২৫শে ডিসেম্বর হচ্ছে হযরত ঈসা (আ.)এর পবিত্র জন্মদিন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর প্রায় সাড়ে পাঁচশ' বছর আগে পৃথিবীর বুকে আগমন করেছিলেন হযরত ঈসা (আ.)।
হযরত ঈসা (আ.) একদিকে ছিলেন মানবপ্রেম ও ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রগামী অন্যদিকে ছিলেন জুলুম,বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুকরণীয় আদর্শ। মহান আল্লাহ তাঁকে তাওরাত, ইঞ্জিল ও বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে বনী ইসরাইলীদের কাছে রাসুল হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। সূরা আলে ইমরানের ৪৮ ও ৪৯ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "ঈসা বলেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের জন্য নিদর্শন এনেছি। আমি কাঁদা দিয়ে একটি পাখীর মূর্তি তৈরী করে,তাতে ফু'দেব। ফলে তা আল্লাহর ইচ্ছায় পাখী হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে মৃতকে জীবিত করব। তোমরা তোমাদের ঘরে যা খাও এবং জমা কর আমি তাও তোমাদের বলে দেব। তোমরা যদি বিশ্বাসী হও তবে সত্য মেনে নেয়ার ব্যাপারে এতে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।"
হযরত ঈসা (আ.) এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি জন্মের পর অর্থাৎ দোলনা থেকেই কথা বলতে পারতেন এবং তিনি যা বলতেন, সত্য বলতেন। পবিত্র কোরআনের সূরা মারইয়ামের ৩০ থেকে ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে," হযরত ঈসা বললেন, নিঃসন্দেহে আমি আল্লাহর একজন বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী বানিয়েছেন। আমি যেখানেই থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আজীবন নামায ও যাকাত আদায় এবং মায়ের অনুগত থাকতে। আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেননি। শান্তি আমার প্রতি- যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হব। "
আল্লাহপাক মানব জাতিকে একত্ববাদের দিকে আহ্বান করার জন্যে যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। নবী-রাসূলগণ আল্লাহর প্রতি মানুষের সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য একত্ববাদের কথা বলতে গিয়ে তাঁরা নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি, ভয়-ভীতি, জুলুম নির্যাতন ও জানমালের ক্ষতির শিকার হয়েছেন। হযরত ঈসাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন না। মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁকে যেমন ত্যাগ-তিতিক্ষা সহ্য করতে হয়েছে তেমনি তাঁর কুমারী মাতা হযরত মারিয়াম (সা.আ.)কেও অনেক দুঃখ-কষ্ট ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে। এবার আমরা তাঁর সম্পর্কেই কিছু কথা বলবো।
হযরত মারিয়াম ছিলেন হযরত ইমরান ( আ. ) এর মেয়ে । আল্লাহর দরবারে মারিয়াম ছিলেন অসম্ভব মর্যাদার অধিকারী । আল্লাহ তাঁর ইবাদাত কবুল করেছেন এবং আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চার জন নারীর একজন বলে মনে করতেন।
হযরত মারিয়াম ছোট্টবেলা থেকেই হযরত যাকারিয়া ( আ.) এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তিনি তাঁর প্রতিটা মুহূর্ত আল্লাহর ইবাদাতসহ অন্যান্য ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে কাটাতেন। হযরত মরিয়ম আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যানে এত মশগুল থাকতেন যে, নিজের খাবারের কথাও ভুলে যেতেন । কিন্তু মারিয়ামের অভিভাবকের দায়িত্বপালনকারী হযরত যাকারিয়া ( আঃ ) যখনই তাঁর কক্ষে যেতেন, তখনই সেখানে বেহেশতি খাবার দেখতে পেতেন। তিনি এত মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন যে, নবী-রাসূল না হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কথা পবিত্র কোরআনের অনেক জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে এ পর্যায়ে আমরা কুমারী মাতা হযরত মারিয়ামের গর্ভে হযরত ঈসার জন্মের কাহিনী জানবো পবিত্র কোরআন থেকে।
সূরা মারিয়ামের ১৬ থেকে ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, "হে মুহাম্মদ! এই কিতাবে মারিয়ামের অবস্থা বর্ণনা করুন, যখন সে তার পরিবারের লোকজন থেকে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল এবং তাদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য সে পর্দা করলো। এ অবস্থায় আমি তার কাছে নিজের রুহ অর্থাৎ ফেরেশতাকে পাঠালাম এবং সে তার সামনে একটি পূর্ণ মানবাকৃতিতে নিয়ে হাযির হলো। মারিয়াম অকস্মাৎ বলে উঠলো, "তুমি যদি আল্লাহকে ভয় করে থাকো তাহলে আমি তোমার হাত থেকে করুণাময়ের আশ্রয় চাচ্ছি।"
মারিয়াম এ কথা বলে আল্লাহর দূতের প্রতিক্রিয়া জানার জন্যে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সাথে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এ অবস্থা অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আল্লাহর দূত কথা বলে উঠলেন-‘আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার কাছে এসেছি।'এ কথা শুনে মারিয়ামের অন্তর প্রশান্ত হলো। কিন্তু তারপরই ফেরেশতা বললো-‘আমি এসেছি তোমাকে একটি পবিত্র সন্তান দান করতে।' এ কথা শুনে মারিয়াম অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো-‘তা কী করে সম্ভব! এখন পর্যন্ত কোনো পুরুষ মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি, কিংবা আমি তো অসতী মেয়েও নই!'
আল্লাহর দূত বললো-‘তার মানে হলো, তোমার আল্লাহ বলেছেন, ‘এটা আমার জন্যে খুবই সহজসাধ্য একটি ব্যাপার। আর এই ঘটনাটাকে আমরা জনগণের জন্যে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করবো এবং আমাদের পক্ষ থেকে এটি হবে একটা রহমত। এটা একটা অবশ্যম্ভাবী এবং স্থিরীকৃত ব্যাপার।'
মারিয়াম অবশেষে সন্তান সম্ভবা হলেন। যখন প্রসব বেদনা উঠলো তখন তিনি উষর জনহীন এক প্রান্তরে একটি শুকনো খুরমা গাছের নীচে গেলেন। বেদনায় আনমনে বললেন-‘যদি এর আগে আমার মৃত্যু হতো এবং সবকিছু ভুলে যেতাম।' অতিরিক্ত কষ্টের মুখেই তিনি যখন এসব বলেছিলেন তখন হঠাৎ অলৌকিক শব্দ তাঁর কানে ভেসে এলো-‘দুশ্চিন্তা করো না! ভালো করে দেখো, তোমার রব তোমার পায়ের নীচে থেকে একটি ঝর্ণাধারা জারি করেছেন। আর তোমার মাথার ওপরে তাকাও। দেখো শুকনো খুরমা গাছে কী সুন্দর খেজুর পেকে আছে। ওই গাছে নাড়া দাও যাতে তরতাজা পাকা খেজুর ঝরে পড়ে। এই সুস্বাদু খেজুর খাও আর ওই নহরের পানি পান করো এবং নবজাতককে দেখে চক্ষু জুড়াও। যখন যেখানেই কোনো মানুষ তোমার কাছে এই সন্তান সম্পর্কে জানতে চাইবে, তুমি কেবল ইশারায় বোঝাবে যে ‘আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে রোযা রেখেছি, নীরবতার রোযা, তাই কারো সাথে কথা বলবো না।'
আল্লাহর কুদরতে হযরত মারিয়াম মা হলেন। সন্তানের মুখ দেখে মা খুশি হলেন ঠিকই কিন্তু মনে সংশয়-না জানি কে, কী ভাবে! আল্লাহ তাই তাঁকে জানিয়ে দিলেন,তিনি যেন কারো সাথে কথা না বলেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মারিয়াম (সা. ) পুত্রকে কোলে নিয়ে শহরের দিকে যেতে লাগলেন। মানুষ যখন তাঁর কোলে সন্তান দেখতে পেলো,আশ্চর্য হলো। এতোদিন যারা মারিয়ামকে একজন পবিত্র ও সচ্চরিত্রবতী এবং তাকওয়াসম্পন্ন বলে মনে করতো,তারা খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কেউ কেউ আবার তিরস্কারের সুরে বলতে লাগলো: " ছি,ছি! এতো তাকওয়া,এতো পূত-পবিত্রতা। অভিজাত বংশের মুখে চুনকালি পড়লো।" তারা বললো, "হে মরিয়ম! একটা আশ্চর্যময় এবং বাজে কাজ করেছো।"
মারিয়াম আল্লাহর আদেশক্রমে চুপ করে রইলেন। কেবল কোলের সন্তানের প্রতি ইঙ্গিত করলেন।
এমন সময় হযরত ঈসা (আ) কথা বলে উঠলেন : "আমি আল্লাহর বান্দা! তিনি আমাকে ঐশীগ্রন্থ দান করেছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। আমি যেখানেই থাকি না কেন আল্লাহ আমাকে তাঁর বরকতপূর্ণ ও মঙ্গলময় করেছেন। যতোদিন আমি বেঁচে থাকবো ততোদিন তিনি আমার প্রতি নামায ও যাকাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মায়ের প্রতি অনুগত থাকার নির্দেশও দিয়েছেন। আমাকে তিনি প্রতিহিংসা পরায়ন বা অনমনীয় হবার মতো হতভাগ্য বানাননি।
ঈসা (আ.) সবশেষে বলেন, "আমার ওপরে আল্লাহর শান্তি বা সালাম, যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং যেদিন আমি মরে যাবো,আবার যেদিন আমি জীবিতাবস্থায় জাগ্রত হবো।"
ঈসা (আ) ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলেন। সেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর ওপর দায়িত্ব বর্তিত হয়েছিল বনী ইসরাঈলকে এক আল্লাহর ইবাদাত বা তৌহিদের পথে আহ্বান জানানোর। তিনি তাঁর নবুয়্যতের প্রমাণ স্বরূপ বহু মোজেযা দেখিয়েছেন। তিনি ভাস্কর্য তৈরীর কাদামাটি দিয়ে পাখি তৈরী করেন এবং তার ভেতর ফুঁ দিলে আল্লাহর আদেশে পাখিটার ভেতর প্রাণের সঞ্চার হয়। প্রাণিত হবার পর মাটি দিয়ে তৈরী পাখিটা উড়ে যায়। তিনি জন্মান্ধ এবং বধিরদেরকে আল্লাহর দেওয়া মোজেযার সাহায্যে সুস্থ করে দিতেন। কুষ্ঠ রোগীরাও তাঁর হাতের ছোঁয়ায় সুস্থ হয়ে যেত। এমনকি মৃতদেরকেও তিনি আল্লাহর দেওয়া অলৌকিক শক্তি বলে জীবিত করে দেন।
হযরত ঈসা (আ.) একাধারে ৩০ বছর আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করেন। কিন্তু বনী ইসরাইলের আলেমদের শত্রুতার কারণে জনগণ ঈমান আনা থেকে বিরত থাকতো। স্বল্পসংখ্যক লোকজন যারা তাঁর কথায় ঈমান এনেছিল,তাদের অনেককেই শিষ্য হিসেবে মনোনীত করলেন যাতে তারা আল্লাহর পথে বা সত্য দ্বীনের পথে আহ্বানের ক্ষেত্রে তাঁর সহযোগী হয়। কিন্তু ইহুদিরা ঈসা (আ) এর সাথে এতো বেশি শত্রুতা করতে লাগলো যে শেষ পর্যন্ত তাঁর ওপর তারা আক্রমণই করে বসলো। তারা চেয়েছিল হযরত ঈসা (আ) কে মেরে ফেলতে। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শত্রুদের অত্যাচার থেকে ঈসা (আ) কে রক্ষা করলেন। তাঁকে সশরীরে জীবন্ত আসমানে উঠিয়ে নিলেন।
ইসলামের আদর্শ ও বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈসা (আ) বেঁচে আছেন এবং শেষ যামানায় হযরত মাহদি (আ) যখন আবির্ভূত হবেন তখন তাঁরও আগমন ঘটবে। শুধু তাই নয়, তিনি ইমাম মাহদির ইমামতিতে নামাজ পড়বেন এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁকে সহযোগিতা করবেন।
বর্তমান বিশ্বে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, সহিংসতা, বর্ণ-বৈষম্য, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে, এখন সময় এসেছে ধর্মের প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করার। আধিপত্যকামী, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করলেও তারাই আবার নিজেদেরকে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করছে। অথচ আজ যদি যিশু খ্রিস্ট বা হযরত ঈসা (আঃ) পৃথিবীতে থাকতেন তাহলে তিনি বিশ্বের বলদর্পী ও আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতেন এমনকি এক মুহুর্তও অত্যাচারিত জনগোষ্ঠীর মুক্তির জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতেন না। আজ যারা নিজেদেরকে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী হিসেবে দাবি করছে তাদের উচিত ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাকসহ বিশ্বের সব নির্যাতিত জনপদে শান্তি ফিরিয়ে আনা। আর তাহলেই হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মদিন পালন স্বার্থক হবে।
source : http://bangla.irib.ir