ইসলাম মানব-প্রকৃতির ধর্ম হওয়ায় এর নানা দিক আকৃষ্ট করছে পাশ্চাত্যের সত্য-সন্ধানী মানুষকে। এমনকি লেখক, চিন্তাবিদ, গবেষক ও তাত্ত্বিকরাও এর ব্যতিক্রম নন। ইসলামের গতিশীলতা ও এ ধর্মের নির্দেশিত জীবন-যাপন পদ্ধতিই পশ্চিমাদের ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। অস্ট্রিয়ার নও-মুসলিম নারী 'জয়নাব ল্যান্টসেল'-এর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এর অন্যতম প্রমাণ।
ইসলাম হচ্ছে যুক্তি, বিবেক, মানবীয় সম্মান ও মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার ধর্ম। এ ধর্ম মানুষকে দেয় ইহকাল ও পরকালের সৌভাগ্যের দিশা। অন্যদিকে খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা যুক্তির আলোকে খ্রিস্ট ধর্মের দিকে তাকান তারা এর মধ্যে যুক্তি-বিরোধী অনেক কিছু দেখতে পান। এ ধর্ম ত্রিত্ববাদ বা তিনজন স্রস্টা থাকার কথা বলে। এ ধর্মে ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র ও আল্লাহ হিসেবে দাবি করার মাধ্যমে মানবীয় প্রকৃতিকে দুষিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধর্ম বিয়ে করাকেও তিরস্কার করে। কেবল পাপ থেকে দূরে রাখার প্রয়োজনে খ্রিস্ট ধর্ম সাধারণ মানুষকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে।
তাই খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেকেই যখন ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষাগুলোর মধ্যে তুলনা করেন তখন তারা ইসলামকে মানুষ গড়ার মাধ্যম ও বিবেক-সম্মত ধর্ম হিসেবে দেখতে পান এবং খুব সহজেই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নেন। এ অবস্থায় তারা ইসলামী বিধানকে বরণ করে নেন এবং এ ধর্মের ওপর অবিচল থাকার জন্য সব ধরনের বিপদ, বাধা ও কষ্ট সহ্য করেন।
মিসেস ক্লারা ল্যান্টসেল মুসলমান হওয়ার পর নিজের জন্য জয়নাব নামটি বেছে নেন। ব্যাপক গবেষণার পর মুসলমান হন তিনি। ক্লারা ল্যান্টসেল জন্মসূত্রে ছিলেন খ্রিস্টান। কিন্তু এ ধর্ম তার প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। তিনি প্রচলিত খ্রিস্ট ধর্ম প্রসঙ্গে বলেছেন: "যেসব কারণে খ্রিস্ট ধর্ম যুব সমাজ ও জনসাধারণের কাছে আকর্ষণ হারাচ্ছে সেসবের মধ্যে সুদৃঢ় ভিত্তি না থাকা অন্যতম। কারণ, এ ধর্মের বিধি-বিধানগুলোর নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। প্রত্যেকেই খ্রিস্ট ধর্মের বিধি-বিধানগুলোকে নিজের সুবিধামত ব্যাখ্যা করে।" মিসেস ক্লারা ল্যান্টসেল আরো বলেছেন:
"কেউ যদি উচ্চতর লক্ষ্যে উপনীত হতে চায় তাহলে তার উচিত বেশি বেশি প্রচেষ্টা চালানো এবং দিক-নির্দেশনা ও উপদেশের আলোকে বেশি বেশি পদক্ষেপ নেয়া, ঠিক যেভাবে একজন ক্রীড়াবিদ মেডেল অর্জনের জন্য ব্যাপক পরিশ্রম করেন ও নানা উপদেশ মেনে চলেন। তাই আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যও ন্যুনতম প্রচেষ্টাগুলো চালানো জরুরি। এই সর্বনিম্ন কর্তব্যগুলো হল ধর্মের মূল ভিত্তি-কেন্দ্রিক যার অভাবে ধর্ম ক্রমেই ধ্বসে পড়ে। খ্রিস্ট ধর্ম ঠিক এই দশারই শিকার হয়েছে। এ ধর্মে তথাকথিত যেসব বাইবেল ও পবিত্র বাণী দেখা যায় সেগুলোর বেশিরভাগই মতামত মাত্র এবং খ্রিস্ট ধর্মে মানুষের জীবন-যাপন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত ও যথাযথ বিধান নেই। কিন্তু আমি সব সময়ই পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধানের সন্ধানে ছিলাম যাতে তা আমাকে সবচেয়ে ভালো পথে পরিচালিত করতে পারে।"
সামাজিকতা, বন্ধু-বাৎসল্য, প্রফুল্লতা, আন্তরিকতা ও দয়ার মত মহত গুণগুলোর সঞ্চালন ইসলামের আরেকটি বড় দিক। মুসলমানদের এইসব গুণ অনেক অমুসলিমকে আকৃষ্ট করছে এ ধর্মের দিকে। শৈশবে যুদ্ধাহত একদল ইরানির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে ইসলামের এইসব দিকের সৌন্দর্য দেখেছিলেন অস্ট্রিয়ার নও-মুসলিম জয়নাব ওরফে মিসেস ক্লারা ল্যান্টসেল যা ইসলামের দিকে তার আকৃষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: 'ইসলামের বিশেষ করে শিয়া মাজহাবের রয়েছে আকর্ষণীয় বহু দিক। এইসব আকর্ষণের মধ্যে আমার কাছে যে দু'টি দিক সবচেয়ে মধুর ও সুন্দর মনে হয়েছে তার একটি হল, ইসলাম মানুষকে প্রফুল্ল থাকার ও সুন্দর আচার-আচরণের শিক্ষা দেয়। চিকিৎসার জন্য অস্ট্রিয়ায় আসা একদল যুদ্ধাহত ইরানির মধ্যে আমি আধ্যাত্মিক নানা আকর্ষণসহ এই দিকটি দেখতে পেয়েছি। তাদের অনেকেরই ছিল না হাত ও পা এবং রাসায়নিক হামলার কারণে অনেকের চেহারাও বিকৃত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ছিলেন বেশ উৎফুল্ল ও প্রফুল্ল। তাদের এমন আনন্দিত ভাব আমাদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলত। এইসব আচরণ ছিল খুব দৃঢ় ও গভীর বিশ্বাসের সুফল। শৈশবের সেই অভিজ্ঞতার কারণেই আমি ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম। ধর্মের প্রভাবে মানুষের এতটা দৃঢ়-বিশ্বাস বা আত্মবিশ্বাস ও প্রশান্ত চিত্ত এক অবিশ্বাস্য বিস্ময়।'
অস্ট্রিয়ার নও-মুসলিম জয়নাব ওরফে মিসেস ক্লারা ল্যান্টসেলের মতে, দ্বিতীয় যে বড় দিক ইসলামের দিকে তার আকৃষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে তা হল ইসলামী বিধি-বিধানের সুদৃঢ় অস্তিত্ব। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: 'ইসলামী শরিয়তে রয়েছে মানুষের জন্য জীবনের সব দিকের বিধান। এইসব বিধান নানা সমস্যার ক্ষেত্রে মানুষকে দেয় সর্বোত্তম সমাধান ও মানুষকে পরিচালিত করে পূর্ণতার দিকে।'
ইসলাম সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি পরিবার ব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করার বিধান ও দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। পরিবার সম্পর্কে ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য তুলে ধরতে গিয়ে অস্ট্রিয়ার নও-মুসলিম জয়নাব ওরফে মিসেস ক্লারা ল্যান্টসেল বলেছেন:
'একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান যদি গির্জার পরিবর্তে পরিবার ও সমাজে জীবন যাপন করতে চায় তাহলে তিনি বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হবেন। কারণ, পারিবারিক জীবন সম্পর্কে খ্রিস্ট ধর্মের কোনো সুধারণা নেই। এ ধর্ম একাকীত্ব ও বৈরাগ্যের জীবনকে বেশি গুরুত্ব দেয়। একজন খ্রিস্টান যদি পড়াশুনার জন্য সফর করতে চান কিংবা সন্তানকে সুশিক্ষিত করতে চান বা জীবনের অন্য ক্ষেত্রে কোনো কাজ করতে চান তাহলে খ্রিস্ট ধর্মের বিধি-বিধান ঘেঁটে এ সম্পর্কে বাস্তব ও বিস্তারিত কোনো নির্দেশনা পাবেন না। কিন্তু ইসলাম ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনসহ জীবনের সব ক্ষেত্রের খুঁটি-নাটি দিক সম্পর্কেও বিস্তারিত এবং নিখুঁত দিক-নির্দেশনা দেয়। একমাত্র ইসলামেরই রয়েছে এই বিশেষ বৈশিষ্ট। এভাবে ইসলাম মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তার জীবন্ত উপস্থিতি বজায় রাখতে সক্ষম। ইসলামের বিধি-বিধানগুলো মানুষের বিবেক ও যুক্তির সঙ্গেও মানানসই। ফলে এ মহান ধর্ম মানুষের অসহায় একাকীত্ব ও অর্থহীনতার ভাবকে এ পার্থিব জীবনেই দূর করতে সক্ষম।'
অস্ট্রিয়ার নও-মুসলিম ল্যান্টসেল আরো বলেছেন:
'বাইবেলে দয়া প্রদর্শনের কথা যদি থেকেও থাকে তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি বা রূপ সম্পর্কে তাতে কোনো দিক-নির্দেশনা পাবেন না। ফলে এ সংক্রান্ত উপদেশ পালনের ক্ষেত্রে বাস্তবতার ময়দানে মানুষ ভুল করতে পারে। অস্ট্রিয়ায় একজন নিষ্ঠাবান বা বিশ্বাসী ক্যাথলিক ও সাধারণ নাগরিকের মধ্যে পার্থক্য হল ওই ঈমানদার ক্যাথলিক প্রতি রোববারে এবং কয়েকটি বিশেষ দিনে গির্জায় হাজির হন। এ ছাড়া তাদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু একজন মুসলমান যদি আন্তরিকভাবে ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলেন তাহলে তিনি সর্বোত্তম কল্যাণ লাভ করেন।'
অস্ট্রিয়ার নও-মুসলিম নারী জয়নাব ওরফে ল্যান্টসেল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে নানা বাধা-বিপত্তির শিকার হয়েছেন। কিন্তু ইসলাম তাকে দিয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
'যে ধর্মের বিধান মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের পদে পদে উপস্থিত পাশ্চাত্যে সে ধর্মের বিধান মেনে চলা বেশ কঠিন। কিন্তু এই কষ্টের মধ্যেও আল্লাহর উপস্থিতিকে অনুভব করা যায়। খোদার সঙ্গে সম্পর্ক ও নৈকট্য আর ভালবাসা নানা কাজ বা আমলের মধ্যে প্রকাশিত হয়। আসলে ইসলামের মহান শিক্ষাগুলো মানুষকে দেয় প্রশান্তি ও আত্ম-বিশ্বাস। অথচ এই প্রশান্তি আজ পাশ্চাত্যে পুরোপুরি অস্তিত্বহীন।' #