পবিত্র মহররম মাসের আগমনের সাথে সাথে বিশ্ব মুসলিম জেগে ওঠে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর অক্লান্ত জেহাদি প্রেরণা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সকল প্রজন্মকেই উদ্দীপ্ত করে তোলে। যেভাবে বৃষ্টি এসে সতেজ করে তোলে তৃষ্ণার্ত সকল উদ্ভিদকে।
প্রায় এক বছর আগে,মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসকবর্গের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভের সূচনা হয়, ওই বিক্ষোভকে অনেকেই উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বলে অভিহিত করতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু এ সব বিক্ষোভকারী যখন আল্লাহ আকবর ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে গগন বিদারী ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মাতিয়ে তুলেছেন, বিশেষ করে তিউনিশিয়া, মিশর, বাহরাইন, ইয়েমেন ও লিবিয়ার রাজপথ ও চত্বরগুলোতে আন্দোলনরত জনতা দলে দলে নামাজের কাতারে দাঁড়ালেন তখন এ গণ জাগরণের প্রকৃতি নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে এবং এটি যে ইসলামী গণ জাগরণ তা বুঝে নিতে আর কোনো অসুবিধাই হয় নি। ইসলামী এই জাগরণ মূলত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অর্থনীত, রাজনীতি আর আধিপত্যের বিরুদ্ধে শক্তিমত্তা ও সংহতির প্রকাশ।
দীর্ঘ নীরবতার পর ইসলামী এ জাগরণ পুনরায় ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন ইঙ্গিত বহন করে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থী অনেক দলের উদ্ভব ঘটেছে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো খুবই অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছে কেননা ইসলামী জাগরণের ফলে সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতির প্রকৃতি মোটেও বুঝে উঠতে পারছে না সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। তাই মোকাবেলার উপায় স্থির করতে পারছে না বলে জটিল এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো। চলমান এ গণ জাগরণের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধেগুলোর সঙ্গে মানুষের বিধি-দত্ত প্রকৃতির মিল রয়েছে। বস্তুবাদী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চেয়ে এটি একদিকে যেমন শক্তিশালী তেমনি পশ্চিমা বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যারা এ আন্দোলনকে মূল্যায়নের চেষ্টা করবেন তারা এটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবেন। ইসলামী গণ জাগরণের ফলে অন্যান্য ধর্মগুলোরও সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা বেড়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এখন ধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছে। বর্তমানে কম্যুনিজম ব্লক বা পূর্ব ও পশ্চিমা ব্লক শব্দগুলোর স্থান দখল করে নিয়েছে রাজনৈতিক ইসলাম, বিপ্লবী ইসলাম বা খোমেনির ইসলাম । অবশ্য এখন অনেক বিশ্লেষকই হন্যে হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী গণ জাগরণের শেকড় অন্বেষণ করছেন। ইসলামী গণ জাগরণের শেকড় খুঁজে পেতে হলে তাদেরকে মুসলমানদের বুদ্ধিভিত্তিক ও আদর্শিক বিশ্বাসের ভিত্তিমূল অনুধাবন করতে হবে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিগত অর্ধ শতকের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও সফল ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।আধিপত্যবাদ ও অন্যায় এবং জুলুমের বিরুদ্ধে এ বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। হজরত ইমাম হোসাইন বিন আলী(আ)এর বীরত্বপূর্ণ পন্থা ও অমর চিন্তাদর্শের আলোকেই এ বিপ্লবের অভ্যুদয় ঘটেছে। ইমামের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের জীবনদৃষ্টি বদলে গেছে। জীবনকে তাঁরা নতুনভাবে ব্যাখার মধ্য দিয়ে সত্য অনুসরণ,ন্যায়কামিতা,স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ ইত্যাদি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ইয়াজিদের মতো কোনো খোদাদ্রোহী যে সময় মানুষের জীবনকে অপদস্থের অতল অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল,তাদেরকে কাঙ্ক্ষিত জীবন যাপন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। সে সময় হজরত ইমাম হোসাইন ইহলোকিক ও পারলৌকিক কল্যাণময় জীবন ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কারবালার বীরত্বপূর্ণ ঘটনার পথ বেছে নেন। এ পথ তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে জেনেও এগিয়ে যেতে পিছ পা হননি তিনি।
হজরত ইমাম হোসাইন (আ) এর দৃষ্টিতে মানবিকতা ও আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সুন্দর জীবন মানুষের প্রতি খোদার বিশেষ উপহার। তিনি মনে করতেন, তাই সব মানুষের সুন্দর জীবনের অধিকার রক্ষা করতে হবে। কাজেই কোনো ভাবে মানুষের সুন্দর জীবন বিনষ্টের প্রচেষ্টা চালানো যাবে না। যদি কেউ জুলুম নিপীড়নের পথ বেছে নেয় তবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সুরা নেসার ৯৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে
'যারা নিজের অনিষ্ট করে, ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করে বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলেঃ এ ভূখন্ডে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলেঃ আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব, এদের বাসস্থান হল জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ স্থান।'
ইমাম হোসাইন(আ) সত্য ও খোদা-পন্থী আন্দোলনের মাধ্যমে অন্ধকার রজনীতে উজ্জ্বল আলোকমালার এবং হতাশ হৃদয়ে গভীর আশার সঞ্চার করেন। মানুষের মধ্যে জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টিরও সঞ্চার করেছে তাঁর এ আন্দোলন। দাসত্ব ও অবমাননার যে শৃঙ্খল জনগণকে আবদ্ধ করে রেখে ছিলো ইমাম হোসাইন(আ) বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে তা উপড়ে ফেলেন ও সমাজকে ইসলামী পথে চলার দীক্ষা দেন।
ইমামের এই আন্দোলন যে ধীরে ধীরে মানুষকে জাগিয়ে তুলেছে তার প্রমাণ মেলে হুর ইবনে ইয়াজিদ রিয়াহির ঘটনা থেকে। হুর ছিলেন ইয়াজিদের বাহিনীর বিখ্যাত বীর। তিনি ইমামের আন্দোলনের যথার্থতা উপলব্দি করে বিপথগামীদের কাতার থেকে বিছিন্ন হয়ে সত্যের কাতারে অর্থাৎ ইমামের সাথে এসে যোগ দিয়েছিলেন।
হজরত ইমাম হোসাইন (আ) ইয়াজিদের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দৃশ্যত: বিজয় লাভ করেননি । কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ) ও তার সঙ্গীদের মহান শাহাদাত মুসলিম সমাজকে প্রচণ্ড ভাবে আন্দোলিত করেছে। মুসলিম সমাজকে কঠোর আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের পথে উদ্দীপ্ত করেছে এবং উমাইয়া বংশের অত্যাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজ অনুধাবন করতে পারে যে, পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য অর্থাৎ ইমামরা সত্য ও ইসলামের পথ অনুসরণ করছেন। দুর্নীতির পঙ্কে আকণ্ঠ নিমজ্জিত উমাইয়াদের দু:শাসন কেবল ইসলামের মূল্যবোধ অনুসরণ করা থেকেই বিরত থাকেনি বরং প্রতিনিয়ত ইসলামী সমাজকে আদিম জাহেলিয়াতের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টাই করেছে।
এ ভাবে জনমনে ততকালীন শাসক গোষ্ঠীর প্রতি গভীর এক বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়। নবী বংশধরদের সহায়তা না দেয়ার জন্য হেজাজ ও ইরাকের জনমনে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এমনকি, ইসলামী গণজাগরণ তখন চারদিকে ব্যপ্তিলাভ করতে থাকে। আর এ ভাবে তাওয়াবীনে আন্দোলন, মোখতারের বিপ্লব ও অন্যান্য বিপ্লবের পটভূমি রচিত হয়েছে। আশুরার ঘটনার কথা উল্লেখ করতে যেয়ে আরবি ব্যাকরণের অন্যতম রচয়িতা আবুল আসোয়াদ দোয়েলি সব সময় সূরা আ'রাফের ২৩ আয়াতের উদ্বৃতি দিয়ে বলতেন
'তারা উভয়ে বললঃ হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব।'
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী আশুরার শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেছেন, আশুরা সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঐক্য ও সমবেদনা এবং এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ ঘটনা সমাজকে সচেতন, প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি লাভের গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টার প্রতি ইংগিত করছে। তিনি বলেন, আশুরার আমাদেরকে দীক্ষা দিচ্ছে যে ইসলামের সুরক্ষার দায়িত্ব যারা নেবেন তাদের অন্যান্য গুণের চেয়ে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি থাকা বেশি প্রয়োজনীয়। ইসলাম সম্পর্কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান নেই এমন ব্যক্তি নিজের অজান্তেই ধোঁকা খেয়ে ভুলপথে চলে যেতে পারে । ইবনে জিয়াদ ফাসেক বা বর্বর ছিলো না কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান ছিলো না।
আশুরা বিপ্লব ইসলামের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ৬১ হিজরি অর্থাৎ আজ থেকে এক হাজার তিনশ ৭১ বছর আগে এ বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন হজরত ইমাম হোসেইন (আ)। ইতিহাসে তার এ বিপ্লব স্বাধীনতার কামনায় ভরপুর তারুণ্য ও সাহসিকতার অমর গাঁথা হয়ে উঠেছে। আত্ম মর্যাদা ও ন্যায়বিচার যাদের কাম্য তারা আজো ইমাম হোসাইন(আ)এর দীক্ষার অনুসরণ করছেন এবং তার মতোই বলছেন, অপমাননাকর জীবন চাই না তার বদলে সম্মানের সাথে মৃত্যুই আমাদের কাম্য।(রেডিও তেহরান)