বয়,মহান আল্লাহর অসংখ্য দরুদ ও সালাম তাঁদের ওপর বর্ষিত হোক,আসলে একই মিশন ও ঐশী কার্যক্রমের দু’পিঠ স্বরূপ ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের নিজ নিজ স্থানে ও বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও কর্মসমূহ গুরুত্ব ও ত্যাগ-তিতীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে পরিপূর্ণরূপে ভারসাম্যপূর্ণ এবং হুবহু একই ছিল।
ঠিক যেমন ইমাম হাসান (আ.) তাঁর জীবন উৎসর্গ করার ব্যাপারে মোটেও কুণ্ঠিত ছিলেন না ঠিক তেমনি ইমাম হুসাইনও মহান আল্লাহর পথে ইমাম হাসানের চেয়ে অধিক আত্মোৎসর্গকারীও ছিলেন না। তিনি (হাসান) নীরব জিহাদের জন্য নিজ জীবনকে সংরক্ষণ করেছিলেন-যার ফলে প্রতিশ্রুত সুযোগ,সময় ও মুহূর্ত এসে উপস্থিত হয় এবং ইমাম হুসাইন কারবালায় চির অবিস্মরণীয় বিপ্লব বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন। তাই কারবালায় মহান আন্দোলন ও শাহাদাত হুসাইনী হবার আগে ছিল পূর্ণরূপে হাসানী। কারণ,ইমাম হাসান (আ.) কারবালা আন্দোলন ও বিপ্লবের ভিত রচনা করেছিলেন মুয়াবিয়ার সাথে তাঁর সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করার মাধ্যমে।
ইমাম হাসান (আ.)-এর চূড়ান্ত বিজয় ছিল প্রজ্ঞাসুলভ ধৈর্য ও দৃঢ়তার দ্বারা বাস্তব পরিস্থিতিকে অনুধাবন করতঃ স্পষ্ট করে দেয়া; আর এর আলোকেই ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় শাশ্বত বিজয় ও সাহায্য অর্জন করতে পেরেছিলেন। যেন এ দুই ভ্রাতা ছিলেন একই ধারার ও লক্ষ্যপানে অগ্রসরমান দু’জন সঙ্গী। ধৈর্য ও প্রজ্ঞাসুলভ দৃঢ় ভূমিকা ছিল ইমাম হাসানের এবং বিপ্লব ও বীরত্বব্যাঞ্জক প্রতিরোধ ছিল ইমাম হুসাইন (আ.)-এর। অবশেষে পরস্পর পরিপূরক এ দু’ভূমিকা থেকেই একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যমণ্ডিত এক অসাধারণ ও পূর্ণাঙ্গ কৌশলের উদ্ভব হয়েছিল। যেভাবে ইয়াযীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিরোধ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্য অপরিহার্য ছিল ঠিক তদ্রূপ ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাত-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন ইমাম হাসানের জন্য অপরিহার্য ছিল। আর ইমামদ্বয়ের বাহ্যত ভিন্ন ধরনের এ দু’পদক্ষেপ আসলে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও সময়ের ভিন্নতার কারণেই গ্রহণ করতে হয়েছিল।
ইমাম হাসান (আ.) যদি সন্ধিচুক্তি না করতেন তাহলে মুয়াবিয়ার প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হতো না এবং সে অপমানিত ও অপদস্থও হতো না। আর কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.) যদি শাহাদাত বরণ না করতেন তাহলে পাপাত্মা ইয়াযীদ ও বনি উমাইয়্যার শাসনকর্তৃত্ব এত দ্রুত নিঃশেষ ও ধ্বংস হতো না। যদি এ দু’ইমামের ত্যাগ-তিতীক্ষা না থাকত তাহলে ইসলাম ধর্ম আবু সুফিয়ানের ধর্মে রূপান্তরিত হয়ে যেত। আসলে ইসলামের অস্তিত্বই তখন ধ্বংস হয়ে যেত।
সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করার পর মদীনায় প্রত্যাবর্তন
সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করার পর ইমাম হাসান (আ.) সপরিবাবে মদীনায় ফিরে আসেন। ইমাম হুসাইনও মদীনায় ফিরে এসে সেখানে বসবাস করতে থাকেন। আর যারাই তাঁর নিকট এসে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করার আবেদন করত তাদেরকে তিনি বলতেন,“মুয়াবিয়ার সাথে আমাদের একটি চুক্তি আছে যা আমরা মেনে চলব এবং সে যতদিন পর্যন্ত জীবিত আছে ততদিন পর্যন্ত আমরা কোন পদক্ষেপ নেব না।”
ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাত
ইমাম হাসান (আ.) মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে ইবাদত-বন্দেগী ও জনগণকে সঠিক পথ প্রদর্শনের কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি শাম ও মদীনায় মুয়াবিয়া ও তার সমর্থকদের সাথে উপযুক্ত ক্ষেত্র ও পরিস্থিতিতে কঠোর আচরণ প্রদর্শন এবং ভর্ৎসনা ও সমালোচনা করেছেন।
সন্ধিচুক্তির দশ বছর পর মুয়াবিয়া তার লম্পট পুত্র ইয়াযীদকে পরবর্তী খলীফা হিসাবে মনোনীত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় যা ইমাম হাসানের সাথে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তির ধারা,বরং ইসলাম ধর্মের বিধি-বিধানের পরিপন্থী ছিল। মুয়াবিয়া তার এ শয়তানী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পথে ইমাম হাসান (আ.)-কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাধা হিসাবে চিহ্নিত করে। তাই সে যে কোন উপায়ে ইমাম হাসানের প্রাণনাশের সিদ্ধান্ত নেয়।
মুয়াবিয়া তার এ জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য ইমাম হাসানের স্ত্রী জাদাহ্ বিনতে আশআসকে ব্যবহার করে। মুয়াবিয়া তার কাছে চিঠি লেখে এবং এক লক্ষ দিরহাম পাঠিয়ে তার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় যে,যদি সে ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে তাহলে সে তাকে ইয়াযীদের সাথে বিবাহ দেবে। অবশেষে মুয়াবিয়ার এ জঘন্য পরিকল্পনা পাপিষ্ঠা জাদার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। ইমাম হাসান (আ.) জাদাহ্ কর্তৃক প্রয়োগকৃত বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।
মৃত্যুবরণ করার পূর্বে ভ্রাতা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতি ইমাম হাসান (আ.) অসিয়ত করে বলেছিলেন,“আমাকে গোসল দেয়া ও কাফন করার পর আমাকে নানা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কবরের কাছে নিয়ে যাবে যাতে করে তাঁর সাথে আমার পুনঃসাক্ষাৎ হয়। তবে জনগণ (বনি উমাইয়্যার সমর্থকরা) হয়তো ভাবতে পারে যে,তোমরা আমাকে রাসূলুল্লাহর কবরের পাশে সমাহিত করতে চাচ্ছ। আর এ কারণেই সেখানে তারা জড়ো হয়ে বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে। আমি তোমাকে মহান আল্লাহর নামে শপথ করাচ্ছি এবং প্রতিশ্রুতি নিচ্ছি যে,আমার জন্য শিঙ্গা বসিয়ে দেহ থেকে বের করে আনা রক্তের পরিমাণও যেন রক্তপাত না ঘটে।”
ইমাম হুসাইন (আ.) ইমাম হাসানের নির্দেশ মতে এ অসিয়ত আঞ্জাম দেয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে বাধা দেয়া হয়। বাধাদানকারীদের (বনি উমাইয়্যা ও তাদের সমর্থকদের) সাথে ইমাম হুসাইনের বেশ কিছু উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। বাধাদানকারীরা জানাযার নামাযে সমবেত লোকদের ওপর বৃষ্টির ন্যায় তীর বর্ষণ করতে লাগল। ইমাম হুসাইন (আ.) তখন ইমাম হাসানের লাশ জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে নিয়ে গিয়ে দাফন করেন।৩
ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)-এর শাহাদাতের পর ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সার্বিক নেতৃত্বের গুরু-দায়িত্ব ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ওপর অর্পিত হয়। ৬০ হিজরীর ১০ মুহররম কারবালায় শাহাদাত বরণ করা পর্যন্ত তাঁর ইমামত দীর্ঘ ১০ বছরের কিছু অধিককাল স্থায়ী হয়েছিল।
(চলবে)
তথ্যসূত্র :
১.ইবনে আসাকির প্রণীত ইতিহাস,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২১।
২.হায়াতুল ইমাম আল হাসান,২য় খণ্ড,পৃ. ২০২; ইবনে শাহরাশুবের আল মানাকিব,২য় খণ্ড,পৃ. ১৪৩ থেকে উদ্ধৃতি সহকারে)
৩.মুহম্মদ আহসানুল্লাহ্ প্রণীত ফিলাফতের ইতিহাস,পৃ. ১০৭,ইসলামিক ফাউন্ডেশন,বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত)
(জ্যোতি,৩য় বর্ষ,১ম সংখ্যা)