রহমত বরকত মাগফেরাত আর নাজাতের মাস রমযান। এই মাস তাই সবার কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই কল্যাণময় রমযান এখন বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। পুরোটা মাস জুড়ে আমরা রমযানের রহমতের বৃষ্টিধারায় ভিজে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলাম দেহ এবং আত্মাকে। পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলাম আপন সত্ত্বাকে। এই পরিশুদ্ধি কিংবা আত্মিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের অজান্তেই অনেক ভুল ক্রটি হয়ে থাকতে পারে। সেজন্যে প্রয়োজন ভুল ক্রটিগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্যে বেশি বেশি দান করা। এই দানে আপনি যেমন উপকৃত হবেন তেমনিভাবে উপকৃত হবে যাদেরকে দান করবেন তারা। এই দান কিন্তু আপনার বিনিয়োগ । এমনটি ভাববার কোনো কারণ নেই যে দান করার ফলে আপনার মালের ক্ষতি হচ্ছে।
আপনারা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন যে সব কৃষক মাঠে ফসল ফলায় তারা ফসলের কিছু বীজ আলাদা করে রেখে দেয়। বীজগুলো সাধারণত উত্তম ও পুষ্ট দেখেই সংরক্ষণ করা হয়। এই যে বীজগুলো, সেগুলো কিন্তু তারই ফলনের একটা উত্তম অংশ। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় ভালো বীজগুলো কৃষক জমিতে খরচ করলো। খরচ না করে সে ওগুলো খেতেও পারতো। তা না করে সে জমিতে লাগালো। ফলাফল হলো একেকটি বীজ থেকে অগণিত শস্যদানার জন্ম হলো। পবিত্র কোরআনে এই উদাহরণটিকে দান খয়রাত প্রসঙ্গে দেওয়া হয়েছে। যারা দান সদকা করে তারা পরকালীন প্রতিদান ছাড়াও পৃথিবীতেই কয়েকগুণ বেশি পুরস্কুত হবে। আমরা যেন এই পুরস্কারে ভূষিত হতে পারি সেই তৌফিক আল্লাহ যেন আমাদের দান করুন।
দান খয়রাত যারা করে না তাদেরকে কৃপণ বলা হয়। কৃপণদের ব্যাপারে ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যেমনটি বললেন মাওলানা ইমরান মাজহারি। "পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফেধনাঢ্য ব্যক্তিরা যদি আল্লাহর দেয়া সম্পদের হক আদায় না করার পরিণতিসম্পর্কে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমাকরে রাখে এবং আল্লাহর রাহে তার হক আদায় না করে আপনি (হে নবী ) তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন। এরপর আল্লাহপাক বলেছেন, এইস্বর্ণ-রৌপ্যকে আগুনের মধ্যে গলিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর ও পিষ্ঠদেশে দাগ দেয়াহবে। হাদিস শরীফে লেখা হয়েছে, এই তিন স্থানে দাগ দেয়ার দর্শন এবং হেকমতহলো এই যে, বিত্তবানদের (যারা কৃপণ) কাছে গরিব লোকরা যখন হাত প্রসার করেতখন তারা প্রথমে মাথা হেলিয়ে বাধা দেয়, এরপরও যখন সাহায্যের জন্য পীড়াপীদিকরা হয় তখন পাজর প্রদর্শন করে অন্যদিকে চলে যায়,এরপরও সাহায্য চাইলে পিষ্ঠপ্রদর্শন করে চলে যায়। এ সমস্ত কৃপণ লোকদের কপাল, পাজর ও পিষ্ঠদেশেস্বর্ণ-রৌপ্য গলিয়ে দাগ দেয়া হবে।"
কিন্তু অনেকেই কৃচ্ছতা এবং কৃপণতা-এই দুটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলেন। কৃচ্ছতা বলতে কি বোঝায় সে সম্পর্কে মাওলানা লুৎফর রহমান বললেনঃ "কৃচ্ছতা শব্দটি অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয় । আমরা যে আত্মশুদ্ধির কথাবলি তার মধ্যে সেলফ রেকটিফিকেশাস বা কেউ নিজেকে সংশোধন করতে চাইলে তারপ্রথম পর্যায় হচ্ছে - কোনো বিষয়ে সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না । কোরআনে করীমেআল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, তোমরা কোনো অবস্থাতেই কৃপণতা করো না । সুরাবনী ইসরাইলের ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, দান করার সময়একেবার হাত খুলে সবকিছু দিওনা আবার হাতকে নিজের স্কন্ধের সাথে সঙ্কুচিত করে কৃপণতা করো না । দুটোর মাঝামাঝি বা মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো । আবার সূরা ফোরক্বানের একটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন , আল্লাহর প্রকৃত বান্দাতারাই যারা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার সময় কৃপণতা করে না আবার দান করার সময়সীমা লঙ্ঘন করে না । হাদীস শরীফে কৃচ্ছতা সাধন বা পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে । হাদীস শরীফে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সবকিছুতে মধ্যম পন্থা গ্রহণ করাই একজন বিবেকবান সচেতন মানুষের জন্যে সময়ের দাবী । ফলে মাহে রমজান সিয়াম সাধনা ও তাক্কওয়া অর্জনের যে প্রশিক্ষণ দেয় সেই প্রশিক্ষণের মধ্যে আল্লাহর একজন প্রকৃত বান্দা এমন জীবন গ্রহণ বা ধারণ করবেনা যে জীবনটা অপব্যয়ের অভিশাপে অভিশপ্ত । আবার এমন কঞ্জুস, কৃপণ বা অর্থলোভী হবে না যাতে করে সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে ধিকৃত ও ঘৃণিতহয় । হাদীস শরীফে এ সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সৌখিন - সে আল্লাহর কাছে, মানুষের কাছে এবং বেহেশতের কাছেও সৌখিন । আর যেব্যক্তি বখিল কৃপণ বা কঞ্জুস সে আল্লাহ থেকেও দূরে ; মানুষ থেকেও দূরে এবংজান্নাত থেকেও দূরে । অপর এক হাদীসে রাসুলে পাক (সা) এরশাদ করেছেন, ''কৃপণ ওকাঞ্জুস ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না । সুতরাং রমজান আমাদের যে তাক্বওয়ারপ্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দেয় এ আত্মশুদ্ধি শিক্ষার মধ্যে দিয়ে আমরাএমন একটা জীবন গ্রহণ ও ধারণ করবো যে জীবনটা আমাদেরকে পরিচ্ছন্ন জীবন উপহার দেবে। আর এভাবে যদি আমরা রমজানকে কাজে লাগাতে পারি তাহলে লা আল্লাকুমতাত্তাকুন অর্থাৎ সে পর্যায়ে আমরা আল্লাহর গ্রহণ কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবো বাতার বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি পাবো । এমন অনেক রোজাদার রয়েছেন যাদের রোজার বিনিময়ে কেবলমাত্র ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া আল্লাহর কাছে আর কিছুই পাওয়ার থাকে না ।
ঈদের আনন্দে ভেসে গিয়ে আবার অনেকেই লাগামহীনভাবে খরচ করার চেষ্টা করেন। যদিও ইসলামে আয় এবং ব্যয়ের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখার কথা বললেন মাওলানা লুৎফর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি হাদিসের ঘটনা উদ্ধৃত করে বললেনঃ
একবার এক সাহাবী রাসূলের দরবারে জীর্ণ-শীর্ণ পোশাক ও ছেড়া জামা-কাপড় পরেএলেন। রাসূল খোদা তার দিকে তিনবার তাকালেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) এ সময় বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আপনি তার দিকে তিন বার কেন তাকালেন ? রাসূলুল্লাহ বললেন, লোকটা বোধহয় গরীব। হযরত আবু বকর জানালেন, লোকটা গরীব না, সে অত্যন্তকৃপণ। আল্লাহর রাসূল লোকটির উদ্দেশ্যে বললেন, তুমি আমার দরবার থেকে চলেযাও। আল্লাহ যে পরিমাণ তৌফিক দিয়েছেন সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে তুমি একটা জামাতৈরি করে নিয়ে আসো। এ ঘটনার পরদিন আরেকজন সাহাবী আসলেন চকচকে ঝকঝটে জামাগায়ে দিয়ে। হুজুর তিনবার তার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই লোকটা বোধহয় খুববিত্তশীলী। তখন এক সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ব্যাপারটি আসলে তেমন না।এই লোকটা আসলে তার ততটুকু আছে তার চেয়ে বেশী দেখানোর চেষ্টা করে ।রাসূলুল্লাহ এবার লোকটির উদ্দেশ্যে বললেন, এই জামা পরিধান করা তোমার জন্যহারাম কারণ এই জামা নিঃসন্দেহে তোমাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে। সুতরাংতোমার যতটুকু সামর্থ আছে সে অনুযায়ী ব্যয় কর। বেশীও নয়, কমও নয়, মাঝখানেযতটুকু মাঝামাঝি পর্যায়ে ব্যয় করাই প্রকৃত মুমীনের জীবন। "
ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে অর্থাৎ মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে সকল কাজে। আর মনে রাখতে হবে দান খয়রাত করলে সম্পদ কমে না। রাসূলে কারিম (সা) বলেছেনঃ সদকা দাও! সদকা তোমার মালামালকে যেমন বৃদ্ধি করবে তেমনি আল্লাহর রহমতও তোমার ওপর বর্ষিত হবে। ইমাম বাকের (আ) বলেছেন, দান খয়রাত বা সদকা মানুষকে সত্তর রকম বালা মুসিবৎ থেকে রক্ষা করে। ... সদকা দানকারী অকালমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। আমরাও তাই বেশি বেশি দান সদকার মধ্য দিয়ে পবিত্র এই মাহে রমযানকে বিদায় দেওয়ার চেষ্টা করবো। আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দিন।#