মহাকৌশলী আল্লাহর সৃষ্টিকূলের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অপার বিস্ময়ের নানা স্বাক্ষর। মহান আল্লাহর বিস্ময়কর অশেষ সৃষ্টির মধ্যে পানি অন্যতম।
পানির অপর নাম জীবন। মানুষের জীবনের অনেক মৌলিক দিকই পানির ওপর নির্ভরশীল। এ জন্যই দেখা যায় অতীতের বড় বড় সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল নদী-তীরে। যেমন, সিন্ধু নদ, নীল নদী এবং ইরাক অঞ্চলের দজলা-ফোরাত নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বড় বড় সভ্যতা। মহান আল্লাহ সুরা আম্বিয়ার ত্রিশ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম।” এ থেকে বোঝা যায়- পানিই জীবন্ত সব কিছুর উৎস। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা ভূমি ও প্রকৃতি, উদ্ভিদ, ফুল-ফল, লতা-পাতা, নদ-নদী, সাগর, মৎসকূল ও অন্যান্য জলজ প্রাণী সবই পানিরই অবদান। আর মহান আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন পানি। পানি জীবনের উৎস এবং জীবনের সংরক্ষকও পানি। মহান আল্লাহর অনন্য নেয়ামত পানি সব কিছুকে পাক-সাফ বা পবিত্র করে।
মহান আল্লাহ সুরা ওয়াক্বেয়ার ৬৮ থেকে ৭০ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “তোমরা যে পানি পান কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আন, না আমি বর্ষন করি? আমি ইচ্ছা করলে তাকে লোনা করে দিতে পারি, অতঃপর তোমরা কেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর না?”
সুরা মুলকের ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি তোমাদের পানি ভূ-গর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদেরকে সরবরাহ করবে পানির স্রোতধারা?”
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর প্রশংসা করে”। তাহলে পানিসহ সৃষ্টিকূলের সব কিছুই এবং সৃষ্টির প্রতিটি অনু,পরমাণু কি আল্লাহর প্রশংসা করে না এবং এসব কিছুরই কি উপলব্ধির বা বোঝার ক্ষমতা নেই? নিঃসন্দেহে পানিসহ বিশ্বের সব সৃষ্টিই জেনে শুনে বা বুঝে-শুনেই আল্লাহর প্রশংসা করে ও তাঁকে সম্মান করে।
সম্প্রতি জাপানের একজন গবেষক এক গবেষণায় এটা দেখেছেন যে, পানির অনুগুলো মানবীয় অনুভূতির মাধ্যমে ও মানুষের কথায় প্রভাবিত হয়। জমাটবদ্ধ পানির বিভিন্ন নমুনার মধ্যে তুলনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে ওই গবেষক এ বিষয়টি প্রমাণ করেছেন। অধ্যাপক মাসারু ইমোটো এ ব্যাপারে দশ হাজার পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে “পানির বার্তা” শীর্ষক একটি বই লিখেছেন। তিনি মনে করেন, পারিপার্শিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি পানির অনু-পরমাণুর ওপর প্রভাব ফেলে।
পানির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় অংশই পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলে বলে ইমোটো উল্লেখ করেছেন। মানুষের আবেগ-উত্তেজনা, চিন্তা-ভাবনা, মতামত, সঙ্গীত, দোয়া ও মুনাজাত পানির অনু-পরমাণুর ওপর প্রভাব ফেলে বলে তিনি প্রমাণ করেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানিকে বলেছেন, “ভালবাসি”। এরপর তিনি ওই পানিকে বরফে পরিণত করে তার অনুগুলোকে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে দেখেছেন, সেগুলো বেশ সুন্দর হয়েছে। এরপর তিনি পানিকে ” ভালবাসি না” বলে একইরকম পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখেছেন যে এর অনুগুলো খুবই অসুন্দর হয়ে গেছে।
অধ্যাপক মাসারু ইমোটো নানা গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, বিভিন্ন উৎস ও পরিবেশ-পরিস্থিতি ভেদে পানির স্ফটিকের গঠনগুলো বিভিন্ন ধরণের হয়। যেমন, ঝর্ণার পানি ও প্রবাহমান পানির স্ফটিক খুবই সুন্দর হয়ে থাকে। অন্যদিকে ঘনবসতিপূর্ণ ও শিল্প-কারখানা সংলগ্ন অঞ্চলের পানি এবং বাঁধের পেছনে জমে থাকা পুরনো পানির স্ফটিক দেখতে এলোমেলো বা এবড়োথেবড়ো কাঁচের মত হয়। যেসব পানি পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার পর এখনও লোকালয়ের মানুষের সংস্পর্শে আসেনি ও মানুষের নেতিবাচক চিন্তার শিকার হয়নি বা তাজা রয়েছে সেসব পানির স্ফটিকও সুন্দর হয়।
এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি, পবিত্র কোরআনের এ আয়াতের কথা যেখানে বলা হয়েছে, “হে ঈমানদাররা, তোমরা অনেক অনুমান বা সন্দেহ থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ।”
জাপানি অধ্যাপক মাসারু ইমোটোর গবেষণায় এটাও দেখা গেছে যে, দোয়া বা প্রার্থনা খুব দ্রুত পানির অনুর ওপর প্রভাব ফেলে। তার মতে দোয়া পানিসহ সব কিছুকেই সুন্দর করে। তিনি বলেছেন, “মুসলমানরা পানি পান, খাবার খাওয়া ও ঘুমানোসহ প্রত্যেক কাজের আগে পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত ” বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ” বা “পরম করুণাময় ও অনন্ত দাতা আল্লাহর নামে” শীর্ষক যে বাক্য বা আয়াত উচ্চারণ করে থাকে তা পানির স্ফটিকের ওপর বিস্ময়কর প্রভাব ফেলে থাকে। এ বাক্যের প্রভাবে পানির স্ফটিক খুবই সুন্দর রূপ নেয়। ইসলাম পানি পানের আগে কেন ” বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ” বলার বিধান দিয়েছে তা এ ঘটনা থেকেও বোঝা যায়। »
ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে পবিত্র কাবা ঘরের পাশে অবস্থিত জমজম কুয়ার পানি সবচেয়ে পবিত্র। এ কুয়া মহান আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতার এক মহান নিদর্শন। জাপানি অধ্যাপক মাসারু ইমোটো জমজম কুয়া সম্পর্কে তার গবেষণার কথা তুলে ধরে বলেছেন, ” জমজম কুয়ার পানির সমতুল্য কোনো পানি পৃথিবীতে নেই। বিশ্বের সব ধরণের পানির স্ফটিকের চেয়ে এই পানির স্ফটিকের গঠন ভিন্ন ধরণের। পরীক্ষায় দেখা গেছে, জম জম কুপের পানির বৈশিষ্ট্য অন্য সব পানির বৈশিষ্ট্যের চেয়ে ভিন্ন। যেমন, জমজমের পানি ছাড়া অন্য সব পানি দীর্ঘকাল আবদ্ধ অবস্থায় থাকলে ও পুরনো হতে থাকলে এসব পানির স্ফটিকের সুন্দর রূপ নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু জমজমের পানির স্ফটিক সহজেই তার সুন্দর রূপ হারায় না। এ ছাড়াও পরীক্ষায় দেখা গেছে, জমজমের পানির মাত্র এক ফোটা এক হাজার ফোটা সাধারণ পানিতে মেশানো হলে সেসব পানিও জমজমের পানির বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। পরীক্ষাগারে সব ধরণের পরীক্ষা ও গবেষণা চালিয়েও এই পানির কোনো একটি বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। আর এর কারণ কী, তা আজও আমরা জানতে পারিনি। তাই এটা স্পষ্ট, জমজমের পানি কোনো সাধারণ পানি নয়। ”
ইসলামের মহান নেতৃবৃন্দ জমজমের পানি পান করার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, ” জমজমের পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পানি। এ কূয়ার পানি দেহ-মনকে সবচেয়ে বেশি চাঙ্গা করে। জমজমের পানি কখনও দূর্গন্ধময় হয় না। এ পানিতে রয়েছে রোগের চিকিৎসা এবং এ পানি কখনও শুকায় না। ”
অধ্যাপক মাসারুর পানি সংক্রান্ত গবেষণায় রয়েছে মানুষের জন্য অনেক শিক্ষা। পানিসহ যে কোনো বস্তুর মধ্যেই আমরা যদি ইতিবাচক শক্তির যোগান দেই তাহলে সেসবও আমাদের ইতিবাচক শক্তি যোগাবে। পানির অসুন্দর স্ফটিক যদি আবারও সুন্দর হতে পারে তাহলে মানুষও তওবার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে গোনাহ ও পংকিলতামুক্ত হতে পারে। তওবা করলে আল্লাহ তওবাকারীর পাপগুলোকে সৎকর্মে পরিণত করবেন বলে ওয়াদা দিয়েছেন। (সুরা ফোরকান, ৭০) সুরা বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তওবাকারীদেরকে পবিত্র মানুষদের পাশাপাশি স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রদের ভালবাসেন”। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)ও বলেছেন, “যে গোনাহ থেকে তওবা করল, সে ব্যক্তি গোনাহ করেনি এমন ব্যক্তির সমান।”
সব কাজের আগে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলার মাধ্যমে আমাদের উচিত আল্লাহর নেয়ামতগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কৃতজ্ঞতা বরকত ও সুফলকে বাড়িয়ে দেয়। ইতিবাচক চিন্তা ও সদ্চ্ছিার জন্য রয়েছে অনেক সওয়াব বা পূণ্য। এভাবে পানির বার্তাগুলো রয়েছে আমাদের জীবন এবং সমাজকে সুস্থ, সুন্দর, ধর্মমুখি, পবিত্র ও আনন্দময় করার অনেক শিক্ষা ।(তেহরান রেডিও)