ক)- কোরআন
পবিত্র কোরআন হচেছ ঐশী শিক্ষার দূর্লভ ঝর্ণাধারা , প্রতিষ্ঠিত হিকমত এবং মানুষের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ভাণ্ডার৷ কোরআন সত্য ও ন্যায়ে পরিপূর্ণ কিতাব যাতে পৃথিবীর অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে সংবাদ দান করা হয়েছে এবং কোন কিছুই তা থেকে বাদ পড়ে নি৷ তবে এটা স্পষ্ট যে , পৃথিবীর ব্যাপক ঘটনাবলী কোরআনের ঐশী আয়াতের মধ্যে নিহিত রয়েছে এবং কেবলমাত্র যারা তার গভীরে পৌঁছতে পারবে তারাই এসত্যকে উপলব্ধি করতে পারবে৷ তারাই হচেছন কোরআনের প্রকৃত কর্ণধার ও মোফাস্সের অর্থা ৎ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত (আ.) গণ৷
আল্লাহর শেষ প্রতিনিধি পৃথিবীর এক মহান সত্য যার প্রতি কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং ওই সকল আয়াতের ব্যাখ্যায়ও বহু রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে নিম্নে তার কিছু তুলে ধরা হল:
যেমন সূরা আম্বিয়ার ১০৫ নং আয়াতে বলা হচেছ:
﴿وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِن بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ﴾
নিশ্চয়ই আমরা তৌরাতের পর যাবুরে উল্লেখ করেছি যে , যোগ্যতা সম্পন্ন বান্দারা পৃথিবীর আমাদের উত্তরাধিকারী হবে৷
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন:
ইমাম মাহদী (আ.) ও তাঁর সাহায্যকারীরা হচেছন সেই যোগ্য বান্দা যারা পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবেন (তাফসীরে কুম্মী খণ্ড- ২ , পৃ.-৫২)৷
সূরা কাসাসের ৫ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে:
﴿وَنُرِيدُ أَن نَّمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَ نَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَ نَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ﴾
এবং আমরা ইচছা করলাম যাদেরকে পৃথিবীর বুকে (বঞ্চিত) হীনবল করা হয়েছিল তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে এবং উত্তরাধিকারী করতে৷
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন:
বঞ্চিত বা হীনবল বলতে রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতকে বোঝানো হয়েছে৷ অনেক প্রচেষ্টা ও কষ্টের পর আল্লাহ এই বংশের মাহদী (আ.)-কে প্রেরণ করবেন এবং তাকে উচচ মর্যাদা দান করবেন এবং শত্রুদেরকে কঠিন ভাবে লাঞ্চিত করবেন (গাইবাতে শেখ তুসী হাদীস ১৪৩ , পৃ.-১৮৪)৷
সূরা হুদের ৮৬ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে:
﴿بَقِيَّةُ اللّهِ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
আল্লাহর গচিছত সম্পদই তোমাদের জন্য যতেষ্ট যদি তোমরা মু ' মিন হয়ে থাক৷
ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন:
ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হওয়ার পর কা ' বা গৃহে হেলান দিয়ে প্রথমে উক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করবেন৷ অতঃপর বলবেন:
انا بقية الله فی ارضه و خليفته و حجته عليکم
আমিই পৃথিবীর বুকে আল্লাহর গচিছত সম্পদ , তোমাদের প্রতি তাঁর উত্তরাধিকারী এবং হুজ্জাত৷
অতঃপর যারা তাঁকে সালাম করবে তারা বলবে:
السلام عليک يا بقية الله فی ارضه
আপনার প্রতি সালাম , হে পৃথিবীর বুকে আল্লাহ্র গচিছত সম্পদ (কামালুদ্ দ্বীন খণ্ড- ১ , বাব ৩২ , হাদীস ১৬ , পৃষ্ঠা ৬০৩)৷
সূরা হাদীদের ১৭ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে:
﴿اعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يُحْيِي الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ﴾
জেনে রাখ আল্লাহই ধরিত্রীকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন৷ আমি নির্দশনগুলি তোমাদের জন্য বিশদভাবে ব্যক্ত করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার৷
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন:
আল্লাহ তা ' আলা ইমাম মাহদী (আ.)-এর নিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীকে পূনর্জীবিত করবেন৷ কেননা অত্যাচারিদের অত্যাচারের মাধ্যমে পৃথিবী মৃত্যুবরণ করেছিল (গাইবাতে নোমানী পৃ.-৩২)৷
খ)- রেওয়ায়াত
ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিষয়টি এমনই একটি বিষয় , যে সম্পর্কে বহু সংখ্যক রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে৷ ইমামের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় যেমন: জন্ম , শৈশবকাল , স্বল্প ও দ্বীর্ঘমেয়াদী অদৃশ্যকাল , আবির্ভাবের নিদর্শন , আবির্ভাবের পর এবং বিশ্বব্যাপী অনুশাসন সম্পর্কে ইমামগণ হতে পৃথক পৃথক হাদীস বর্ণিত হয়েছে৷ যেমনিভাবে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য , অদৃশ্যকালীন পরিস্থিতি , প্রতিক্ষাকারীদের পুরষ্কার সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে৷ আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হচেছ এই হাদীসসমূহ শিয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের গ্রন্থেই বর্ণিত হয়েছে এবং ইমাম মাহ্দী সম্পর্কিত বহু হাদীসই মুতাওয়াতির৷
ইমাম মাহদী (আ.)-এর আর একটি বৈশিষ্ট্য হচেছ মাসূমগণ তাঁর সম্পর্কে অতি সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন৷ যার সমষ্টি থেকে ইমাম মাহদী (আ.)-এর ন্যায়নিষ্ঠ বিপ্লবের গুরুত্ব প্রকাশ পায়৷ এখানে আমরা ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কিত চৌদ্দ মাসুম (আ.) হতে বর্ণিত হাদীসসমূহকে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করেছি:
* রাসূল (সা.) বলেছেন:
" তার সৌভাগ্য , যে মাহ্দীকে দেখবে৷ তারও সৌভাগ্য , যে মাহদীকে ভালবাসবে এবং সেও সৌভাগ্যবান , যে তাঁর ইমামতকে গ্রহণ করবে" (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২ , পৃ.-৩০৯)৷
* ইমাম আলী (আ.) বলেছেন:
" আবির্ভাবের প্রতিক্ষায় থেকো এবং কখনোই আল্লাহর রহমত থেকে বিমুখ হয়ো না৷ এটা অতি সত্য যে , আবির্ভাবের প্রতিক্ষায় থাকা আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম ইবাদত" (বিহারুল আনওয়ার খণ্ড- ৫২ , পৃ.-৩০৯)৷
* হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (আ.)-এর কিতাবে বর্ণিত হয়েছে:
অতঃপর বিশ্ববাসীর প্রতি রহমতের জন্য আওলীগণের পর্যায়ক্রমকে ইমাম হাসান আসকারী ( আ.)-এর সন্তানের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করবে৷ যার মধ্যে হযরত মুসার পূর্ণতা , হযরত ঈসার সৌন্দর্য এবং হযরত আইয়ুবের ধৈর্য থাকবে (কামালুদ্ দ্বীন খণ্ড-১ , বাব ২৮ , হাদীস ১ , পৃ.-৫৬৯)৷
* ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) বলেছেন:
আল্লাহপাক শেষ যামানায় একজন মহাপুরুষকে প্রেরণ করবেন এবং তাঁকে ফেরেশ্তাদের মাধ্যমে সাহায্য করবেন এবং তাঁর সাথীদেরকেও রক্ষা করবেন৷ তাঁকে পৃথিবীর সবকিছুর উপর প্রাধান্য দেয়া হবে৷ তিনি দুনিয়াকে এমভাবে ন্যায়নীতি ও সাম্যে পরিপূর্ণ করবেন যেমনিভাবে পৃথিবী জুলুম অত্যাচারে ভরে গিয়েছিল৷ সেই ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে , তাঁকে দেখবে এবং তাঁর নির্দেশ পালন করবে (ইহতিজাজা খণ্ড-২ , পৃ.-৭০)৷
* ইমাম হুসাইন (আ.) বলেছেন:
আল্লাহ হযরত মাহ্দীর মাধ্যমে ধরিত্রীকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন৷ তাঁর মাধ্যমেই সত্য দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপর প্রাধান্য দান করবেন যদিও মুশরিকরা তা পছন্দ করে না৷ তিনি অদৃশ্যে থাকবেন অনেকেই দ্বীনচ্যুত হবে আবার অনেকেই দ্বীনের প্রতি প্রতিষ্ঠিত থাকবে৷ যে ব্যক্তি অদৃশ্যকালীন অবস্থায় বিভিন্ন অত্যাচার ও মিথ্যাচারে ধৈর্য ধারণ করবে সে রাসূল (সা.)-এর সাথে থেকে মুশরিকেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে (কামালুদ্ দ্বীন খণ্ড- ১ , বাব ৩০ , হাদীস ৩ , পৃষ্ঠা ৫৮৫)৷
* ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেছেন:
আমাদের কায়েমের অদৃশ্যকালীন সময়ে যারা আমাদের প্রতি বিশ্বাসে অনড় থাকবে আল্লাহ তা ' আলা তাকে বদর এবং ওহুদের যুদ্ধে শাহাদত প্রাপ্তদের মত সহস্র শহীদের পুরস্কার দান করবেন (কামালুদ্ দ্বীন খণ্ড- ১ , বাব ৩১ , হাদীস পৃষ্ঠা ৫৯২)৷
* ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন:
মানুষের জন্য এমন সময় আসবে যখন তাদের ইমাম অদৃশ্যে থাকবে এবং সেই ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে , ঐ সময়ে আমাদের বেলায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে (কামালুদ্ দ্বীন খণ্ড- ১ , বাব ৩২ , হাদীস-১৫ , পৃষ্ঠা ৬০২)৷
* ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন:
আমাদের কায়েমের জন্য দৃ ' টি অদৃশ্য রয়েছে একটি স্বল্পমেয়াদী অপরটি দীর্ঘমেয়াদী ( গাইবাতে নোমানী বাব ১০ , হাদীস ৫ , পৃষ্ঠা ১৭৬)৷
* ইমাম কাযিম (আ.) বলেছেন:
ইমাম মাহদী (আ.) দৃষ্টির অন্তরালে থাকবেন কিন্তু মু ' মিনরা তাঁকে কখনোই ভুলবেন না ( গাইবাতে নোমানী বাব ৩৪ , হাদীস ৫৬ , পৃষ্ঠা ৫৭)৷
* ইমাম মুসা রেযা (আ.) বলেছেন:
ইমাম মাহদী (আ.) যখন আবির্ভূত হবেন পৃথিবী তাঁর জ্যোতিতে আলোকিত হয়ে যাবে এবং তিনি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করবেন৷ সুতরাং তখন কেউই কারো প্রতি অত্যাচার করবে না (গাইবাতে নোমানী বাব ৩৫ , হাদীস ৫ , পৃষ্ঠা ৬০)৷
* ইমাম তাকি আল জাওয়াদ (আ.) বলেছেন:
আমাদের কায়েম তিনি যার অদৃশকালীন অবস্থায় তাঁর প্রতিক্ষায় থাকতে হবে এবং আবির্ভাবের পর তাঁর নির্দেশ পালন করতে হবে (গাইবাতে নোমানী বাব ৩৬ , হাদীস ১ , পৃষ্ঠা ৭০)৷
* ইমাম হাদী আন্ নাকি (আ.) বলেছেন:
আমার পর ইমাম হচেছ আমার পুত্র হাসান এবং তার পর তার পুত্র মাহ্দী ইমাম হবে এবং তিনি দুনিয়াকে এমভাবে ন্যায়নীতি ও সাম্যে পরিপূর্ণ করবেন যেমনিভাবে পৃথিবী জুলুম অত্যাচারে ভরে গিয়েছিল (গাইবাতে নোমানী বাব ৩৭ , হাদীস ১০ , পৃষ্ঠা ৭৯)৷
* ইমাম হাসান আসকারী (আ.) বলেছেন:
আল্লাহর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে , তিনি আমার মৃত্যুর পূর্বেই আমাকে আমার উত্তরাধিকারী দান করেছেন৷ সে সকল দিক থেকেই রাসূল (সা.)-এর অনুরূপ (গাইবাতে নোমানী বাব ৩৭ , হাদীস ৫ , পৃষ্ঠা ১৭৬)৷