৭ ডিসেম্বর (রেডিও তেহরান):পবিত্র কুরআনের সুরা আ'রাফের কিছু দিক আমরা আগেই জেনেছি যে সুরা আরাফ পবিত্র কুরআনের সপ্তম সুরা। অবতীর্ণ বা নাজিল হওয়ার দিক থেকে এটি কুরআনের ৩৯ নম্বর সুরা। মাক্কি এই সুরার অন্য নাম আলমাস। কারণ, বিচ্ছিন্নভাবে আলিফ, লাম, মিম ও সোয়াদ অক্ষরগুলো দিয়ে এই সুরা শুরু হয়েছে। এবারে এই সুরার ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতের দিকে লক্ষ্য করুন।
৩১. হে বনী-আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাযের সময় নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নাও, খাও, পান কর আর অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।
৩২.আপনি বলুন: আল্লাহর সাজ-সজ্জাকে (বা সৌন্দর্যের উপকরণগুলোকে), যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুগুলোকে কে হারাম করেছে? আপনি বলুন: এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্যে (যদিও পার্থিব জীবনে অন্যরাও তা থেকে উপকৃত হয়) এবং কিয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্যে। এমনিভাবে আমি আয়াতগুলো বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্যে যারা বুঝে।
কুরআনের এ দুই আয়াত থেকে বোঝা যায় ইসলাম পাক-পবিত্র ও সুস্বাদু খাদ্য, পবিত্রতা ও সৌন্দর্য চর্চা তথা পবিত্র আর সুন্দর জামা-কাপড় পরা, সুগন্ধি ব্যবহার এবং পরিপাটি থাকাকে গুরুত্ব দেয়। বাহ্যিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এখানে। উন্নত মানবীয় ও নৈতিক গুণ এবং সংকল্প বা নিয়তের বিশুদ্ধতা ও অপব্যয় আর বিলাসিতা বর্জন হচ্ছে আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের কিছু উপকরণ। অপব্যয় বলতে সব ধরনের বাড়াবাড়িকেও বোঝানো হয়। সঠিক পরিমাণে পবিত্র খাবার গ্রহণ ও ভোজন বিলাসিতা থেকে মুক্ত থাকাও আধ্যাত্মিক বা আত্মিক সৌন্দর্য অর্জনের জন্য জরুরি।
ইসলাম কৃপণতার বিরোধিতার পাশাপাশি সব ধরনের নেয়ামতের অপচয় ও অপব্যবহারেরও বিরোধী। ইসলাম মধ্যপন্থাকেই উৎসাহ দেয়। এ ধর্ম পরিমিত মাত্রায় খাদ্য ও সৌন্দর্যের উপকরণসহ সব ধরনের নেয়ামতের ব্যবহারকে ধার্মিকতার পরিপন্থী বলে মনে করে না। আবার অতিরিক্ত মাত্রায় সৌন্দর্য-সামগ্রীর ব্যবহার ও জাক-জমককেও সমর্থন দেয় না।
মানুষ সৌন্দর্য ও সুন্দরের প্রেমিক। তাই তারা ভালবাসে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, কবিতা বা সাহিত্য ও শিল্প এবং সুন্দর পোশাক ও সুগন্ধ। ইসলাম মানুষের এই অনুভূতির প্রতিও সচেতন। তাই ইসলাম এসবের ব্যবহারকে নিষিদ্ধ তো করেইনি, বরং উৎসাহ দিয়েছে। বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত নামাজের জন্য সুন্দর পোশাক পরতেন। ইমাম হুসাইন (আ.)-কে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, মহান আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালবাসেন। তাই আল্লাহর উদ্দেশ্যেই আমি নিজেকে সুন্দর পোশাকে সজ্জিত করি।
বিশ্বনবী (সা.)-কে মেরাজের সময় নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তিনি যেন এমন লোকদের থেকে দূরে থাকেন যারা বেশি খায়, বেশি ঘুমায় ও বেশি হাসে। অতি-ভোজন আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও নানা ধরনের রোগও বয়ে আনে। অতিরিক্ত খাদ্য-সামগ্রী শরীরের কাজে আসে না বলে সেইসব বাড়তি খাবার হৃৎপিণ্ডসহ শরীরের নানা অংশ ও যন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে দেখা দেয় বিষক্রিয়া, অচলাবস্থা ও অন্য অনেক ধরনের রোগ। বিশ্বনবী (সা.)ও বলেছেন, "পেট হচ্ছে সব ধরনের রোগের বাসা এবং সংযম হচ্ছে সব ওষুধের মূল।"
বিশ্বনবী (সা.) ছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। সুরা আ'রাফের ১৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
"বলে দাও, হে মানব মণ্ডলী। তোমাদের সবার প্রতি আমি সেই আল্লাহর পাঠানো রাসূল, সমগ্র আসমান ও জমিনে রয়েছে যার রাজত্ব। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। সুতরাং তোমরা সবাই ঈমান আনো আল্লাহর উপর তাঁর পাঠানো উম্মী বা নিরক্ষর নবীর উপর, যিনি বিশ্বাস রাখেন আল্লাহর এবং তাঁর সমস্ত বাণীর উপর। তাঁর অনুসরণ কর যাতে সরল পথপ্রাপ্ত হতে পার।"
এ আয়াত থেকে বোঝা যায় বিশ্বনবী (সা.)'র দাওয়াত বা আহ্বান বিশ্বজনীন। তাঁর আহ্বান কোনো বিশেষ জাতি বা গোত্রের কিংবা গ্রুপের প্রতি সীমিত ছিল না। মহান আল্লাহ সবাইকে এ নবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে একত্ববাদী হতে বলছেন এবং সবার আগে নিরক্ষর মহানবী (সা.) যে নিজেই আল্লাহর বাণী বা কুরআনে বিশ্বাসী তা এখানে জানিয়ে দিচ্ছেন। আর নিজের প্রচারিত ধর্মের প্রতি তাঁর বিশ্বাসই এ ধর্মের সত্যতার এবং তাঁর বক্তব্যের সত্যতার স্পষ্ট নিদর্শন। তাই যারা সুপথ পেতে চান ও সৌভাগ্যের প্রত্যাশা করেন তাদেরকে অবশ্যই এই নবীর অনুসারী হতে হবে।
উম্মী বলতে এক অর্থে নিরক্ষর হওয়াকে বোঝায়। এর অন্য অর্থ হল, মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম নেয়ার পরের অবস্থায় তথা সহজাত অবস্থার মধ্যেই থেকে যাওয়া এবং শিক্ষা নেয়ার জন্য কারো শরণাপন্ন না হয়ে ওই অবস্থাতেই জীবন অতিবাহিত করা। এ বিষয়টি অন্যদের জন্য ত্রুটি হিসেবে বিবেচিত হলেও মহানবী (সা.)'র জন্য তা ছিল নৈপুণ্য। কারণ, তিনি অন্য কারো কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন ছাড়াই ওহি এবং ইলমে লাদুন্নি বা আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের মাধ্যমে আদি ও অন্তের সব জ্ঞানের ওপর পরিব্যাপ্ত ছিলেন, তাই লিখতে ও পড়তে সবকিছুই জানতেন। সুরা আনকাবুতের দ্বিতীয় আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী মহানবী (সা.) যদি কুরআন নাজির হওয়ার আগ থেকেই পড়তে ও লিখতে পারতেন তাহলে এই অপবাদ রটানো হত যে তিনি আল্লাহর বাণী বলে মানুষের কাছে যা প্রচার করছেন তা আসলে তাঁর নিজেরই কথা বা অন্য কোনো মানুষ তাঁকে এইসব বাণী শিখিয়ে দিয়েছেন। ফলে মানুষ সন্দেহ ও বিভ্রান্তির শিকার হত। কিন্তু মহানবী (সা.) লিখতে ও পড়তে পারতেন না বলে কুরআন সম্পর্কে এই জাতীয় প্রচারণা মিথ্যা বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.)ও বিধর্মীদের সাথে বিতর্কে বলেছেন:
"আমাদের নবীর সত্যতার কয়েকটি প্রমাণ হলো এই যে তিনি ছিলেন ইয়াতিম, নিঃস্ব, রাখাল এবং তিনি কোনো বই পড়েননি ও কোনো শিক্ষকের কাছেও যাননি, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এমন এক গ্রন্থ এনেছেন যাতে রয়েছে নবী-রাসূলদের ঘটনা, অতীতের ইতিহাস ও ভবিষ্যতের কথা।" মোট কথা, বিশ্বনবী (সা.) ওহী নাজিল হওয়ার আগ পর্যন্ত লিখতে ও পড়তে জানতেন না, কিন্তু এর পর ওহির সুবাদে জ্ঞানের এক অতলান্ত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত হন। ফলে এ সময় তিনি চাইলে লিখতে ও পড়তে পারতেন। কিংবা অনেকের মতে তিনি ওহি অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে অবশ্যই লিখতে ও পড়তে পারতেন।#
source : irib