সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৩২-১৩৫
সূরা আল আ'রাফের ১৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَقَالُوا مَهْمَا تَأْتِنَا بِهِ مِنْ آَيَةٍ لِتَسْحَرَنَا بِهَا فَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِينَ
“তারা (তথা ফেরাউন ও তার দলবল মুসা-আ.কে) আরও বলল, আমাদের উপর জাদু করার জন্য তুমি যে নিদর্শনই নিয়ে আস না কেন আমরা কিন্তু তোমার উপর ঈমান আনব না।” (৭:১৩২)
এই আয়াতসহ কুরআনের এ জাতীয় আরো আয়াত থেকে বোঝা যায়, বেশিরভাগ কাফিরই সত্যকে বোঝার পরও তা অস্বীকার করে কুফরি করেছে। অহংকার ও দুর্বিনীত স্বভাবের কারণেই তারা কুফরি করত। এই আয়াতেও কাফিররা হযরত মুসা (আ.)-কে বলছে যে, তুমি সুনিশ্চিত থাক যে যত দলিল-প্রমাণই আমাদের দেখাও না কেন আমরা তোমার ওপর ঈমান আনছি না। অর্থাত ঈমান আনারই কোনো ইচ্ছেই আমাদের নেই। অথচ সত্য-সন্ধানী মানুষ হলে তারা এটা বলত যে, যদি বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখাতে পারেন তাহলে আমরা আপনার আহ্বান মেনে নেব ও আপনার প্রতি ঈমান আনব। তাই দেখা যায় ফেরাউনের দরবারের সুদক্ষ জাদুকররা গোড়া ও দুর্বিনীত ছিল না বলে যখনই এটা বুঝতে পেরেছে যে হযরত মুসা (আ.) যা দেখাচ্ছিলেন তা জাদু নয় তখনই তারা তাঁর প্রতি ঈমান আনে। কিন্তু ফেরাউনের সাঙ্গপাঙ্গরা জাদুবিদ্যা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও জাদুকরদের বক্তব্য মেনে নিতে পারেনি। তারা এরপরও মুসা (আ.)-কে জাদুকর বলে অপবাদ দিচ্ছিল।
এ আয়াতের দু’টি শিক্ষা হল:
এক. নবী-রাসূলদের জাদুকর বলে অপবাদ দেয়া ছিল সবচেয়ে বেশি প্রচলিত রীতি। কিন্তু নবী-রাসূলরা কখনও ময়দান ছেড়ে দেননি, বরং নানা অপবাদ ও বাধা সত্ত্বেও দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
দুই. অহংকার ও গোড়ামি এক ধরনের মানসিক রোগ। এ রোগ মানুষকে সত্যের তথা ধর্মের পথ মেনে নিতে বাধা দেয়।
সূরা আল আরাফের ১৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الطُّوفَانَ وَالْجَرَادَ وَالْقُمَّلَ وَالضَّفَادِعَ وَالدَّمَ آَيَاتٍ مُفَصَّلَاتٍ فَاسْتَكْبَرُوا وَكَانُوا قَوْمًا مُجْرِمِينَ
“সুতরাং আমি (আমার ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে) তাদের উপর পাঠিয়ে দিলাম তুফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত (প্রবাহ) প্রভৃতি বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক। তারপরেও তারা গর্ব করতে থাকল। বস্তুতঃ তারা ছিল অপরাধপ্রবণ।” (৭:১৩৩)
কাফিরদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও গোঁড়ামি অব্যাহত থাকায় আল্লাহ ফেরাউনের সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক অনেক আজাব বা শাস্তি পাঠালেন। তাদের বেশিরভাগই ছিল কৃষিজীবী। আকাশ থেকে এত বৃষ্টি বর্ষিত হল যে বন্যার পানির নিচে বহু অঞ্চল তলিয়ে গেল। পঙ্গপাল ও অন্যান্য পোকামাকড় তাদের ফসল নষ্ট করে দিল। তাদের ব্যবহারের পানি রক্তে পরিণত হল। ফলে তাদের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। আর এসবই ছিল তাদের অহংকার, খোদাদ্রোহিতা ও পাপের শাস্তি। তাওরাতেরও বিভিন্ন অংশে কুরআনে বর্ণিত এইসব শাস্তির কথা উল্লেখিত হয়েছে।
এ আয়াতের দু’টি শিক্ষা হল:
এক. জীবজন্তু আল্লাহর নির্দেশিত দায়িত্ব পালন করে। কখনও তারা আল্লাহর রহমত ছড়িয়ে দেয়, যেমনটি মাকড়া গুহার মধ্যে বিশ্বনবী (সা.)-কে রক্ষা করেছিল। আবার কখনও কখনও তারা আল্লাহর শাস্তি কার্যকর করে, যেমন, কৃষি ক্ষেতে পঙ্গপালের আক্রমণ।
দুই. পাপ ও অহংকার সত্যকে অস্বীকারের পথ খুলে দেয়।
সূরা আল আরাফের ১৩৪ ও ১৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَمَّا وَقَعَ عَلَيْهِمُ الرِّجْزُ قَالُوا يَا مُوسَى ادْعُ لَنَا رَبَّكَ بِمَا عَهِدَ عِنْدَكَ لَئِنْ كَشَفْتَ عَنَّا الرِّجْزَ لَنُؤْمِنَنَّ لَكَ وَلَنُرْسِلَنَّ مَعَكَ بَنِي إِسْرَائِيلَ (134) فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُمُ الرِّجْزَ إِلَى أَجَلٍ هُمْ بَالِغُوهُ إِذَا هُمْ يَنْكُثُونَ (135)
“আর তাদের উপর যখন কোন আযাব আসত তখন তারা বলত, হে মূসা! আমাদের জন্য তোমার পরওয়ারদেগারের কাছে সে বিষয়ে দোয়া কর যা তিনি তোমার সাথে ওয়াদা করে রেখেছেন (ও তোমার দোয়া কবুল করেন)। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে এ আযাব সরিয়ে দাও, তবে অবশ্যই আমরা ঈমান আনব তোমার উপর এবং বনী-ইসরাঈলদেরকে (মুক্তি দেব ও) তোমার সাথে যেতে দেব।” (৭:১৩৪)
“অতঃপর যখন (মুসা-আ.-এর দোয়ার কারণে) আমি তাদের উপর থেকে শাস্তিকে সেই নির্দিষ্ট কাল (যা তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল) পর্যন্ত পৌঁছার আগেই তুলে নিতাম , সাথেসাথেই তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করত।” (৭:১৩৫)
ফেরাউনের সম্প্রদায়ের ওপর নানা ধরনের আসমানী বালা-মুসিবত নাজেল হয়েছিল তাদের অবাধ্যতা বা নাফরমানির কারণেই। তারাও বুঝতে পেরেছিল যে, এসব শাস্তি প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়। তাই তারা ওইসব শাস্তি তুলে নেয়ার জন্য মুসা (আ.)-কে বলত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে। তারা এই ওয়াদাও দিয়েছিল যে, যদি তুমি এইসব শাস্তি তুলে নিতে পার তাহলে তোমার ওপর ঈমান আনব এবং বনি-ইসরাইল জাতিকে আর কষ্ট দেব না। তাদেরকে স্বাধীন করে দেব যাতে তারা তোমার সঙ্গী হতে পারে।
হযরত মুসা (আ.) তাদেরকে আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, এইসব শাস্তি বা আজাব কতদিন ধরে অব্যাহত থাকবে যাতে ফেরাউনের সম্প্রদায় বুঝতে পারে যে শাস্তিগুলো প্রাকৃতিক দূর্যোগ নয় বরং খোদায়ী আজাব। যাই হোক, তিনি তাদের অনুরোধ মেনে নিয়ে শাস্তি বন্ধের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করায় তাঁর দোয়া কবুল হয়। অর্থাত শাস্তি বন্ধ হয়ে যায় নির্ধারিত মেয়াদের আগেই। কিন্তু ফেরাউনের জাতি এইসব মোজেজা এবং খোদায়ী নিদর্শন দেখার পরও হযরত মুসা (আ.)-কে দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে ও পুনরায় খোদাদ্রোহীতায় নিমজ্জিত হয়।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হল:
এক. বিপদ-মুসিবত দূর করার জন্য আল্লাহর ওলিদের উসিলা করা খুবই কার্যকর পদ্ধতি। কাফিররা তাদের ওপর নেমে আসা খোদায়ী শাস্তি বন্ধ করার জন্য হযরত মুসা (আ.)-এর শরণাপন্ন হয়ে বলেছিল, আপনি আমাদের ওপর থেকে এইসব শাস্তি তুলে নেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন।
দুই. মানুষের জীবনের সুখ ও দুঃখ কোনো ঘটনাক্রমিক ব্যাপার নয়, বরং সুনিয়ন্ত্রিত ও স্পষ্ট বিধানের আওতাধীন যা কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিন. মানবজাতিকে খোদাদ্রোহী ও জালেম শক্তির হাত থেকে রক্ষা করা ছিল নবী-রাসূলদের মিশনের অন্যতম লক্ষ্য।
source : alhassanain