বাঙ্গালী
Monday 25th of November 2024
0
نفر 0

ইমাম হোসাইন (আ.)এর চেহলাম

ইমাম হোসাইন (আ.)এর চেহলাম

আশুরার ঘটনার পর কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এই অভ্যুত্থান কোনো ভৌগোলিক,জাতীয়তা বা কালের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। বরং ইতিহাস জুড়ে তিনি সূর্যের মতো সমগ্র বিশ্বকে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করার উৎস হয়ে ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার নেতা মহাত্মা গান্ধী তাঁর দেশের জনগণকে সচেতন করার জন্যে ধর্ম-বর্ণ-মাযহাব নির্বিশেষে সবাইকে ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (আ) এর অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন-জুলুমের উপর বিজয় অর্জনের একমাত্র পথ ইমাম হোসাইনের পথ। তিনি বলেছেনঃ "আমি ভারতের জনগণের জন্যে নতুন কোনো জিনিস নিয়ে আসি নি। কেবল কারবালার কালবিজয়ী বীরের জীবনেতিহাস নিয়ে গবেষণা করে যে ফলাফল পেয়েছি তা-ই আমি ভারতকে দেখিয়েছি। যদি আমরা ভারতকে মুক্তি দিতে চাই,তাহলে সেই পথটিই আমাদেরকে অতিক্রম করতে হবে যে পথ হোসাইন ইবনে আলী অতিক্রম করেছেন।"
কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ) এবং তার সঙ্গীসাথীদের শাহাদাতের পর ইমামের খান্দানের মধ্য থেকে যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাদেরকে বন্দী করা হয়েছিল। এদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বে ছিলেন ইমাম হোসাইনের মহিয়সী বোন হযরত যেয়নাব (সা)। ইতিহাসের ভাষ্য অনুযায়ী ইয়াযিদের বাহিনীর কমান্ডার ওমর সাদ প্রথমে শহীদদের মাথাগুলোকে কুফার শাসক ইবনে যিয়াদের কাছে পাঠায়। ১১ই মুহররম তারিখ বিকেলে বন্দীদের কাফেলা নিয়ে কুফার পথে রওনা হয়। বর্ণিত আছে শহীদদের দেহ মোবারক বনী আসাদ গোত্র কারবালায় এসে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কারবালার তপ্ত মাটির উপরে তিন দিন পড়ে ছিল। তারা শহীদদের পবিত্র লাশের জানাযা নামায পড়েন এবং লাশগুলোকে দাফন করেন। বন্দী কাফেলাকে হৃদয়বিদারক অবস্থার মধ্য দিয়ে কুফায় এবং তারপর সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সাইয়্যেদ ইবনে তাউস তাঁর আল্লাহুফ গ্রন্থে লিখেছেনঃ "ওমর সাদ ইমাম হোসাইন (আ) এর পরিবার-পরিজনের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে কারবালা থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়। মহিলাদেরকে গেলিমে ঢাকা উটের পিঠে চড়ায়। উটের পিঠে লোক বসা বা মালামাল রাখার জন্যে যে বাক্স বাঁধা থাকে তাকে মাহ্মেল বলা হয়। ইমাম হোসাইন (আ) এর পরিবার পরিজনদের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে যেসব উটের পিঠে চড়ানো হয়েছিল সেগুলোর পিঠে কোনো মাহমেল ছিল না, না ছিল কোনো ছায়ার ব্যবস্থা। কাফেলার মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নারী এবং শিশু। পুরুষদের মাঝে কেবল আলী ইবনে হোসাইন ইমাম সাজ্জাদ (আ) এবং ইমাম হাসান (আ) এর দুই সন্তান কাফেলায় ছিলেন। এই কাফেলা যখন কুফা শহরে গিয়ে উপস্থিত হয়, তখন আরেক আশুরা শুরু হয়।"
হযরত যেয়নাব (সা) কারবালার হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর কঠিন অবস্থার মধ্যে কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু কুফায় তিনি অসম্ভব বীরত্বপূর্ণ এবং প্রজ্ঞাময় আচরণ করে ঐতিহাসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি বনী উমাইয়াদের জুলুম-নির্যাতনপূর্ণ শাসনের বিরুদ্ধে পরবর্তী আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। বাশির ইবনে খুযায়ের আসাদি বলেছেনঃ "সেইদিন আলী (আ) এর কন্যা যেয়নাব (সা) সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কেননা খোদার কসম তার মতো আর কোনো নারীকে আমি দেখি নি যে কিনা আপাদমস্তক সলজ্জভঙ্গিতে গভীর শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সাথে পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখতে পারেন। মনে হয় তিনি তাঁর পিতা ইমাম আলী (আ) এর কাছ থেকেই এরকম অর্থপূর্ণ বক্তব্য দিতে শিখেছেন।
যেয়নাব (সা) কুফাবাসীদের উপস্থিতিতে তাদের চুক্তি ভঙ্গ করা সম্পর্কে কথা বলেন এবং বনী উমাইয়াদের বাহ্যিক বিজয়কে নস্যাৎ করে দেন। যেয়নাব (সা) অসম্ভব ভারসাম্যপূর্ণ ও অকাট্য যুক্তিপূর্ণ ভাষায় বক্তব্য রেখে কুফাবাসীদেরকে জাগিয়ে তোলেন যে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং সতর্ক হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। যেয়নাবের বক্তব্য কুফাবাসীদের মাঝে পরিবর্তন এনে দেয়। যার ফলে কুফায় আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটে, সেই অভ্যুত্থানটি মানসিক এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত অভ্যুত্থান। কুফাবাসীরা যেয়নাবের বক্তব্য শুনে তাদের ভুল স্বীকার করলো এবং তওবা করলো। এটাই হলো তাউয়াবিন বা তওবাকারীদের অভ্যুত্থান। যেয়নাব (সা)এর বক্তব্যে এসেছেঃ "হে কুফাবাসীগণ! হে প্রতারকের দল! হে বিশ্বাসভঙ্গকারীগণ! তোমরা আমাদের অবস্থা দেখে কান্নাকাটি করছো? হ্যাঁ! বেশি বেশি কাঁদো, আর কম কম হাঁসো! কারণ তোমরা তোমাদের লজ্জা-শরম খুইয়ে নিজেদের ব্যক্তিত্বকে উলঙ্গপনার দূষণে দূষিত করেছো! তোমাদের এই লজ্জার কালিমা কোনোদিন মুছবে না, কোনোদিন ঘুচবে না। জেনে রাখো তোমাদের আখেরাতের জন্যে তোমরা এমন নোংরা এবং মন্দ আমল পাঠিয়েছো যা দেখে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তোমাদের  উপর অবশ্যই ক্ষিপ্ত হবেন।"
হযরত যেয়নাব (সা) এবং হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ) এর পক্ষ থেকে এরকম স্পষ্ট ভাষণ ইয়াযিদের শাসনের মূল কেন্দ্র সিরিয়াতেও অব্যাহত ছিল। তাদেঁর বক্তব্য শুনে জনগণের মাঝে পরিবর্তন আসে। জনগণ তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং তারা উমাইয়াদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি দেখে ইয়াযিদ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বন্দী কাফেলাকে মদীনায় ফিরে যাবার আদেশ জারি করে। কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী ঐ বছরেরই চেহলামের দিনে আবার কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী পরবর্তী বছরের চেহলাম বার্ষিকীতে ইমাম হোসাইন (আ) এবং অপরাপর শহীদদের পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যগণ তপ্ত রক্তসিক্ত ঐতিহাসিক কারবালার মাটিতে পুনরায় পা রাখেন। স্বজন হারানোর বেদনা আর ইসলামের পতাকাবাহীদের ওপর করুণ নির্যাতনের শোকে কারবালায় এক হৃদয়বিদারক মাতম অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সালাম তোমাকে হে ইমাম হোসাইন! সালাম তোমাকে এবং সেইসব পবিত্র ও মহান ব্যক্তিদের যাঁরা তোমার প্রদর্শিত পথে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

Protest einer Antikriegsgruppe gegen Luftangriff Amerikas auf ein Krankenhaus
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র মাথা ...
১০ ই মহররমের স্মরণীয় কিছু ঘটনা ও ...
আত্মগঠনের মাস : রমযান
দুঃখ-কষ্ট মোকাবেলার উপায়
পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ
রজব মাসের ফজিলত ও আমলসমূহ
তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন

 
user comment