১৫ ই শাবান হল মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদী (আ.)'র পবিত্র জন্মদিন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের ১১ তম সদস্য ইমাম হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ.)'র পুত্র হিসেবে (আজ হতে ১১৮১ চন্দ্রবছর আগে) তাঁর জন্ম হয়েছিল ২২৫ হিজরিতে ইরাকের (বর্তমান রাজধানী বাগদাদের উত্তরে) পবিত্র সামেরা শহরে।
তাঁর মায়ের নাম ছিল নার্গিস এবং তিনি মহান আল্লাহর আদেশে এক পর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যান। তাঁর অদৃশ্য থাকার সময়ও দুই ভাগে বিভক্ত। স্বল্পকালীন সময়ের জন্য অদৃশ্য হওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদে অদৃশ্য থাকা। দীর্ঘ মেয়াদে অদৃশ্য থাকার পর উপযুক্ত সময়ে তিনি আবার আবির্ভূত হবেন (যেভাবে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আবারও ফিরে আসবেন ঈসা-আ.) এবং সব ধরনের জুলুম ও বৈষম্যের অবসান ঘাটিয়ে বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। অতীত যুগের সুন্নি মনীষী ও আলেম সমাজের অনেকেই এই মহান ইমামের জন্ম গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন।
সাহাবী, তাবেয়ী ও সহীহ হাদিস গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে মহানবী (সা.) হতে বর্ণিত সুসংবাদ প্রদানকারী শত শত বর্ণনাতে ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ইমাম মাহদির আবির্ভাব সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। যদি আহলে বাইতের ইমামদের রেওয়ায়েত এই বর্ণনাগুলোর সাথে যোগ করা হয়, তাহলে এ সংক্রান্ত বর্ণনার সংখ্যা ১০০০-এরও বেশি হবে। যদিও ইমামগণ তাঁদের সব হাদিসকে সব সময় মহানবী (সা.)-এর সাথে সম্পর্কিত করেননি, তবে তাঁরা অসংখ্যবার তাগিদ দিয়ে বলেছেন যে, তাঁরা যা বর্ণনা করেছেন তা তাদের পবিত্র পূর্বপুরুষগণ এবং তাঁদের শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ মহানবী (সা.) থেকেই তাঁরা লাভ করেছেন।
এ সব বর্ণনায় ইমাম মাহদির (আ.) আবির্ভাবের যুগে পৃথিবী, বিশেষ করে যে অঞ্চলে ইমাম মাহদি (আ.) আবির্ভূত হবেন সেই অঞ্চল, যেমন ইয়েমেন, হিজায, ইরান, ইরাক, শাম (সিরিয়া, লেবানন ও জর্দান), ফিলিস্তিন, মিশর ও মাগরিবের (মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও লিবিয়া) যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা ছোট-বড় অনেক ঘটনা এবং বহু ব্যক্তি ও স্থানের নামকে শামিল করে।
বেশ কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েত ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরপরই পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হযরত ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের বিপ্লব ও আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে।
এ সব রেওয়ায়েত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোমানদের (পাশ্চাত্য) সাথে তুর্কী এবং তাদের সমর্থকদের (রুশ) বাহ্যত একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হবে যা বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হবে। ( এখানে তুর্কি বলতে চৈনিক জাতিও হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন)
কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে ইমাম মাহদি (আ.)-এর সমর্থক দু’টি সরকার ও প্রশাসন ইরান আর ইয়েমেনে প্রতিষ্ঠিত হবে। মাহদি (আ.)-এর ইরানী সঙ্গী-সাথীরা তাঁর আবির্ভাবের বেশ কিছুকাল আগে নিজেদের একটি সরকার গঠন করে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। অবশেষে তারা ঐ যুদ্ধে বিজয়ী হবে।
ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে ইরানীদের মধ্যে দু’ব্যক্তি (একজন খোরাসানী সাইয়্যেদ তথা বিশ্বনবী-সা.'র বংশধর যিনি হবেন রাজনৈতিক নেতা এবং অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্ যিনি হবেন সামরিক নেতা) আবির্ভূত হবেন এবং এ দু’ব্যক্তির নেতৃত্বে ইরানী জাতি তাঁর আবির্ভাবের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
কিন্তু ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের কয়েক মাস আগে তাঁর ইয়েমেনী সঙ্গী-সাথিগণের বিপ্লব ও অভ্যুত্থান বিজয় লাভ করবে এবং তারা বাহ্যত হিজাযে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা পূরণ করার জন্য তাঁকে সাহায্য করবে।
হিজাযের এ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হচ্ছে হিজাযের কোন এক বংশের এক নির্বোধ ব্যক্তি যার নাম হলো আবদুল্লাহ্, সে দেশের সর্বশেষ বাদশাহ্ হিসেবে নিহত হবে এবং তার স্থলাভিষিক্ত কে হবে- এ বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন এক মতবিরোধের সৃষ্টি হবে যা ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে।
“যখন আবদুল্লাহর মৃত্যু হবে, তখন জনগণ কোন্ ব্যক্তি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে- এ ব্যাপারে কোন ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে না। আর এ অবস্থা ‘যুগের অধিপতি’র (ইমাম মাহদির) আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে। বহু বছর রাজত্ব করার দিন শেষ হয়ে কয়েক মাস বা কয়েক দিনের রাজত্ব করার অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী শাসনের পালা চলে আসবে।”
আবু বসীর বলেন : “আমি জিজ্ঞাসা করলাম : এ অবস্থা কি দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে? তিনি বললেন : কখনই না। বাদশাহ (আবদুল্লাহর) হত্যাকাণ্ডের পরে এ দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হিজাযের গোত্রগুলোর মধ্যকার সংঘাত ও কলহে পর্যবসিত হবে।”
“(ইমাম মাহদির) আবির্ভাবের নিদর্শনগুলোর অন্যতম হচ্ছে ঐ ঘটনা যা দু’হারামের (মক্কা ও মদিনা) মাঝখানে সংঘটিত হবে। আমি বললাম : কোন্ ঘটনা ঘটবে? তিনি বললেন : দু’হারামের মাঝে গোত্রীয় গোঁড়ামির উদ্ভব হবে এবং অমুকের বংশধরদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বিরোধী গোত্রের ১৫ জন নেতা ও ব্যক্তিত্বকে অথবা তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে।”
এ সময়ই ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের নিদর্শনগুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং সম্ভবত এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে আসমানি আহ্বান বা ধ্বনি যা তাঁর নামে ২৩ রমজানে শোনা যাবে। (বিভিন্ন ইসলামী বর্ণনা ও হাদিস অনুযায়ী দিনটি হবে শুক্রবার)
সাইফ ইবনে উমাইরাহ্ বলেছেন : “আমি আবু জাফর আল মনসূরের (দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলীফা) নিকটে ছিলাম। তিনি কোন ভূমিকা ছাড়াই বললেন : হে সাইফ ইবনে উমাইরাহ্! নিঃসন্দেহে আকাশ থেকে একজন আহ্বানকারী আবু তালিবের বংশধরগণের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির নাম ঘোষণা করবে। আমি বললাম : আমি আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি এ কথা বর্ণনা করেছেন? তিনি বললেন : হ্যাঁ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, এ কথা আমি আমার নিজ কানে শুনেছি। আমি বললাম : হে আমীরুল মুমিনীন! আমি এখন পর্যন্ত এ ধরনের হাদিস কারো কাছ থেকে শুনি নি। তিনি বললেন : হে সাইফ! এ কথা সত্য। যখন ঐ ঘটনা ঘটবে তখন আমরাই সর্বপ্রথম এ আহ্বানে সাড়া দেব। তবে ঐ ধ্বনি আমাদের একজন পিতৃব্য-পুত্রের প্রতি নয় কি? আমি বললাম : সে কি ফাতিমার বংশধর হবে? তিনি বললেন : হ্যাঁ, হে সাইফ! অনন্তর যদি আমি এ রেওয়ায়েতটি আবু জাফার মুহাম্মদ ইবনে আলী আল-বাকির থেকে না শুনতাম তাহলে সমগ্র জগতবাসী আমাকে বললেও আমি তা মেনে নিতাম না। কিন্তু এর বর্ণনাকারী তো ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আলী।”
এ সব রেওয়ায়েত অনুসারে এই আসমানি আহ্বান শোনা যাওয়ার পরই ইমাম মাহদি (আ.) গোপনে তাঁর কতিপয় সঙ্গী ও সমর্থকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন। তখন তাঁর ব্যাপারে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী আলোচনা হতে থাকবে এবং তাঁর নাম সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকবে। তাঁর প্রতি ভালোবাসা সবার হৃদয়ে আসন লাভ করবে।
তাঁর শত্রু রা তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে খুব ভীত হয়ে পড়বে এবং এ কারণে তারা তাঁকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করবে। জনগণের মাঝে ছড়িয়ে যাবে যে, তিনি মদিনায় অবস্থান করছেন।
বিদেশী সামরিক বাহিনী অথবা হিজায সরকার সে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনয়ন এবং সরকারের সাথে গোত্রসমূহের দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করার জন্য সিরিয়াস্থ সুফিয়ানী সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইবে।(হাদিস বা ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী সুফিয়ানী বাহিনীর নেতা সুফিয়ানী হবে মুয়াবিয়ার বংশধর)
এ সেনাবাহিনী মদিনায় প্রবেশ করে হাশেমী বংশীয় যাকে পাবে তাকেই গ্রেফতার করবে। তাদের অনেককে এবং তাদের অনুসারীদেরকে হত্যা করবে এবং অবশিষ্টদেরকে জেলখানায় বন্দী করে রাখবে।
“সুফিয়ানী তার একদল সৈন্যকে মদিনায় প্রেরণ করবে এবং তারা সেখানে এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে। মাহদি ও মানসূর সেখান থেকে পলায়ন করবেন। তারা মহানবীর (সা.) সকল বংশধরকে গ্রেফতার করবে। আর এর ফলে কোন ব্যক্তিই মুক্ত থাকবে না। সুফিয়ানী বাহিনী ঐ দু’ব্যক্তিকে ধরার জন্য মদিনা নগরীর বাইরে যাবে এবং ইমাম মাহদি (ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে) হযরত মুসা (আ.)-এর মতো ভীত ও চিন্তিত অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে মক্কাভিমুখে চলে যাবেন।”
অতঃপর ইমাম মাহদি (আ.) মক্কা নগরীতে তাঁর কতিপয় সঙ্গী-সাথীর সাথে যোগাযোগ করবেন যাতে করে তিনি পবিত্র হারাম থেকে এশার নামাযের পরে মুহররম মাসের দশম রাতে (আশুরার রাতে) তাঁর আন্দোলনের সূচনা করতে পারেন। তখন তিনি মক্কার জনগণের উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণ দান করবেন। এর ফলে তাঁর শত্রু রা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাঁর সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে এবং শত্রু দেরকে বিতাড়িত করে প্রথমে মসজিদুল হারাম ও তারপর পবিত্র মক্কা নগরীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।
মুহররম মাসের দশম দিবসের (আশুরার দিবস) প্রভাতে ইমাম মাহদি সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর বাণী প্রদান করে বিশ্বের জাতিগুলোকে আহ্বান জানাবেন যাতে করে তারা তাঁকে সাহায্য করে। তিনি ঘোষণা করবেন যে, যে মুজিযার প্রতিশ্র“তি তাঁর শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত মুহাম্মদ (সা.) দিয়েছিলেন তা ঘটা পর্যন্ত তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করবেন। আর উক্ত মুজিযা হবে ইমাম মাহদি (আ.)-এর আন্দোলন দমন করার জন্য পবিত্র মক্কাভিমুখে অগ্রসরমান সুফিয়ানী প্রেরিত বাহিনীর ভূ-গর্ভে প্রোথিত হওয়া।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই প্রতিশ্রুত মুজিযা বাস্তবায়িত হবে এবং যে সুফিয়ানী বাহিনী পবিত্র মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিল তা ধ্বংস হয়ে যাবে।
যখন তারা (সুফিয়ানী প্রেরিত বাহিনী) মদিনার মরু প্রান্তরে পৌঁছবে তখন মহান আল্লাহ্ তাদেরকে ভূমিধ্বসের মাধ্যমে ভূ-গর্ভে প্রোথিত করবেন। আর এটা হচ্ছে মহান আল্লাহর বাণীর বাস্তব রূপ। তিনি বলেছেন, “আর যদি আপনি হে নবী! যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত তাদের কঠিন অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন তখন আপনি ভীত হয়ে যাবেন; আর তাদের শাস্তি বিন্দুমাত্র কম করা হবে না এবং তারা নিকটবর্তী স্থানে (মহান আল্লাহর শাস্তির) শিকার হবে। যখনই তারা মরু প্রান্তরে পৌঁছে যাবে ঠিক তখনই তাদেরকে ভূমি গ্রাস করবে এবং যারা সামনে থাকবে তারা ঐ দল কি করছে তা দেখার জন্য পিছনে ফিরে আসবে অথচ তারাও ঐ একই ভাগ্য বরণ করবে; আর যারা পিছনে থাকবে তারা তাদের [যারা ভূমিধ্বসের কারণে ভূ-গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে) সাথে মিলিত হবে অর্থাৎ তাদের স্থানে (ভূমি ধ্বসের স্থানে) পৌঁছে তাদের খুঁজতে থাকবে তখন তারাও ঐ একই বিপদে পতিত হবে।
এ মুজিযার পর ইমাম মাহদি (আ.) ১০০০০-এরও বেশি সেনা নিয়ে মক্কা থেকে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন এবং শত্রু বাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর সেখানে অবস্থান গ্রহণ এবং মদিনা শত্রু মুক্ত করবেন। এরপর তিনি দুই হারাম (মক্কা ও মদিনা) মুক্ত করার মাধ্যমে হিজায বিজয় এবং সমগ্র অঞ্চলের (আরব উপদ্বীপ) ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন।
কতিপয় রেওয়ায়েত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম মাহদি (আ.) হিজায বিজয়ের পর দক্ষিণ ইরান অভিমুখে রওয়ানা এবং সেখানে খোরাসানী ও শুআইব ইবনে সালিহের নেতৃত্বাধীন ইরানী সেনাবাহিনী ও সেদেশের জনগণের সাথে মিলিত হবেন। তারা তাঁর হাতে বাইআত করবে। তিনি তাদের সহায়তায় বসরায় শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন যার ফলে তিনি এক সুস্পষ্ট ও বিরাট বিজয় লাভ করবেন।
এরপর তিনি ইরাকে প্রবেশ করবেন এবং সেখানকার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করবেন। তিনি সেদেশে সুফিয়ানী বাহিনীর অবশিষ্টাংশ এবং অন্যান্য দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে তাদেরকে পরাভূত ও হত্যা করবেন।
এরপর তিনি ইরাককে তাঁর প্রশাসনের কেন্দ্র এবং কুফা নগরীকে রাজধানী হিসাবে মনোনীত করবেন। আর এভাবে ইয়েমেন, হিজায, ইরাক এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো সর্বতোভাবে তাঁর শাসনাধীনে চলে আসবে।
রেওয়ায়েতগুলো এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইরাক বিজয়ের পর ইমাম মাহদি (আ.) সর্বপ্রথম যে যুদ্ধের উদ্যোগ নেবেন তা হবে তুর্কীদের সাথে তাঁর যুদ্ধ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে :
أول لواء يعقده يبعثه إلى التّرك فيهزمهم
“প্রথম যে সেনাদল তিনি গঠন করবেন তা তিনি তুর্কদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করবেন। অতঃপর তা তাদেরকে পরাজিত করবে।”
বাহ্যত তুর্কী বলতে রুশদেরকেও বোঝানো হতে পারে যারা রোমানদের (পাশ্চাত্যের) সাথে যুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়বে।
ইমাম মাহদি (আ.) সেনাদল গঠন করার পর তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীকে কুদসে (জেরুজালেম) প্রেরণ করবেন। এ সময় তাঁর সেনাবাহিনী দামেস্কের কাছে ‘মার্জ আযরা’ এলাকায় আগমন করা পর্যন্ত সুফিয়ানী পশ্চাদপসরণ করতে থাকবে এবং তাঁর ও সুফিয়ানীর মাঝে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। তবে ইমাম মাহদি (আ.)-এর প্রতি জনসমর্থন বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাঁর সামনে সুফিয়ানীর অবস্থান এতটা দুর্বল হয়ে পড়বে যে, রেওয়ায়েত থেকে প্রতীয়মান হয় সুফিয়ানী তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইবে। কিন্তু এ কাজের জন্য তার ইহুদী-রোমান মিত্র ও পৃষ্ঠপোষক এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করবে।
তারা তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পর ইমাম মাহদি (আ.) ও তাঁর সেনাবাহিনীর সাথে এক বিরাট যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ যুদ্ধের উপকূলীয় অক্ষরেখাগুলো ফিলিস্তিনের আক্কা (عكّا) থেকে তুরস্কের আনতাকিয়াহ্ (انطاكية) পর্যন্ত এবং ভিতরের দিকে তাবারীয়াহ্ থেকে দামেস্ক ও কুদস পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। (তাবারীয়াহ্ শহর এবং এ শহরের প্রসিদ্ধ হ্রদটি জবর-দখলকৃত ফিলিস্তিনে তথা বর্তমান ইহুদিবাদী ইসরাইলে অবস্থিত)।
এ সময় সুফিয়ানী, ইহুদী এবং রোমান সেনাবাহিনী মহান আল্লাহর(ঐশী) ক্রোধে পতিত হবে এবং তারা মুসলমানদের হাতে এমনভাবে নিহত হতে থাকবে যে, তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রস্তরখণ্ডের পিছনেও লুকায় তখন ঐ প্রস্তরখণ্ড চিৎকার করে বলে উঠবে : “হে মুসলমান! এখানে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। তাকে হত্যা করো।”
এ সময় মহান আল্লাহর সাহায্য ইমাম মাহদি (আ.) ও মুসলমানদের কাছে আসবে এবং তাঁরা বিজয়ী বেশে আল কুদসে প্রবেশ করবেন।
খ্রিস্টান পাশ্চাত্য আকস্মিকভাবে ইমাম মাহদি (আ.)-এর হাতে ইহুদী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক শক্তিসমূহের পরাজয় বরণের কথা জানতে পারবে। তাদের ক্রোধাগ্নি প্রজ্বলিত হবে এবং তারা ইমাম মাহদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।
কিন্তু আকস্মিকভাবে হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে পবিত্র কুদসের ওপর অবতরণ করবেন এবং তিনি সমগ্র বিশ্ববাসী, বিশেষ করে খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।
হযরত ঈসা মসীহ্ (আ.)-এর অবতরণ বিশ্ববাসীর জন্য এমন এক নিদর্শন হবে যা হবে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের জন্য আনন্দের কারণ।
সম্ভবত হযরত ঈসা (আ.), ইমাম মাহদি ও পাশ্চাত্যের মাঝে মধ্যস্থতা করবেন এবং এ কারণে দু’পক্ষের মধ্যে সাত বছর মেয়াদী একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে :
“তোমাদের ও রোমানদের (পাশ্চাত্য) মধ্যে চারটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হবে। এগুলোর মধ্যে চতুর্থটি হিরাক্লিয়াসের এক বংশধরের সাথে সম্পাদিত হবে এবং তা সাত বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে।”
মাস্তূর বিন গাইলান নামীয় আবদুল কাইস গোত্রের এক ব্যক্তি তখন জিজ্ঞাসা করেছিল : “হে রাসূলাল্লাহ্! ঐ দিন জনগণের নেতা (মুসলমানদের নেতা) কে হবেন?” তিনি বলেছিলেন : “আমার বংশধর মাহদি। যাকে দেখে মনে হবে তার বয়স ৪০ বছর। তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল তারকার মতো জ্বলজ্বল করতে থাকবে। তার ডান গালের ওপর একটি তিল থাকবে। ঐ সময়ে সে দু’টি কাতাওয়ানী* কাবা** পরিহিত থাকবে এবং তাকে দেখতে ইসরাইল বংশীয় পুরুষদের মতো লাগবে। সে ভূগর্ভস্থ সম্পদরাজি উত্তোলন করবে এবং র্শিক ও পৌত্তলিকতায় পূর্ণ একটি নগরীকে মুক্ত ও পবিত্র করবে।”
(*কাতাওয়ান : কুফার একটি এলাকার নাম)
(**কাবা : বিশেষ পোশাক)
কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে পাশ্চাত্য দু’বছর পরে সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করবে। সম্ভবত এ চুক্তি ভঙ্গ করার কারণ হচ্ছে ঐ ভয়-ভীতি যা ঈসা (আ.) কর্তৃক পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের মাঝে গণজাগরণ ও সংহতির জোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে উদ্ভূত হবে। বহু পাশ্চাত্যবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং ইমাম মাহদি (আ.)- কে সাহায্য ও সমর্থন দান করবে।
এ কারণেই রোমানরা দশ লক্ষ সৈন্য সহকারে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে অকস্মাৎ আক্রমণ চালাবে।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে :
“তখন পাশ্চাত্য তোমাদের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে ৮০টি সেনাদল নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। প্রতিটি সেনাদলে ১২০০০ সৈন্য থাকবে।”
আর মুসলিম বাহিনী তাদের মোকাবিলা করবে এবং হযরত ঈসা (আ.) ইমাম মাহদি (আ.)-এর নীতি অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যশীল করে তাঁর নীতি ঘোষণা করবেন এবং ইমাম মাহদির পেছনে বায়তুল মুকাদ্দাসে নামায আদায় করবেন।
রোমানদের (পাশ্চাত্য) বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধ যে সব স্থান বা অক্ষ বরাবর আল কুদস মুক্ত করার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সে সব স্থানে অর্থাৎ আক্কা থেকে আনতাকিয়া, দামেস্ক থেকে আল কুদস (বাইতুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম) এবং মার্জ দাবিক* পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সংঘটিত হবে। এ মহাযুদ্ধে রোমীয়গণ শোচনীয় পরাজয় বরণ করবে এবং (ইমাম মাহদির নেতৃত্বে) মুসলমানগণ স্পষ্ট ও বৃহৎ এক বিজয় লাভ করবে। (*দাবিক : জবর-দখলকৃত ফিলিস্তিনের তথা অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের একটি এলাকার নাম)।
এ যুদ্ধের পর ইমাম মাহদির সামনে খ্রিস্টান ইউরোপ ও পাশ্চাত্য বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। আর দৃশ্যত অনেক জাতি বিপ্লবের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশে ইমাম মাহদি ও হযরত ঈসা (আ.)-এর বিরোধী সরকারসমূহের পতন ঘটাবে এবং ইমাম মাহদির সমর্থক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করবে।
ইমাম মাহদি (আ.) কর্তৃক সমগ্র পাশ্চাত্য বিজয় এবং তা তাঁর শাসনাধীনে চলে আসার পর অধিকাংশ পাশ্চাত্যবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে। এ সময় হযরত ঈসা (আ.) ইন্তেকাল করবেন। মাহদি (আ.) ও মুসলমানগণ তাঁর জানাজার নামায পড়বেন। হাদিসের বর্ণনানুসারে ইমাম মাহদি হযরত ঈসা (আ.)-এর জানাজার নামায ও দাফন অনুষ্ঠান প্রকাশ্যে জনতার উপস্থিতিতে সম্পন্ন করবেন যাতে অতীতের মতো তাঁর ব্যাপারে কেউ পুনরায় অগ্রহণীয় উক্তি করতে না পারে। অতঃপর ইমাম মাহদি তাঁকে তাঁর মা হযরত মরিয়ম সিদ্দীকা (আ.) নিজ হাতে যে বস্ত্রটি বয়ন করেছিলেন তা কাফন হিসাবে পরিধান করাবেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসে তাঁর মায়ের কবরের পাশে দাফন করবেন।
ইমাম মাহদি (আ.) কর্তৃক সমগ্র বিশ্ব বিজয় এবং বিশ্বের সকল দেশ, রাষ্ট্র ও প্রশাসন একটি একক ইসলামী প্রশাসনের আওতায় একীভূত হওয়ার পর তিনি বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মাঝে বিভিন্ন পর্যায়ে ঐশী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তিনি পার্থিব জীবনের উন্নতি ও বিকাশ এবং মানব জাতির সচ্ছলতা, কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন কল্পে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তিনি সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার এবং মানব জাতির ধর্মীয় ও পার্থিব জ্ঞানের পর্যায়কে উন্নীত করার চেষ্টা চালাবেন।
কতিপয় হাদিস অনুযায়ী ইমাম মাহদি (আ.) মানব জাতির জ্ঞানের সাথে আরও যে জ্ঞান যোগ করবেন তার প্রবৃদ্ধির হার হবে ২৫ : ২ অনুপাতে। অর্থাৎ মানব জাতি এর আগে জ্ঞানের যে দু’ভাগের অধিকারী ছিল তার সাথে আরো ২৫ ভাগ যুক্ত করবেন এবং সার্বিকভাবে মানুষের জ্ঞান তখন ২৭ ভাগ হবে।
ঠিক একইভাবে ইমাম মাহদি (আ.)-এর যুগে অন্যান্য গ্রহ ও নভোমণ্ডলের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীবাসীদের যোগাযোগের দ্বার উন্মুক্ত হবে। বরং আমাদের পার্থিব এ জগতের সামনে গায়েবী (আধ্যাত্মিক ও অবস্তুগত) জগতের দ্বারগুলো খুলে যাওয়া শুরু হবে।
সম্ভবত অভিশপ্ত দাজ্জালের অভ্যুত্থান ও ফিতনা ইমাম মাহদি (আ.)-এর যুগে মানব জাতি যে ব্যাপক ও অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও বৈষয়িক উন্নতি সাধন করবে তার ফলশ্রুতিতে ঘটবে অর্থাৎ দাজ্জাল এসবের অপব্যবহারের মাধ্যমে একটি বিচ্যুত ধারা সৃষ্টি করবে। সে মূলত যুবক ও নারীদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য চোখ ধাঁধানো উন্নত মাধ্যম ও পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করবে এবং এ শ্রেণীই তার অনুসারী হবে।
দাজ্জাল সমগ্র বিশ্বব্যাপী ফিতনা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। তার ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার দ্বারা অনেকেই প্রতারিত হবে। অনেকেই তার কথা বিশ্বাস করবে। কিন্তু ইমাম মাহদি দাজ্জালের ধোঁকাবাজি প্রকাশ্যে ধরিয়ে দেবেন এবং তাকে ও তার অনুসারীদেরকে হত্যা করবেন।
যা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো তা হচ্ছে প্রতিশ্রুত হযরত মাহদি (আ.)-এর বিশ্বজনীন আন্দোলন ও বিপ্লবের একটি সার্বিক চিত্র ও পটভূমি। কিন্তু যে যুগে এ সব ঘটনা ঘটবে সে যুগের সবচেয়ে স্পষ্ট নিদর্শন ও ঘটনাবলী রেওয়ায়েতগুলোয় বর্ণিত হয়েছে।
প্রথমে যে ফিতনা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ওপর আপতিত হবে এবং রেওয়ায়েতগুলো যা সর্বশেষ ও সবচেয়ে কঠিন ফিতনা বলে অভিহিত হয়েছে তা ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমে বিদূরিত হয়ে যাবে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, এ বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগের যাবতীয় সাধারণ ও বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য এ শতাব্দীর (বিংশ শতক) শুরুতে পাশ্চাত্য এবং তাদের মিত্র প্রাচ্য দেশসমূহের সৃষ্ট ফিতনার সাথে মিলে যায়। কারণ এ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা সকল মুসলিম দেশ ও এ দেশগুলোর সকল পরিবারকে আক্রান্ত করবে।
“এমন কোন ঘর বিদ্যমান থাকবে না যেখানে এ ফিতনা প্রবেশ করবে না এবং এমন কোন মুসলমান থাকবে না যে এ ফিতনা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”
“যেভাবে লোভাতুর ক্ষুধার্ত হরেক রকমের সুস্বাদু খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে ঠিক সেভাবে কাফির জাতিগুলো মুসলিম দেশগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে।”
“ঐ ফিতনার সময় পাশ্চাত্য থেকে একদল এবং প্রাচ্য থেকে আরেকদল আমার উম্মতের ওপর শাসন চালাবে।”
উল্লেখ্য যে, আমাদের শত্রুরা তাদের কালো সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের এ প্রক্রিয়া (ফিতনা) শামদেশ (সিরিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) থেকে শুরু করবে এবং সে দেশকে তারা সভ্যতার আলো বিকিরণের উৎস বলে অভিহিত করবে। এর ফলে এমন একটি ফিতনার উদ্ভব হবে যা রেওয়ায়েতগুলোতে ‘ফিলিস্তিনের ফিতনা’ নামে উল্লিখিত হয়েছে। মশকের ভিতরে পানি যেমন আন্দোলিত হয়ে থাকে ঠিক তেমনি এ ফিতনার কারণে শামদেশ বা সিরিয়া তীব্রভাবে আন্দোলিত হবে এবং লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে।
“যখন ফিলিস্তিনের ফিতনার উদ্ভব হবে তখন মশকের ভিতর পানি যেভাবে উদ্বেলিত হয় ঠিক সেভাবে শামদেশ বিশৃঙ্খলা, গোলযোগ ও অস্বাভাবিক অবস্থার শিকার হবে। আর যখন এ ফিতনার পরিসমাপ্তির সময় এসে যাবে তখন তার যবনিকাপাত হবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে মুষ্টিমেয় লোকই অনুতপ্ত হবে।”
রেওয়ায়েতগুলো (সে যুগের) মুসলমানদের সন্তান ও প্রজন্মগুলোকে এভাবে বর্ণনা করেছে যে, তারা এমনভাবে এ ফিতনা ও বিশৃঙ্খলাময় সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠবে যে, তারা ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একেবারেই অনবগত থেকে যাবে। সে সব অত্যাচারী শাসনকর্তা অনৈসলামিক বিধি-বিধান এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার ভিত্তিতে মুসলমানদের ওপর শাসন করবে এবং তাদের ওপর সবচেয়ে নিকৃষ্ট পন্থায় নির্যাতন চালাবে।
হাদিসগুলোয় উল্লিখিত হয়েছে যে, এ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার উদ্গাতা হবে রোমান এবং তুর্কীরা। তুর্কীরা বাহ্যত রুশ জাতি হতে পারে। আর যখন ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে কতিপয় বড় ঘটনা ঘটবে তখন তারা তাদের সেনাবাহিনীকে ফিলিস্তিনের রামাল্লা, আনতাকিয়া এবং তুরস্ক-সিরিয় উপকূলে এবং সিরিয়া-ইরাক-তুরস্ক সীমান্তে অবস্থিত জাযীরায় (দ্বীপে) মোতায়েন করবে।
“যখন রোমান ও তুর্কীরা (রুশ জাতি) তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে তখন তারা নিজেরাও পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হবে এবং বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সংঘর্ষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। তখন তুর্কীদের সমর্থকবৃন্দ জাযীরাহ্ এলাকায় এবং রোমের বিদ্রোহীরা রামাল্লায় অবস্থান গ্রহণের জন্য রওয়ানা হয়ে যাবে।
রেওয়ায়েতসমূহে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, ইরান থেকে ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের সূত্রপাত হবে।
“তাঁর আবির্ভাব ও প্রকাশের সূত্রপাত প্রাচ্য থেকে হবে এবং যখন ঐ সময় উপস্থিত হবে তখন সুফিয়ানী আবির্ভূত হবে।”
অর্থাৎ সালমান ফারসি (রা.)-এর জাতি ও কালো পতাকাবাহীদের হাতে ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাব ও আত্মপ্রকাশের পটভূমি রচিত এবং কোম নগরী থেকে এক ব্যক্তির হাতে তাদের আন্দোলনের সূত্রপাত হবে।
“কোম থেকে এক ব্যক্তি উত্থিত হবে এবং জনগণকে (ইরানী জাতি) সত্যের দিকে আহ্বান করবে। যে দলটি তার চারপাশে জড়ো হবে তাদের হৃদয় ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় হবে এবং তারা এতটা অক্লান্ত ও অকুতোভয় হবে যে, যুদ্ধের প্রচণ্ড চাপও তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করবে না এবং তারা যুদ্ধে ক্লান্ত হবে না। তারা সব সময় মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে। আর শুভ পরিণতি কেবল মুত্তাকী-পরহেজগারদের জন্যই নির্ধারিত।”
তারা (ইরানী জাতি) তাদের অভ্যুত্থান এবং বিপ্লব সফল করার পর তাদের শত্রুদের (পরাশক্তিগুলোর) কাছে অনুরোধ করবে যে, তারা যেন তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ না করে। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে জবরদস্তি করবে।
“তারা তাদের অধিকার দাবি করবে কিন্তু তাদেরকে তা দেয়া হবে না। তারা পুনরায় তা চাইবে। আবারও তাদের অধিকার প্রদান করা হবে না। তারা এ অবস্থা দর্শন করতঃ কাঁধে অস্ত্র তুলে নেবে এবং তাদের দাবি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। (অবশেষে তাদের অধিকার প্রদান করা হবে) কিন্তু এবার তারা তা গ্রহণ করবে না। অবশেষে তারা রুখে দাঁড়াবে এবং তোমাদের অধিপতির (অর্থাৎ ইমাম মাহদির) হাতে বিপ্লবের পতাকা অর্পণ করা পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। তাদের নিহত ব্যক্তিরা হবে সত্যের পথে শহীদ।”
বিভিন্ন রেওয়ায়েত অনুসারে অবশেষে তারা তাদের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে বিজয়ী হবে এবং যে দু’ব্যক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তারা তাদের মাঝে আবির্ভূত হবেন। এ দু’জনের একজন ‘খোরাসানী’ যিনি ফকীহ্ ও মারজা অথবা রাজনৈতিক নেতা হিসাবে এবং অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্ যিনি হবেন শ্যামলা বর্ণের চেহারা ও স্বল্প দাঁড়িবিশিষ্ট এবং রাই অঞ্চলের (দক্ষিণ তেহরানের) অধিবাসী তিনি প্রধান সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
ইমাম মাহদি (আ.)-এর কাছে এ দু’ব্যক্তি ইসলামের পতাকা অর্পণ করে তাঁদের সর্বশক্তি নিয়ে তাঁর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন। আর শুআইব ইবনে সালিহ্ ইমামের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হবেন।
ঠিক একইভাবে বেশ কিছু রেওয়ায়েতে এমন একটি অভ্যুত্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে যা সিরিয়ায় উসমান সুফিয়ানীর নেতৃত্বে সংঘটিত হবে। এই উসমান সুফিয়ানী হবে পাশ্চাত্যপন্থী ও ইহুদীদের সমর্থক। সে সিরিয়া ও জর্দানকে একত্রিত করে নিজ শাসনাধীনে নিয়ে আসবে।
“সুফিয়ানীর আবির্ভাব একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়- যার শুরু থেকে সমাপ্তিকাল পনের মাস স্থায়ী হবে। প্রথম ছয় মাস সে যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত থাকবে এবং পাঁচটি অঞ্চল নিজ দখলে আনার মাধ্যমে পূর্ণ নয় মাস সে ঐ সব অঞ্চলের ওপর শাসনকার্য পরিচালনা করবে।”
অনেক রেওয়ায়েত অনুসারে সিরিয়া ও জর্দান ছাড়াও সম্ভবত লেবাননও ঐ পাঁচ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এ হচ্ছে এক ধরনের অশুভ ঐক্য যা সুফিয়ানীর মাধ্যমে শাম দেশে বাস্তবায়িত হবে। কারণ এর উদ্দেশ্য হবে ইসরাইলের পক্ষে একটি (আরব) প্রতিরক্ষা ব্যূহ এবং ইমাম মাহদি (আ.)-এর হুকুমতের (সরকার ও প্রশাসনের) ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ইরানীদের প্রতিরোধ করার জন্য একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ও ফ্রন্ট লাইন গড়ে তোলা।
এ কারণেই সুফিয়ানী ইরাক দখল করার পদক্ষেপ নেবে এবং তার সেনাবাহিনী ইরাকে প্রবেশ করবে।
“সে (সুফিয়ানী) ১৩০০০০ সৈন্য কুফার দিকে প্রেরণ করবে এবং তারা রাওহা ও ফারুক নামক একটি স্থানে অবতরণ করবে। তাদের মধ্য থেকে ৬০০০০ সৈন্যকে কুফার দিকে প্রেরণ করা হবে এবং তারা নুখাইলায় হযরত হুদ (আ.)-এর সমাধিস্থলে অবস্থান গ্রহণ করবে। আর আমি যেন সুফিয়ানীকে (অথবা তার সহযোগী ও সঙ্গীকে) দেখতে পাচ্ছি যে, সে কুফা ও তোমাদের সুবিস্তৃত ও চিরসবুজ জমিগুলোতে অবস্থান নিচ্ছে। তার পক্ষ থেকে একজন আহ্বানকারী উচ্চস্বরে ঘোষণা করতে থাকবে যে, যে ব্যক্তি আলীর অনুসারীদের (কর্তিত) মাথা আনবে তাকে এক হাজার দিরহাম দেয়া হবে। আর এ সময় প্রতিবেশী প্রতিবেশীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে বলবে যে, এ ব্যক্তি তাদের অন্তর্ভুক্ত।”
তখন হিজাযে উদ্ভূত রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করার জন্য সুফিয়ানীকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। ইমাম মাহদির সরকার- যার কথা সবার মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকবে এবং মক্কা নগরী থেকে যার শুভ সূচনা হবে তা ধ্বংস করার জন্য সুফিয়ানী সরকারকে শক্তিশালী করা হবে।
এতদুদ্দেশ্যে সুফিয়ানী হিজাযে তার সেনাবাহিনী প্রেরণ করবে। তার সেনাবাহিনী মদিনা নগরীতে প্রবেশ করেই সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। এরপর তারা পবিত্র মক্কাভিমুখে রওয়ানা হবে। ইমাম মাহদি (আ.) মক্কা নগরী থেকেই তাঁর আন্দোলন শুরু করবেন। এরপর পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌঁছানোর আগেই সুফিয়ানী বাহিনীকে কেন্দ্র করে যে মহা অলৌকিক ঘটনা (মুজিযা) ঘটার প্রতিশ্রুতি মহানবী (সা.) দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত হবে অর্থাৎ সুফিয়ানী বাহিনী ভূগর্ভে প্রোথিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
“একজন আশ্রয় গ্রহণকারী মহান আল্লাহর গৃহে (বায়তুল্লাহয়) আশ্রয় নেবে। তখন একটি সেনাবাহিনী তার পিছনে প্রেরণ করা হবে। যখনই তারা মদিনার মরুভূমিতে (মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে) পৌঁছবে তখন তারা ভূগর্ভে প্রোথিত হবে।”
ইরাকে ইরানী ও ইয়েমেনীয়দের হাতে পরাজয় বরণ এবং ইমাম মাহদি (আ.)-এর হাতে হিজাযে ভূগর্ভে দেবে যাওয়ার মুজিযা সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে সুফিয়ানী বাহিনীর পরাজয় বরণ করার পর সুফিয়ানী পশ্চাদপসরণ করবে। আর ইমাম মাহদি সেনাবাহিনী নিয়ে দামেস্ক ও বাইতুল মুকাদ্দাস (আল কুদস) অভিমুখে রওয়ানা হবেন। সুফিয়ানী ইমাম মাহদি (আ.)-কে মোকাবিলা করার জন্য শাম দেশে তার সেনা বাহিনী সংগ্রহ ও পুনর্গঠনে ব্যস্ত থাকবে।
রেওয়ায়েতসমূহে এ যুদ্ধকে ‘এক মহা বীরত্বপূর্ণ ঘটনা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে যা উপকূলীয় এলাকায় আক্কা থেকে সূর (سور) ও আনতাকিয়াহ্ পর্যন্ত এবং শামের অভ্যন্তরে দামেস্ক থেকে তাবারীয়াহ্ ও কুদস পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
ঠিক একইভাবে কতিপয় রেওয়ায়েতে অপর একটি আন্দোলনের কথা উল্লিখিত হয়েছে যা ইমাম মাহদি (আ.)-এর সরকারের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী এবং ইয়েমেনে সংঘটিত হবে। এ আন্দোলন ও বিপ্লবের নেতা ইয়েমেনীকে এ সব রেওয়ায়েতে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাঁকে সাহায্য করা মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব বলে গণ্য করা হয়েছে।
“পতাকাসমূহের মধ্যে ইয়ামানীদের পতাকার চেয়ে হিদায়েতকারী আর কোন পতাকা নেই। ইয়ামানীর আবির্ভাব ও উত্থানের পর জনগণের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা হারাম হয়ে যাবে। আর যখন সে আবির্ভূত হবে এবং আন্দোলন করবে তখন তাকে সাহায্য করার জন্য দ্রুত ছুটে যাবে। কারণ তার পতাকা হবে হিদায়েতের পতাকা। তার বিরোধিতা করা কোন মুসলমানের জন্য জায়েয হবে না। যদি কোন ব্যক্তি এ কাজ করে তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। কারণ ইয়ামানী জনগণকে সত্য ও সৎ পথের দিকে আহ্বান জানাবে।”
যেমন করে আমরা রেওয়ায়েতগুলো থেকে সুফিয়ানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইরানীদের সাহায্য করার জন্য ইরাকে ইয়ামানী বাহিনী প্রবেশ করার বিষয়টি জানতে পারি ঠিক তেমনি হিজাযে মাহদি (আ.)-কে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ইয়ামানী ও তাঁর সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথাও জানতে পারি।
অনুরূপভাবে কতিপয় রেওয়ায়েতে ইয়ামানী ও সুফিয়ানী বাহিনীর আবির্ভাবের আগে একজন মিশরীয় ব্যক্তির আন্দোলনের কথা বর্ণিত হয়েছে। আবার মিশরীয় সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত আরেকটি আন্দোলন এবং মিশরের আশপাশের কিবতিদের পরিচালিত তৎপরতার কথাও ঐ সব রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে। এরপর ঐ সব রেওয়ায়েত মিশরে পাশ্চাত্য অথবা মাগরিবী (মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও লিবিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট) সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং এর পরপরই শাম দেশে সুফিয়ানীর আবির্ভাব ও উত্থানের কথা আমাদেরকে অবহিত করে।
“তখন তারা (ইমাম মাহদি ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা) মিশরে প্রবেশ করবে এবং সে সেখানে মিম্বারে আরোহণ করে সে দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবে। পৃথিবী ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ফলে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে যাবে। আকাশ থেকে রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হবে। বৃক্ষরাজি ফলদান করবে। ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদ জন্মাবে এবং তা পৃথিবীবাসীদের জন্য শোভাবর্ধক হবে। বুনো জীব-জন্তু নিরাপদে বসবাস করবে, সেগুলো গৃহপালিত পশুর মতো নিরুপদ্রবে সর্বত্র চড়ে বেড়াবে। মুমিনদের অন্তরে জ্ঞান-বিজ্ঞান এতটা স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসবে যে, কোন মুমিনই জ্ঞানার্জনের জন্য তার দীনী ভাইয়ের মুখাপেক্ষী হবে না। ঐ দিন ‘মহান আল্লাহ্ সবাইকে তাঁর অসীম সম্পদের মাধ্যমে ধনাঢ্য করে দেবেন’ (يغني الله كلّا من سعته)- পবিত্র কোরআনের এ আয়াতটির বাস্তব নমুনা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হবে।”
তবে অনেক রেওয়ায়েত অনুযায়ী মুসলিম দেশ মাগরিবের (মরক্কো ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো) সেনাবাহিনী শাম ও মিশরে প্রবেশ করবে। এদের একটি অংশ ইরাকেও প্রবেশ করবে। তাদের ভূমিকা হবে বাধাদানকারী আরব অথবা আন্তর্জাতিক বাহিনীর ভূমিকার ন্যায়। তাই তারা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী হবে না। বরং এ বাহিনী শামে ইমাম মাহদি (আ.)-এর সরকারের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারীদের এবং ইরানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এরপর তারা জর্দানের দিকে পশ্চাদপসরণ করবে এবং তাদের অবশিষ্টাংশ সুফিয়ানীর অভ্যুত্থানের পর পশ্চাদপসরণ করবে অথবা তার সাথে যোগ দেবে। অতঃপর তারা মিশরীয়দের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখীন মিশর সরকারের সাহায্যার্থে অথবা শামে সুফিয়ানীর উত্থানের সামান্য প্রাক্কালে যে পাশ্চাত্য বাহিনী মিশরে প্রবেশ করবে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য মিশরের দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে।
ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শেষ জামানায় ইহুদীরা পৃথিবীর বুকে ফিতনা সৃষ্টি এবং দম্ভ প্রকাশ করবে। তারা নিজেদেরকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করবে। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে তাদের এ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। তাদের দম্ভ এবং শ্রেষ্ঠত্ব অন্বেষী মনোবৃত্তি ঐ সব পতাকাবাহীর হাতে চূর্ণ হয়ে যাবে যারা খোরাসান (ইরান) থেকে বের হবে।
“ইসলামের ঝাণ্ডাগুলো আল কুদসে পতপত করে ওড়া পর্যন্ত তাদেরকে (খোরাসানীদেরকে) তাদের সিদ্ধান্ত থেকে কোন কিছুই বিরত রাখতে পারবে না।”
ইরানীরা এমন এক জাতি যাদেরকে মহান আল্লাহ্ শীঘ্রই ইহুদীদের ওপর বিজয়ী করবেন। কোরআনের ভাষায় :
“আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষ থেকে অতি শক্তিশালী বান্দাদেরকে প্রেরণ করব।”
ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের আগে এবং পরে এক দফায় অথবা কয়েক দফায় ইহুদীদের যে প্রতিশ্রুত ধ্বংস সংঘটিত হবে তা রেওয়ায়েতসমূহে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে এ সব রেওয়ায়েতে তাদের ধ্বংসপ্রাপ্তির সর্বশেষ পর্যায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, ইমাম মাহদি (আ.) এবং তাঁর সেনাবাহিনী- যার অধিকাংশ সদস্যই হবে ইরানী তাঁদের হাতে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে।
এ ঘটনাটি বিরাট এক যুদ্ধ আকারে সংঘটিত হবে। এ যুদ্ধে শামের শাসনকর্তা উসমান সুফিয়ানী ইহুদী জাতি ও রোমীয়দের (পাশ্চাত্য) পাশে এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহের প্রথম কাতারে অবস্থান করবে।
কতিপয় রেওয়ায়েত অনুসারে ইমাম মাহদি (আ.) আনতাকিয়ার একটি গুহা, ফিলিস্তিনের একটি পাহাড় এবং তাবারীয়ার হ্রদ থেকে তাওরাতের আসল কপিগুলো বের করে আনবেন। তিনি তাওরাতের সেই সব কপির ভিত্তিতে ইহুদীদেরকে দোষী সাব্যস্ত করবেন এবং তাদের কাছে নিদর্শন ও মুজিযাগুলো স্পষ্ট করে প্রকাশ করবেন।
আল কুদস মুক্ত করার যুদ্ধের পর যে কিছু সংখ্যক ইহুদী বেঁচে যাবে তারা ইমাম মাহদির কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং যারা আত্মসমর্পণ করবে না তাদেরকে আরব দেশগুলো থেকে বিতাড়িত করা হবে।
রেওয়ায়েতগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছু আগে রোমান ও তুর্কীদের মধ্যে অর্থাৎ পাশ্চাত্য ও রাশিয়ার মধ্যে একটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবে যার সূত্রপাত হবে পূর্ব দিক হতে। আরো কিছু রেওয়ায়েত থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উপরিউক্ত যুদ্ধ আসলে একাধিক আঞ্চলিক যুদ্ধ আকারে সংঘটিত হবে।
“ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের বছরে পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হবে যেগুলোর দ্বারা পাশ্চাত্যজগৎ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ) ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
“জ্বালানি কাঠে যেভাবে আগুন ধরে ঠিক তদ্রূপ পাশ্চাত্যে যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত হবে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাসীদের মধ্যে, এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেবে। আর মানব জাতি নিরাপত্তাহীনতার ভীতির কারণে কঠিন দুঃখ-কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হবে।”
ঠিক একইভাবে আরো কিছু হাদিস থেকে জানা যায় যে, এ যুদ্ধের ফলে সংঘটিত জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও তার আগে ও পরে সমগ্র বিশ্বব্যাপী যে প্লেগ বা মহামারী দেখা দেবে তাতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হবে। তবে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যতীত মুসলমানগণ সরাসরি এ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে না।
“বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা (ইমাম মাহদির আবির্ভাব) ঘটবে না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম : যখন পৃথিবীর জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে যাবে তখন আর কোন্ ব্যক্তি অক্ষত থাকবে?” ইমাম বললেন, “তোমরা কি অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে থাকতে চাও না?”
কিছু কিছু রেওয়ায়েতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ যুদ্ধ বেশ কয়েকটি ধাপে সংঘটিত হবে। আর ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাব, তাঁর হিজায মুক্তকরণ এবং ইরাকে তাঁর প্রবেশ করার পরই এ যুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায় এসে যাবে। (আল্লামা আলী আল কুরানির 'ইমাম মাহদি-আ.'র আত্মপ্রকাশ' শীর্ষক বই-অবলম্বনে। বইটির অনুবাদক মোহাম্মাদ মুনীর হোসেন খান)
source : irib.ir