আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা –আবনা- : আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজি ‘বর্তমান বিশ্বে তাকফিরি মুভমেন্টসমূহ’ শীর্ষক দ্বিতীয় সম্মেলনে আগত দেশী ও বিদেশী অতিথিদেরকে স্বাগত জানিয়ে, এ সম্মেলন মানব জাতির জন্য বিশেষতঃ মুসলিম বিশ্বের জন্য বিশেষ কার্যকারিতা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন : এটি কোন রাজনৈতিক সম্মেলন নয়, একটি ইলমি সম্মেলন। অতএব, আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হবে ইলমি ও জ্ঞানভিত্তিক। আমাদের উচিত প্রতিটি মাযহাবের প্রতি সম্মান দেখানো, আর এটাই হচ্ছে মূলনীতি।
বিশিষ্ট এ মারজায়ে তাকলিদ বলেন : আমরা এ সম্মেলনের মাধ্যমে দু’টি লক্ষ্যে পৌঁছুতে চাই। প্রথমতঃ আমরা চাই তাকফিরি চিন্তাধারা উৎস সম্পর্কে পরিচিত হতে; যাতে সহজ-সরল যুবকরা তাকফিরি দলগুলোর দ্বারা প্রতারিত হয়ে তাদের দিকে আকৃষ্ট না হয়। দ্বিতীয়তঃ মুসলিম আলেম সমাজ যাতে ঐক্যবদ্ধভাবে তাকফিরিদের থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়ে তাকফিরিদের অশুভ সংস্পর্শ থেকে ইসলামকে রক্ষা করেন।
তার সংযোজন : আমাদের উচিত এ কথার ঘোষণা দেয়া যে, যারা ইসলাম ধর্মকে হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাতের ধর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করে তারা আমাদের থেকে নয়। তারা এ কাজের মাধ্যমে ইসলাম বিরোধীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে, ফলে বিশ্বে ইসলামভীতি বৃদ্ধি পায়। আমরা মহান আল্লাহ্কে রহমান (পরমকরুণাময়) ও রাহিম (অসীম দয়ালু) হিসেবে বিশ্বাস করি এবং সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতের ভাষ্যমতে মহানবি (স.) সারা বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ।
বিশিষ্ট এ মুফাসসির আরো বলেন : মহান আল্লাহ্ সকল মানুষের সম্পর্ককে ঐক্যের মাঝে রেখেছেন, অপরাধকর্মের মাঝে নয়। সূরা বাকারাহ’র ৮৪ নং আয়াতে বলা হচ্ছে : ((و قولوا للناس حسنا)) “তোমরা মানুষের সাথে উত্তম ভাষায় কথা বলো”।
আয়াতুল্লাহ মাকারেম উপস্থিতদের উদ্দেশ্যে বলেন, মহানবি (স.) যে ইসলাম এনেছেন সে সম্পর্কে এ ধরনের সেমিনারে আলোচনা হয়। পথভ্রষ্ট তাকফিরিরা যে সকল কথা বলে তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।
এরপর তিনি নিম্নোক্ত বিষয়াদির প্রতি আলোকপাত করেন:
বিভ্রান্ত এ জাতি ও তাকফিরের বিষাক্ত বৃক্ষ প্রথম যে ফলটি ইসলামের জন্য দিয়েছে তা চিন্তার উর্ধ্বে ক্ষতিকারক। তারা নৃশংসভাবে ও চরম বর্বরতার সাথে মুসলিম ও অমুসলিমদেরকে হত্যা করে চলেছে। এরচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হল তারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সময় ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবির ধ্বনি উচ্চারণ করে।
আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মাজার ও ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করে তারা অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। যে সকল অর্থনৈতিক অবকাঠামো তারা ধ্বংস করেছে, হয়তবা আগামী ৫০ বছরেও তা নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। সম্প্রতি তারা ইরাকে এমন কিছু অমুসলিমকে হত্যা করেছে, মুসলমানদের সাথে যাদের কোন দ্বন্দ ছিল না। এরচেয়েও জঘন্যভাবে তারা অমুসলিম নারীদেরকে বন্দী হিসেবে বাজারে নিলামে তুলেছে।
পবিত্র কুরআনের নির্দেশ, যে সকল ব্যক্তিরা তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নয় তাদের সাথে উত্তম আচরণ কর। তাদের বিষয়ে ন্যায়বিচার অবলম্বন কর, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ ন্যায়পরায়নদেরকে ভালবাসেন। অতএব, তাদের প্রতি হামলার প্রশ্নই আসে না বরং তাদের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি করা যায়।
তাকফিরিরা গোটা বিশ্বকে অনিরাপদ করে তুলেছে। কারণ তারা কোন আইনের প্রতিই সম্মান দেখায় না। ছোট-বড় কারো উপরই তারা দয়ার্দ্রতা দেখায় না। হয়তবা কেউ কেউ তাকফিরিদেরকে ইসলামের প্রাথমিক যুগে আবির্ভূত খাওয়ারেজে’র (খারেজিদের) সাথে সম্পৃক্ত করতে চাইবেন। কিন্তু খারেজিরা কখনই এ ধরনের অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়নি। তারা এমন হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়নি। তারা অমুসলিম নারীদেরকে বাজারে নিলামে তোলেনি। জিহাদুন নিকাহ’র নামে পতিতাবৃত্তির প্রচলন ঘটায়নি। তাকফিরিরা তাদের চেয়ে অধিক বিপজ্জনক ও ধ্বংসাত্মক। এক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হল, ঐক্যবদ্ধভাবে এবং যুক্তি ও দলিলের মাধ্যমে বিভ্রান্ত এ চিন্তাকে সমূলে উৎপাটন করা।
এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রাখা জরুরী যে, তাকফিরিদের শত্রুতা শুধুমাত্র শিয়াদের সাথে নয়। তারা সকল ইসলামি আকিদা পরিপন্থী এবং তাদের রক্ত ও সম্পদকে তারা মুবাহ মনে করে। এ কথার সপক্ষে যুক্তি হচ্ছে; ওয়াহিব চিন্তাধারার উদ্ভাবক তার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলেন : ‘মুশরিক আলেমরা এ বিষয়টি স্বীকার করেছে যে, হারামাইন শারিফাইন -মক্কা ও মদিনা-, বসরা ও ইরাকের জনগণ এতদিন পর্যন্ত মুশরিক ছিল।’ যেভাবে আপনারা সকলেই অবগত যে, ওয়াহাবিরা মক্কা ও মদিনাকে দখল করে নেয়ার পর একটি সনদ তৈরী করে সকল মুফতিকে তাতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল। মুফতিদেরকে এ কথাটি স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়েছিল যে, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের তওহিদ হচ্ছে খাঁটি এবং মক্কা ও মদিনার যে তওহিদ তা হচ্ছে শিরকপূর্ণ। তাদের কুফরটি এমনই যে, তাদের রক্ত ও সম্পদকে হালাল করে দেয় এবং তাদের অনন্তকালের জন্য জাহান্নামবাসী করে।
সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি তার একটি রেসালাহ’তে উল্লেখ করেছেন, যে ব্যক্তি সৌরজগতে ‘সূর্য অনঢ় থাকা’র প্রতি বিশ্বাস রাখে তার রক্ত মুবাহ ও হালাল। আরো স্পষ্ট করে বলতে চাই তার ভাষ্যমতে; যে ব্যক্তি সূর্যের অনঢ় থাকার উপর বিশ্বাসী যদি সে তওবা না করে তবে তার রক্তকে তিনি হালাল বলে জ্ঞান করেন। লক্ষ্য করুন তাকফিরি চিন্তাধারা মধ্যযুগের চেয়েও এগিয়ে গেছে। এ বিষয়ক সকল বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে সূর্য অনঢ়, তাহলে এ সকল ব্যক্তিদের রক্ত সৌদি গ্রান্ড মুফতির দৃষ্টিতে কোন মূল্য রাখে না ও মুবাহ(!)। চিন্তা করুন এ বিষয়টি ইসলাম ধর্মের উপর কি ধরনের আঘাত হানতে পারে। আয়াতের ভুল তাফসির করার কারণে এ ধরনের ভয়ংকর ফতওয়া দিয়েছে তারা।
মুসলিম আলেমগণ জানেন এবং আমিও বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাই যে, মূলতঃ তওহিদের বিষয়ে তাদের বিরাট এক ভুল ধারণা থেকে তাকফিরের জন্ম। পবিত্র কুরআন ও মহানবি (স.) এর সুন্নতের ভিত্তিতে, তাদের এ ভুল চিন্তা তাদেরকে মূল বিষয়বস্তু হতে দূরে নিক্ষেপ করেছে। আর তাই তারা সকলকে তাকফির (কাফের বলে আখ্যায়িত) করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, আল্লাহর নবী (স.) ও আল্লাহর আওলিয়াদেরকে উসিলা হিসেবে গ্রহণ করাকেও তারা কুফর বলে আখ্যায়িত করে। এমনকি কুফরের যে বিভিন্ন অর্থ রয়েছে সে বিষয়েও তারা গাফিল।
দীর্ঘ ১৪০০ বছর যাবত মুসলমানরা আল্লাহর ওলিদের মাজারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আসছে। তাদের মাজার যেয়ারতে যায়। ১৪০০ বছর যাবত সকল মুসলমানই কি তাহলে কাফের ছিল এবং তাদের সকলের রক্ত ও সম্পদ কি মুবাহ? এগুলো কি কুসংস্কার নয়? উপস্থিত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত আলেমগণ এবং যারা আমার কথা শুনছেন তাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
তাকফির সমস্যাটি বর্তমানে শুধু মুসলিম বিশ্বের জন্য নয় বরং সারা বিশ্বের মানুষের জন্য সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সকলেই এ বিষয়টি স্বীকার করে যে, এ সমস্যা শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে সমাধানযোগ্য নয়। অবশ্যই সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং গণমাধ্যমের সহযোগিতায় এর মোকাবিলা করতে হবে। যাতে এ বিভ্রান্ত চিন্তাকে সমূলে উৎপাটন করা যায়। মুসলিম বিশ্বের আলেমদের উচিত হবে যুক্তি ও দলিলের ভিত্তিতে একে উপড়ে ফেলা। রাজনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে একে ধ্বংস করা সম্ভব নয়, কারণ প্রতিদিনই অজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। এ কারণে আমরা গতবছর তাকফিরি চিন্তাধারার বিপদ বিষয়ক সম্মেলন আয়োজনের পর গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশ করেছি। যাতে এর মাধ্যমে আমরা তাকফিরি মুভমেন্টগুলোর মোকাবিলা করতে পারি। আমরা আশাবাদী যে, ওলামা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগণ এ সকল গ্রন্থ হতে অধিক উপকৃত হবেন।
ওয়াহাবি আলেমরা বিশেষভাবে সৌদি আলেমদের উদ্দেশ্যে আমি বন্ধুত্ব পরায়নতার সাথে আহবান জানাতে চাই তারা যেন তাদের মূল গ্রন্থসমূহে তাকফির বিষয়ক যে সকল লেখা রয়েছে সেগুলোকে সরিয়ে ফেলে তদস্থলে যে সকল বিষয়ে মহানবি (স.) গুরুত্বারোপ করেছেন সেগুলোকে স্থলাভিষিক্ত করে। পাশাপাশি ইসলামি দেশসমূহে যে সকল তাকফিরি চিন্তা রয়েছে সেগুলোকে তাদের বইগুলোতে থেকে সরিয়ে ফেলার আহবান জানাচ্ছি। মানুষের মাঝে সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে নিজের ভুল সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর তা শুধরে নেয়।
বিশ্বের সকল রাজনৈতিক নেতার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, যে সকল দেশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে তাকফিরি চিন্তাধারার সমর্থন করে তাদের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কেননা এমন একদিন আসবে যেদিন ‘তাকফির’ তাদেরকেও গ্রাস করবে। বিভ্রান্ত এ দলটি কোন সীমানা চেনে না।
আমি মুসলিম দেশসমূহের সম্মানিত রাষ্ট্রদূতদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি, এ বিষয়টিকে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দিন। যাতে এরচে বেশী অপরাধকর্মের সাক্ষী আমরা না হই।
তাকফিরি চিন্তার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও চিন্তাগত সমাধানের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর তাই এ সমস্যার মোকাবেলায় মধ্যপ্রাচ্যে একটি চ্যানেল চালু করা অত্যন্ত জরুরী; যা সকল ইসলামি দেশের অংশগ্রহণেই চালু হবে। যাতে এর মাধ্যমে তাকফিরিদের প্রকাশ্যে আকর্ষণীয় শ্লোগানসমূহের বাস্তব রূপ সকলের সামনে ফুটে ওঠে। আমরা আন্তর্জাতিক এ চ্যানেল তৈরিতে নিজেদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করছি।
যারা অবমাননা করাকে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করে তারা মূলতঃ শত্রুদের চরকাতেই তেল দিচ্ছে। মহান আল্লাহর কাছে কামনা করি যেন বিশ্বের রাজনৈতিকদেরকে অধিক সচেতনা, যোদ্ধাদেরকে শক্তি ও আলেমদেরকে তওফিক প্রদান করুন, যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকফির নামক এ ফেতনার আগুন নেভাতে পারে এবং পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ একটি স্থানে রূপান্তরিত করতে পারে।#
source : abna24