বাঙ্গালী
Friday 27th of December 2024
0
نفر 0

হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র জন্মবার্ষিকী ২০১৫

হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর মহান আত্মার প্রতি জানাচ্ছি অশেষ দরুদ ও সালাম এবং সবাইকে জানাচ্ছি মুবারকবাদ।
হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র জন্মবার্ষিকী ২০১৫

হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর মহান আত্মার প্রতি জানাচ্ছি অশেষ দরুদ ও সালাম এবং সবাইকে জানাচ্ছি মুবারকবাদ।
 
 
 
হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.) ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি ছিলেন আল্লাহর শীর্ষস্থানীয় বন্ধু, মানবজাতির জন্য খোদায়ী ধর্ম ও সত্যের প্রকাশ, বিশ্বজুড়ে অজ্ঞতা ও নৈরাজ্যের কালো আঁধারে আল্লাহর নূরের প্রতিফলন এবং মানবজাতিকে সুপথ দেখানোর মিশনে ছিলেন ত্রুটি-বিহীন ও নিবেদিত-প্রাণ। তিনি আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম উপহার দিয়েছেন এবং এই পথে অসংখ্য বাধা-বিঘ্ন আর জুলুমের শিকার হয়ে শাহাদত বরণ করেছেন। আমাদের এই আলোচ্য মহাপুরুষ ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত (আ.) ও নিষ্পাপ ইমামকুলের সদস্য, সতকর্মশীলদের অন্যতম নেতা, নবী-রাসূলদের উত্তরসূরি ও  একজন পরিপূর্ণ মহামানব।
 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) ছিলেন ইসলামের অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ সময়ে প্রকৃত ইসলামের প্রদীপকে জিইয়ে রাখার ও আরো বিকশিত করার অন্যতম কাণ্ডারি। বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের এই সদস্য ছিলেন অজস্র মহত গুণের আধার এবং যোগ্য মু'মিন গড়ে তোলার অনন্য এক শিক্ষক। আজ আমরা এ মহামানবের পবিত্র জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি জোরদারে তার বিশেষ অবদানের কথা বিশেষভাবে আলোচনা করব।
 
 
 
ইমাম মুসা ইবনে জাফর আল কাযিম (আ.)'র জন্ম হয়েছিল ১১৯ হিজরির সাতই সফর। তাঁর পিতা ছিলেন বিশ্ববিশ্রুত ইমাম হযরত জাফর সাদিক (আ.)। রাগ সংবরণে অশেষ ধৈর্যের জন্যই এই মহান ইমামকে বল হত কাযিম। তিনি ছিলেন পিতা ইমাম জাফর সাদিক (আ.)'র মতই নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার। পিতার মহত গুণগুলোর সবই অর্জন করেছিলেন ইমাম মুসা কাযিম (আ.)। তাঁর ৩৫ বছরের ইমামটির জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে কারাগারে ও নির্বাসনে।
 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আব্বাসীয় শাসকদের শত অত্যাচার ও নিপীড়ন এবং কারাদণ্ড ও নির্বাসন সত্ত্বেও ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রচারের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
 

এ আন্দোলনের যে বিশেষ ধারা তাঁর মহান পিতা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) শুরু করেছিলেন তা আরও বিকশিত হয়েছিল পুত্রের প্রজ্ঞা, কৌশল ও ত্যাগ-তিতিক্ষাপূর্ণ অধ্যবসায়ের সুবাদে। বিশেষ করে পবিত্র কুরআনের প্রকৃত তাফসির ও হাদীস বর্ণনা তাঁর মাধ্যমে আরও বিকশিত হয়।ইমাম তাঁর অনুসারীদেরকে জ্ঞান অর্জনের জন্য অশেষ অনুপ্রেরণা যোগাতেন। তিনি বলতেন, জ্ঞান মৃত আত্মাকে জীবিত করে যেমনটি বৃষ্টি জীবিত করে মৃত ভূমিকে।
 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) বিভ্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গ ত্যাগ করতে নিজ অনুসারীদের তাগিদ দিতেন। মানুষ কখনও বিভ্রান্ত ব্যক্তির কুপ্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে না এবং যখন মন্দ ব্যক্তির ওপর আল্লাহর শাস্তি নাজেল হয় তখন তার সঙ্গে থাকা সত ব্যক্তিও সেই শাস্তি এড়াতে পারে না বলে এই মহান ইমাম উল্লেখ করেছেন।
 

আব্বাসীয় শাসকদের বিভ্রান্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত চাল-চলন যে ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা পিতার মতই তা তুলে ধরেছিলেন ইমাম মুসা কাযিম (আ.) । তাই আব্বাসীয় শাসকরা চাইতেন না জনগণের সঙ্গে ইমামের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাক। তারা জনগণের ওপর নবী বংশের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর জন্য যে কোনো ধরনের প্রতারণ, প্রচারণা, বর্বরতা ও নৃশংসতার আশ্রয় নিতে দ্বিধা বোধ করত না। এমনকি বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইত এবং তাঁদের অনুসারীদের ওপর জুলুম ও নৃশংস আচরণের ক্ষেত্রে আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের চেয়েও বেশি অগ্রসর হয়েছিল, যদিও তাদের নেতৃত্বে সংঘটিত উমাইয়া বিরোধী আন্দোলন জন-সমর্থন পেয়েছিল এই প্রতিশ্রুতির কারণে যে ইসলামী খেলাফতে সমাসীন করা হবে বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতকে। কিন্তু তারা সেই ওয়াদা লঙ্ঘন করে নিজেরাই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে। আব্বাসীয়রা ইমাম জাফর সাদিক ও ইমাম মুসা কাযিম (আ.) সহ নবী বংশের বেশ কয়েকজন ইমামকে শহীদ করেছিল।
 

হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.) তাঁর বন্দী অবস্থার নিকৃষ্টতম সময়েও বিচক্ষণতা, বীরত্ব এবং সংগ্রামী ও আপোষহীন মনোভাব ত্যাগ করেননি।
 


ইমাম এক চিঠিতে হারুনের কাছে লিখেছিলেন: এমন কোনো দিন নেই যে আমি কষ্টে কাটাইনি অথচ এমন কোনো দিন নেই যে তুমি সুখ-স্বচ্ছন্দে কাটাওনি। কিন্তু, ওই দিন পর্যন্ত আরাম আয়েশে লিপ্ত থাক যেদিন আমরা উভয়ই এমন এক জগতে পদার্পণ করব যার কোনো শেষ নেই এবং ওই দিন অত্যাচারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইমামের আধ্যাত্মিক খ্যাতি, জ্বালাময়ী বক্তব্য ও দৃঢ় মনোবল ছিল আব্বাসীয় শাসক হারুনের কাছে অসহনীয়।
 

ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)’র অনুসারীদের সঙ্গে তাঁর সার্বক্ষণিক যোগাযোগের কথাও হারুন তার গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিল। হারুন এটাও বুঝতে পেরেছিল যে ইমাম যখনই উপযুক্ত সুযোগ পাবেন তখনই স্বয়ং বিপ্লব করবেন কিংবা তাঁর সঙ্গীদেরকে আন্দোলনের নির্দেশ দেবেন, ফলে তার হুকুমতের পতন হবে অনিবার্য। তাই হারুন বিষ প্রয়োগ করে আপোষহীন ৫৫ বছর বয়স্ক এই ইমামকে শহীদ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
 

হারুন খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিণত করা ও জনগণের সম্পদ লুটের জন্য লজ্জিত ছিল না। উপরন্তু সে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য বিশ্বনবী (সা.)’র রওজায় গিয়ে রাসূল (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলে: হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার সন্তান মুসা ইবনে জাফরের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি আন্তরিকভাবে তাঁকে বন্দী করতে চাইনি। বরং আপনার উম্মতের মধ্যে যুদ্ধ ও বিরোধ সৃষ্টি হবে এ ভয়েই আমি এ কাজ করেছি।
 

ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)-কে বসরায় ঈসা ইবনে জাফর নামক এক জল্লাদের কারাগারে এক বছর বন্দী রাখা হয়। সেখানে ইমামের উত্তম চরিত্র জাফরের ওপর এমন প্রভাব রাখে যে ওই জল্লাদ হারুনের কাছে এক লিখিত বার্তায় জানিয়ে দেয় যে: তাঁকে আমার কাছ থেকে ফিরিয়ে নাও, নতুবা আমি তাঁকে মুক্ত করে দেব। এরপর হারুনের নির্দেশে ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)-কে বাগদাদে ফাযল ইবনে রাবির কাছে কারারুদ্ধ করা হয়। এর কিছু দিন পর ফাযল ইবনে ইয়াহিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয় এই মহান ইমামকে। কয়েক দিন পর সেখান থেকেও তাঁকে পাঠানো হয় কুখ্যাত জল্লাদ সানদি ইবনে শাহাকের কারাগারে।
 

ইমাম কাযিম (আ.)-কে এক কারাগার থেকে বার বার অন্য কারাগারে স্থানান্তরের কারণ ছিল এটাই যে হারুন প্রতিবারই কারা প্রহরীকে নির্দেশ দিত ইমামকে গোপনে হত্যা করার। কিন্তু তাদের কেউই রাজি হয়নি এ কাজ করতে। অবশেষে সানদি ইমামকে বিষ প্রয়োগ করতে রাজি হয়। বিষ প্রয়োগের তিন দিন পর ১৮৩ হিজরির এমন দিনে তিনি শাহাদত বরণ করেন।
 

হারুন ইমামকে শহীদ করার আগে একদল গণ্যমান্য ব্যক্তিকে কারাগারে উপস্থিত করেছিল যাতে তারা সাক্ষ্য দেয় যে ইমাম কাযিম (আ.) স্বাভাবিকভাবেই মারা গেছেন। এভাবে সে আব্বাসীয় শাসনযন্ত্রকে ইমাম (আ.)কে হত্যার দায়িত্বভার থেকে মুক্ত রাখতে ও ইমামের অনুসারীদের সম্ভাব্য আন্দোলন প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইমামের প্রজ্ঞা সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। কারণ, ওই সাক্ষীরা যখন ইমামের দিকে তাকিয়েছিল তখন তিনি বিষের তীব্রতা ও বিপন্ন অবস্থা সত্ত্বেও তাদেরকে বললেন: আমাকে নয়টি বিষযুক্ত খুরমা দিয়ে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে, আগামীকাল আমার শরীর সবুজ হয়ে যাবে এবং তার পরদিন আমি ইহজগত থেকে বিদায় নেব।
 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.)’র মহানুভবতা, প্রেমময় ইবাদত, নম্রতা, সহিষ্ণুতা, তত্ত্বীয় ও জ্ঞানগর্ভ বিতর্কে ইমামের ঐশী জ্ঞান এবং দানশীলতা ছিল শত্রুদের কাছেও সুবিদিত। তত্ত্বীয় ও জ্ঞানগর্ভ বিতর্কে ইমামের ঐশী জ্ঞান, বিস্তৃত চিন্তাশক্তি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ দখল ফুটে উঠত। তিনি যে কোনো প্রশ্নের সঠিক, পরিপূর্ণ এবং প্রশ্নকারীর বোধগম্যতার আলোকে জবাব দিতেন। তাঁর প্রেমময় ইবাদত ছিল সাধকদের জন্য আদর্শ।
 

মদীনার অধিবাসীরা ইমাম মুসা কাযিম (আ.)-কে যাইনুল মুতাহাজ্জেদীন অর্থাত রাত্রি জাগরণকারীদের সৌন্দর্য উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এই মহান ইমাম এত সুন্দর ও সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন যে, যে কেউ তা শুনে কেঁদে ফেলত।
 

এবারে বুদ্ধিমত্তা বা আকল সম্পর্কে ইমামের বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরছি:
 

"নিশ্চয় মহান আল্লাহ বুদ্ধিমান ও বুঝসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিজ কিতাবে সুসংবাদ দিয়েছেন এবং বলেছেন : “অতঃপর সুসংবাদ দিন বান্দাদেরকে, যারা নানা বক্তব্য শোনে তা থেকে উত্তম বক্তব্যকে অনুসরণ করে। তারা হলো যাদেরকে আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছেন এবং তারাই হলো জ্ঞানী।” (যুমার:১৭-১৮) নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের বুদ্ধির মাধ্যমেই তাদের ওপরে হুজ্জাত বা নিজ দলিলগুলো পূর্ণ করেছেন এবং সত্যের বর্ণনাকে তাদের প্রতি ন্যস্ত করেছেন এবং প্রমাণ দিয়ে তাদেরকে নিজ প্রতিপালকের প্রতি পথ নির্দেশনা দিয়েছেন।
 

আল্লাহ ইরশাদ করেন: “নিশ্চয় আকাশগুলো ও পৃথিবী সৃষ্টির আর দিবারাত্রির আগমনের মধ্যে ... বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন নিহিত রয়েছে।” (বাকারা:১৬৩-১৬৪)
 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আরো বলেছেন: নিশ্চয় মহান আল্লাহ এ সমস্ত বিষয়কে নিজ পরিচয়ের দলিল হিসাবে উপস্থাপন করেছেন যাতে তারা বোঝে এসবের এক পরিচালক রয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন: “এবং তিনি রাত ও দিনকে এবং সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন এবং নক্ষত্রপুঞ্জও তাঁরই আদেশে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত; নিশ্চয় এতে বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।” (সূরা নাহল:১২) তিনি আরও ইরশাদ করেন : “হা-মীম। স্পষ্ট কিতাবের শপথ! নিশ্চয় আমরা একে অবতীর্ণ করেছি আরবি কোরআন হিসাবে যাতে তোমরা বুদ্ধি প্রয়োগ কর।” (যুখরুফ:১-৩) আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন : “আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে হলো তোমাদেরকে বজ্র প্রদর্শন করান তোমাদের মনে ভয় এবং আশা জাগ্রত করার জন্য। আর আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন যাতে মৃত ভূমিকে জীবন্ত করেন। নিশ্চয় এর মধ্যে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।” (রূম:২৪)
 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আরো বলেছেন, আল্লাহ এরপর বুদ্ধিমানদেরকে উপদেশ দিয়েছেন এবং তাদেরকে পরকালের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। ইরশাদ করেন : “পার্থিব জীবন নিছক ক্রীড়া ও কৌতুক বৈ কিছু নয়। আর পারলৌকিক আলয় বা আবাসই হলো তাদের জন্য উত্তম, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, তোমরা কি বুদ্ধি খাটাও না?” (আনআম:৩২) আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন : “তোমাদের যা দান করা হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগবিলাস ও এর শোভামাত্র এবং যা আল্লাহর কাছে আছে তা উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী; তোমরা কি বোঝো না?” (কাসাস:৬০)
 
 
ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আরো বলেছেন, "আল্লাহ এরপর ভয় প্রদর্শন করেছেন তাদেরকে যারা তাঁর আযাব সম্পর্কে বিবেকবান হয় না। আল্লাহ ইরশাদ করেন:
 

“অতঃপর অন্যদেরকে উৎখাত করেছি আর তোমরা প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় তাদের ওপর দিয়ে অতিক্রম করো। তোমরা কি বুদ্ধি খাটাও না?” (সাফফাত:১৩৬-১৩৮) এরপর বর্ণনা করেছেন যে, বিবেক আছে জ্ঞানের সাথে। আল্লাহ ইরশাদ করেন: “এই দৃষ্টান্তগুলো তুলে ধরেছি সব মানুষের জন্য, তবে সেগুলো সম্পর্কে বুদ্ধি খাটায় না জ্ঞানীরা ব্যতীত।” (আনকাবুত:৪৩) আল্লাহ এরপর ভর্ৎসনা করেছেন যারা বুদ্ধি প্রয়োগ করে না তাদেরকে, ইরশাদ করেছেন: “এবং যখনই তাদেরকে বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা তোমরা অনুসরণ করো তখন তারা বলে, বরং আমরা অনুসরণ করবো সেটার যার ওপর আমাদের পিতৃ পুরুষদের পেয়েছি। যদিও তাদের পিতৃপুরুষরা এমন ছিল যে বুদ্ধি খাটাতো না এবং সুপথ প্রাপ্ত হত না।” (বাকারা:১৭০) মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন : “নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জন্তু হলো বধির ও বোবারা, যারা বুদ্ধি খাটায় না।” (আনফাল:২২)আল্লাহ এরপর ইরশাদ করেন : “যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো কে আকাশগুলো ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছে, তারা বলবে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। বলুন প্রশংসা আল্লাহরই। বরং তাদের অধিকাংশই জানে না তথা বুদ্ধি খাটায় না।” (লুকমান:২৫) আল্লাহ এরপর অধিকাংশকে ভর্ৎসনা করেছেন।
 
আল্লাহ ইরশাদ করেন: “যদি পৃথিবীর অধিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশের অনুসরণ করেন তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথে পরিচালিত করবে।” (আনআম:১১৬) আরও ইরশাদ করেন “তবে তাদের অধিকাংশই জানে না।” (আনআম:৩৭) আর তাদের অধিকাংশেরই চেতনা নেই। আল্লাহ এরপর স্বল্প সংখ্যককে প্রশংসা করেছেন, ইরশাদ করেন : “আর আমার বান্দাদের কম সংখ্যকই অধিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী।” (সাবা:১৩) আরও ইরশাদ করেন : “কতই না কম তারা?” (সাদ:২৪) আরও ইরশাদ করেন: “তাঁর তথা নবীর ওপর বিশ্বাস আনেনি কমসংখ্যক ব্যতীত।” (হুদ:৪০)
 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আরো বলেছেন,” আল্লাহ এরপর প্রজ্ঞাবানদের সম্পর্কে ইরশাদ করেন : “তিনি যাকে চান প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দেয়া হয় অনেক কল্যাণ তাকে দেয়া হয়েছে এবং উপদেশ গ্রহণ করে না বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত।” (বাকারা:২৬৯) নিশ্চয় আল্লাহ বলেন : “সত্যই এতে (এই কোরআনে) স্মরণ রয়েছে তাদের জন্য যারা বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি।” (ক্বাফ:৩৭) (লুকমান:১২) আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন : “অবশ্য আমরা লোকমানকে দিয়েছি প্রজ্ঞা।”
 

ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আরো বলেছেন: প্রজ্ঞা দিয়েছি অর্থ উপলব্ধি ও বিবেক (চিন্তাশক্তি ও অনুধাবন ক্ষমতা) দিয়েছি। নিশ্চয় লোকমান নিজ পুত্রকে বললেন : সত্যের আজ্ঞাধীন হও তাহলে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান হবে। পুত্র আমার দুনিয়া হলো একটা অতল সমুদ্র, তার মধ্যে অনেক ব্যক্তি ডুবে গেছে। তার মধ্যে তোমার নৌকা হলো আল্লাহ ভীতি (তাকওয়া), এর দাঁড় হলো ঈমান, এর পাল হলো তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর ভরসা), এর মাঝি হলো বিবেক, এর পথ নির্দেশক হলো জ্ঞান আর এর নোঙ্গর হলো ধৈর্য। প্রত্যেক জিনিসের একটি প্রমাণ থাকে। বুদ্ধিমানের প্রমাণ হলো চিন্তা অনুধ্যান। আর চিন্তা অনুধ্যানের প্রমাণ হলো নীরবতা। আর প্রত্যেক জিনিসের একটি বাহন থাকতে হয়। আর বুদ্ধিমানের বাহন হলো বিনয়। আর তোমার মূর্খতার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে এমন বাহনে আরোহণ করবে যা তোমার জন্য নিষিদ্ধ।
 
 
 
ইমাম মুসা কাযিম (আ.) আরো বলেছেন : যদি তোমার হাতে থাকে একটি আখরোট আর লোকেরা বলে এটা মাণিক্য, এতে তোমার কোন লাভ নেই যখন তুমি জান যে সেটা আখরোট। আর যদি তোমার হাতে থাকে মাণিক্য এবং লোকেরা বলে এটা আখরোট তাহলেও তোমার কোন ক্ষতি নেই যখন তুমি জানো যে এটা মাণিক্য।
 
 
 
আল্লাহ নবী ও রসুলদেরকে তাঁর বান্দাদের কাছে প্রেরণ করেননি কেবল এজন্য ছাড়া যে আল্লাহর সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করবে। আর তাদের মধ্যে উত্তম সাড়াদানকারী হলো আল্লাহর অধিকতর পরিচয় অর্জনকারী। আর তাদের মধ্যে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অধিকতর জ্ঞানী হলো তাদের মধ্যে উত্তম বিবেকবান। আর তাদের মধ্যে অধিকতর বিবেকবান হলো যাদের মর্যাদা দুনিয়া ও পরকালে উচ্চতর। এমন কোন বান্দা নেই যার জন্য একজন লাগামধারী ফেরেশতা নেই। আর সে ফেরেশতার কাজ হলো আল্লাহর জন্য বিনয়াবনত ব্যক্তিকে উচ্চে তুলে ধরা আর আত্মগর্বীকে নীচ ও হীন করা।
 
 
 
নিশ্চয় মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য রয়েছে দুটি হুজ্জাত (প্রমাণ) বাহ্যিক হুজ্জাত আর অভ্যন্তরীণ হুজ্জাত। বাহ্যিক হুজ্জাত হলো রসুল, নবী ও ইমামগণ আর অভ্যন্তরীণ হুজ্জাত হলো বিবেকসমূহ। বুদ্ধিমান হলো সেই ব্যক্তি হালাল যাকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন থেকে বিরত করে না আর হারাম তার ধৈর্যের ওপর জয়ী হয় না।
 

যে ব্যক্তি তিনটা জিনিসকে তিনটা জিনিসের ওপর কর্তৃত্ব প্রদান করে সে যেন তার কু প্রবৃত্তিকে তার বুদ্ধি ধ্বংস করার কাজে সহায়তা দিল। যে ব্যক্তি দীর্ঘ প্রত্যাশা দিয়ে নিজ বুদ্ধির আলোকে আঁধার করে দেয় এবং বেশি কথা বলার মাধ্যমে বিরল প্রজ্ঞাকে মুছে ফেলে আর প্রবৃত্তির কামনা দিয়ে শিক্ষার আলোকে নিভিয়ে ফেলে। সে যেন বুদ্ধির ধ্বংস করার জন্য কু প্রবৃত্তিকে সহায়তা দিল। আর যে তার বুদ্ধিকে ধ্বংস করলো সে তার দীন ও দুনিয়াকে ধ্বংস করলো। কীভাবে তোমার আমল আল্লাহর কাছে পবিত্র হবে যখন তুমি নিজ বুদ্ধিকে আল্লাহর নির্দেশ থেকে বিরত রেখেছ এবং তোমার বুদ্ধির ওপর বিজয়ী করার জন্যে তোমার কু প্রবৃত্তির আজ্ঞাবাহী হয়েছ। একাকীত্বের ওপরে ধৈর্যধারণ বুদ্ধির শক্তির পরিচায়ক। যে ব্যক্তি মহামহিম আল্লাহর সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে সে দুনিয়াপন্থী ও এর প্রতি আসক্তদের থেকে দূরে থাকে এবং তাঁর প্রতিপালকের কাছে যা রয়েছে তার প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠে। আর আল্লাহ তার ভয়ের সময় তার সঙ্গী এবং একাকীত্বে তার সহায় হন। তিনিই তার অসামর্থের সময়ে সক্ষমতার এবং বংশের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত থাকার ক্ষেত্রে তার সম্মানের কারণ হন।
 

এই মহান ইমামের প্রতি অজস্র সালাম ও দরুদ পাঠিয়ে এবং সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে শেষ করছি আজকের এই আলোচনা। তবে তাঁর আগে তুলে ধরছি ইমাম মুসা কাযিম (আ.)’র বরকতময় কয়েকটি সংক্ষিপ্ত বাণী:
 
 
 
১. খোদা পরিচিতির পরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম পন্থা হল নামাজ, বাবা মায়ের প্রতি সদাচরণ এবং হিংসা, স্বেচ্ছাচার, অহংকার ও দাম্ভিকতা পরিহার করা।
 
২.বিনয়ের অর্থ হল, মানুষের সঙ্গে সেরকম আচরণ কর যেরূপ তুমি মানুষের কাছে আশা কর।
৩. যদি কেউ পার্থিব জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তবে তার হৃদয় থেকে আখিরাতের ভয় বিদায় নেয়।#


source : irib
0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আখেরাতের ওপর বিশ্বাস
তাকওয়া হাসিলের উপায়
কোরআন ও চিকিৎসা বিজ্ঞান
আদাবুস সুলূক (আধ্যাত্মিক পথ ...
খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি
হুজুর (সা.)-এর সন্তান-সন্ততিগণ
হযরত ফাতেমার চরিত্র ও কর্ম-পদ্ধতি
হযরত ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র ...
সমাজ কল্যাণে আল-কুরআনের ভূমিকা
মহানবী (স.) হতে বর্ণিত ৪০টি হাদীস (২)

 
user comment