মাহমুদ জাবির: হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মদিন মুসলমানদের জন্যে ঈদের দিন। আমাদের অনুভূতির তারতম্যের কারণে আমরা কিন্তু ঈদের মাহাত্ম্যটা বোঝার ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য তৈরি হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি লক্ষ্য করি আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের জন্মদিন উপলক্ষে যেভাবে উৎসব করি আনন্দ করি, একটা পার্টি তার দলের নেতার জন্য যেভাবে উৎসব পালন করে, আনন্দ করে তার চাইতে আমাদের আরও বেশি উৎসব আনন্দ করা উচিত আমাদের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মদিন উপলক্ষে। এক্ষেত্রে আমরা শুধু হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মদিনই উদযাপন করব না, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এমন একজন ব্যক্তি নন যে তাকে নিয়ে তার জন্মদিনকে নিয়েই উৎসব পালন করব বরং আমরা এক আদর্শের উদযাপন করছি। সেই আদর্শের উদযাপনটা আরও বড় মহিমান্বিত এবং একজন ব্যক্তির চাইতে একজনের আদর্শ অনেক মুল্যবান। সেক্ষেত্রে যিনি আদর্শ চর্চা করেন, যিনি আদর্শ ধারণ করেন তাঁর মূল্য পৃথিবীর অন্য সকল মানুষের চাইতে অনেক উপরে।
আজকে আমরা ঈদের দিনে স্মরণ করতে চাই হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শকে, যে আদর্শ কে দুর্ভাগ্যবশত অনেক মানুষ ভুলে আছে, অনেক মানুষ আদর্শ নিয়ে বিভ্রান্তিতে রয়েছে এবং আদর্শের এক ধরণের ভুল ব্যখ্যা এবং এক ধরণের ভুল ধারণা পোষণ করছে। আমরা দেখি প্রতিটি দলই যারা ধর্মের নামে আছেন মুসলমানদের মধ্যে সবাই হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ভক্ত বলে দাবি করেন। এক্ষেত্রে বহু পীর মাশায়েখের জন্ম হয়েছে, বহু অনুসারীর জন্ম হয়েছে এবং আমরা আবার দেখতে পাই হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিরোধী মতবাদও তৈরি হয়েছে এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিরুদ্ধবাদিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে থেকে দেখা যায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতি আকর্ষণ, আদর্শ শক্তি অন্যদিকে বিকর্ষণ শক্তি দুটোই আমরা লক্ষ্য করি। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আকর্ষণ শক্তিতে ব্যাপক জনগোষ্ঠী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শকে স্মরণ করছে এবং সেই আদর্শকে অনুসরণ করে চলার জন্য চেষ্টা করছে। আরেক অংশ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য ব্যাপক উৎসবে মেতে আছে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা সে কাজগুলো করে যাচ্ছে, তারা বিভিন্ন বই লিখেছে, গ্রন্থ লিখেছে, তারা লিখে বুঝিয়েছে- হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ যুগে প্রযোজ্য না। এটা ছিল আগেরকালে, মধ্যযুগের আদর্শ হিসেবে থাকলেও বর্তমানকালে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে আমরা আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে পারি না। এক্ষেত্রে অনেক বিতর্ক আছে। আমরা দেখি পাশ্চাত্যের তাত্ত্বিকরা, দার্শনিকরা তারা কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওপর অনেক লেখা লিখেছে যদিও তাদের অনেকেই হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পক্ষে লিখেছে, কোন কোন দার্শনিক পক্ষ বিপক্ষ দুটাই লিখেছে। আর আমরা যারা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ভক্ত, আমাদেরকে আরও বেশি স্টাডি করতে হবে যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শের, তাঁর মাহাত্ম্যের গভীরতা কতটুকু সেটি আমরা বুঝার যতই চেষ্টা করি না কেন আমরা সম্পূর্ণ বুঝতে পারব না; কেননা আমাদের ক্ষমতা সীমিত, সীমিত ক্ষমতায় আমরা চেষ্টা করবো হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ অনুধাবন করতে এবং সে ক্ষেত্রে আমরা দেখব আধুনিক সভ্যতায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শকে চরমভাবে নির্বাসিত করা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর যে আদর্শ সে আদর্শকে সভ্যতার নামে নির্বাসিত করা হয়েছে। সিগমুড ফ্রয়েড একটা বই লিখেছেন “Civilization & its Discontents” অর্থাৎ ‘সভ্যতা এবং অসন্তোষ’ বইতে তিনি লিখেছেন, ধর্ম যদি মানুষ মানে তাহলে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, মানুষ অশান্তিতে থাকে, অসুখী জীবনযাপন করে। তখন তাদের কাছে যদি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কথা বলি যেটা কুরআন শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে -‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) তিনি সারা বিশ্বের রহমত স্বরূপ’। তাহলে ফ্রয়েড এর এই বইটিতে কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে না। এই বইটিতে বুঝাচ্ছে ধর্ম যারা মানে তাদের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, অশান্তিতে থাকে, ধর্ম তাদের এক ধরনের অবদমন তৈরি করতে চায়, কেননা সে বিনোদন করতে চায়, সে ফূর্তি করতে চায়, আর ধর্ম মানতে গেলে তাকে অনেক নিয়ম কানুন মানতে হয়, তাকে নির্দিষ্ট কোড মানতে হয়। ধর্ম বলছে এই নিয়ম নীতি মানো, আমার মন বলছে এটা মানতে ইচ্ছে করে না। ধর্ম বলছে হিজাব পরো, মন বলছে আমার হিজাব পরতে ভালো লাগে না। তখন ফ্রয়েড বলছে ধর্ম তো অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। আর পাশ্চাত্যে লিবার্টি নামে যে চেতনা তৈরি করছে সে চেতনা আমরা শিক্ষার মাধ্যমে, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পাচ্ছি তখন আমাদের আরও বেশি হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে দূরে ঠেলে দেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি এটাই তো আমাদের জন্য আশীর্বাদ, হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে আশীর্বাদ সেটা মনে মনে স্বীকার করি তবে প্রাকটিকালি এটা আমি মনে করতে চাই না। অত্যাধুনিক টেকনোলজি যেটা সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে দেখতে পাচ্ছি সেই অত্যাধুনিক টেকনোলজি আমাদের বলছে তুমি আনন্দ কর, বিনোদন কর টিভি আছে, ফেসবুক আছে, ইন্টারনেট আছে সব কিছু আমাদের বলছে তুমি যত পার বিনোদন কর এবং বলছে উপচেপড়া বিনোদন কর, তারমানে উপচেপড়া বিনোদন করার সুযোগ কিন্তু আমাদের সৃষ্টি হয়েছে। যখন উপচে পড়া বিনোদন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে আর ভালো লাগে না কেননা হযরত মুহাম্মদ (সা.) তো আর বলেন নাই তুমি যত পার উপচে পড়া বিনোদন কর, যত পার ফূর্তি কর, হযরত মুহাম্মদ (সা.) তো আর এগুলো বলেন নাই। বরং হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বক্তব্যগুলো এসবের বিরুদ্ধে চলে গেছে। কেননা হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন তোমরা অশ্লীলতার চর্চা করো না, অশ্লীলতা কিন্তু ন্যায়বিচারের পরিপন্থি, ন্যায়বিচারের সাথে সাংঘর্ষিক। অশ্লীলতা সুন্দর সমাজ গঠনের বিরোধী । এ ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করি ধর্ম মানতে গেলে আমি আনন্দ করতে পারি না, বিনোদন করতে পারি না, ফূর্তি করতে পারি না, যেভাবে মিডিয়া উৎসাহিত করে সেইভাবে আমরা ফূর্তি করতে পারি না। এখন আমাদের আধুনিক যুগে যে আধুনিক সভ্যতা তৈরি হয়েছে, আধুনিক সভ্যতায় আমরা যদি লক্ষ্য করি বহু তাত্ত্বিক তারা অনেক সুন্দর সুন্দর মুখরোচক ধ্যান ধারণা আমাদের মধ্যে প্রবিষ্ট করাচ্ছে, আমরা তা শিখছি শিক্ষার মাধ্যমে এবং মিডিয়ার মাধ্যমে। সেখান থেকে আমরা কি শিখতে পারছি, আমরা শিখতে পারছি পাশ্চাত্যে যে স্বাধীনতা, পাশ্চাত্যে যে লিবার্টি, পাশ্চাত্যে যে মুক্ত স্বাধীনতার কথা বলা হয়, পাশ্চাত্যে যে মুক্ত অর্থনৈতিক বাজারের কথা বলা হয় এবং আধুনিক যে গণতন্ত্রের কথা বলা হয় এই সব কিছুর আদর্শ যদি আমরা গ্রহণ করতে পারি তাহলে আমাদের আর ধর্মের প্রয়োজন নেই। তাহলে এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শিখিয়েছে, আমাদের সংস্কৃতি শিখিয়েছে, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা শিখাচ্ছে তুমি যদি ধর্ম মানো তাহলে সর্বোচ্চ নামাজ পড়, রোজা রাখো, হজ কর আর কিছু দান খয়রাত করতে পারো। এবং এই প্যাকেজটা আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করছে। বিভিন্ন মহাসমাবেশে বলা হয় আমরা নামাজ পড়ব, রোজা রাখব, কিছু তজবি পড়ব আর আমরা কিছু দান খয়রাত করব তাহলে আমরা বেহেশতবাসী হব । তখন কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি মিডিয়া কিন্তু ব্যাপক পরিসারে এই ধরণের সমাবেশকে প্রচার করছে, ব্যাপকভাবে প্রসার করছে এবং লাইভ দেখাচ্ছে তারা কিভাবে কষ্ট করছে, কিভাবে কষ্ট করে আসছে, অবরোধকে উপেক্ষা করে , শীতের কষ্টকে উপেক্ষা করে তারা কিভাবে আয়োজনে শামিল হচ্ছে আর তখন যে সব মিডিয়া, পত্রিকা ধর্মের বিরুদ্ধে বেশি লেখে সেই পত্রিকাগুলোর মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি- ঐ পত্রিকাগুলো কলাম লিখছে, তারা লিখছে -এইখানে তারা দ্বীনের প্রচারণার জন্য আসছে এবং তারা কাউকে সমালচনার জন্য আসে নাই, তারা কারো সমালোচনা করতে চায় না তারা কারো কটূক্তি করতে চায় না সুতরাং তারা কত মহৎ, তারা সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে ভ্রাতৃত্ববোধ এ আবদ্ধ এ ধর্ম পালন করতে আসছে। এইভাবে যে সব সেকুল্যাররা ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার করছে তারাই কিন্তু আজকে আমাদেরকে এই ধরণের ধর্মের দিকে আবার অনুপ্রাণিত করছে। আবার যখন আমরা শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে যাই তখন দেখি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের অনেক তাত্ত্বিকদের মুখোমুখি করেছে। তখন কিছু তাত্ত্বিকদের কথা যেমন কার্ল মার্ক্সের কথা। সে কার্ল মার্ক্স বলেছিল, সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল শ্রমের মধ্য দিয়ে। যত মানুষ শ্রম বিনিয়োগ করবে ততই সভ্য হয়ে উঠবে। আবার আমরা লক্ষ্য করি বারট্রান্ড রাসেল তিনি বলেছিলেন সভ্যতার বিকাশ হয়েছে মস্তিষ্কের বিকাশের মধ্য দিয়ে। যত বেশি জ্ঞান চর্চা হবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যত বিকাশ হবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত আবিষ্কার করবে, মানুষ যত সায়েন্টিফিক হবে, বিজ্ঞান্মনস্ক হবে ততই মানব সমাজ সুন্দর হবে এবং বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা মধ্য দিয়ে সভ্যতার অগ্রযাত্রা নিহিত। তখন কিন্তু আমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যাই, ধর্ম তাহলে কোথায় আছে? আমাদের প্রচলিত ধর্ম ওয়ায়ালাদের কথা শুনলে বুঝতে পারা যায় যে, ধর্মের আসলে কার্যকারিতা নেই। ধর্ম আমাদের যা শিখাচ্ছে তা তো কিছু আনুষ্ঠানিকতা কিন্তু পরিশ্রম যখন আমাদের উন্নতর শিখরে নিয়ে যাবে তখন আমরা কি বলবো, কেননা আমরা পড়েছি পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসুতি। আবার আমরা জানি যদি জ্ঞান চর্চা কর লেখাপড়া করো তাহলে তোমার সম্মান অনেক বেশি, ডিগ্রি যত বেশি হবে ততই তুমি সম্মানিত হবে, সুযোগ সুবিধা পাবে আর যদি তুমি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারো তাহলে সভ্যতা অনেক এগিয়ে যাবে, পাশ্চাত্যে এই সব প্যাকেজ আবিষ্কার করেছে। ম্যাক্স বেভার বলেছে, ক্যাপিটালিজম এর বিকাশ যত বেশি হবে সভ্যতার বিকাশ তত হবে। ট্যালকম পারসন এর মতো সমাজ তাত্ত্বিক বলেছেন যে, পুঁজিবাদী সমাজ একটা ভারসাম্যপূর্ণ সুন্দর সমাজ তৈরি করতে পারে। এখন আমরা যদি কুরআনে দেখি আল্লাহ্পাক বলেছেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে সত্য দ্বীন সহ পথ নির্দেশ পাঠিয়েছে যাতে অন্যান্য সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী হয়। অন্যান্য দ্বীন বলতে কি বুঝায় ? দ্বীন মানে কিন্তু জীবন ব্যবস্থা। এখন অন্যান্য দ্বীনের উপর বিজয়ী হয় মানে কি? এখন আমাদের সমাজে সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত দ্বীনগুলো কি কি? আমরা যদি দেখি সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত দ্বীনগুলোর একটা পুঁজিবাদ আরেকটা হলো সমাজতন্ত্র। আর ট্র্যাডিশনাল যে দ্বীনগুলো আছে যেমন হিন্দু, খ্রিস্টান সেগুলো ট্র্যাডিশনাল দ্বীন। আধুনিক দ্বীন হিসেবে আসছে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র। আমরা যে লেখাপড়া করি না কেন আমাকে পড়তে হয় সোশ্যালিজম অথবা ক্যাপিটালিজম। এই দুইটা তত্ত্ব জ্ঞান শিখতে হয়। আমি যদি বিজনেস অনুষদে পড়ি আমাকে পড়তে হয় ক্যাপিটালিজম, আমি আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান পড়ি না কেন আমাকে হয় ক্যাপিটালিজম না হয় সোশ্যালিজম এর মতাদর্শের মধ্যে পড়তে হয়। এই দুই আদর্শের জ্ঞান কিন্তু আমাদের আসছে। এখন দেখবো যখন মিডিয়া টিভি এর সামনে হাজির হই তখন আমি হৃদয় দিয়ে পুঁজিবাদী সংস্কৃতির সাথে মিশে যাই। তখন আমি বলি হযরত মুহাম্মদ (সা.) আশীর্বাদ- এটা আমি কিছু কিছু জায়গায় মানতে পারি, তবে টিভি যে সব আমাদের আদর্শ বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে এটা কি কম আশীর্বাদ! যখন টিভি তৈরি করছে মডেল নারীদেরকে, পুরুষদেরকে মডেল হিসেবে আবির্ভাব করছে। এই মডেল মানে কি? তারা আবার বলছে তারকা। এবং এদেরকে বলা হচ্ছে তারকা এরা হল উজ্জ্বল নক্ষত্র। তখন আমরা কি ভিতর থেকে এর বিরুদ্ধাচারণ করেছি? সমাজ কি করে? আজকে যখন ঐশ্বরিয়া লাল গালিচা দিয়ে হেঁটে যায় তখন পত্রিকাগুলো ভালো করে লেখে আলোর ঝলক পড়েছে এখানে। সুতরাং ঘুম থেকে উঠে আমরা আর নবী-রাসুলদের আলোর ঝলক দেখি না আলোর ঝলক দেখি কাদের, ঐশ্বরিয়ার। এরা আবার জাতিসংঘের দূত। তাহলে আমরা নবী-রাসুলদের বলি দূত, ম্যাসেঞ্জার। জাতিসংঘের দূত যদি হয় ঐশ্বরিয়া তখন আধুনিক সভ্যতায় আমাদের বলেছে তোমরা নবী-রাসুলদের আদর্শ থেকে সরে যাও আমরা নতুন আদর্শ রূপে নতুন দূত হিসেবে হাজির করেছি। টিভিতে ইন্ডিয়া আর পাশ্চাত্যের নায়ক নায়িকা এরা আমার হৃদয়ে যত টানা ভালো লাগে আমাদের, এতো টুকু কি ভালো লাগে আমাদের হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে?
কুরআন শরীফে বলছে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে বলেছেন সিরাজুম মনিরা । অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা.) আলোর প্রদীপ । প্রদীপ মানে হচ্ছে যিনি সব সময় আলো দিয়ে যাবেন । এখন আমরা কি মনে করি হযরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের আলো দিয়ে যাচ্ছেন ? আমরা যারা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসরণ করি আমরা কি সেই আলোর অংশীদারি হয়েছি? এখন আমরা দেখি যে আমরা ভুল ব্যাখ্যা করছি, বিভ্রান্তিতে রয়েছি। বর্তমানে চোখ ধাঁধানো সভ্যতায় আমরা অন্ধ হয়ে পড়েছি। এখন চোখ ধাঁধানোর সভ্যতা, আমরা যদি চোখ মন সমৃদ্ধ মানুষ হই তাহলে চোখ মনকে ধাঁধিয়ে দেবে এই মিডিয়া। তখন মিডিয়া একটা নতুন ধর্ম তৈরি করেছে সে ধর্মের নাম হলো লাভ (Love) । পাশ্চাত্যের তাত্ত্বিক উলরিচ বেক তার বইতে লিখেছে লাভ ইজ দ্যা সেক্যুলার রিলিজিয়ান । লাভ (Love) হলো ধর্ম নিরপেক্ষ ধর্ম । মানে এটা অত্যাধুনিক ধর্ম, আধুনিক সভ্যতার ধর্ম হলো লাভ (Love)। এখন আমরা যদি ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করি তখন আমরা বলি ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’। ‘ লা ইলাহা ইল্লালাহ’তে যদি আমরা প্রবেশ করি , এটাকে যদি আমরা গ্রহণ করি, স্বীকার করি তখন আমরা বলি ধর্মে প্রবেশ করেছি। আর আমাদের নাটক, সিনেমা, মিডিয়ার অনুষ্ঠানাদিতে বিভিন্ন সিরিয়ালে আমাদের তুলে ধরা হয় আমাদের উত্তম আদর্শ হল- তুমি লাভের চর্চা কর। দেশে সিনেমায় দেখাচ্ছে তোমার বয়স কম হলেও তুমি লাভ রিলেশন কর আর বিদেশি সিনেমায় দেখাচ্ছে তুমি বিয়ের আগেই লাভ রিলেশন কর আর শুধু বিয়ের আগেই নয় বিয়ের পরও তুমি এক্সট্রা লাভ রিলেশনও কর। এটার আবার একটা কালেমা আছে, আমাদের ধর্মের কালেমা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ এটা হলো আমাদের কালেমা। আর ওদের লাভ রিলেশন এর জন্য যে কালেমা পড়ানো হয় সেটি হলো “আই লাভ ইউ”। এটা বলে সে লাভ রিলিজিয়ন এর দলভুক্ত হয়ে যায়। আর এই রিলিজিয়নের এতো প্রভাব বিস্তার হয়ে গেছে তখন কি আমাদের হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আলো সে আলো কি আমরা দেখতে পাই? এখন আমরা লক্ষ্য করেছি এমন এক সমাজে এসেছি সেই আলোর অনুপস্থিতিতে , সে আলো আমাদের ভেতর না আসার কারণে আমরা লক্ষ্য করেছি সমাজ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সে সময় আমরা দেখেছি জাহেলি যুগ এখন আমারা নতুন করে জাহেলি যুগ দেখতে পাচ্ছি। এই জাহেলি যুগে প্রচুর মানুষ আছে কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ চর্চা করার মানুষ বহু কমে গেছে। এর কারণ দুটো, একটি অজ্ঞতা অন্যটি জ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে সে পাশ্চাত্যমুখী হওয়া। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ চর্চা কমে গেছে কারণ অজ্ঞতা দিয়ে সে ধর্ম বুঝেছে , সে জ্ঞান দিয়ে ধর্ম বুঝেনি। রাহুল সংস্কৃতয়ান তার ইসলামের রূপরেখা এই বইতে বলেছিলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) তিনি একজন পুরোপুরি দোষমুক্ত চিলেন না তবে মানুষ হিসেবে তিনি মানুষের উপকার করেছেন। আমরা দেখি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে তিনি মানুষকে পবিত্র করতেন। তিনি মানুষকে কিতাব শিক্ষা দিতেন , হিকমত শিক্ষা দিতেন। তাহলে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একটা বড় গুণাবলী ছিল তিনি মানুষকে পবিত্র করতেন। তাহলে তিনি কত টুকু পবিত্র হলে মানুষকে পবিত্র করার কাজ করতেন মানুষকে পবিত্র করতেন। তিনি শুধুই পবিত্র ছিলেন না অন্যদের পবিত্র করতেন। যার কাছে আলো নাই সে অন্যকে আলো দিতে পারে না। আর আমরা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর যে শিক্ষা, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আলোর অনুসারী হই তাহলে আমরা পবিত্রতার কাজের মধ্যে চলে যাব। আমরা যদি পবিত্রতার কাজের মধ্যে নিজেদের নিবিষ্ট না করি তাহলে এই উজ্জ্বল সভ্যতা আমরা কিন্তু নির্মাণ করতে পারব না । আমরা বলছি আধুনিক সিভিলাইজেশন , এই আধুনিক সভ্যতা কিন্তু আলোকিত সভ্যতা না । যদিও জোর গলায় পাশ্চাত্যরা শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের শিখাচ্ছে , মিডিয়া দ্বারা বুঝাচ্ছে যে পাশ্চাত্যের সভ্যতা চোখ ধাঁধানো , আলোকিত সভ্যতা কেননা পাশ্চাত্যের সভ্যতায় জ্ঞান এসেছে, বিজ্ঞান এসেছে, টেকনোলজি এসেছে । এখন এটা আমাদের দেখতে হবে শুধু জ্ঞান আর শ্রম দিয়ে কিন্তু উন্নত সভ্যতা নির্মাণ করা যায় না। কেননা মানুষকে যদি পবিত্র না করা হয়, পিউরিফিকেশন এর কর্ম যদি না নেয়া হয় মানুষের ক্ষেত্রে তাহলে সে সমাজ অধঃপতনের নিম্নস্তরে যাবে। যেটা আমরা পাশ্চাত্যের সভ্যতায় দেখতে পাচ্ছি । পাশ্চাত্যের সভ্যতায় লিবার্টির কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে এবং তারা মনে করে অনেক স্বাধীনতা পাচ্ছে , এটা মনে করতে তারা অশ্লীলতায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, অশ্লীলতা প্রদর্শন করছে। যত নিজেকে অন্যের সামনে অশ্লীলতা প্রদর্শন করবে তত তুমি আধুনিক এটা বুঝানো হচ্ছে আমাদের । পাশ্চাত্যের সভ্যতা এই বস্তুবাদী জাঁকজমক এর চেতনা, জাঁকজমক এর সংস্কৃতি তৈরি করছে ব্যাপক ভাবে, বিপজ্জনক ভাবে আমাদের সভ্যতা ধ্বংস করছে। কেননা বলছে আমি ডিসাব্লিমেট হব, ওপেন হব, আমি যদি নিজেকে ধর্মের নিয়ম নীতি দ্বারা চলি তাহলে আমি ব্যাকডেটেড হয়ে যাবো । পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের এগুলো শিখাচ্ছে। এবং আমাদের শিখাচ্ছে আমরা যদি আল্ট্রা মরডান না হতে পারি তাহলে আমাদের জীবন ব্যর্থ। আর আমি যদি প্রচুর অর্থ উপার্জন করে অত্যাধুনিক ভোগ বিলাসের জীবন গঠন না করতে পারি তাহলে আমার জীবন ব্যর্থ । পাশ্চাত্যের সভ্যতা আমাদের এটা শিখিয়েছে। তখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এসে এতো মার্কেটিং সিস্টেম, অরগানাইজড সিস্টেম তৈরি করেছে যে আমরা তখন প্রলুব্ধ হই। আগে শয়তান মানুষকে প্রলুব্ধ করতো এখন পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রলুব্ধ করছে কেননা এই শয়তান পাশ্চাত্য সভ্যতা তৈরি করে দিয়েছে। তাহলে শয়তানের মনের ভিতর ঢুকে কুমন্ত্রণা দেয়ার দরকার নেই শয়তান কখন কুমন্ত্রণা দেয় যখন সে ধর্মের পথে থাকে তখন। কিন্তু ধর্মের ঢোকার আগেই শয়তানের কুমন্ত্রণা বন্ধ হয়ে গেছে কেননা পাশ্চাত্যের সভ্যতা এখন আমাদের কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। আর এখন আর আমাদের পাশ্চাত্যের কাছে যাওয়ার দরকার নাই, ঘরে যে টিভি তা প্রতিদিন আমাদের কুমন্ত্রণা দিতেছে। টিভি একটা ইবলিশ হিসেব কাজ করছে, এটা আমাকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে , যে এটা আমাদের কাছে আফিম হয়ে গেছে। মার্ক্স বলেছিল ধর্ম আফিম , যদিও আমরা দেখি অনেকেই ধর্মকে আফিম হিসেবে নিয়ে জঙ্গি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে যায় এই ক্ষেত্রে ধর্ম আফিম কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে ধর্ম আফিম না। আধুনিক সভ্যতায় আজ আফিম হলো আধুনিক সংস্কৃতি। পাশ্চাত্যের আর ইন্ডিয়ার যে হিন্দি সংস্কৃতি- এই সংস্কৃতি এখন আমাদের কাছে আফিম হিসেবে কাজ করে, এতো বেশি আফিম হিসেবে কাজ করে যে বিজ্ঞানে আবিষ্কার হয়েছে মদ খেলে যেভাবে মস্তিষ্ক উলটপালট হয়ে যায় অশ্লীলতা, যে অশ্লীল সংস্কৃতিকে আমাদের সামনে মিডিয়া হাজির করছে এই সব আমাদের মস্তিষ্ককে একইভাবে উলটপালট করে দেয়। মোবাইল ইন্টারনেট এসে যে নীল সংস্কৃতি হাজির করেছে সে নীল সংস্কৃতি আমাদের মস্তিষ্ককে এমন ভাবে উলটপালট করে যে দিব্য জ্ঞান সে তা হারিয়ে ফেলে। এখন লক্ষ্যহীন, উদেশ্যহীন জীবন যাপন করছে। এই যে দুরবস্থা আজকের যুগে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ, শিক্ষা এতো বেশি প্রয়োজন যে পৃথিবীর অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শের চর্চা আজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কুরআনে বলা হয়েছে, সত্যসহকারে প্রেরণ করা হয়েছিল সাক্ষী হিসেবে । সাক্ষী মানে কি ? কুরআনে বলা হয়েছে আমি মুসা ( আ. ) কে প্রেরণ করেছিলাম সাক্ষী হিসেবে ফেরাউনের কাছে। সাক্ষী জিনিসটা হলো সে স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে, সত্য নিয়ে সমাজের বৃহৎ শক্তির সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে। সে হলো সাক্ষ্যদাতা যে, আমি কাউকে ভয় করি না, আমার কাছে এই আদর্শ, ইসলাম আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ, সে এটা নিয়ে ফেরাউনের কাছে দাঁড়িয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সাক্ষ্যদাতা মানে সমাজে যারা অন্যায় অবিচার জুলুম করে, লুটপাট করে তাদের সামনে কঠিন ভাবে দৃঢ় ভাবে দাড়িয়ে যাওয়া। হযরত মুহাম্মদ (সা.) কঠিন ভাবে দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন এই সবের বিরুদ্ধে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু ইবাদত বন্দেগী করে কাটিয়ে দিতেন না , তিনি এইসব জুলুম অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কাফেরের সামনে , জালেমের সামনে কঠিন ভাবে দৃঢ় ভাবে দাঁড়ানো কঠিন ইবাদত, অনেক বড় ইবাদত, উচ্চ মর্গের ইবাদত; যেটা আমরা সমাজ থেকে পাই না। প্রচলিত সমাজ বলছে সমাজে যত অন্যায় অবিচার হবে সব সহ্য করতে হবে। আমাদের সহনশীলতা বাড়াতে হবে , যতই অত্যাচার হোক না কেন, অবরোধ হোক না কেন আমাদের কারো উপর ক্ষোভ নাই। কেন ? আমাদের ধর্ম এটা শিক্ষা দেয় নাই। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজ এ ভাষণে বলেছিলেন, তোমরা অত্যাচার করবে না, অত্যাচারিতও হবে না । কুরআনে বলা হয়েছে সূরা বাকারায়- তোমরা অত্যাচারিত হবেও না করবেও না। আর ধর্মান্ধরা বলে তুমি অত্যাচারিত হও, সহনশীল হও । অত্যাচার করো না কিন্তু অত্যাচারিত হও। সুতরাং আমাদের ধর্মটা বুঝতে হবে। ইসলাম ধর্ম হলো তুমি অত্যাচারিত হবে না অত্যাচার করো না। সমাজে যে সব দ্বীন আছে ইসলাম তার চেয়ে অনেক উপরে। পাশ্চাত্যে সমাজের তাত্ত্বিকরা বলছে আমাদের লিবার্টি অর্জন করতে হবে, স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। আল্লামা তাবাতাবাঈ বলেছিলেন, ইসলাম যা আমাদের শিক্ষা দেয় তা স্বাধীনতার চেয়েও অনেক উপরে। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় আল্লাহ্র একত্ববাদ । আর আমাদের আধুনিক সভ্যতা আমাদের শিখাচ্ছে বহুত্ববাদ। আর আল্লামা তাবাতাবাঈ বলেছেন একত্ববাদের মান স্বাধীনতার মানের চেয়ে অনেক উপরে। স্বাধীনতার চর্চা সমাজে গোলযোগ সৃষ্টি করে স্বাধীনতার চর্চা পরিবারে অশান্তির সৃষ্টি করে, স্বাধীনতার চর্চা অশ্লীলতা বৃদ্ধি করছে, অন্যকে ক্ষতি করছে। কিন্তু ইসলাম আমাদেরকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্বের কথা বলছে। ইসলাম আমাদেরকে মানুষের সমস্যা সমাধানের দায়িত্বশীল করে তুলছে। আমাদের বুঝতে হবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) তখনই আমাদের জন্য রহমত যখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ গ্রহণ করে আমরা অন্যায় অবিচার জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো, যে অশ্লীলতা মিডিয়া আমাদের ছড়াচ্ছে সে অশ্লীলতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসবো এবং উন্নত সংস্কৃতি আমরা নির্মাণ করব। এই উন্নত সংস্কৃতি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ যা আমরা কুরআন থেকে শিখতে পারি। দুর্ভাগ্য আজ আমাদের সমাজে! যে কুরআন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে আমাদের জন্য হেদায়েত হিসেবে পাঠিয়েছেন সে কুরআন আজকে আমাদের এতো ভালো লাগে না। আজকের সমাজে ধর্মান্ধরা বলছে, কুরআন পড়া ফরজ না, ফরজ হইল নামাজ পড়া। ফলে এমনিতেই মানুষের কুরআনের প্রতি আগ্রহ কম আর আজকে কুরআন এর প্রতি আগ্রহ আরো কমে গেছে। আর এই অবস্থায় যদি আমরা কুরআন থেকে দূরে থাকি তখন আমরা দেখি কুরআন এর চর্চার চাইতে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি চর্চা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আজ আমরা বিপজ্জনক অবস্থায় পার করছি। আজকে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি, পাশ্চাত্যের শিক্ষা ব্যবস্থা, পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের সমাজকে কলুষিত করে ফেলেছে তখন কিন্তু আমরা নতুন করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ বোঝার চেষ্টা করবো। কুরআনে বলা হয়েছে হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার উম্মত দের নিয়ে আল্লাহ্র কাছে অভিযোগ করেছেন, “হে আল্লাহ্ আমার এই সম্প্রদায় কুরআনকে তো পরিত্যাজ্য মনে করে।” হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার সম্প্রদায় এর সময় বলেছিলেন যে, তার সম্প্রদায় কুরআন পরিত্যাজ্য মনে করে তাহলে আজকের সমাজে কুরআন থেকে কতো দূরে ? কেননা কুরআন এর শিক্ষা থেকে আমাদেরকে দূরে রাখা হয়েছে।
কুরআনে বলা হয়েছে , তোমরা কি গভীর চিন্তার সাথে কুরআন অধ্যয়ন করো না। আজকে আমরা তো কুরআনই পড়ি না, গভীর অধ্যয়ন তো আরও পরের বিষয়। গভীর চিন্তায় কুরআন অধ্যয়ন করা, কুরআনের শিক্ষা ও চর্চা থেকে আমরা ব্যাপক ভাবে দূরে সরে পড়েছি । এই জায়গাতে আমরা বলবো হযরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের রহমত যখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ আমার জীবনকে আলোকিত করে তুলবে। আজকের সমাজে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের সামনে নকল নবী হাজির করা হয়েছে। সেক্যুলার নবী হাজির হচ্ছে আমাদের সমাজে। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস কে অর্থনৈতিক শাখায় নবী হিসেবে ধরা হচ্ছে, যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শোষণমূলক কার্যকর করার জন্য আমাদের মাঝে আসছেন। এই ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস সারা বিশ্বে বাহবা পাচ্ছে, অনেক কিছু অর্জন করছে , নোবেল পুরুস্কার পাচ্ছে এতে আমরা অনেকই খুশী হচ্ছি। হযরত মুহাম্মদ সা. বিদায় হজের সময় বলেছিলেন সুদ গ্রহণ ও আদান প্রদান মানে লেনদেন করা নিষিদ্ধ। অথচ সমাজে এই সুদের কারবারির মাধ্যমে সমাজে সে অনেক কিছু প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাই অর্থনৈতিক সেক্টরে সে কিন্তু একজন আলোকিত মানুষ! আমাদের মিডিয়া বলেছে সে আদর্শিক মানুষ। পাশ্চাত্যের মিডিয়া যে আমাদের গণতন্ত্রের কথা বলেছে সে গণতন্ত্র বলে জিকির তুলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে ক্ষমতায় আসবে রাজনৈতিক ভাবে আমাদের সামনে, সে একজন আলোকিত মানুষ। আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মডেল/তারকার নাম দিয়ে যারা অশ্লীলতার চর্চা করতে আহব্বান করছে তারা হচ্ছে আমাদের কাছে সাংস্কৃতিক আলোকিত মানুষ। আর এই যদি আমাদের মনে মগজে গেঁথে যায়, চর্চা হয় তাহলে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ উপেক্ষিত। কেননা হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধুমাত্র নামাজ কুরআন পড়তে আসেন নাই তিনি সমাজে আল্লাহ্র বিধান কার্যকর করার জন্য এসেছেন। কুরআন বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছিলেন। পাশ্চাত্যের জোসেফ স্টিগলিজ বলেছে, পুরা পাশ্চাত্যে যে বড় ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে সেটি হোল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অসমতা। তখন আবার সে বলেছিল বিপদ শুধু অর্থনৈতিক না, রাজনৈতিক বিপদও; আমরা শুধু নির্বুদ্ধিতার রাজনীতি করি। আমরা এইখানে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে জিকির তুলছি অথচ জোসেফ স্টিগলিজ বলেছে আমরা নির্বুদ্ধিতার রাজনীতি করি। পাশ্চাত্যের এত নির্বুদ্ধিতার রাজনীতি হল, পাশ্চাত্যের যে অবিচার মূলক, শোষণ মূলক, নিপীড়ন মূলক অত্যাচার শাসন চলছে। জন কেরি বলছে আমাদের লক্ষ্য একটাই শান্তি, সমৃদ্ধি, প্রগতিশীলতা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদেরকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী এর বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব আমাদের সাথে একত্রিত হয়ে লড়াই করতে হবে।
আমরা দেখি সন্ত্রাসবাদ দিয়ে, জঙ্গিবাদের নাম দিয়ে আজকে ধর্মের আসল দিকটা আড়াল করা হয়েছে এবং তালেবান আল কায়েদা যখন হামলা চালিয়েছে উগ্রতার সাথে বিভিন্ন জায়গায় হামলা করে তখন পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, তাত্ত্বিকরা তারা ইসলামকে কটাক্ষ করতে থাকে এমনকি তারা এও বলে যে, কুরআনকে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করা ছাড়া এর কোন উপায় নাই। তারা বলছে এরা ফ্যাটালিজম, এরা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে হবে এবং নির্মূল করতে হবে কুরআনকে। এক সময় তারা পাশ্চাত্যে ক্যাথোলিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো ধর্মের নাম দিয়ে। আজকে এই যুগে ইসলামকে অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদ নাম দিয়ে ইসলামের আসল রূপ আড়াল করা হচ্ছে। ধর্ম শুধু একটা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে পড়ে গেছে। বলা হয় তুমি নামাজ পড়, রোজা রাখো , জিকির করো, ইনশাল্লাহ আশা করা যায় তুমি বেহেশত পাবে। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সঙ্গীগণ অত্যাচারী কাফেরগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাহলে সে সময় সঙ্গী ছিল এখন কি আমরা সঙ্গী না। আমরা যদি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সঙ্গী, অনুসারী হই তাহলে কুফরির বিরুদ্ধে, কুফরি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, কুফরি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমাদের যদি চেতনা তৈরি না হয় তাহলে কি আমরা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর চেতনার সঙ্গী? যারা থাকবে নিজেদের প্রতি সহনশীল। দুর্ভাগ্যবশত তা উল্টে গেছে। আমাদের আজ জালেম কুফরিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নাই কিন্তু নিজেদের মধ্যে দলাদলি, এই দল সেই দল এটা নিয়ে মাতামতিতে আছি। কিন্তু আমরা যদি দেখি ইসলাম এমন একটা ধর্ম যেখানে ন্যায়বিচারকে খুব গুরুত্ব প্রদান করে। ধর্মীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি সফল ব্যক্তি ছিলেন। এখন রাজনীতি মানে কে? ক্ষমতা এখন নেটওয়ার্ক এর মধ্যে। সব কিছু এখন কন্ট্রোলিং প্রযুক্তির মধ্যে। এই সময় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শকে আমরা যদি চর্চা করতে যাই তাহলে তাকে খণ্ডিত অবস্থায় না দেখে এমন অবস্থায় দেখা উচিত যিনি সকল মানুষের জন্য অনুকরণীয়, আদর্শ এবং এর বিকল্প যেন হতে পারে না। জর্জ বারনাড’শ বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি যদি একজন মানুষ হযরত মুহাম্মদ সা. এর মত আধুনিক যুগে সমস্ত কিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করে তাহলে সকল সমস্যা থেকে সমাধান আসবে, সমস্যা দূর হবে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) আদর্শকে আমাদের বুঝতে হবে। আমরা যদি হযরত মুহাম্মদ (সা.) আদর্শকে অনুসরণ করতে পারি, তাহলেই উন্নত সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি এবং আমরা হযরত মুহাম্মদ (সা.) আদর্শকে অনুসরণ করে আমরা এই কাজে অগ্রগামী হতে পারি, সমাজে যে শোষণ জুলুম অত্যাচার অপসংস্কৃতিতে ভরে গেছে এই পরিস্থিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুযোগ্য অনুসরণকারী প্রয়োজন, কেননা আজ যদি হযরত মুহাম্মদ (সা.) থাকতেন তিনি সুদ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলতেন। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চেয়ে আমাদের দেশে সুদ ব্যবস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে শীতে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, আমরা একটা কম্বল দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছি, কম্বল দেয়া ভালো কিন্তু এর সমাধান অন্যভাবে করতে পারি , সে সমাধান দিতে পারি। তারা উপার্জনের পরও কেন কম্বল কিনতে পারছে না কারণ তারা ঋণগ্রস্ত। তারা কৃষি কাজ করছে কিন্তু ব্যাপক হারে এনজিও এর কাছে অনেক ঋণগ্রস্ত। সুদ সহ ঋণ তাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। যদি পরিশোধ না করতে পারে তার বাড়ির সামনে মিটিং বসছে, তাকে অপদস্ত করা হচ্ছে তখন সে ঘরের জিনিস বিক্রি করে হলেও তার ঋণ শোধ করছে তাহলে সে কিভাবে কম্বল কিনবে? সুদ সিস্টেম এখন রাজনৈতিক সিস্টেম এ পরিণত হয়েছে। কুরআনে সূরা বাকারায় বলা হয়েছে, সুদ ব্যবস্থা তোমরা যদি না ছাড় তাহলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে জেহাদ ঘোষণা করতে বলা হয়েছে। আমাদের আধুনিক ভোগবাদীরা, তারা ভাবছে ব্যাংকে কিছু টাকা রাখলে আমার টাকা বাড়বে। তাহলে তার সাইকোলজির মধ্যেই আছে সুদ গ্রহণের মানসিকতা। আজকে যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এগুলো সব দমন মূলক শোষণ মূলক ব্যবস্থা, অশ্লীল। আজ এই দুরবস্থায় যদি আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) আদর্শকে অনুসরণ করতে পারি তাহলে আমরা আমাদের ঈমান কে রক্ষা করতে পারবো। ইমাম বাকের (আ.) বলেছিলেন, সেই ব্যক্তির ঈমান আছে যারা আল্লাহ্র বন্ধুদের সাথে ভালোবাসা রাখে আর আল্লাহ্র শত্রুর সাথে ঘৃণা পোষণ করে। সুতরাং আল্লাহ্র বন্ধু নবী রাসুলগণ, তাদের উত্তরসুরি ইমামগণ এর সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি, তাদের আদর্শকে নিয়ে কাজ করতে পারি। আর এ যুগে যারা আল্লাহ্র শত্রু তারা সমাজের দুশমন, খোদায়ী ব্যবস্থাকে যারা নির্মূল করতে চায় রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ভাবে আমরা যদি তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠার সাথে কাজ করি ইনশাল্লাহ এক সময় উন্নত সমাজ তৈরি করতে পারব। গিডেন্স বলেছিল, সমাজ কাঠামোকে পরিবর্তন করবে এজেন্ট, যদি এজেন্ট হয় জ্ঞানী, আমি বলবো সমাজ কাঠামো পরিবর্তন হবে না। সমাজ কাঠামোর বাহ্যিকটা পরিবর্তন হবে, কিন্তু সমাজের কাঠামোর পরিবর্তন হইতে হলে স্প্রিচুয়াল (Spritual) হইতে হবে। আধুনিক সভ্যতা না উন্নত সভ্যতা গঠনের জন্য জ্ঞান এবং শ্রমের এই দুটার উপর স্থান পাবে স্প্রিচুয়ালিটি(Sprituality) । হযরত মুহাম্মদ সা. আদর্শকে অনুসরণ করে আমরা যদি নিজেকে পবিত্র করে উন্নত গুণাবলীর অধিকারী হতে পারি, তাহলে আশা রাখি এই সমাজ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে উন্নতর হবে। তখন আমরা দেখবো হযরত মুহাম্মদ (সা.) আসল উজ্জ্বল প্রদীপ। কিন্তু আমরা ইচ্ছা করে সেই প্রদীপের উপর একটা পর্দা টেনে দিয়েছি যার ফলে আমরা আলো পাচ্ছি না। এখন আমাদের কে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি, বস্তুবাদী জীবন ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে আসতে হবে। আমাদের হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ নিয়ে কাজ করতে হবে। #
source : irib