বাঙ্গালী
Sunday 1st of September 2024
0
نفر 0

আমাকে এ নারীর হাত হতে মুক্তি দাও!: দিশাহারা ইবনে জিয়াদ

কারবালায় ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ) ও তাঁর ৭২ জন সঙ্গী সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে খাঁটি ইসলাম বা পবিত্র মুহাম্মাদি ইসলামকে রক্ষার জন্য যে অনন্য বিপ্লবের ধারা গড়ে দিয়ে যান তার সংরক্ষণ ও ক্রমবিকাশ যাদের কাছে ঋণী ইমাম হুসাইনের বোন হযরত জাইনাব (সালামুল্লাহি আলাইহা) তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। প্রখর বুদ্ধিমত্তা, উপস্থিত জ্ঞান ও ধর্মীয় গভীর জ্ঞানের জন্য মহানবীর এই নাতনীকে বলা হত ‘বনি হাশিমের বিজ্ঞ নারী’ বা ‘আক্বিলেয়ে বনি হাশিম’।
আমাকে এ নারীর হাত হতে মুক্তি দাও!: দিশাহারা ইবনে জিয়াদ

কারবালায় ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ) ও তাঁর ৭২ জন সঙ্গী সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মাধ্যমে খাঁটি ইসলাম বা পবিত্র মুহাম্মাদি ইসলামকে রক্ষার জন্য যে অনন্য বিপ্লবের ধারা গড়ে দিয়ে যান তার সংরক্ষণ ও ক্রমবিকাশ যাদের কাছে ঋণী ইমাম হুসাইনের বোন হযরত জাইনাব (সালামুল্লাহি আলাইহা) তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। প্রখর বুদ্ধিমত্তা, উপস্থিত জ্ঞান ও ধর্মীয় গভীর জ্ঞানের জন্য মহানবীর এই নাতনীকে বলা হত ‘বনি হাশিমের বিজ্ঞ নারী’ বা ‘আক্বিলেয়ে বনি হাশিম’।
 
 
 
কুফায় ইবনে জিয়াদের দরবারসহ নানা স্থানে এবং দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে বন্দী অবস্থায় ইমাম হুসাইন (আ.)’র বোন হযরত জাইনাব (সালামুল্লাহি আলাইহা) যেসব সাহসী বক্তব্য রেখেছিলেন তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
 


ইতিহাসের পাতা থেকে তার সেইসব বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরছেন হুজ্জাতুল ইসলাম মো: আনিসুর রহমান ‘ইবনে জিয়াদের প্রতি জাইনাবে কোবরার উচিত জবাব: সৌন্দর্য ছাড়া কিছুই দেখিনি!’ শীর্ষক সংকলনে। এখানে তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:
 
 
 
বন্দীদেরকে কারবালা থেকে কুফায় স্থানান্তরের পর, কুফার গভর্নর ইবনে জিয়াদ এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যার উপলক্ষ ছিল বিজয়-উল্লাস করা ও বন্দীদেরকে জনগণের সামনে প্রদর্শন করা। জনগণের কাছে বিজয়-স্মারক উন্মোচন করা আর সর্বসাধারণের মধ্যে আলী পরিবারের প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণার কারণ তুলে ধরাও ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। স্বনামধন্য ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদেরকে দারুল ইমারায় তথা রাজদরবারের এই অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল।
 
 
 
বহু মানুষের ভিড়ের মধ্যে নির্দেশ দেয়া হল যে, বন্দীদেরকে নিয়ে আসা হোক!
 

বন্দীদেরকে আনা হল, হযরত জাইনাবে কোবরা ইবনে জিয়াদের প্রতি সম্পূর্ণ তোয়াক্কাহীনভাবে দরবারের এক কোণায় মাটিতে বসে পড়লেন। কয়েকজন নারীও তার চারপাশে বসলেন। যদিও হযরত জাইনাবে কোবরা’র পরনে আভিজাত কোনো পোশাক ছিল না এবং বন্দীর আলামত তার মধ্যে প্রস্ফুটিত ছিল কিন্তু তাঁর মর্যাদা, গাম্ভীর্য ও দৃঢ়তা ইবনে জিয়াদের দরবারের উপর এমন প্রভাব ফেলেছিল যে, সবার দৃষ্টি ছিল তাঁরই দিকে। ইবনে জিয়াদ জিজ্ঞাসা করল: কে এই মহিলা? জাইনাবে কোবরা কোন উত্তর দিলেন না। চারপাশের সবাই নিশ্চুপ রইল! ইবনে জিয়াদ দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পেল না। ফলে তৃতীয়বারও একই প্রশ্ন করে ইবনে জিয়াদ: কে এই মহিলা?
 

হযরত জাইনাবে কোবরা’র পাশে বসে থাকা একজন মহিলা উত্তর দিল: তিনি হচ্ছেন রাসূলের (সা.) কন্যা হযরত ফাতিমা (সা.)’র মেয়ে জাইনাব।
 

ইবনে জিয়াদ তার অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে কটাক্ষ করে বলল: আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানাই যে, তিনি তোমাদেরকে করেছেন অপমানিত এবং তোমাদের মধ্যে অধিকাংশের জীবন বিনাশের মাধ্যমে এটা প্রমাণ করেছেন যে, তোমাদের দাবী ছিল মিথ্যা!!!
 

হযরত জাইনাব পরিপূর্ণ সাহসিকতার সাথে দাঁতভাঙ্গা উত্তর দিলেন:
 
“সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা একমাত্র সেই মহান আল্লাহর জন্য যিনি তাঁর প্রেরিত পুরুষ হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে আমাদের মাথায় অতি সম্মান ও মর্যাদার মুকুট পরিয়েছেন, আমাদেরকে যে কোন ধরণের অপবিত্রতা হতে পুত:পবিত্র রেখেছেন, নিশ্চয়ই যারা পাপাচারী তারাই কেবল অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয় এবং যারা পাপাচার ও ব্যভিচার করে তারাই মিথ্যাবাদী! আল্লাহর প্রশংসা যে, আমরা সে রকম নই।”১
 

ইবনে জিয়াদ এই কঠোর উত্তর শুনে বলল: আল্লাহ তোমার ভাই ও তার পরিবারের সাথে কি করলো তা দেখেছো?! আল্লাহর কৃতকার্যকে তুমি কিরূপ দেখলে?!
 

এই মুহুর্তেই হযরত জাইনাবে কোবরা তাঁর ঐতিহাসিক কথাটি তুলে ধরলেন এবং আশুরা সম্পর্কে সবচেয়ে উচ্চ মাপের যে কথাটি বলা যেতে পারে সে কথাটি তুলে ধরলেন ও বললেন:
 

“আমি সৌন্দর্য ছাড়া কিছুই দেখিনি! তাঁরা ঐ ধরণের ব্যক্তি ছিলেন যাদের ভাগ্যে আল্লাহ শাহাদত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, সে জন্যই তাঁরা শাহাদতের মাধ্যমে তাদের চিরস্থায়ী জায়গায় পৌঁছে গেছেন কিন্তু খুব শীঘ্রই মহান আল্লাহ তোমাকে ও তাদেরকে একটি স্থানে একত্রিত করবেন। আর তুমি তখন তোমার কৃতকর্মের জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুত থেক এবং আল্লাহর বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রাখ, এবার তুমি দেখ ঐ বিচারের ক্ষেত্রে বিজয় কাদের জন্য? তোমার মা তোমার জন্য শোক পালন করুক হে মার্জনা’র পুত্র!”২
 

ইবনে জিয়াদ কখনো এ ধরণের ক্ষুরধার ও সুস্পষ্ট উত্তর আশা করেনি। তাই হযরত জাইনাবে কোবরা’র শক্তিশালী যুক্তি ও দৃঢ়-চিত্ত প্রতিরোধের সামনে নিজেকে পরাজিত মনে করেছে। ফলে সে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হল যার নমুনা তার চেহারায় ফুটে উঠেছিল। আর এ অবস্থায় তার পাশে থাকা একজন বলে উঠল: হে আমীর (সর্দার)! এই উক্তিগুলো একজন মহিলার আর আমাদের রীতি-নীতিতে এমনটা নেই যে, একজন মহিলার উক্তির ভিত্তিতে তাকে তিরস্কার করা হবে বা তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
 

ইবনে জিয়াদ হযরত জাইনাবে কোবরা’র বক্তব্যের বিষয়টি এভাবে সুরাহা করল:
 যে অবাধ্য ও বিদ্রোহীরা তোমাদের পরিবারের সদস্য তারা নিহত হয়েছে। আর এর মাধ্যমে আল্লাহ আমার আত্মাকে প্রশান্তি দান করেছেন।
 

হযরত জাইনাবে কোবরা তার কথায় বিমর্ষ হয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন:
 
“আমার নিজের জীবনের কসম! আমার সর্দার ও নেতাকে হত্যা করেছো, আমার পরিবার-পরিজনকে ধ্বংস করে দিয়েছ, আমার সকল ডাল-পালাগুলো ভেঙ্গে দিয়েছ, আমার মূল শিকড়কে কেটে ফেলেছ, যদি এত হত্যা, লুটপাট, আতঙ্ক ও নির্যাতন তোমার অন্তরকে প্রশমিত করে থাকে তাহলে আমিও বলবো যেন ঐ অন্তর সর্বদা এ ধরণের প্রশান্তিই অর্জন করে!”
 

ইবনে জিয়াদ যেহেতু জাইনাবে কোবরা’র কথার উত্তর দেওয়ার মত আর কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না তাই সে বলল: এই মহিলা তো ঐ সব নারীর মত যারা বিভিন্ন শব্দকে পরস্পরের সাথে জুড়ে দিয়ে নানা বাক্য সাজায় ও কাব্যিকদের মত কথা বলে! তার পিতাও এমনিভাবে শব্দ নিয়ে খেলা করতো ও কবিতা আবৃতি করতো!
 

হযরত জাইনাবে কোবরা ইবনে জিয়াদের এই কথারও উত্তর দিলেন: “কোথায় মহিলা আর কোথায় কাব্য দেখছ?! যে অবস্থায় আমি আপতিত হয়েছি এই অবস্থায় কোনক্রমেই কবিতা পাঠ করা যায় না, এ পর্যন্ত যা বলেছি তা তো কেবল আমার অন্তরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কিছু অংশমাত্র।”৩ (আগার জাইনাব না বুদ...গ্রন্থ হতে সংকলিত)
 

তথ্যসূত্র:
 ১। আল-ইরশাদ, খ.২, পৃ.১১৫; তারিখে তাবারী, খ.৪, পৃ.৩৪৯; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইবনে কাসীর), খ.৮, পৃ.২১০; মাকতালুল হুসাইন (আবু মাখনাফ আল-ইজদী), পৃ.২০৫; কাশফুল গাম্মা, খ.২, পৃ.৬৩; আ’লামুল ওয়ারা, পৃ.২৫১; মাসিরুল আহযান, খ.২, পৃ.২৯১; বিহারুল আনওয়ার, খ.৪৫, পৃ.১১৭।
 ২। লুহুফ, পৃ.১৬০; আমালী (সাদুক), পৃ.১৬৫।
 ৩। আল-ইরশাদ, খ.২, পৃ.১১৫; তারিখে তাবারী, খ.৪, পৃ.৩৪৯; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইবনে কাসীর), খ.৮, পৃ.২১০; মাকতালুল হোসাইন (আবু মাখনাফ আল-ইজদী), পৃ.২০৫; মাসিরুল আহযান, খ.২, পৃ.২৯১; কাশফুল গাম্মা, খ.২, পৃ.৬৩; আ’লামুল ওয়ারা, পৃ.২৫১; জাওয়াহিরুল মাতালিব ফি মানাকিবুল ইমাম আলী (ইবনুদ দামিশকী), খ.২, পৃ.২৯১; বিহারুল আনওয়ার, খ.৪৫, পৃ.১১
 
 
 
[ উল্লেখ্য, কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, ‘আমি সৌন্দর্য ছাড়া কিছুই দেখিনি!... আল্লাহর বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রাখ,-- এইসব বক্তব্য হযরত জাইনাবের মুখ থেকে শোনার পর নেকড়ের মত ক্ষিপ্ত হয়েও নির্লজ্জের মত জিয়াদ বলে, " আমি খুশি হয়েছি, কারণ, যা চেয়েছি তা পেয়েছি। "
 
জবাবে জাইনাব (সা.) বলেছিলেন," তুমি দুনিয়ার মাধ্যমে নেশাগ্রস্ত, প্রতারিত ও ফিতনাগ্রস্ত। তুমি কি মনে করেছ হুসাইনের পরে তুমি আনন্দের সঙ্গে পৃথিবীতে চিরদিন টিকে থাকবে? স্বস্তিতে থাকবে? কখনও না, তুমি স্বস্তির মুখ দেখবে না। তুমি কখনও তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে পারবে না। হে ইবনে জিয়াদ! তুমি নিজের হাতে নিজের ওপর যে কলঙ্ক লেপন করেছ তা অনন্তকাল পর্যন্ত থেকে যাবে।" (হযরত জাইনাবের এসব ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি সত্য হয়েছিল)

এতে দিশেহারা, অস্থির ও ক্ষিপ্ত হয়ে ইবনে জিয়াদ চিৎকার করে বলে: " আমাকে এ নারীর হাত থেকে মুক্তি দাও; ওদেরকে কারাগারে নিয়ে যাও।"
 
ইবনে জিয়াদ ও তার দলবল জনগণের প্রতিক্রিয়া ও বিদ্রোহের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তাই তারা জনগণের সম্ভাব্য প্রতিরোধ ও ক্ষোভ এড়ানোর জন্য নবী-পরিবারসহ কারবালার সব বন্দীদেরকে দামেস্কে পাঠানোর জন্য জন-মানবহীন অচেনা পথগুলো ব্যবহার করতে তাদের সেনাদের নির্দেশ দেয়।  এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: 'কুফায় জয়নাব (সা.)’র তেজোদৃপ্ত ভাষণে ইবনে জিয়াদের আতঙ্ক' শীর্ষক প্রবন্ধ।  (রেডিও তেহরান)] #
 
 


source : irib
0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আমাকে এ নারীর হাত হতে মুক্তি দাও!: ...
ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘প্রত্যাশা’ ...
বাস্তবতার দর্পনে ওহাবি মতবাদ (১১ - ...
চাকরিতে বাধা হিজাব ; নিরাপত্তা ...
ইরান মুসলিম জাতিগুলোর জন্য আদর্শ ...
সূরা আ'রাফ;(২৬তম পর্ব)
ভারতে যে দাঙ্গা মুসলিম নারীদের ...
সুফীবাদ প্রসঙ্গে
মিয়ানমারে ইমাম হুসাইন (আ.) এর ...
পোপ ও ইয়েমেনের মানুষ হত্যাকারীরা

 
user comment