জাওহার ইকবাল খান
॥ শেষ কিস্তি ॥* যে পশুর লেজ বা কোনো কান এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি কাটা সে পশু কোরবানি জায়েজ নেই। তবে জন্মগতভাবেই যদি কোনো ছোট হয় তাহলে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। জামে তিরমিযী ১/২৭৫; মুসলনাদে আহমদ ১/৬১০; ইলাউস-সুনান ১৭/২৩৮; কাযীখান ৩/৩৫২; আলমগীরী ৫/২৯৭-২৯৮।
* কোরবানির পশু হারিয়ে যাওয়ার পর যদি আরেকটি কেনা হয় এবং পরে হারানোটিও পাওয়া যায় তাহলে কোরবানিদাতা গরিব হলে (যার উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়) তার দুটি পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। আর ধনী হলে কোনো একটি কোরবানি করলেই হবে। তবে দুটি কোরবানি করাই উত্তম। সুনানে বায়হাকী ৫/২৪৪; ইলাউস সুনান ১৭/২৮০; বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৯; কাযীখান ৩/৩৪৭।
* অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' পড়তে হবে। যদি দ্বিতীয় ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে না পড়ে তবে ওই কোরবানি সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। রুদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪।
* কোরবানির পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা দ্বারা উপকৃত হওয়া জায়েজ নেই। যেমন হালচাষ করা, আরোহন করা, পশম কাটা ইত্যাদি। সুতরাং কোরবানির পশু দ্বারা এসব করা যাবে না। যদি করে তবে পশমের মূল্য হালচাষের মূল্য ইত্যাদি সদকা করে দিবে। মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬; নাইলুল আওতার ৩/১৭২; ইনাউস সুনান ১৭২৭৭ কাযীখান ৩/৩৫৪ আলমগীরী ৫/৩০০।
* কয়েকজনে মিলে কোরবানি করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরিকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েজ হবে। নতুবা ওই শরিকের টাকা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য তার স্থলে অন্যকে শরিক করা যাবে। বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৬ কাযীখান ৩/৩৫১।
* কোরবানির গোশত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে দেয়া জায়েজ। ইলাউস সুনান ১৭/২৮৩ আলমগীরী ৫/৩০০।
* কোরবানির গোশতের এক-তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে, আর এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী ৫/৩০০।
* জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কোরবানির পশুর কোনো কিছুই পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া জায়েজ হবে না। সহীহ বুখারী ১/৩৩২; সহীহ মুসলিম ২/৪২৩; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৮; কাযীখান ৩/৩৫৪। স্বরূপ, তাৎপর্য ও সম্পাদন-পদ্ধতি সব দিক থেকেই তা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ইসলামের ইবাদত সম্পূর্ণ তাওহীদ ভিত্তিক। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর জন্যই তা হতে পারে। অন্য কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা শক্তির জন্য হতে পারে না। ঈদুল আজহা শিক্ষা দেয় আল্লাহপ্রেমে তাকওয়া ও মনের একাগ্রতা নিয়ে কোরবানি করতে হবে, লোক দেখানোর জন্য নয়। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ঈদুল আজহা শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; এর প্রকৃত রূপ হলো মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তাকওয়া নিয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর নামে উৎসর্গ করা। তাই উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা প্রভৃতি গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু ও কোরবানির পশুর মধ্যে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
মুসলমানদের শুধু কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু জবাইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বিশ্ব মানবতার শান্তি ও কল্যাণের জন্য সবাইকে উৎসর্গিত ও নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। মানুষের অন্তর থেকে পাশবিক শক্তি ও চিন্তা-চেতনাকে কোরবানি করে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কোরবানি জীব-জানোয়ার বা পশু হনন করতে আসে না, বরং কোরবানির মাধ্যমে পশুপ্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার এটি যে একটি উত্তম ব্যবস্থা তা স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদুল আজহা প্রতি বছর ফিরে আসে। আসুন, আমরা দলমত-নির্বিশেষে সবাই মিলেমিশে কোরবানির সঠিক দীক্ষা নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, পাপমুক্ত পরিবেশ, হিংসামুক্ত রাজনীতি, সন্ত্রাসমুক্ত দেশ, প্রেম ও ভালোবাসা বিজড়িত বিশ্ব গড়ে তুলি!
লেখক : সাংবাদিক ও শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ