২৮ এপ্রিল (রেডিও তেহরান): এক আল্লাহর ইবাদত ও মূর্তিপূজা বা অংশীবাদ নিয়ে নিজ জাতির সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, নমরূদ একবার স্বপ্নে দেখে যে, তার নগরের কিনারায় একটি তারার উদয় হয়েছে। এই তারার জ্যোতি ছিল চাঁদ ও সূর্যের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল। গণকরা এর ব্যাখ্যায় বলল, ব্যাবিলন শহরে এ বছর এক শিশু জন্ম নেবে যার হাতে তোমার রাজত্বের পতন ঘটবে। তবে এখনও সে মাতৃগর্ভে আসেনি। এ কথা শোনা মাত্র সে আদেশ জারি করলো যে, নারী-পুরুষের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো হবে।
প্রতি দশ জন নারীর জন্য একজন পাহারাদার থাকবে। যদি কোনো পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হয় তবে তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু আল্লাহর মহিমায় এমন প্রতিকূল পরিবেশেও হযরত ইব্রাহিম (আ.) মাতৃগর্ভে এলেন। প্রসবকাল কাছাকাছি হলে তাঁর মা নমরূদের ভয়ে একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন এবং সেখানে জন্ম নিলেন ইব্রাহিম (আ.)। মা নবজাতককে একটি কাপড়ে জড়িয়ে রাখেন এবং গুহার মুখে একটি পাথর চাপা দিয়ে বাড়ি চলে এলেন। দ্বিতীয় দিন গিয়ে দেখেন যে শিশু ইব্রাহিম (আ.) নিজের আঙ্গুল চুষছে, আর তার এক আঙ্গুল দিয়ে দুধ ও অন্য আঙ্গুল দিয়ে মধু বের হচ্ছে। এভাবে তিনি লালিত হতে থাকেন এবং আল্লাহর কুদরতে অন্য শিশুরা এক বছরে যতটা বেড়ে যায় তিনি মাত্র এক মাসে ততটা বড় হলেন!
কিছুকাল পর নমরুদের ভয় কমে গেলে ইব্রাহিম (আ.)-কে গুহা থেকে বের করে আনা হয়। যখন তিনি শহরে এলেন তখন তাঁকে নমরূদের কাছে নেয়া হয়। তিনি দেখলেন এক কদাকার মানুষ সিংহাসনে উপবিষ্ট, আর তাঁর চারপাশে দাসদাসীরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি এই কদাকার মানুষের পরিচয় জানতে চাইলে কেউ বলল, 'ইনি হলেন আল্লাহ বা খোদা। আর এরা তাঁর সৃষ্টি।' ইব্রাহিম (আ.) স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন," এটা কিভাবে সম্ভব যে, আল্লাহ অন্যদের নিজের থেকে সুন্দর করে সৃষ্টি করেন?"
এবারে সুরা আনআমের ৩২ নম্বর আয়াতের অর্থের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এই আয়াতে বলা হয়েছে:
وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَلَلدَّارُ الآخِرَةُ خَيْرٌ لِّلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلاَ تَعْقِلُونَ
"পার্থিব জীবন ক্রীড়া ও কৌতুক ছাড়া কিছুই নয়। পরকালের আবাস পরহিজগারদের জন্যে শ্রেষ্টতর। তোমরা কি চিন্তা-ভাবনা কর না ?
পবিত্র কুরআনের এই আয়াতে পার্থিব জীবন ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা ও বিকাশের পথে এই দুই জীবনই হল পরস্পরের পরিপূরক। তাফসিরকারকদের মতে, পার্থিব জীবন বা দুনিয়ার জীবনকে ক্রীড়া-কৌতুকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এ জন্য যে, সাধারণত ক্রীড়া ও খেলাধুলা হল কল্পনা-ভিত্তিক। কারণ, খেলা শেষ হওয়ার পর সব কিছু আগের বা বাস্তব অবস্থায় ফিরে আসে। নাটক বা ছায়াছবির ক্ষেত্রেও দেখা যায় অভিনয় শেষ হওয়ার পর তথাকথিত নায়ক বা নায়িকার প্রেম বা প্রতিহিংসার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। তদ্রুপ এই বিশ্ব জগতও একটি নাট্যশালার মত। মানব-মানবী হচ্ছে এর অভিনেতা অভিনেত্রী মাত্র। এইসব ক্রীড়া-কৌতুক মানুষকে এতোটাই ব্যস্ত করে রেখেছে যে এইসব ক্রীড়া যে প্রত্যাশিত সময়ের আগেই শেষ হয়ে যেতে পারে সে বিষয়ে তারা অচেতন হয়ে আছে। পার্থিব জীবনের চাকচিক্য অনেক মানুষকে সহজেই প্রতারিত করে। তাই পার্থিব জীবনের তুলনায় পারলৌকিক অসীম জীবনের গুরুত্ব বোঝা সবার জন্য সম্ভব নয়। আর এ জন্যই মানুষকে এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার আহ্বান জানিয়েছেন মহান আল্লাহ। পরকালের জীবন কখনও শেষ হবে না। আর বেহেশতের জীবন অজস্র নেয়ামতে ভরপুর এবং সেখানে দুঃখ, ভয় ও বেদনার অস্তিত্ব নেই।
অন্য কথায় এটা স্পষ্ট যে, কাফিররা পার্থিব জীবনকে গুরুত্ব দেয় এবং পরকালকে অস্বীকার করে। আল্লাহ পরকালকে গুরুত্ব দিয়ে এর ভয়ঙ্কর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। এরপর পার্থিব জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরে বলেছেন যে, এটা ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া কিছুই না, আসল হল পরকাল, যার কল্যাণ কেবল সাবধানীরাই ভোগ করবে। আর অসাবধানী ব্যক্তিদের পরিণাম খুবই মন্দ হবে।
সুরা আনআমের একটি আয়াতে যে কোনো ধরনের শ্রেণী বৈষম্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। বিখ্যাত তাফসির-গ্রন্থ 'দুররুল মানসুর'-এ বলা হয়েছে: একদল কুরাইশ মহানবী (সা.)'র পাশে একদল দরিদ্র মুসলমানদের দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয়। তারা মানুষের মর্যাদাকে ধন-সম্পদের পরিমাণ দিয়ে বিচার করতো। তাই সেইসব সাহাবির ঈমান ও উচ্চতর আত্মিক অবস্থান সম্পর্কে অসচেতন থেকেই তারা বলে ওঠে: হে মুহাম্মাদ! আপনি জনগণের মধ্য থেকে কেবল এদের পেয়েই সন্তুষ্ট হয়েছেন? আল্লাহকে কি এদেরকেই বাছাই করেছেন আমাদের মধ্য থেকে? আমরা কি এদেরই অনুসারী হব? আপনি যদি আমাদের মন জয় করতে চান তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এদেরকে আপনার কাছ থেকে দূর করুন। আর এ সময় নাজিল হয় পবিত্র কুরআনের সুরা আনআমের ৫২ ও ৫৩ নম্বর আয়াত:
وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِم مِّن شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِم مِّن شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُونَ مِنَ الظَّالِمِينَ،
كَذَلِكَ فَتَنَّا بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لِّيَقُولواْ أَهَـؤُلاء مَنَّ اللّهُ عَلَيْهِم مِّن بَيْنِنَا أَلَيْسَ اللّهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِينَ،
"আর তাদেরকে বিতাড়িত করবেন না, যারা সকাল-বিকাল নিজ পালকর্তার ইবাদত করে, তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তাদের হিসাব বিন্দুমাত্রও আপনার দায়িত্বে নয় এবং আপনার হিসাব বিন্দুমাত্রও তাদের দায়িত্বে নয় যে, আপনি তাদেরকে বিতাড়িত করবেন। নতুবা আপনি অবিচারকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবেন।
আর এভাবেই আমি কিছু লোককে কিছু লোক দিয়ে পরীক্ষায় ফেলেছি যাতে তারা বলে যে, এদেরকেই কি আমাদের সবার মধ্য থেকে আল্লাহ বেছে নিয়েছেন ও নিজ অনুগ্রহ দান করেছেন তথা তাদেরকে ঈমানের নেয়ামত দান করেছেন? আল্লাহ কি কৃতজ্ঞদের সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত নন ?"
মহান আল্লাহ এ আয়াতে স্পষ্টভাবে মহানবী (সা.)-কে বলছেন যে, আপনি কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকেই সম্পদ ও বংশের বিবেচেনায় নিজের কাছ থেকে দূর করবেন না, বরং আপনার সাহচর্যকে সব ঈমানদারের জন্যই সমানভাবে উন্মুক্ত রাখুন। ইসলাম ধনী ও পুঁজিবাদী শ্রেণীর সব ধরনের অন্যায় আবদারকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করে এবং শ্রেণীগত প্রাধান্যের অলীক দাবিকে তিরস্কার করে। #
source : irib.ir