-এম এস শহিদ
ভূমিকা
৭১৭ খৃষ্টাব্দে খলিফা সুলায়মানের মৃত্যুর পর তার চাচাত ভাই ওমর বিন আব্দুল আজীজ খিলাফত লাভ করেন। খলিফা ওমরের পিতা আব্দুল আজীজ খলিফা আব্দুল মালিকের ভ্রাতা ছিলেন এবং মাতা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের দৌহিত্রী। হজরত ওমরের সাথে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মিল থাকায় ওমর বিন আব্দুল আজীজ ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় ওমর হিসেবে পরিচিত। উমাইয়া বংশের ইতিহাসে দ্বিতীয় ওমরের অভিষেক সত্যিই একটি যুগান্তকারী ঘটনা। অনাচার, অধর্ম, বর্বরতা, ষড়যন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, বিলাসিতা যখন উমাইয়া খিলাফতে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল সে সময় তিনি শাসনভার গ্রহণ করেন। প্রশাসক হিসেবে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন। কেননা খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বে তিনি হেজাজের শাসনকর্তা ছিলেন। এ সময় তিনি ন্যায়পরায়ণতা, সরলতা, চারিত্রিক মাধুর্য, ধর্মপরায়ণতা ও প্রজাবাৎসল্য দ্বারা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেই তিনি পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাদের স্বেচ্ছাচারী নীতি বর্জন করেন এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের মৌলিক ইসলামী আদর্শগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াস পান। আর এ কারণেই তাঁকে ‘উমাইয়া সাধু' বলে অভিহিত করা হয়।
দ্বিতীয় ওমর ও ইসলামি রাষ্ট্রনীতি
সার্বজনীন মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্বিতীয় ওমর নিরপেক্ষ শাসননীতি প্রবর্তন করেন এবং সাম্রাজ্যে সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য তিনি পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাদের সামাজ্যবাদী, স্বৈরাচারী ও স্বার্থান্বেষী নীতি পরিহার করেন। দ্বিতীয় ওমরের শাসননীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল : প্রথমত, সমরনীতির পরিবর্তে শান্তি ও সংরক্ষণ নীতি অক্ষুণ্ণ রাখা। কারণ তার মতে, সংরক্ষণ করতে না পারলে রাজ্য সম্প্রসারণ কেবল নিরর্থকই নয়, বরং বহুবিধ সমস্যার সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, তিনি স্বজনপ্রীতি, গোত্রপ্রীতি, দল ও পক্ষপাতিত্ব নীতিকে পরিত্যাগ করেন। প্রজাবৎসল্য ও ধর্মভীরু খলিফা উমাইয়া বংশের প্রতি কোনপ্রকার দুর্বলতা প্রকাশ না করে সকল শ্রেণীর প্রজাদের সমান সুযোগ-সুবিধা দান করতেন। মানবতার সেবা এবং জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে প্রজাপালনই ছিল খলিফা দ্বিতীয় ওমরের শাসনের মূলমন্ত্র। অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থাকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি অত্যচারী, লোভী ও অযোগ্য প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বরখাস্ত করে তদস্থল বিশ্বস্ত, পরোপকারী, ন্যায়নিষ্ঠ এবং উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদান করেন। এক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দেন। কেননা তিনি দলীয়, গোত্র ও বংশীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ছিলেন। খলিফা দ্বিতীয় ওমরের পূর্ববর্তী শাসকদের কেউ কেউ হিমরীয় অথবা মুদাবীয় গোত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কিন্তু খলিফা দ্বিতীয় ওমর খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেই পূর্ববর্তী শাসনকর্তাদের নীতি পরিহার করে সমতা, নিরপেক্ষতা ও কল্যাণকর নীতির বশবর্তী হয়ে হিমরীয় ও মুদাবীয় উভয় গোত্র থেকে শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। দ্বিতীয় ওমরের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব ছিল তিনি দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ন্যায়নীতি ও নিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে শাসনকর্তাদের নিয়োগ ও পদচ্যুত করতেন। কোনপ্রকার দুর্বলতা তার নীতিজ্ঞান ও কর্তব্যবোধকে আচ্ছন্ন করতে পারে নাই। প্রাদেশিক শাসনকর্তার কার্যকলাপের ওপর তিনি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। নির্যাতন ও সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে তিনি ঘোরাসানের শাসনকর্তা উমাইয়াপন্থী ইয়াজিদ-ইবন-মুহাল্লাবকে বরখাস্ত ও কারারুদ্ধ করেন। স্পেনের শাসনকর্তা আল-হুরকেও তিনি অযোগ্যতার জন্য পদচ্যুত করেন। দ্বিতীয় ওমর কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর প্রশাসকদের এরূপ নির্দেশনামা দেন : ‘‘তোমাদের জেনে রাখা কর্তব্য যে, ন্যায়পরায়ণতা ও মহানুভবতা দ্বারাই ধর্মের প্রতিপালন হয়ে থাকে। কোন পাপকেই ছোটো করে দেখা উচিত নয়। জনাকীর্ণ স্থানকে জনশূন্য করতে চেষ্টা করো না। প্রজাদের সাধ্যাতীত কোন কিছুই করার চেষ্টা করো না। তারা যা দিতে পারে তাই গ্রহণ করো। জনসংখ্যা এবং ঐশ্বর্য যাতে বৃদ্ধি করা যায় তার চেষ্টা করবে। নম্র ও নিষ্ঠুরহীনভাবে শাসন করবে। উৎসব উপলক্ষে কোন উপঢৌকন গ্রহণ করো না। জনসাধারণের মধ্যে যে সমস্ত পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বিতরণ করা হয়েছে তার মূল্য গ্রহণ করো না। পর্যটক, বিবাহ, উষ্ট্রের দুগ্ধের ওপর কোন কর ধার্য করো না। যে ইসলাম ধর্ম সানন্দে গ্রহণ করেছে তাকে জিজিয়া দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করো না।''
দ্বিতীয় ওমর ও ন্যায়পরায়ণতা
ন্যায়নিষ্ঠ, কর্তব্যজ্ঞান, জনকল্যাণ, ইসলামের প্রতি অনুরাগ, সাম্য ও সমতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে খলিফা দ্বিতীয় ওমর খোলাফায়ে রাশেদীনের পঞ্চম ধর্মপ্রাণ খলিফা বনে সমাদৃত হন। দ্বিতীয় ওমর ভোগ-বিলাসের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতেন এবং সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। কথিত আছে, খলিফা হবার পূর্বে তিনি প্রচুর ধন-সম্পদের [৫০,০০০ টাকা মূল্যের] মালিক ছিলেন। কিন্তু তিনি খিলাফত লাভ করার পর মাত্র ২০০ টাকা মূল্যের সম্পত্তি রেখে বাকি সমুদয় সম্পত্তি জনকল্যার্থে দান করেন। নিজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে খলিফা তার বংশের সকল উমাইয়াকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ বাইতুলমালে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি তার স্ত্রী ফাতেমাকে পিতা ও ভ্রাতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মণিমুক্তা খচিত অলঙ্কারাদি বাইতুল মালে জমা দিতে বললে সানন্দে তার আদেশ পালন করা হয়। রাজকীয় অশ্বশালার অশ্বগুলি খলিফার নির্দেশে বিক্রি করে সংগৃহীত অর্থ বাইতুলমালে জমা রাখা হয়। খলিফা দ্বিতীয় ওমর রাসূলে করিম স. এবং আমীর বংশধরদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।
দ্বিতীয় ওমর ও ফাদাক বাগান
ইসলামের গোড়ার ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, ফাদাক বাগানটি বিনা যুদ্ধে ইসলামের গণিমত হিসেবে প্রাপ্ত হয়েছিল এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া লিহি ওয়া সাল্লাম তা হযরত ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহাকে দান করেছিলেন।কিন্তু তাঁর তিরোধানের পর সর্ব প্রথম ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর ফাতেমার কাছ থেকে তা জোরপূর্বক নিয়ে নিয়েছিলেন। তবে ফাদাক দখল করার খেত্রে খলিফা মসনদের উদ্দেশ্য কী ছিল সে ব্যাপারে নানাবিধ কারণ বর্ণিত হয়েছে যা আমরা যথাস্থানে উল্লেখ করেছি।
কিন্তু তারপর থেকে দেখা গেছে যে, কোন খলিফা তা ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং পরবর্তি খলিফা তা ফেরত নিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে ফাদাকের অর্থনৈতিক প্রভাবটি গুরুত্বপূর্ণ। সংক্ষেপে তার অর্থনৈতিকি বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য করুন :
আব্দুল্লাহ ইবনে হাম্মাদ আনসারীর বর্ণনায় ফাদাকের বাগান থেকে বাৎসরিক আয় ছিল ২৪ হাজার দিনার এবং অন্যান্য বর্ণনায় তার পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার দিনার। প্রথম থেকেই খলিফার মসনদে অধিষ্ঠিত সাসকগণের যারাই নবী স. এর আহলে বাইতের বিরোধী পক্ষ্য বলে পরিগণিত হতো, তাদের সবার মতে আহলে বাইতের কাছে এই বিশাল আয় থাকাটা গ্রহণযোগ্য ছিল না।
ইবনে আবিল হাদিদ মো'তাজেলি আলী ইবনে তাকির কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ফাদাকের বাগানটি অত্যধিক মূল্যবান ছিল এবং বর্তামানে কুফার খেজুর বাগান সমূহ থেকে যে পরিমাণ ফল পাওয়া যায়, তার সমতুল্য খেজুর উৎপন্ন হতো। প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফা হযরত আবু বকর ও ওমর ঐ ফসল থেকে হযরত ফাতেমাকে সা.বঞ্চিত করার উদ্দেশ্য এমন ছিল যাতে হযরত আলীর মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে খেলাফতের বিরুদ্ধে সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে। এই একই উদ্দেশ্যে আহলে বাইতের সদস্য ও বণি হাশেমকেও খোমসের অধিকার থেকে বঞ্চিক করেছিল। যে খোমসের অধিকার মহান আল্লাহ তা'য়ালা সূরা আনফালের ৪১ নং আয়াতে তাদেরকে সে অধিকার দিয়েছেন। অবশেষে মারওয়ান ইবনে হাকাম ঈর্ষাবশে ফাদাক নামের বাগানটি আত্মসাৎ করেন। দ্বিতীয় ওমর খিলাফত লাভ করে বাগানটি মহানবীর পরিবারবর্গের কাছে হস্তান্তর করেন। এ বাগান হতেই তাঁদের ভরণ-পোষণ চলতো।
দ্বিতীয় ওমর ও আহলে বাইতের প্রতি ভক্তি-ভালবাসা
খলিফার মহানুভবতার আরো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় হজরত আলীর পরিবারের প্রতি সহনশীল মনোভাব। উমাইয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় হযরত আলী ও তাঁর বংশধরের প্রতি প্রত্যেক উমাইয়া শাসক ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করতেন। কিন্তু দ্বিতীয় ওমরের খিলাফতে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা মুয়াবিয়ার শাসনামল থেকে শুরু করে উমাইয়া খলিফা এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ শুক্রবার জুমা নামাযের পর মিম্বার হতে খলিফা আলী ও তাঁর বংশধরদের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণের যে ঘৃণ্য প্রথা প্রচলিত করেছিলেন দ্বিতীয় উমর তা বাতিল করেন। উপরন্তু আব্দুল মালিক কর্তৃক বাজেয়াপ্ত তালহার সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর করেন।
দ্বিতীয় ওমর ও ইসলামি সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা
দ্বিতীয় ওমরের রাজত্বে উমাইয়া খিলাফতের চরম শত্রু খারিজী সম্প্রদায় শান্তি ভঙ্গ করে নাই। তিনি খারিজিদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের দাবি-দাওয়া ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করে তাদের সাথে সমঝোতা করেন। কারণ তিনি শান্তিপ্রিয় ছিলেন ও রক্তপাত নীতির বিরোধী ছিলেন।