অনুসন্ধান,জ্ঞান,ইজতিহাদ ও তাকলীদ
১। অনুসন্ধান ও জ্ঞানার্জন সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :
আমরা বিশ্বাস করি যে,মহান আল্লাহ আমাদেরকে চিন্তাশক্তি দিয়েছেন এবং দিয়েছেন বুদ্ধিবৃত্তি (আকল)। আর এ কারণেই তিনি আমাদেরকে তার সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করতে এবং গভীর অনুসন্ধান ও অনুধাবন করতে আদেশ দিয়েছেন। অনুধাবন করতে বলেছেন সমগ্র সৃষ্টি নিদর্শন এবং স্বয়ং আমাদের সৃষ্টিতেও তার প্রজ্ঞা ও পরাক্রমকে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন-
“আমরা বিশ্বজগতে ও তাদের মধ্যে আমাদের নিদর্শন দেখাতে থাকব যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের নিকট স্পষ্ট রূপে প্রতীয়মান হয় যে,তিনি (মহান আল্লাহ) সত্য।” (সুরা হামীম সেজদাহ- ৫৩)
যারা তাদের পূর্ব পুরুষদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে তাদেরকে ভৎসনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন-
“তারা বলে,আমরা বরং আমাদের পূর্ব পুরুষদের অনুসৃত পথই অনুসরণ করব এমনকি তাদের পূর্ব পুরুষগণের কোন জ্ঞান না থাকলেও?” (সুরা বাকারা -১৭০)
অনুরূপ,মহান আল্লাহ তাদেরকেও ভৎসনা করেন যারা কেবলমাত্র তাদের অমূলক ধারণার উপর অনুসরণ করে। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেন-
“তারা তাদের (অমূলক) ধারণা ব্যতীত অন্য কিছুই অনুসরণ করে না।” (সুরা আন-আম- ১১৬)
প্রকৃতপক্ষে,আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিই আমাদেরকে বাধ্য করে সৃষ্টিকে অনুধাবন করতে ও তার সৃষ্টি কর্তাকে জানতে। তদ্রূপ কারো নবুওয়াতের দাবী ও তার কর্তৃক প্রদর্শিত মোজেযার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে ও তার দাবীর সত্যাসত্য পরীক্ষা করতে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি আমাদেরকে বাধ্য করে। এ বিচার বিশ্লেষণ ব্যতীত কাউকে অনুসরণ করা আমাদের জন্য সঠিক নয় যদিও বা তার জ্ঞান ও মর্যাদা অভূতপূর্ব হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে আমাদেরকে চিন্তা করতে ও জ্ঞানার্জন করতে আহবান জানানো হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনের এ আহবানের কারণ হলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির ফেতরাতগত (সৃষ্টি প্রকরণগত) স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা যার উপর অনুসরণ করে প্রত্যেক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই সিদ্ধান্ত প্রদান করে। সত্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে (সৃষ্টিগতভাবে) আমাদের চিন্তা ও জ্ঞানগত যোগ্যতার ভিত্তিতেই পবিত্র কোরআন আমাদেরকে সতর্ক করছে এবং আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে আমাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তির উত্তরাধিকারগত চাহিদার দিকে পরিচালিত করছে।
অতএব এটা সঠিক নয় যে,মানুষ স্বীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অজ্ঞ থেকে যাবে কিংবা কোন শিক্ষক বা অন্যকোন ব্যক্তির অনুসরণ করবে। বরং তার জন্য আবশ্যক হলো ফিতরাতগত বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে গভীর অনুসন্ধান ও বিচার বিশ্লেষন করে ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোর উপর সুষ্পষ্ট জ্ঞান লাভ করা। ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোকে উসূলে দ্বীন১ বলে নামকরণ করা হয় যে গুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো -
১। তাওহীদ বা একত্ববাদ
২। নবুওয়াত বা রিসালাত
৩। ইমামত
৪। মা’য়াদ বা কিয়ামত
যে কেউ এসকল মৌলিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তার পূর্ব পুরুষ বা অন্য কাউকে অন্ধ অনুসরণ করবে সে নিশ্চিত রূপে মিথ্যা দ্বারা আবিষ্ট হবে এবং সরল পথ থেকে বিচ্যুত হবে। আর এ ব্যাপারে কখনোই কোন অজুহাত গ্রহনযোগ্য হবে না।
মৌলিক বিশ্বাসসমূহ দুটি মূলনীতির উপর নির্ভরশীল-
প্রথমত: মৌলিক বিশ্বাসগুলোকে বিচার বিশ্লেষণ ও অনুধাবন করা আবশ্যক এবং এক্ষেত্রে অন্য কাউকে অনুসরণ করা যাবে না।
দ্বিতীয়ত: এ বিশ্বাসগুলো অর্জন করা শরীয়তগতভাবে আবশ্যক হওয়ার পূর্বেই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আবশ্যক হয়ে পড়ে। (অর্থাৎ শুধু ধর্মীয় উৎস থেকে আমরা এগুলো অর্জন করবো না যদিও ধর্মে এগুলো নিশ্চিতরূপে বর্ণিত হয়েছে। বরং আমরা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার মাধ্যমে তা অর্জন করবো।) আর মৌলিক বিশ্বাস গুলোর ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন,চিন্তা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা,বুদ্ধিবৃত্তিক অনুধাবন ব্যতীত বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আবশ্যকীয় হওয়ার কোন অর্থই থাকে না।
২। দ্বীনের গৌণ বিষয়সমূহের (ফুরুয়ে দ্বীন) ক্ষেত্রে অন্যের অনুসরণ (তাকলীদ) সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :
দ্বীনের গৌণ বিষয়সমূহ বা ফুরুয়ে দ্বীন বলতে বুঝায় কার্যগত ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানসমূহকে। এগুলোর ক্ষেত্রে (সবার জন্য) বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা ও গবেষণা আবশ্যক নয়। বরং সেক্ষেত্রে আবশ্যক হলো নিম্নলিখিত পন্থাত্রয়ের মধ্যে একটিকে অবলম্বন করা (যদি না নামায ও রোজার মত দ্বীনের সুষ্পষ্টরূপে প্রমাণিত কোন বিষয় হয়)।
(ক) যোগ্যতা থাকলে গবেষণা (ইজতিহাদ) করতে হবে এবং আহকামের দলিলগুলোকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে হবে।
খ) যদি সক্ষম হয় তবে তার কাজকর্মের ব্যাপারে সাবধানতা (এহতিয়াত) অবলম্বন করতে হবে।
গ) অনুমোদিত বা সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার অধিকারী এমন কাউকে অনুসরণ করতে হবে যিনি জ্ঞানী এবং ন্যায়পরায়ণ (যিনি নিজেকে পাপ কর্ম থেকে বিরত রাখেন,দ্বীনের রক্ষক,স্বীয় কামনা বাসনার অনুসারী নন বরং তার প্রভুর আদেশ নিষেধ মেনে চলেন)।
অতএব যদি কেউ মোজতাহিদ বা গবেষক না হয়ে থাকে,কিংবা সাবধানতা বা এহতিয়াত অবলম্বন না করে,অথবা নির্দিষ্ট শর্তের বা যোগ্যতার (প্রাগুক্ত) অধিকারী কাউকে অনুসরণ না করে তবে তার সমস্ত এবাদতই বাতিল হয়ে যাবে এবং তা থেকে কোন কিছুই কবুল হবে না,এমনকি সারাজীবন নামায,রোজা,পালন করলেও। তবে তাকলীদ (বা পূর্ব বর্ণিত কোন ব্যক্তির অনুসরণ) করলে পূর্বে কৃত আমলসমূহ এ শর্তে কবুল হবে যে,সেগুলো অনুসৃত মোজতাহিদের মতানুসারে ও আল্লাহর তুষ্টির জন্য করা হয়েছে।
৩। ইজতিহাদ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :
আমরা বিশ্বাস করি যে,ফুরুয়ে দ্বীনের আহকামের ক্ষেত্রে ইমামের আত্মগোপনের সময়কালে ইজতিহাদ করা সমস্ত মুসলমানের জন্য ওয়াজীবে কেফায়া। অর্থাৎ এটা প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক মুসলমানের জন্যেই ওয়াজীব। কিন্তু যদি তাদের মধ্যে কেউ একজন এ যোগ্যতা অর্জন করে তবে অন্যরা এ দায়ভার থেকে অব্যাহতি পায়। যদি কেউ ইজতিহাদের দ্বারে পৌঁছে এবং সকল মনোনীত শর্ত বা যোগ্যতা অর্জন করে তবে ফুরুয়ে দ্বীনের ক্ষেত্রে তাকে অনুসরণ (বা তার তাকলীদ) করাই অন্যদের জন্য যথেষ্ট।
সকল যুগে মুসলমান মাত্রই স্বয়ং বিষয়টির প্রতি মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। যখন কিছু ব্যক্তি ইজতিহাদের দ্বারে পৌছার জন্য নিজেদেরকে নিয়োজিত করে ও মুজতাহিদ হয় এবং যখন তারা অনুসরণীয় হওয়ার মত সকল শর্ত পূরণ করে,তখন ফুরুয়ে দ্বীনের ক্ষেত্রে তাদেরকে অনুসরণ করা অন্যদের জন্য আবশ্যক যারা ব্যক্তিগতভাবে ইজতিহাদ করতে চান না। ইজতিহাদের দ্বারে পৌঁছানো কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তি ব্যতীত সম্ভব নয়। যেক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষেই ইজতিহাদ করা সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে তাদের মধ্য থেকে কিছু ব্যক্তিকে এ মর্যাদায় পৌঁছার জন্য তৈরী করতে হবে। কিন্তু মৃত মুজতাহিদের তাকলীদ করা তাদের জন্য বৈধ নয়।
ইজতিহাদ হলো শরীয়তের বিভিন্ন দলিলের উপর বিচার বিশ্লেষণ করে মহানবী (সা.) ফুরুয়ে দ্বীনের ক্ষেত্রে যে আহকাম এনেছেন সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। মহানবীর (সা.) এ আহকাম কাল ও আধারের পরিবর্তনে কখনোই পরিবর্তিত হবে না। (মোহাম্মদ (সা.) এর হালাল কিয়ামত পর্যন্ত হালাল,তার হারাম কিয়ামত পর্যন্ত হারাম)। আর শরীয়তের দলিলগুলোর উৎস হলো-পবিত্র কোরআন,রাসুলের (সা.) ও ইমামগণের (আ.) সুন্নাত,ইজমা (ফকীহগণের মতৈক্য) এবং বুদ্ধিবৃত্তি (আকল) যে সম্পর্কে উসুলে ফিকাহ শাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে। ইজতিহাদের এ মর্যাদা লাভের জন্য এক দীর্ঘ সময়কালের অধ্যয়ন ও জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন এবং এটা কখনোই অর্জিত হবে না যদি না কেউ এক্ষেত্রে একনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী হয়।
৪। মোজতাহিদের মর্যাদা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস :
আমরা বিশ্বাস করি যে,সকল ইস্পিত শর্ত পূরণকারী মুজতাহিদ হলেন ইমামের (আ.) অবর্তমানে তার প্রতিনিধি। সুতরাং তিনি (মুজতাহিদ) হলেন সমস্ত মুসলিম জনতার পরিচালক এবং তিনি ইমামদের (আ.) সমস্ত দায়িত্ব (যেমন-মীমাংসা,বিচার কার্য,প্রশাসনিক কর্মকান্ড ইত্যাদি) পালন করে থাকেন। এ কারণে আহলে বাইতের ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন-
“মুজতাহিদকে প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হলো ইমামকে (আ.) প্রত্যাখ্যান করা। আর ইমামকে (আ.) প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হলো আল্লাহকে প্রত্যাখ্যান করা। আর এটা অংশীবাদ ও শিরকের নামান্তর বৈ কিছু নয়।”
অতএব,সকল মনোনীত যোগ্যতার অধিকারী মুজতাহিদ কেবলমাত্র ফতুয়া প্রদানের ক্ষেত্রেই ক্ষমতাধর নন বরং তার সার্বজনীন বেলায়াত (অভিভাবকত্ব) বিদ্যমান। সুতরাং হুকুম,মীমাংসা,বিচার ইত্যাদি তার জন্য নির্ধারিত যে কোন আবশ্যকীয় ক্ষেত্রে তার নিকট ব্যতীত অন্য কারো শরনাপন্ন হওয়া বৈধ নয়,যদি না তার অনুমতি থাকে। তদ্রূপ তার আদেশ ব্যতীত শাস্তি প্রদান বৈধ নয়। ইমামের (আ.) জন্য নির্ধারিত মালামালের ক্ষেত্রেও মুজতাহিদের শরনাপন্ন হতে হবে।
ইমামের (আ.) অনুপস্থিতিকালীন সময়ে ইমাম (আ.) এ সকল দায়িত্ব ও মর্যাদা দিয়েছেন তার প্রতিনিধি হিসেবে। আর এ জন্যই তাকে বলা হয় নায়েবে ইমাম বা ইমামের প্রতিনিধি।
সূত্র:
১. এ পুস্তিকায় যে সকল মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলোই সম্পূর্ণ নয়। ভাগ্যলিপি,রাজাআতের মত এমন অনেক বিশ্বাস রয়েছে যে গুলোতে বিশ্বাস করার আবশ্যকতা নেই বা এ গুলোতে অনুসন্ধানেরও কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। এগুলোর সত্যতার জন্য নবী ও ইমামগনের (আঃ) উক্তিই যথেষ্ট। আমাদের এ ধরনের অনেক বিশ্বাস আছে যেগুলো আমাদের ইমামগনের (আঃ) নিকট থেকে নিশ্চিতরূপে বর্ণিত হয়েছে