বাঙ্গালী
Tuesday 26th of November 2024
0
نفر 0

মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান (আ) এর শাহাদাত বার্ষিকী

মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান (আ) এর শাহাদাত বার্ষিকী

মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান (আ) এর শাহাদাত বার্ষিকী
হিজরী সনের আটাশে সফর ইসলামের ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আছে , এইদিন ইসলামের মহান নবী আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ রাসূল বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) এর ওফাত দিবস। অবশ্য ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে মহানবীর ইন্তেকাল হয়েছে বলেও প্রসিদ্ধি রয়েছে। তবে মতানৈক্যের উর্ধ্বে উঠে যে বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করতে হবে তা হলো, মহানবী (সা) এই পৃথিবীতে আমাদের জন্যে যে বার্তা নিয়ে এসেছেন, যেই আদর্শ নিয়ে এসেছেন তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যে, সেই আদর্শ আমরা কতোটা অনুসরণ করছি , কতোটা বাস্তবায়ন করছি আমাদের জীবনে-তা একবার পর্যালোচনা করে দেখা উচিত। মনে রাখতে হবে রাসুলের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একমাত্র উপায় হলো তাঁর প্রদর্শিত পথে চলা। জীবন সমস্যার সমাধানে তাঁর নির্দেশনাকে কাজে লাগানো। তাঁর চারিত্র্যিক ও নৈতিক আদর্শে আমাদের জীবনকে রাঙিয়ে তোলাই হবে তাঁর প্রতি ভালোবাসা নিবেদনের অন্যতম উপায়।
রাসূল ( সা ) বলেছিলেন, ‘যারা হাসান ও হুসাইনকে ভালবাসবে তারা আমাকেই ভালবাসলো,আর যারা এ দুজনের সাথে শত্রুতা করবে তারা আমাকেই তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করলো।' এই হাসান-হোসাইনকে রাসূল এতো বেশি আদর করতেন এইজন্যে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই দুইজনকে বেহেশতে যুবকদের নেতা বলে অভিহিত করেছেন। এছাড়া তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ চরিত্রের অধিকারী। আটাশে সফর তারিখে হযরত ইমাম হাসান (আ) এরও শাহাদাত বার্ষিকী। তো রাসূলের হাদীস অনুযায়ী এই ইমামের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদন স্বয়ং নবীজীর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনেরই শামিল। তাই আমরা ইমাম হাসান মুজতবা (আ) এর শাহাদাত বার্ষিকীতে তাঁরি জীবনেতিহাস নিয়ে আলোচনা করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করার চেষ্টা করবো।
হে ইমাম ! বিষের পেয়ালায় চুমু দিয়ে আমাদের করেছো ঋণী
আমরা তোমার পদাঙ্ক দেখে দেখে এগিয়ে চলেছি
তোমার সাক্ষাতে, কোথায় তুমি ,
মরুঝড় এসে বুঝি মুছে দিলো তোমার পদচিহ্ন
এবার কী করে পাবো সত্যের নাগাল !
রাতের আঁধারে দূর আকাশে জ্বলজ্বলে একটি তারা
পথ দেখালো শেষে , যার আলোয় জ্বলমান
বেহেশতের যুবনেতার নাম - ইমাম হাসান !
ইমাম হাসান ( আ ) ছিলেন রাসুলে কারীম ( সা ) এর প্রিয় নাতি। হযরত আলী ( আ ) এবং হযরত ফাতেমা ( সা ) এর বড়ো সন্তান। রাসুলের সাহচর্য পাবার কারণে তাঁর মধ্যে নৈতিক যে মূল্যবোধগুলো গড়ে উঠেছিল তা ছিল অনেকটা রাসুলের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের মতোই। সেজন্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি তাঁর এক বিশেষ অনুরাগ ছিল। কখনো এই আসক্তির বহিপ্রকাশ ওযুর সময় অনেকে তাঁর চেহারায় অবলোকন করতেন। যখন তিনি ওযুতে মগ্ন হতেন তখন তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো, তিনি কম্পিত হতেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো-আপনি এরকম হন কেন ? উত্তরে তিনি বলেন-যে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয় তাঁর এরকম অবস্থাই যথোপযুক্ত। ষষ্ঠ ইমাম থেকে বর্ণিত যে, ইমাম হাসান (আঃ) তাঁর যমানার সর্বশ্রেষ্ঠ আবেদ বা ইবাদতকারী ও মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন। আর যখনি তিনি মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা স্মরণ করতেন, তখনি ক্রন্দন করতেন এবং বেহাল হয়ে পড়তেন। তিনি পদব্রজে আবার কখনো নগ্নপদে পঁচিশ বার আল্লাহর ঘর যিয়ারত করেন।
সিফফিনের যুদ্ধের সময় মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের (আ) নিকট আবদুল্লাহ বিন ওমরকে এ কথা বলে পাঠায় যে "যদি আপনার পিতার অনুসরণ থেকে বিরত থাকেন তাহলে আমরা খেলাফত আপনার হাতে ছেড়ে দেবো। কেননা, কোরাইশের লোকজন আপনার পিতার প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট, কারণ আপনার পিতা তাদের বাপ-দাদাদের হত্যা করেছে , তবে তারা আপনাকে গ্রহণ করতে কোন আপত্তি করবে না।"
ইমাম হাসান (আঃ) উত্তরে বলেছিলেন-‘কোরাইশরা ইসলামের পতাকা ভূলুণ্ঠিত করতে দৃঢ়চিত্ত ছিল। আমার বাবা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ইসলামের জন্যে তাদের মধ্যেকার অবাধ্য ও রগচটা ব্যক্তিদেরকে হত্যা ক'রে তাদের চক্রান্তকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিল। তাই তারা আমার পিতার সাথে শত্রুতার ঝাণ্ডা উত্তোলন করেছিল।'
ইমাম হাসান এই যুদ্ধে এক মূহুর্তের জন্যেও বাবার উপর থেকে তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করেন নি বরং শেষ পর্যন্ত তাঁর সাথে সমন্বয় ও সমচিত্তের পরিচয় দিয়েছেন।
মুয়াবিয়া যে ইমামের হাতে বাইয়্যাত গ্রহণ করে নি তাই নয় বরং ইমামকে উৎখাতের জন্যে সে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সে কিছু লোককে গোপনে নির্দেশ দিয়েছিলো ইমামকে হত্যা করার জন্যে। আর এ কারণেই ইমাম জামার নিচে বর্ম পরিধান করতেন এবং বর্ম ব্যতীত নামাযে অংশ গ্রহণ করতেন না। একদিন মুয়াবিয়ার গোপন প্রতিনিধি ইমামের দিকে তীর নিক্ষেপ করে। কিন্তু ঐ তীরে ইমামের কোন ক্ষতি হয় নি । মুয়াবিয়া কিন্তু তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি। সে তার লম্পট সন্তান ইয়াযিদকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে এবং তার পক্ষে জনগণের বাইয়াত গ্রহণ করে। নিজের দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করেই ক্ষান্ত হয় নি মুয়াবিয়া বরং তিনি ইমাম হাসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুয়াবিয়া ইমামকে সন্ধি করার আহ্বান জানায়। ইমাম পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সন্ধি করাকেই মিল্লাতের জন্যে অনুকূল বলে মনে করে। এই সন্ধিচুক্তিতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন ধারা রাখা হয়েছিল।
যেমন :
১) আহলে বাইতের অনুসারীদের রক্ত সম্মানিত ও হেফাজত থাকবে এবং তাদের অধিকার পদদলিত করা যাবে না।
২) হযরত আলীকে গালি-গালাজ দেওয়া যাবেনা।
৩) মুয়াবিয়া রাস্ট্রের আয় থেকে এক মিলিয়ন দেরহাম সিফফিন ও
জামালের যুদ্ধের ইয়াতিমদের মধ্যে বণ্টন করবে।
৪) ইমাম হাসান মুয়াবিয়াকে আমিরুল মুমিনিন বলে সম্বোধন করবে না।
৫) মুয়াবিয়াকে অবশ্যই আল্লাহ কিতাব এবং রাসুলের (সাঃ) সুন্নাত
মোতাবেক আমল করতে হবে।
৬) মুয়াবিয়া, তার মৃত্যুর পরের জন্যে খেলাফতের ভার অন্য কারো উপর সোপর্দ করে যাবে না ইত্যাদি।
৭) মুয়াবিয়া উপরোক্ত শর্তগুলো এবং অন্যান্য আরো সব শর্তাবলী মেনে নিয়েছিল যার সবটাই ইসলাম ও বিশেষ করে আহলে বাইতের অনুসারীদের হেফাজতের জন্যে প্রয়োজন ছিল । ফলে যুদ্ধের  পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু মুয়াবিয়া এই সন্ধিচুক্তিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য প্রচারণা চালিয়েছিল-ইমাম হাসান (আ) নাকি তাকেই বেশি উপযুক্ত মনে ক'রে খেলাফতের দায়িত্ব তার হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে ইমাম হাসান প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন - ‘মুয়াবিয়া মিথ্যাচার করছে , কোরআন এবং নবীর সুন্নাত মতে আমরা অর্থাৎ নবীর আহলে বাইত সকলের চেয়ে যোগ্যতর। তাছাড়া আমরা সন্ধিচুক্তির যে কয়েকটি ধারা পাঠকদের উদ্দেশে ব্যক্ত করেছিলাম। সেখানে স্পষ্টই বলা হয়েছিল যে , মুয়াবিয়াকে আমিরুল মুমিনিন বলা যাবে না।'
ইমামের এ ধরনের স্পষ্ট বক্তব্যে মুয়াবিয়া ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী পর্যায়ে সরাসরি সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে। তারপর থেকেই যে-কোনোভাবে ইমামকে হত্যা করার পাঁয়তারা করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্রে ইমামকে শহীদ করার জন্যে বিষ প্রয়োগ করা হয়।
ইমাম হাসান শাহাদাতের অমৃত পেয়ালা পান করে মুসলমান সমাজের জন্যে যে শিক্ষা রেখে গেছেন তাহলো মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সত্যকে কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শাহাদাতবরণ করা অনেক বেশি সম্মান ও মর্যাদার। আমরা যেন তাঁর প্রদর্শিত এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের জীবনকেও ধন্য করতে পারি-সেই দোয়া চেয়ে এখানেই গুটিয়ে নিচ্ছি রাসূলের ইন্তেকাল এবং ইমাম হাসানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আমাদের বিশেষ আলোচনা। রেডিও তেহরান)
 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-১১তম পর্ব
যদি কেউ দাড়ি না রাখে তাহলে সে কি ...
বাংলাদেশের নিম গাছ আরাফাতের ...
মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান ...
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত-পূর্ব ...
কে হযরত আলী (আ.) কে শহীদ করেছে? তার ...
আল কোরআনের অলৌকিকতা (৬ষ্ঠ পর্ব)
কবর জিয়ারত
কোরবানির ইতিহাস
পবিত্র ঈদে গাদীর

 
user comment