শীয়া মাযহাবের উপদলসমূহ
প্রত্যেক মাযহাবেই কম বেশী এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা ঐ মাযহাবের মূলভিত্তি রচনা করে। ঐ বিষয়গুলোর পরে অন্যসব বিষয় দ্বিতীয় শ্রেণীর পর্যায়ভূক্ত। তাই মাযহাবের মূলনীতির উপর পূর্ণ আস্থা রেখে দ্বিতীয় শ্রেণীর খুঁটি-নাটি বিষয়ের মত পার্থক্যের ভিত্তিতে অন্য যেসব দল গঠিত, সেসব দল ঐ মূল মাযহাবের উপদল হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীর সকল ঐশী ধর্মেই (ইহুদী, খৃষ্টান, মাজুসী ও ইসলাম) এ ধরণের দল ও উপদলের উপস্থিতি বিদ্যমান। প্রথম তিন ইমামের {হযরত ইমাম আলী (আ.), হযরত ইমাম হাসান (আ.) ও হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)} যুগে শীয়া মাযহাবের কোন উপদলের সৃষ্টি হয়নি। হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদতের পর অধিকাংশ শীয়াই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পুত্র হযরত ইমাম সাজ্জাদ (জয়নুল আবেদীন) (আ.)-কে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে। কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক, যারা ‘কিসানিয়া’ নামে পরিচিত ছিল, ইমাম আলী (আ.)-এর তৃতীয় পুত্র হযরত মুহাম্মদ বিন হানাফিয়াকে তাদের ৪র্থ ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ বিন হানাফিয়াই ছিলেন সেই প্রতীক্ষিত মাহদী (আ.)। যিনি ‘রোযাভী’ নামক পাহাড়ে অদৃশ্য হয়েছিলেন এবং কোন একদিন আত্মপ্রকাশ করবেন! হযরত ইমাম সাজ্জাদ (জয়নলু আবেদীন) (আ.)-এর শাহাদতের পর অধিকাংশ শীয়ারাই তদীয় পুত্র হযরত ইমাম বাকের (আ.)-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু কিছু সংখ্যক শীয়া হযরত ইমাম জয়নলু আবেদীন (আ.)-এর শাহাদত প্রাপ্ত অন্য এক পুত্র যাইদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। যারা পরবর্তীতে ‘যাইদিয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
হযরত ইমাম মুহাম্মদ বাকের (আ.)-এর শাহাদতের পর তার অনুসারী শীয়ারা তদীয় পুত্র হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর শাহাদতের পর অধিকাংশ শীয়ারাই তদীয় পুত্র হযরত ইমাম মুসা কাজেম (আ.)-কে তাদের সপ্তম ইমাম হিসাবে গ্রহণ করেন। তবে কিছু সংখ্যক শীয়া হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর প্রথম পুত্র ইসমাঈলকে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে। যদিও হযরত ইসমাঈল তার পিতার জীবদ্দশাতেই মৃত্যু বরণ করে ছিলেন। এভাবে হযরত ইসমাঈলকে ইমাম হিসাবে গ্রহণের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে বৃহত্তর শীয়া জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং পরবর্তীতে ‘ইসমাঈলীয়া’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আবার শীয়াদের কেউ কেউ হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর অন্য পুত্র হযরত আবুদলাহু আফতাহকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে। শীয়াদের অন্য একটি অংশ ৬ষ্ঠ ইমামের অন্য এক পুত্র মুহাম্মদকে তাদের ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে। শীয়াদের আরেকটি অংশ ৬ষ্ঠ ইমাম হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-ই তাদের সর্বশেষ ইমাম হিসেবে বিশ্বাস করে। হযরত ইমাম মুসা কাজিমের শাহাদতের পর অধিকাংশ শীয়াই তদীয় পুত্র হযরত ইমাম রেজা (আ.)-কে তাদের অষ্টম ইমাম হিসাবে গ্রহণ করে। শীয়াদের একটি অংশ সপ্তম ইমাম হযরত ইমাম মুসা কাজেম (আ.)-কেই তাদের সর্বশেষ ইমাম হিসাবে বিশ্বাস করে। আর পরবর্তীতে তারা ‘ওয়াকিফিয়াহ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু অষ্টম ইমাম হযরত ইমাম রেজা (আ.) থেকে দ্বাদশ ইমাম হযরত মাহদী (আ.) পর্যন্ত শীয়াদের মধ্যে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উপদলের সৃষ্টি হয়নি। যদিও এসময়ে উপদল সৃষ্টির মত বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু খবু বেশীদিন তা টিকে থাকেনি। বরং এমনিতেই সে সমস্যা মিটে গিয়েছিল। যেমনঃ দশম ইমাম হযরত নাকী (আ.)-এর পুত্র জাফর একাদশ ইমাম হযরত ইমাম আসকারী (আ.)-এর শাহাদতের পর ইমামতের দাবী করেন। ফলে শীয়াদের একটি অংশ তার অনুসারীও হয়ে পড়ে। কিন্তু অল্প কিছু দিন পরই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওদিকে জাফরও ইমামতের দাবী নিয়ে আর তেমন একটা উচ্চবাচ্য করেনি। ফলে ব্যাপারটা ওখানেই ধামা চাপা পড়ে। এ ছাড়াও ইসলামী আইন (ফিকাহ) ও মৌলিক বিশ্বাস সমূহে শীয়া পন্ডিতদের মধ্যে জ্ঞানগত খুঁটিনাটি বিষয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে, যেগুলোকে সঠিক অর্থে শীয়াদের উপদল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। উপরোল্লিখিত অধিকাংশ শীয়া উপদলগুলো বেশ অল্পদিনের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুল শীয়া জনগোষ্ঠীর মোকাবিলায় মুলতঃ মাত্র দু’টা দলই টিকে থাকে। এরা হচ্ছে ‘যাইদিয়াহ’ ও ‘ইসমাঈলীয়াহ’ দল। এদের অস্তিত্ব বর্তমানে ইয়ামান, ভারত এবং লেবাননসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে পরিলক্ষিত হয়। এ কারণেই ‘দ্বাদশ ইমামপন্থী’ শীয়াদের পাশাপাশি শুধুমাত্র ‘যাইদিয়াহ’ ও ইসমাঈলীয়াহ্’ শীয়াদের আলোচনাই যথেষ্ট বলে মনে করছি।
যাইদিয়াহ্ শীয়া উপদল
চতুর্থ ইমাম হযরত ইমাম সাজ্জাদ (জয়নলু আবেদীন) (আ.)-এর শাহাদত প্রাপ্ত পুত্র হযরত যাইদের অনুসারীরাই ‘যাইদিয়াহ’ নামে পরিচিত। হিজরী ১২১ সনে হযরত যাইদ, উমাইয়া খলিফা হিশাম বিন আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। একদল লোক তার হাতে এ উপলক্ষ্যে বাইয়াতও করে। ইরাকের কুফা শহরে খলিফার বাহিনীর সাথে যুদ্ধের সময়ে হযরত যাইদ শাহাদত বরণ করেন। হযরত যাইদের অনুসারীরা তাকে পবিত্র আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম হিসাবে বিশ্বাস করে। হযরত যাইদের পর তদীয় পুত্র ইয়াহ্ইয়া বিন যাইদ তার স্থলাভিষিক্ত ´ হন। তিনিও উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন ইয়াযিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং শহীদ হন। এর পর মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ আব্বাসীয় খলিফা মানসুর দাওয়ানিকির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং শহীদ হন। ইয়াহইয়া বিন যাইদের শাহাদতের পর উপরোক্ত দু’জনকেও যাইদিয়াহগণ্ ইমাম হিসেবে বিশ্বাস করেন। কিন্তু এর পর বেশ কিছু যুগ পর্যন্ত যাইদিয়াদের কার্যক্রমে বিশৃংখলা বিরাজ করে। অতঃপর নাসের অতরুশ নামে হযরত যাইদের ভ্রাতৃবংশীয় জনৈক ব্যক্তি ‘খোরাসানে’ আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু স্থানীয় শাসকগোষ্ঠির উৎপীড়নের কারণে সেখান থেকে পালিয়ে ‘মাযেন্দারান’ গিয়ে আশ্রয় নেন। মাযেন্দারানবাসী তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। জনাব নাসের অতরুশ দীর্ঘ ১৩ বছর যাবৎ মাযেন্দারান ইসলামের প্রচার কার্যচালান এবং প্রচুর সংখ্যক লোককে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং এরা সবাই ‘যাইদিয়াহ’ পন্থী শীয়ায় পরিণত হয়। এর পর তাদের সহযোগীতায় ‘তাবারিস্থানের’ একটি অংশ দখল করে জনগণের ইমাম হিসাবে সেখানে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। তার পর বহুযুগ ধরে তার বংশের উত্তরাধিকারীরা একের পর এক ঐ অঞ্চলে ইমাম হিসেবে রাজ্য শাসনের কাজ চালিয়ে যান। ‘যাইদিয়া’দের বিশ্বাস অনুসারে হযরত ফাতেমা (আ.)-এর বংশের যে কোন আলেম, বীর, উদার ও সাধুপুরুষ যদি সত্যের পক্ষে রাজনৈতিক বিদ্রোহ পরিচালনা করেন তাহলে, তিনিই ইমাম হওয়ার যোগ্যতোর অধিকারী হবেন। যাইদিয়ারা তাদের প্রাথমিক অবস্থায় ইসলামের প্রথম দু’খলিফা আবু বকর ও ওমরকেও তাদের ইমাম হিসেবে গ্রহণ করত। কিন্তু পরবর্তীতে ‘যাইদিয়া'দের কিছু লোক প্রথম দু’খলিফাকে তাদের ইমামের লিষ্ট থেকে বাদ দেন এবং হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে তাদের সর্বপ্রথম ইমাম হিসেবে ঘোষণা করেন। মৌলিক বিশ্বাসের দিক থেকে ‘যাইদিয়’রা মু’তাযিলাদের সদৃশ্য। কিন্তু ফিকহের ব্যাপারে তারা আহলে সুন্নাতের (চার মাজহাবের একটি) হানাফি মাযহাবের অনুসারী, যার নেতা হল ইমাম আবু হানিফা। অবশ্য জ্ঞানগত বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে তাদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ মত প্রার্থক্যও রয়েছে।১
ইসমাঈলীয়া সম্প্রদায় ও তার গোত্র সমূহ
‘বাতেনী দল’ : ৬ষ্ঠ ইমাম হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর প্রথম পুত্রের নাম ছিল ইসমাঈল।২ তিনি তার পিতা হযরত জাফর সাদেক (আ.)-এর জীবদ্দশাতেই মৃত্যু বরণ করেন। পুত্র ইসমাঈলের মৃত্যুর ব্যাপারে স্বয়ং হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) নিজে সাক্ষী দেন এবং মদীনার তদানিন্তন শাসকও এ ব্যাপারে সাক্ষী দেন। তথাপি শীয়াদের একটি দল বিশ্বাস করত যে, তিনি মৃত্যু বরণ করেননি, বরং আত্মগোপন করেছেন এবং তিনি পুনরায় আত্মপ্রকাশ করবেন! আর তিনি হচ্ছেন সেই প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.)। পুত্র ইসমাঈলের মৃত্যুর ব্যাপারে ৬ষ্ঠ ইমামের সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়টি এক প্রকারের ‘তা’মিদ’ (পবিত্র পানি দিয়ে অভিসিঞ্চন করানো) ছিল, যা আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের ভয়ে সম্পন্ন করা হয়েছিল। শীয়াদের একটি অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, ইমামতের অধিকার ইসমাঈলেরই। কিন্তু পিতার জীবদ্দশায় মৃত্যুর কারণে ইমামত তার ভাই মুহাম্মদের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। শীয়াদের অন্য একটি অংশ বিশ্বাস করত যে, ইসমাঈল যদিও পিতার জীবদ্দশাতেই মৃত্যু বরণ করেছেন, তথাপি সেই ইমাম এবং তার মৃত্যুর পর আপন পুত্র মুহাম্মদ বিন ইসমাঈলই পরবর্তী ইমাম হয়েছেন এবং এভাবে ইমামত ইসমাইল বংশেই সীমিত থাকবে। প্রথম দু’টা উপদল অল্প দিনের মধ্যেই অবলুপ্ত হয়ে যায়। তবে তৃতীয় উপদলটি এখনও টিকে আছে এবং তার আরও কিছু উপদল সৃষ্টি হয়েছে। ইসমাঈলীয়াগণ বিশ্বাসগত দিক থেকে একটি বিশেষ দর্শনের অধিকারী তা বেশ কিছুটা নক্ষত্র পুজারীদের মত যা ভারতীয় আধাত্মবাদের সাথে মিশ্রিত। ইসলামী আইন ও জ্ঞানের ব্যাপারে ইসমাঈলীয়াগণের বিশ্বাস হচ্ছে, প্রতিটি বাহ্যিক বিষয়েরই একটি অর্ন্তদিক রয়েছে এবং কুরআনের প্রতিটি আয়াতেরই ‘তা’উইল’ (পরিবর্তনশীল ব্যাখা)রয়েছে।
এ ছাড়াও তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এ বিশ্ব কখনও ‘হুজ্জাত’ বা ঐশী প্রমাণ বা প্রতিনিধি শূণ্য হতে পারে না। আল্লাহর সেই হুজ্জাত বা প্রমাণ দু’ধরণের : (১) সবাক ও (২) নির্বাক।
আল্লাহর রাসূল (সা.) তার সবাক প্রমাণ। আর রাসূল (সা.)-এর প্রতিনিধি বা ইমামগণ হচ্ছেন আল্লাহর নির্বাক প্রমাণ। ইমামগণ মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকারী তথা মহান আল্লাহর সামগ্রিক প্রভূত্বের বহিঃপ্রকাশ ও প্রমাণ স্বরূপ। আল্লাহর এই প্রমাণ বা হুজ্জাতের ভিত্তি সাতটি সংখ্যার মধ্যে আবর্তিত। অর্থাৎ একজন নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হন, যিনি শরীয়ত ও বিলায়াতের (কর্তৃত্ব ) ক্ষমতার অধিকারী। তার পর তার ওসিয়াত (উইল) অনুসারে সাতজন তার উত্তরাধিকারী হবেন, যাদের সবাই সমমর্যাদা সম্পন্ন হবেন। কিন্তু এদের মধ্যে সপ্তমব্যক্তি নবুয়তের অধিকারীও হবেন এবং তিনি তিনটি পদের অধিকারী হবেন। নবুয়ত, ওসিয়ত, বিলায়াত। পুনরায় তার পর তাঁর ওসিয়ত (উইল) অনুযায়ী সাত জন ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারী হবেন। এদের সপ্তম পূর্বের মতই তিনটি পদ বা মর্যাদার অধিকারী হবেন। আর এ ভাবেই এই ধারা অব্যাহত থাকবে। তারা বলে থাকেন : হযরত আদম (আ.) সর্বপ্রথম নবুয়ত ও বিলায়াত সহ আল্লাহর পক্ষথেকে অবতির্ণ হয়েছেন। তার পর, তার সাত জন উত্তরাধিকারী ছিলেন। এদের মধ্যে সপ্তম ব্যক্তি হচ্ছেন হযরত নুহ (আ.)। আর হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সাতজন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সপ্তম বিশ্বাস হচ্ছেন হযরত মুসা (আ.)। হযরত ঈসা (আ.), হযরত মুসা (আ.)-এর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সপ্তম বিশ্বাস ছিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.), হযরত ঈসা (আ.)-এর সাতজন উত্তরাধিকারীর মধ্যে ছিলেন সপ্তম। আর জনাব মুহাম্মদ বিন ইসমাইল ছিলেন রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সপ্তম। নিয়মানুযায়ী যথাক্রমে হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত আলী (আ.), হযরত ইমাম হুসাইন (আ.), হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.), ইমাম মুহাম্মদ বাকের (আ.), হযরত জাফর সাদিক (আ.) এবং ইসমাইল ও মুহাম্মদ বিন ইসমাইল হচ্ছেন ইমাম। {দ্বিতীয় ইমাম হাসান (আ.)-কে তারা ইমাম হিসেবে গণ্য করেন না} জনাব মুহাম্মদ বিন ইসমাঈলের পর তদ্বংশীয় সাতজন উত্তরাধিকারীর নাম আজও গোপন রয়েছে। তারপর সাতজন উত্তরাধিকারী হচ্ছেন মিশরের ফাতেমী বংশীয় বাদশাহগণ। এদের প্রথম ব্যক্তি হচ্ছেন উবাইদুলাহ্ মাহদী। যিনি সর্বপ্রথম মিশরে ফাতেমী বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
ইসমাঈলীয়াগণ আরও বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর ‘হুজ্জাত’ বা ‘প্রমাণ’ ছাড়াও আরও বারজন নেতা রয়েছেন, যাঁরা আল্লাহর হুজ্জাত বা ঐশী প্রতিনিধির বিশেষ ঘনিষ্ট ব্যক্তি। ইসমাঈলীয়াদের কিছু উপদল যেমন দ্রুযদের বিশ্বাস অনুযায়ী ঐ বারজন নেতার মধ্যে পবিত্র আহলে বাইতের ছয়জন ইমামও অন্তর্ভুক্ত। বাকী ছয়জন অন্যান্য ব্যক্তি। হিজরী ২৮৮ সনে (মিশরে উবাইদুলাহ্ মাহদীর আবির্ভাবের ক’বছর পূর্বে ) কুফা শহরের নিকটে ইরানের খুজিস্তানেরর অধিবাসী জনৈক ব্যক্তির অভুদ্বয় ঘটে, সে কখনও তার আত্ম পরিচয় দেননি। ঐ ব্যক্তি সারা দিন রোযা রাখত ও সারা রাতব্যাপী ইবাদতে নিমগ্ন থাকত এবং কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করত। আর জনগণের মধ্যে ইসমাঈলীয়া মাযহাব প্রচার করত। এভাবে প্রচুর সংখ্যক লোক তার মাধ্যমে ইসমাঈলীয়া মাযহাবে দীক্ষিত হয়। ঐ ব্যক্তি তার অনুসারীদের মধ্যে বারজনকে নেতা হিসেবে নির্বাচন করে। এর পর সে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে কুফা ত্যাগ করে। তার পর থেকে তার কোন সংবাদ আর পাওয়া যায়নি। তারপর আহমাদ ওরফে কিরমিত নামক জনৈক অখ্যাত ব্যক্তি ইরাকে তার স্থলাভিষিক্ত হয় এবং ‘গুপ্ত বিশ্বাস’ শিক্ষার প্রসার ঘটাতে থাকে। ঐতিহাসিকদের বক্তব্য অনুসারে ঐ ব্যক্তি ইসলামের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের স্থলে নতুন নামাজের প্রবর্তন করে। ‘জানাবাতের গোসলের’ আইন সে রহিত করে এবং মদ পানকে হালাল বলে ঘোষণা করে। পাশাপাশি অন্যান্য ‘গুপ্তপন্থী’ (ইসমাঈলীয়া) গোত্রেরর নেতাদেরকে বিদ্রোহ করার আহবান জানায়। এ উপলক্ষ্যে একদল লোককে তার চতুর্পাশ্বে সমবেত করে। এরা ‘গুপ্তপন্থী’ মাযহাবের অনুসারী ছাড়া অন্য কারো জান মালের প্রতি এতটকু সম্মানেও বিশ্বাসী ছিল না। এর ফলে তারা ইরাক, সিরিয়া, বাহরাইন্ ও ইয়ামানে আন্দোলন চালানোর নামে অসংখ্য জনগণকে হত্যা করে এবং তাদের সকল সম্পদ লুন্ঠন করে। তারা বহুবার হজ্জ যাত্রীদের কাফেলায় আক্রমণ চালিয়ে হাজার হাজার হাজীকে হত্যা এবং তাদের সর্বস্ব লুন্ঠন করে। ‘গুপ্তপন্থীদের’ (ইসমাঈলীয়া) জনৈক নেতা আবু তাহের কিরমিত হিজরী ৩১১ সনে বসরা শহর দখল করে সেখানে ব্যাপক গণহত্যা ও লুটতরাজ চালায়। হিজরী ৩১৭ সনে ‘গুপ্তপন্থী’ দের বিরাট এক বাহিনী সহ হজ্জ মৌসুমে সে মক্কাভিমুখে যাত্রা করে। সে সামান্য চেষ্টাতেই মক্কা নগরীর প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের বুহ্য ভেদ করে মক্কায় প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। আবু তাহের কিরমিতির নেতৃত্বে মক্কায় প্রবেশ করে তার বাহিনী মক্কার অধিবাসী ও নবাগত হাজীদের মধ্যে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। এমন কি তারা মসজিদুল হারাম এবং পবিত্র কাবা ঘরের ভেতর রক্তের বন্যা প্রবাহিত করে। এরপর পবিত্র কা’বা ঘরের গিলাফ বা আচ্ছাদনটি টুকরা টুকরা করে নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেয়। এমন কি পবিত্র কা’বা ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে সেখানে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক ‘হাজরে আসওয়াদ’ নামক পবিত্র কালো পাথরটি বের করে ‘ইয়ামানে’ নিয়ে যায়। প্রায় ২২ বাছর যাবৎ ঐ পবিত্র ‘হাজরে আসওয়াদ’ পাথরটি ‘কিরমিতি’ বংশীয় লোকদের কাছে সংরক্ষিত ছিল। এ জাতীয় কার্য কলাপের কারণেই বিশ্বে ও মুসলমানরা ‘ইসমাঈলীয়া’দের (গুপ্তপন্থী) সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয় এবং তাদের ইসলামী মাযহাবসমুহের বহিঃর্ভূত বলে ঘোষণা করে। এমন কি ঐ যুগে উবাইদলাহ মাহদী যখন মিসরে ফাতেমী বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে ‘মাহদী মাওউদ’ (প্রতিশ্রুত মাহদী) এবং ‘ইসমাঈলীয়া’ দের ইমাম হিসাবে ঘোষণা করেছিল সেও আবু তাহের কিরমিতির এহেন জঘণ্য কার্য কলাপের তীব্র নিন্দা ও অসন্তুষ্টি জ্ঞাপন করে। ঐতিহাসিকদের মতানুসারে, ইসমাঈলীয়া (গুপ্তপন্থী) মাযহাবের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা ইসলামের সকল বাহ্যিক আইন-কানুনকেই তাদের তথাকথিত গুপ্ত ও আধ্যাত্মিক পন্থায় ব্যাখার মাধ্যমে ‘তা’উইল’ বা পরিবর্তিত করে। তাদের মতে ইসলামী শরীয়তের এসব বাহ্যিক আইন-কানুন শুধুমাত্র তাদের জন্যেই নির্দিষ্ট, যারা তুলনা মূলক ভাবে কম প্রজ্ঞার অধিকারী এবং আধ্যাত্মিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। তাদের বেশ কিছু ধর্মীয় আইন তাদের ইমামের দ্বারা প্রণীত হয়ে থাকে।
নাযারিয়া, মুসতাআ’লিয়া, দ্রুযিয়া ও মুকনিয়া উপদল সমুহ
হিজরী ২৯৬ সনে আফ্রিকা মহাদেশে যখন উবাইদুলাহ মাহদীর অভ্যুদয় ঘটে, তখন সে ইসমাঈলীয়াদেরকে তার ইমামত গ্রহণের আহবান জানায় এবং মিশরে তার ফাতেমী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তারপর তার বংশের লোকেরা মিশরকে তাদের খেলাফতের রাজধানী হিসেবে পরপর সাত পুরুষ যাবৎ রাজত্ব অব্যাহত রাখে। ফাতেমী বংশের ঐ শাসন আমলে কোন ধরণের উপদলে বিভক্ত না হয়েই তারা ইসমাঈলীয়া ইমামতের পদ ও স্বীয় রাজত্ব সংরক্ষণ করে যেতে সক্ষম হয়। ফাতেমী বংশের সপ্তম পুরুষ বাদশাহ মুসতানসীর বিল্লাহ সাদ বিন আলীর নাযার ও মুসতাআ’লি নামক দু’পুত্র ছিল। খেলাফত ও ইমামতের পদাধিকার দখল নিয়ে দু’ভাবইয়ের মধ্যে চরম বিভেদ শুরু হয়। অতঃপর সুদীর্ঘ সংঘর্ষ ও বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুসতাআ’লী, নাযারকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। এর পর সে নাযারকে বন্দী করে এবং পরিশেষে জেলেই তার মৃত্যু ঘটে। দু’ভাইয়ের এ জাতীয় বিবাদের ফলে ফাতেমীয় অনুসারীদের মধ্যে ‘নাযারিয়া’ এবং ‘মুসতাআ’লী’ নামক দু’টা নতুন দলের সূত্রপাত ঘটে।
(ক) নাযারিয়া : নাযারিয়াগণ মুলত: হাসান সাবাহর অনুসারী ছিল, যে মুসতানসির বিল্লাহর অত্যন্ত ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্থ ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন। মুসতানসির বিল্লাহর মৃত্যুর পর সে নাযারকে সমর্থন করে। একারণে মুসতাআ’লী ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হাসান সাবাহকে মিশর থেকে বহিস্কার করে। মিশর থেকে বহিস্কৃত হয়ে হাসান সাবাহ্ ইরানের আগমন করে। কিছু কাল পরই সে ইরানের কাজভীন ‘আল মউত’ প্রাসাদ সহ আ্রশ প্রাশর প্রাসাদ সমূহ দখল করে বসে এবং সেখানে রাজত্ব করা শুরু করে। হিজরী ৫১৮ সনে হাসান সাবাহর মৃত্যুর পর বুযুর্গ উমিদ রুদবারী এবং তার মৃত্যুর পর তদ্বীয় পুত্র কিয়া মুহাম্মদ, হাসান সাবাহর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শ অনুসারেই শাসন কার্য চালিয়ে যায়। তার মৃত্যুর পর চতুর্থ বাদশাহ্ হাসান আলা ‘যিকরিহিস্ সালাম পৈত্রিক আদর্শ নাযারিয়া মাযহাব ত্যাগ করে এবং ‘গুপ্তপন্থী’ (ইসমাঈলীয়া) মাযহাবের অনুসারী হয়। এরপর হালাকু খান ইরান আক্রমণ করে ইসমাঈলীয়াদের রাজ প্রাসাদ দখল করে তা ধ্বংস করে ধুলিসাৎ করে দেয় এবং ইসমাঈলীয়াদের নির্বিচারে হত্যা করে। এরপর হিজরী ১২৫৫ সনে আগাখান মাহালাতি নামক জনৈক নাযারিয়াপন্থী ইরানের কেরমানশাহ্ অঞ্চলে মুহাম্মদ শাহ্ কাজরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পরাজিত হয়। অতঃপর সে ভারতের বোম্বাই শহরে পালায়ন করে। এরপর সে বোম্বাইতে ‘গুপ্তপন্থী’ নাযারিয়া মাযহাবের ইমাম হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করে এবং তার মাযহাবের প্রচার ও প্রসারের কাজ চালাতে থাকে। তাদের ঐ প্রচার কার্য এখনও অব্যাহত আছে। তারা বর্তমানে ‘আগাখানী’ হিসাবে পরিচিত।
(খ) মুসতাআ’লীয়া : এ মাযহাবের অনুসারীরা সবাই ফাতেমীয় ছিলেন এবং ফাতেমীয় খলিফাদের মধ্যেই এ মাযহাব অব্যাহত ছিল। প্রায় হিজরী ৫৫৭ সন পর্যন্ত এ মাযহাব টিকে ছিল। এর পরই এ মাযহাবের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু কিছু দিন পরই বোহরা নামে এ মাযহাব পুনরায় ভারতে আবির্ভূত হয়, যা আজও সেখানে টিকে আছে।
(গ) দ্রুযিয়া : এ উপদলের অনুসারীরা সিরিয়া সীমান্ত সংলগ্ন ‘দ্রুয’ পর্বতমালার অধিবাসী। এরা মূলতঃ মিশরে ফাতেমীয় খলিফাদের অনুসারী ছিল। কিন্তু ফাতেমীয় ৬ষ্ঠ খলিফার শাসন আমলে জনৈক ‘নেশতেগীন দ্রুযির’ আহবানে গুপ্তপন্থী (ইসমাঈলীয়া বা বাতেনী) সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত হয়। দ্রুযিয়ারা তাদের ইমাম আল হাকিম বিল্লাহ নিহত হওয়ার পর তার ইমামতের প্রতিই স্থির থাকে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি মৃত্যু বরণ করেননি বরং আত্মগোপন করে উর্দ্ধাকাশে গমণ করেছেন। তিনি ভবিষ্যতে পুনরায় জনগণের মাঝে ফিরে এসে আত্মপ্রকাশ করবেন।
(ঘ) মুকনিয়া : মূলতঃ জনাব আতা মারউই মুকনিয়ার অনুসারীরাই ‘’মুকনিয়া’’ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকদের মতানুসারে এরা আবু মুসলিম খোরাসানির অনুসারী ছিল। আবু মুসলিমের মৃত্যুর পর আতা মারউই দাবী করে যে, আবু মুসলিমের আত্মা তার দেহে প্রবেশ করেছে। এর কিছুদিন পর সে নবুয়তের দাবী করে বসে। তার কিছু কাল পর সে খোদা হওয়ার দাবী করে। অবশেষে হিজরী ১৬২ সনে ‘মাওয়ারাইন নাহার’ অঞ্চলের ‘কিশ’ প্রাসাদে তাকে ঘেরাও করা হয়। নিজের গ্রেফতার ও নিহত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর সে আগুন জ্বালিয়ে কিছু সংখ্যক ভক্ত অনুরাগী সহ সেই আগুনে প্রবেশ করে আত্মহত্যা করে। এরপর ‘মুকনিয়ার’ অনুসারীরা ‘ইসমাঈলীয়া’ মাযহাব গ্রহণের মাধ্যমে ‘গুপ্তপন্থী’দের দলে সামিল হয়।
দ্বাদশ ইমাম পন্থী শীয়া এবং যাইদিয়া ও ইসমাঈলীয়া
শীয়া মাযহাবের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি, যা থেকে উপরোল্লিখিত সংখ্যালঘু উপদল সমুহ সৃষ্টি হয়েছে, তা মূলতঃ ‘ইমামিয়া’ বা ‘দ্বাদশ ইমাম পন্থী শীয়া’ মাযহাব নামে পরিচিত। যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, মহানবী (সা.)-এর পরে তার সাহাবীদের মধ্যে দু’টা বিষয় নিয়ে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছিল, যা মহানবী (সা.)-এর শিখানো সুন্নাতের প্রতি গুরুত্ব না দেয়ারই প্রতিফল ছিল। সে দু’টা বিষয় ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক’ ও ইসলামী জ্ঞানের নেততৃ’ এ ব্যাপারে শীয়াদের দৃষ্টিতে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতগণই (আ.) ঐ দু’টা বিষয়ে নেতৃত্বের ন্যায্য অধিকারী ছিলেন। শীয়াদের বক্তব্য ছিল, ইসলামী খেলাফত পদের জন্য ‘বিলায়াত’ ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের যোগ্যতো একান্ত অপরিহার্য শর্ত। আর এ শর্ত একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পবিত্র সন্তানদের মধ্যে বিদ্যমান। কেননা, এ ব্যাপারে স্বয়ং মহানবী (সা.) এবং তার পবিত্র আহলে বাইতের বারজন ইমামের (আ.) সুস্পষ্ট ব্যাখা রয়েছে। শীয়ারা বলতঃ পবিত্র কুরআনের বাহ্যিক শিক্ষা অর্থাৎ ইসলামী শরীয়ত ও আইন কানুন, এবং একই ভাবে মানুষের পূর্ণাঙ্গ আধ্যাত্মিক জীবন বিধান সম্বলিত, যা মৌলিকত্ব ও একান্ত গুরুত্বের দাবীদার। কেয়ামত পর্যন্ত এই কুরআন ও শরীয়ত কখনও বাতিল হবে না। ইসলামী শরীয়তের এই আইন কাননু একমাত্র রাসূল (সা.)-এর আহল বাইতের মাধ্যমে অর্জন করা উচিত।
এখান থেকেই দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়া ও যাইদিয়াদের মূল প্রার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যাইদিয়াগণ মূলত ইমামতের বিষয়টিকে পবিত্র আহলে বাইতের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে করে না এবং ইমামদের সংখ্যা বারজনের মধ্যে নির্ধারিত বলেও বিশ্বাস করে না। একই ভাবে তারা পবিত্র আহলে বাইতের ফেকাহর অনুসরণ করে না যা দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের সম্পূর্ণ বিরোধী বিশ্বাস। অপর দিকে যাইদিয়াগণ বিশ্বাস করেন যে, ইমামত ও নবুয়ত সাতটি সংখ্যার মধ্যে নিয়মিত আবর্তিত হয় এবং নবুয়ত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে এসে শেষ হয়নি। ইসলামী শরীয়তের আইন-কানুন পরিবর্তন ও বাতিলের যোগ্য এবং ইসলামের ব্যাপারে মানুষের মূল দায়িত্ব রহিত হওয়ার ব্যাপারে ‘গুপ্তপন্থী’দের (বাতেনী) দৃষ্টিতে কোন অসুবিধা নেই! অথচ দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের বিশ্বাস হচ্ছে : মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ই সর্বশেষ নবী এবং বারজন ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর পরে তার উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত´ হবেন। শরীয়তের বাহ্যিক কাঠামোই নির্ভরযোগ্য এবং চির অপরিবর্তনশীল। আর তারা কুরআনের বাহ্যিক ও অন্তস্থ রূপ, দুটোতেই বিশ্বাসী। আলোচনার পরিসমাপ্তি: শেইখিয়ে ও কারিম খান গোষ্ঠিদ্বয় গত দু’শতাব্দী থেকে দ্বাদশপন্থী শীয়াদের মাঝে আবির্ভূত হয়েছে। উপরোক্ত উপদল সমূহের সাথে সূত্রগত সামান্য কিছু বিরোধ ছাড়া মৌলিক কোন পার্থক্য না থাকায় তাদেরকে এখানে একটি স্বতন্ত্র উপদল হিসেবে পরিগণিত করা হয়নি। একই ভাবে দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের আরেকটি উপদল যাদেরকে গুপ্তপন্থী ইসমাঈলীয়া শীয়াদের মত ‘গুলাত’ বা বিচ্যুত বলা হয়ে থাকে। যারা কেবল মাত্র শরীয়তের অন্তস্থরূপে বিশ্বাসী তাদের এ জাতীয় বিশ্বাসের পক্ষে কোন প্রকারের সুশৃংঙ্খল যুক্তি উপস্থাপন করতে তারা অক্ষম। তাই তাদেরকেই এখানে একটি স্বতন্ত্র উপদল হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।
দ্বাদশ ইমামপন্থী শীয়াদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পূর্ববর্তী দুটো অধ্যায়ে এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, শীয়াদের বৃহত্তর জন গোষ্ঠিই ‘দ্বাদশ ইমামপন্থী’ শীয়া মাযহাবের অনুসারী। এরা মূলতঃ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর একান্ত ভক্ত ও অনুসারী ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর পরলোক গমনের পর রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা ও ইসলামী জ্ঞানগত নেতৃত্বের বিষয়ে রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সমালোচনা ও প্রতিবাদ করার মাধ্যমে এরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। খেলাফায়ে রাশেদীনের যুগে (হিজরী ১১-৩৫ সন) শাসক গোষ্ঠির দ্বারা শীয়ারা প্রচন্ড রাজনৈতিক চাপের মুখে দিনাতিপাত করে। এরপর উমাইয়া খলিফাদের যুগে (হিজরী ৪০-১৩২ সন) শীয়ারা জান-মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা সার্বিক ভাবে হারিয়ে ফেলে। কিন্তু অত্যাচার ও অবিচারের মাত্রা যতই বাড়তে থাকে, তাদের মৌলিক বিশ্বাসও ততই দৃঢ়তর হতে থাকে। বিশেষ করে তাদের ঐ অসহায়ত্ব ও অত্যাচারীত অবস্থা তাদের নিজস্ব মতাদর্শগত উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখতে সমর্থ হয়। এরপর হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আব্বাসিয়রা যখন খেলাফতের মসনদ দখল করে, শীয়ারা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ঐ মধ্যবর্তী সুযোগে কিছুটা হলেও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলার প্রয়াস প্রায়। কিন্তু কিছু দিন না যেতেই তাদের ভাগ্য আবার সংকুচিত হয়ে এলো। আর এ অবস্থা হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যখন শীয়া মতাদর্শের অধিকারী ‘আলে-বুইয়া’ বংশ শাসন ক্ষমতা দখল করে, শীয়ারা এই প্রথম বারের মত শক্তি অর্জন করার প্রয়াস প্রায়। ঐ সময় তারা ইচ্ছেমত কাজ করার স্বাধীনতা ও সুযোগ ভোগ করে। তখন তারা প্রকাশ্যে ভাবে স্বীয় মতাদর্শ রক্ষার সংগ্রামে অবতির্ণ হয়। এ অবস্থা হিজরী পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। আর হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে মোগলদের ইসলামী দেশ সমূহ আক্রমন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা এবং দীর্ঘদিন ব্যাপী ক্রসেডের যুদ্ধ অব্যাহত থাকার কারণে তদানিন্তন ইসলামী শাসকগোষ্ঠি শীয়া বিশ্বের উপর রাজনৈতিক বা সামরিক চাপ প্রয়োগের তেমন একটা সুযোগ পায়নি। এ ছাড়াও ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু মোগল সম্রাটের শীয়া মাযহাবে দীক্ষিত হওয়া, মাযেন্দারান শীয়াপন্থী ‘মারআশী’ বংশীয় রাজত্ব এবং সর্বত্র শীয়া জনগোষ্ঠীর ব্যাপক বিস্তৃতি শীয়া মাযহাবকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে সাহায্য করে। যার ফলে ইসলামী বিশ্বের আনাচে কানাচে এবং বিশেষ করে ইরানের লক্ষ লক্ষ শীয়া জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অনুভুত হতে থাকে। আর এ অবস্থা হিজরী নবম শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এরপর হিজরী দশম শতাব্দীর শুরুতে ইরানের শীয়াপন্থী ‘সাফাভী’ বংশীয় রাজত্বের উত্থান ঘটে। তারা বৃহত্তর ইরানের শাসনের সুযোগ পায়। এই সময়ে শীয়া মাযহাব রাষ্ট্রিয় ভাবে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যা এখনও (হিজরীর চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত) অব্যাহত আছে। এ ছাড়াও বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি শীয়া বাস করছে।
তথ্যসূত্র :
১. উক্ত বিষয়টি শাহরিস্তানীর ‘মিলাল ওয়ান নিহাল’ গ্রন্থ ও ‘আল - কামিল -ইবনে আসীর’ থেকে সংগৃহীত হয়েছে।
২. উক্ত বিষয়টি ইবনে আস্রিরর’ আল কামিল’ গ্রন্থ ও ‘রাওদাতুস সাফা হাবিবুস সেইর’ ‘আবিল ফিদা’ এবং শাহরিস্তানীর মিলাল ওয়াল নিহাল গ্রন্থ এবং কিছু অংশ ‘তারিখে আগাখানি’ থেকে ঊদ্ধৃত হয়েছে।