বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ)এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের ৫৭ বছর পর বরকতময় রজব মাসের প্রথম দিন ধরনী আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বনবীর পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আঃ)। ইসলামের ইতিহাসে সেটি ছিলো এক সোনালী মুহুর্ত। তিনি ছিলেন ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর সন্তান এবং সবাই তাঁকে বাকের বলেই চিনতো। ইমাম জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে তাকে বাকের বা প্রস্ফুটনকারী বলে অভিহিত করা হতো । জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিলো এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের অনেক জটিল রহস্য তিনি উন্মোচন করেছেন।
সে সময়ের বিখ্যাত পণ্ডিতরা ইমাম বাকের (আঃ) এর সমূদ্রসম জ্ঞানের কাছে ছিলেন বিন্দুসম পানির মতো । তৎকালীন পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত আব্দুল্লাহ বিন আতা মাক্কী এ সম্পর্কে বলেছেন, ইমাম বাকের (আঃ) এর সাথে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় বিখ্যাত মনিষীদের যেভাবে অসহায় দেখেছি, অন্য কারো সাথে আলোচনায় সেরকমটি হতে দেখি নি। বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হাকাম বিন উতাইবাহকে দেখেছি ইমামের পাশে এমনভাবে বসে থাকতে যেমনটি একজন ছাত্র তার শিক্ষকের পাশে বসে থাকে। এই মহান ইমামের শুভ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর বরকতময় জীবন থেকে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
ইমাম হোসেন (আঃ) পুত্র ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর শাহাদাতের পর তাঁর সন্তান ইমাম বাকের (আঃ) ১৯ বছর মুসলিম বিশ্বের অতি স্পর্শকাতর সময়ে উম্মাহর নেতৃত্ব ও ইমামতের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এই সময়টিতে মুসলিম বিশ্বে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হয় এবং আব্বাসিয়োরা উমাইয়াদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ইমাম এ সময় পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞান ও ইসলামী সংস্কৃতি প্রসারের কাজ করেন। তিনি মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানগত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন, যার ফল পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহ পেতে শুরু করে। তিনি ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠির ইসলাম বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং খাঁটি মোহাম্মাদি ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রসারের কাজে হাত দেন।
বিশিষ্ট মুসলিম মনিষী শেখ তুসি ইমাম বাকের (আঃ) এর ছাত্র সংখ্যা ৪৬২ জন বলে উল্লেখ করেছেন। তৎকালীন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা জ্ঞানের দীক্ষা নেয়ার জন্য ইমামের সমীপে উপস্থিত হতেন। এক্ষেত্রে জাবির বিন ইয়াজিদ, জুহরি, আবু হানিফা, আনাস বিন মালিক এবং শাফিঈ'র নাম উল্লেখ করা যায়, যারা ইমামের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে শিক্ষালাভ করেছেন। মোহাম্মাদ বিন তালহা শাফিঈ ইমাম বাকের (আঃ) সম্পর্কে লিখেছেন : "তিনি ছিলেন জ্ঞানের প্রস্ফুটনকারী। তিনি সংক্ষেপে অর্থবহ কথা বলতেন এবং তাঁর মনের জানালা ছিলো উন্মুক্ত। কাজে কর্মে তিনি ছিলেন পবিত্র মানুষ। মহান চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি। আল্লাহর আদেশ পালনই ছিলো তার ব্রত। তিনি ছিলেন আল্লাহর নিকটতম ব্যক্তিদের অন্যতম এবং মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা তাঁর ছিলো।
ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আঃ) এর ইমামত এমন সময় শুরু হয় যখন ইসলামের বিভিন্ন ফেরকা'র মধ্যে ফিকাহ ও বিশ্বাসগত মতপার্থক্য গভীর আকার ধারণ করেছিলো। এই পরিস্থিতিতে তিনি বিশ্বনবীর আহলে বাইতের নির্দেশিত ইসলামের সঠিক পথ মুসলিম উম্মাহর সামনে তুলে ধরেন। তাঁর অল্প সময়ের প্রচেষ্টায় ভ্রান্ত মতাদর্শের অধিকারী ফেরকাগুলো দুর্বল হতে থাকে এবং মানুষ সঠিক ইসলামের দিকে ফিরে আসে। অন্যদিকে উমাইয়া ও আব্বাসিয়োদের মধ্যে ক্ষমতার দলাদলিতে সে সময় মুসলিম বিশ্বে এক অস্থির রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিরাজ করছিলো। ঘন ঘন খলিফা পরিবর্তিত হচ্ছিলো। ইমামের ১৯ বছরের ইমামতকালে ৫ জন খলিফা পরিবর্তিত হন। এই অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ইমাম ছাত্র তৈরির দিকে মনোনিবেশ এবং ইসলামের স্বরূপ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আঃ) এর যুগে উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর আকিদা বা বিশ্বাসগত ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিলো। এ কারণে অনেক মুসলমান প্রকৃত ইসলামের সন্ধানে পথে পথে ঘুরছিলো। ইমাম তাদের সামনে পথের দিশা তুলে ধরলেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন ইসলাম হিসেবে যা তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, তার কতখানি সঠিক এবং কতখানি ভ্রান্ত ধারণা। ফলে উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি ইসলামকে পথভ্রষ্ট করলেও ইমাম বাকের (আঃ) এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইসলাম নতুনভাবে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়।
সাধারণ মানুষের সাথে ইমাম ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন। অতি সাধারণ মানুষ, যাদেরকে সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো, ইমাম তাদের সাথে বসে খাবার খেতেন এবং তাদের সমস্যার সমাধান করতেন। তাঁর এই মধুর ও অমায়িক ব্যবহারের কারণে সবাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। কোন সাহায্যপ্রার্থী ইমামের কাছ থেকে রিক্ত হস্তে ফিরে যেত না এবং এ ধরনের মানুষের সাথে সম্মানজনক আচরণ করার জন্য তিনি তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিতেন। ইমামের সদালাপী ও সহাস্য আচরণের কারণে তার বিরোধিরাও তাঁর ভক্ত হয়ে উঠতো। ইতিহাসে এসেছে, শাম বা সিরিয়ার অধিবাসী এক ব্যক্তি আকিদাগত দিক থেকে ইমামের বিরোধী হলেও সব সময় তাঁর কাছে থাকতেন।
জ্ঞানগত ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনেও ইমাম বাকের (আঃ) তৎপর ছিলেন। অত্যাচারী রাজাবাদশাহদের অন্যায় কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করতেন তিনি। শাসকগোষ্ঠির অত্যাচারে জনগণ যখন অতিষ্ট, তখন ইমাম তাদের সামনে ন্যায়পন্থী শাসকের উদাহরণ তুলে ধরতেন। ফলে জনগণ উপলব্ধি করতো, তারা কতখানি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ইমাম বাকের (আঃ) বলেছেন : যে ব্যক্তির অন্তরে জ্বলজ্বলে ও সাদা কোন অংশ নেই, সে মুমিন নয়। যখন ব্যক্তি কোন পাপ কাজ করে তখন ঐ সাদা অংশের ওপর কালো একটি ছাপ পড়ে। যদি সে তওবা করে আল্লাহর কাছে অনুশোচনা করে তবে সেই কালো ছাপ মুছে যায়। আর যদি সে তওবা না করে পাপ কাজ অব্যাহত রাখে, তবে কালো ছাপ গভীর থেকে গভীরতর হয়। একসময় তার অন্তরে আর কোন সাদা জায়গা থাকে না, পুরোপুরি কালো হয়ে যায়। এ ধরনের অন্তরের অধিকারীরা কখনো সুপথ পায় না।
পাঠক, ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আঃ) সম্পর্কে তার যুগের এক ব্যক্তির মন্তব্য উল্লেখ করে এই মহান ইমামের জন্মবার্ষিকীর আলোচনা শেষ করবো। জনৈক আসাদ বিন কাসির বলেছেন : আমি একবার আমার দরিদ্র অবস্থা এবং আমার ওপর ভাইদের অত্যাচারের ব্যাপারে ইমামের কাছে নালিশ করলাম। তিনি বললেন : "যে ভাই সামর্থবান ও সম্পদশালী অপর ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে, কিন্তু ঐ ভাই দরিদ্র হয়ে গেলে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ও তার ওপর অত্যাচার চালায় সে অত্যন্ত খারাপ মানুষ।" এরপর তিনি আমাকে ৭০০ দেরহাম দান করার নির্দেশ দিলেন যাতে আমি সেই অর্থ দিয়ে আমার দারিদ্র্য দূর করতে পারি। এরপর ইমাম আমাকে বললেন : "তুমি স্বচ্ছল হতে পারলে কিনা তা আমাকে জানিও"। {jcomments on}
source : abna