৩০ সফর ইসলামের ইতিহাসের এক গভীর শোকাবহ দিন। এই দিনে শাহাদত বরণ করেছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.)। এ উপলক্ষে সবাইকে এবং বিশেষভাবে বিশ্বনবী (সা)কে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা এবং মহানবী ও তাঁর এই পবিত্র বংশধরের শানে অশেষ দরুদ আর সালাম ।
ইসলামকে রাজতন্ত্রসহ সব অব্যবস্থা ও অসঙ্গতির হাত থেকে রক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করে গেছেন ইমাম রেজা (আ) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন ১৪৮ হিজরির ১১ জিলকাদ পবিত্র মদিনায়। ইমাম মুসা কাজিম ইবনে জাফর সাদিক (আ.) ছিলেন তাঁর বাবা। মায়ের নাম ছিল উম্মুল বানিন নাজমা।
১৮৩ হিজরিতে খলিফা হারুনের কারাগারে পিতা ইমাম কাজিম (আ.)'র শাহাদতের পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মুসলিম উম্মাহর ইমামতের ঐশী দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম রেজা (আ.)।
শেখ সাদুক ইমাম রেজা (আ.) সম্পর্কে এক বইয়ে লিখেছেন, অসাধারণ নানা গুণ ও যোগ্যতার জন্য আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) রেজা বা সন্তুষ্ট, সাদিক বা সত্যবাদী, ফাজেল বা গুণধর, মু'মিনদের চোখের প্রশান্তি বা আলো ও কাফির বা অবিশ্বাসীদের ক্ষোভের উৎস প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তবে আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.)'র একটি বড় উপাধি হল 'আলেমে আ'লে মুহাম্মাদ' বা মুহাম্মাদ (সা.)'র আহলে বাইতের আলেম।
তিনিই বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের একমাত্র সদস্য যার মাজার রয়েছে ইরানে। প্রাচীন ইরান অঞ্চলে খাঁটি ইসলামের প্রসার ও প্রচার এ মহান ইমামের কাছে চিরঋণী।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইরানের খোরাসানে তাঁর শরীরের একটি অংশকে তথা তাঁর পবিত্র বংশধারার একজন সদস্যকে দাফন করা হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।
প্রায় হাজার বছর আগে লিখিত 'শাওয়াহেদুন্নবুওয়াত' নামক বইয়ে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, যারা ইরানের খোরাসানে অবস্থিত (যার বর্তমান নাম মাশহাদ) ইমাম রেজা (আ.)'র মাজার জিয়ারত করবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তারা বেহেশতবাসী হবে। বিশিষ্ট কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক মাওলানা আবদুর রহমান জামির লিখিত এই বইটি বহু বছর আগে বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে মাওলানা মহিউদ্দিনের মাধ্যমে (পৃ.১৪৩-১৪৪)। তবে এটা স্পষ্ট ইমাম রেজা (আ)’র প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে হলে তাকে হতে হবে প্রকৃত ইসলামের অনুসারী।
ইমাম রেজা (আ.)'র ইমামতের সমসাময়িক আব্বাসীয় শাসক বাদশা হারূন এবং মামুন প্রকাশ্যে নবীবংশের ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির কথা বলে বেড়ালেও ভেতরে ভেতরে ইমামদের রক্তের তৃষ্ণায় তৃষিত ছিলেন।
ধূর্ত বাদশাহ মামুন ইমামকে মদীনা থেকে মার্ভে আসতে বাধ্য করেন। ইমাম রেজার আগমনে মামুন তার সভাসদ এবং অন্যান্য লোকজনকে সমবেত করে বলেন, হে লোকেরা ! আমি আব্বাস এবং আলীর বংশধরদের মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখেছি , আলী বিন মূসা বিন রেজার মতো উত্তম লোক দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আমি চাচ্ছি যে খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেব এবং এই দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত করবো।
ইমাম, মামুনের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি সম্পর্কে জানতেন। তাই তিনি জবাবে বললেন, মহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমার জন্যে নির্ধারিত করে থাকেন, তাহলে তা অন্যকে দান করা উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারী না হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই।
ইমাম রেজা (আ.) মামুনের কথায় খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় মামুন শেষ পর্যন্ত ইমামকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হতে বাধ্য করে। অবশ্য ইমাম কিছু শর্তসাপেক্ষে তা গ্রহণ করেন। যেমন, তিনি প্রশাসনিক কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না ও দূর থেকে খেলাফতের সম্পর্ক রক্ষা করবেন।
ইমাম রেজা (আ) মামুনের উত্তরাধিকারী হতে রাজি হয়েছেন- এ খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে আব্বাসীয়রা ভাবল, খেলাফত বুঝি চিরদিনের জন্যে আব্বাসীয়দের হাত থেকে আলীর (আ) বংশধরদের হাতে চলে গেল। তাদের দুশ্চিন্তার জবাবে বাদশা মামুন তার আসল উদ্দেশ্যের কথা তাদেরকে খুলে বলে। আসলে ইমামকে খোরাসানে আসতে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাঁর পরবর্তী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পেছনে মামুনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, শিয়া মুসলমানদের বৈপ্লবিক সংগ্রামকে স্তিমিত করা। দ্বিতীয়ত আব্বাসীয় খেলাফতকে বৈধ বলে প্রমাণ করা। তৃতীয়ত, ইমামকে উত্তরাধিকারী বানানোর মাধ্যমে মামুন নিজেকে একজন উদার আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে।
মামুনের এইসব অশুভ উদ্দেশ্যের কথা জানার পর আব্বাসীয়রা ইমামকে নানাভাবে হেয় ও মর্যাদাহীন করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ ইমামকে তারা কিছুতেই অপমান করতে পারে নি। যেমন, বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মাধ্যমে জটিল প্রশ্নের অবতারণা করে ইমাম রেজা (আ.)-কে জব্দ করার চেষ্টা করত তারা। এ ছাড়াও একবার ক্ষরা-পীড়িত অঞ্চলে বৃষ্টি বর্ষণের জন্য ইমামকে দিয়ে এই আশায় দোয়া করানো হয় যে দোয়া কবুল না হলে ইমামের মর্যাদা ধূলিসাৎ হবে। কিন্তু ইমাম প্রতিটি জ্ঞানগত বিতর্কে বিজয়ী হতেন এবং বৃষ্টির জন্য করা তাঁর দোয়াও কবুল হয়েছিল।
ইমাম রেজা (আ) মামুনের বিরুদ্ধে অকপট সত্য বলতেন। ফলে মামুন কোনোভাবেই ইমামকে পরাস্ত করতে না পেরে ২০৩ হিজরির ৩০ সফর ইরানের বর্তমান মাশহাদ প্রদেশের তুস নামক অঞ্চলে ইমামকে বিষ-মাখানো ডালিম বা আঙ্গুর খাইয়ে শহীদ করে। তখন ইমামের বয়স ছিল পঞ্চান্ন বছর। আসলে বিষ প্রয়োগে ইমামের সাময়িক মৃত্যু ঘটলেও আসল মৃত্যু ঘটেছিল মামুনেরই। অন্যদিকে ইমাম ও তাঁর আদর্শ হয়ে পড়ে অমর ।
ইমাম রেজার (আ) শাহাদাতের পবিত্র রক্ত থেকে জন্ম দিয়েছে খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের লক্ষ-কোটি অনুসারী। বিশ্বনবীর (সা) বংশধর ইমাম হুসাইন (আ) ও ইমাম রেজা (আ)সহ আহলে বাইতের সদস্যদের নেতৃত্বের সুদূরপ্রসারী অবদান হিসেবে যুগে যুগে গড়ে উঠেছে অনেক আন্দোলন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবও সেই ধারবাহিকতারই ফসল।
এই মহাপুরুষের দু’টি বাণী শুনিয়ে ও সবাইকে আবারও গভীর শোক আর সমবেদনা জানিয়ে শেষ করব এই আলোচনা। ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন,
১."জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হচ্ছে এমন এক গচ্ছিত সম্পদ যার চাবি হল, প্রশ্ন। আল্লাহর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষিত হোক, কারণ প্রশ্নের মাধ্যমে চার গ্রুপ তথা প্রশ্নকারী, শিক্ষার্থী, শ্রবণকারী ও প্রশ্নের উত্তর-দাতা সবাই-ই সাওয়াব পান।"
২। মুমিন ক্রুদ্ধ হলেও তা তাকে অপরের অধিকার রক্ষা থেকে বিরত করে না।#
source : abna24