ভারতের পার্লামেন্টে সন্ত্রাসী হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত আফজাল গুরুকে ফাঁসি দেয়ার পর শোকের ছায়া নেমে এসেছে দিল্লির তিহার কারাগারের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
বার্তা সংস্থা আবনা : ভারতের পার্লামেন্টে সন্ত্রাসী হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত আফজাল গুরুকে ফাঁসি দেয়ার পর শোকের ছায়া নেমে এসেছে দিল্লির তিহার কারাগারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। তাকে ফাঁসি দেয়ার সময় জল্লাদও অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনিও আফজাল গুরুর উদ্দেশ্যে 'আল বিদা' বা 'বিদায়' শব্দটি উচ্চারণ করেন। ফাঁসিতে ঝোলার একটু আগেই একই শব্দে জল্লাদকে বিদায় জানিয়েছিলেন আফজাল গুরু। এ খবর দিয়েছে ভারতের ইংরেজি দৈনিক দি হিন্দু।
এ খবরে আরো বলা হয়েছে, আফজাল গুরুর ফাঁসির অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা দৈনিকটিকে জানান, ফাঁসিতে ঝোলানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যান আফজাল গুরু। কিন্তু তারপরও জেল কোড অনুযায়ী তার লাশ পুরো আধা ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর আফজাল গুরুর লাশ ফাঁসির দড়ি থেকে নামিয়ে তিহার কারাগারে ৩ নম্বর জেলের কাছে অবস্থিত কাশ্মিরের গেরিলা নেতা মকবুল বাটের কবরের পাশেই দাফন করা হয়।
তিনি আরো বলেন, আফজাল গুরু ও মকবুল বাটের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল, বাট কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা ছিলেন। কিন্তু আফজাল গুরু সে ধরণের কথা কোনোদিনও বলেননি। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো নেতা ছিলেন না বরং তিনি দুর্নীতিমুক্ত ভারত চেয়েছেন। এ ছাড়া, আফজাল গুরু বলতেন, তাকে অনাবশ্যকভাবে এ (ভারতের সংসদে হামলার) মামলায় জড়ানো হয়েছে।
ভারতের উগ্র ডানপন্থী মহলসহ কোনো কেনো মহল আফজাল গুরুর ফাঁসিতে আনন্দ প্রকাশ করলেও তিহার কারাগারে এ উতসবের নাম গন্ধও ছিল না। বরং অনেক কারাকর্মীকে অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।
তিহার জেলের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, আফজাল ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। তিনি খুবই ভদ্র আচরণ করতেন। কারাকর্মীদের প্রত্যেকের নাম তিনি জানতেন এবং যখন তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয় তখনও তিনি প্রত্যেকের নাম ধরে ডেকে তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা বা সালাম জানিয়েছেন। কারাকর্মীরা কে কেমন আছেন তাও জানতে চেয়েছেন তিনি।
ফাঁসিতে যাওয়ার আগে তিনি জল্লাদের উদ্দেশ্যে একটি ছোট্ট মিনতি করেন আর তা হলো, 'প্রচণ্ড ব্যথা পেতে পারি' এমন কিছু নিশ্চয়ই তুমি করবে না। জল্লাদ চোখের পানি সামলে নিশ্চিত করেন, 'না এমন কোনো কাজই করা হবে না।' জল্লাদ এ সময় আফজাল গুরুর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না। জল্লাদের চোখ বারবার পানিতে ভরে যাচ্ছিলো। তার বেশ কষ্ট হয়েছে নিজেকে সামলাতে। এ সময় আফজাল গুরুর চোখে কালো কাপড়ে বেঁধে দেয়া হয় এবং নতুন পৃথিবীতে তার যাত্রা যে কষ্টহীন হবে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
আফজাল গুরুকে ফাঁসি দেয়ার কথা আগের দিন সন্ধ্যায় তাকে জানানো হয়েছে বলে ভারতের কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমে যে খবর দেয়া হয়েছে তা সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন তিহার জেলের এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আসলে ফাঁসি দেয়ার খবরটি ফাঁসির দিন সকালেই জানানো হয় আফজাল গুরুকে। খবরটি খুবই শান্তভাবে গ্রহণ করেন তিনি। সে দিন সকালে তাকে শুধু এক কাপ চা দেয়া হয়েছিল। তিনি এতই শান্তভাবে ফাঁসি দেয়ার খবরটি গ্রহণ করেন যে তাকে নাশতা দেয়া হলেও তা খেতে পারতেন তিনি।
'ফেরান' নামে পরিচিত কাশ্মিরি আলখেল্লা তার পরনে ছিল। তিনি গোসল করেন এবং কাপড় পাল্টে কুর্তা পায়জামা পরেন ও জীবনের শেষ নামাজ আদায় করেন।
এর আগে, তিহার কারাগারে ২৫টি প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এ কারাগারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা শেষ ১০টি প্রাণদণ্ড কার্যকর করার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। কিন্তু ফাঁসির খবর পাওয়ার পর বা ফাঁসি আসন্ন জেনেও কেউ যে এমন শান্ত ও নির্বিকার থাকতে পারেন আগে কখনোই এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাদের।
আফজালের জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টায় তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন কারা কর্মকর্তা ছিলেন। আফজাল গুরু তাদের কাছে জীবন-মৃত্যু নিয়ে নিজের চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরেন। সত্যের পথে চলাটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে কথা বলেন।
সে দিন সকালে তিনি এতোটাই শান্ত ছিলেন যে একটা কাগজে নিজের চিন্তাধারার খানিকটা লিপিবদ্ধও করেন। লেখা শেষে তাতে তারিখ ও সই দেন তিনি।
নিজ পরিবার সম্পর্কে কী ভাবছেন এবং কে তাদের দেখাশোনা করবে জানতে চাওয়া হলে আফজাল গুরু জবাবে বলেন, "আল্লাহ আমাদের সবাইকে দেখছেন এবং তিনিই আমার পরিবারের প্রতি নজর রাখবেন।"
ওই কারা কর্মকর্তা বলেন, আফজাল গুরুর প্রচণ্ড আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল বলেই তিনি এমন সাহস দেখাতে পেরেছেন। তিনি ছিলেন খুবই জ্ঞানী এবং ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের ওপর তার অগাধ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য ছিল।
তিহার জেলের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, কোনো দুষ্ট শক্তির বিনাশ ঘটলে সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন কিন্তু কোনো নিষ্পাপ ও ভাল হৃদয়ের মানুষ চলে গেলেই নেমে আসে বিষাদ।
তিনি আরো বলেন, আফজাল গুরু সব সময়ই উতফুল্ল ও শান্ত স্বভাবের ছিলেন। ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেই মানুষ ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। কিন্তু হাসি মুখে ফাঁসিতে যাওয়ার যে রূপকথা প্রচলিত রয়েছে আফজাল গুরুর বেলায় ঠিক তাই-ই ঘটেছে।
আফজাল গুরু ফাঁসির মঞ্চের শেষ ১০০ ধাপ হেঁটেই পাড়ি দিয়েছেন। এ পথটুকু পার হতে গিয়ে সন্ত্রাসবাদের দায়ে অভিযুক্ত অনেকেই নানা ধরণের চেঁচামেচি করেন, কিন্তু তেমন কিছুই করেননি আফজাল গুরু; বরং আশপাশের কারা কর্মীদের কুশল জানতে চেয়েছেন ও হাসিমুখে তাদের প্রতি শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে জীবনের শেষ পথটি অতিক্রম করেন তিনি।#রেডিও তেহরান