নাহজুল বালাগায় চিত্তাকর্ষক যেসব বিষয় রয়েছে, ইবাদাত এবং আল্লাহর জিকির তার মধ্যে অন্যতম। ইবাদাত সম্পর্কে মানুষের মাঝে যেসব দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় তা অভিন্ন নয়। কেউ কেউ ইবাদাত সম্পর্কে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন এবং কেবল এক ধরনের দায়িত্ব হিসেবে পালন করেন। আবার অনেকেই ইবাদাতকে দেখেন আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই নাহজুল বালাগায় লক্ষ্য করা যাবে। ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে ইবাদাত হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্তির সিঁড়ি এবং আল্লাহকে সাধ্যমতো চেনার আন্তরিক প্রয়াস।অন্যভাবে বলা যেতে পারে,বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো ইবাদাত। আলী (আ) ইবাদাতের আত্মা বলতে আল্লাহকে স্মরণ করাকেই বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন- আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর জিকিরকে অন্তরের মরীচা দূর করার উৎসের সাথে তুলনা দিয়ে বলেছেন এর মাধ্যমে শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং আনুগত্য লাভ করে। এরকম সবসময়ই ছিল এবং আছে যে,আল্লাহ কালের সর্বযুগেই এমনকি যেসময় নভী-রাসূলগণ ছিলেন না তখনো এমন কিছু বান্দার অস্তিত্ব রেখে দিয়েছেন এবং এখনো রক্ষা করছেন যাঁদের সাথে তিনি তাঁর অনেক রহস্য নিয়ে কথা বলেন এবং তাদের বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী আল্লাহ তাঁদের সাথে কথা বলেন। আলী (আ) এ ধরনের ইবাদাতকারীদের অবস্থান সম্পর্কে বলেন-ফেরেশতারা তাঁদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাদের ওপর শান্তির ছায়া নেমে এসেছে। তাঁদের জন্যে আকাশের দ্বারগুলো উন্মুক্ত হয়ে গেছে। তাঁদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহের শেষ নেই। আল্লাহর বন্দেগি করার মাধ্যমে তাঁরা আল্লাহর দরবারে অনেক উচ্চ মর্যাদা ও অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। তাঁদের কর্মকাণ্ড তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি আল্লাহর পছন্দনীয় বলেই প্রশংসনীয় হয়েছে। যাঁরা এভাবে আল্লাহকে ডাকেন,তাঁরা আল্লাহর ক্ষমা ও মাগফেরাতের সুগন্ধি অনুভব করেন এবং গুনাহের কৃষ্ণ পর্দা অপসারণকে অনুভব করেন।
ইসলামে ইবাদাত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে সমান্তরাল। আর ইবাদাত বিষয়টাই ইসলামে সমষ্টিগত, ব্যক্তিগত নয়। অর্থাৎ সবাই মিলে একত্রিত হয়ে এই ইবাদাত পালনের বিধান রয়েছে ইসলামে। এতে ব্যাপক সামাজিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে পালনীয় ইবাদাত যে নেই তা নয়। তবে সেগুলোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যা পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি তাঁর জীবনের করণীয় কর্মের অংশের সাথে পরিচিত হয়। যেমন নামায। নামায হলো ইবাদাতের পরিপূর্ণ বাহ্যিক প্রকাশ। নামায আদায়ের মাধ্যমে নৈতিক এবং সামাজিক বহু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ব্যাপারে ইবাদাতকারী সচেতন হয়। সেইসাথে মানুষ পবিত্রতা,অন্যদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন,সময় জ্ঞান,দিক নির্ণয়,আল্লাহর যথার্থ বান্দাদের সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন হয়। ইসলামের সবচেয়ে বড়ো দিকটি হলো,অন্যদের ভালো ও উত্তম কাজগুলোকেও ইসলাম ইবাদাত বলে গণ্য করে।
আলী (আ) ইবাদাতকে খুবই উপভোগ্য বলে মনে করেন। দুনিয়াবি মজার সাথে যার তুলনা হয় না। ইবাদাতটা উৎসাহ ও উদ্দীপনাময়। তাঁর দৃষ্টিতে তিনিই সৌভাগ্যবান ইবাদাতের প্রাণবায়ু যাঁকে স্নেহের পরশ বুলিয়ে যায়। যিনি তাঁর সকল প্রকার অভাব-অভিযোগ,চাওয়া-পাওয়ায় আল্লাহর শরণাপন্ন হন। তিনিই সৌভাগ্যবান যিনি আলোকিত ভুবনে প্রবেশ করেন এবং সকলপ্রকার দুৎখ-বেদনা থেকে যিনি মুক্ত,সেইসাথে যিনি পরিপূর্ণ স্বচ্ছ,নির্মল ও আন্তরিক। এ ব্যাপারে নাহজুল বালাগা থেকেই বরং সরাসরি আলী (আ) এর বক্তব্য শোনা যাক।
কী সৌভাগ্যবান তিনি, যিনি আল্লাহ প্রদত্ত কর্তব্যগুলো পালন করেন। আল্লাহ তাঁর সাহায্যকারী। আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ফলে তাঁর কষ্ট ও অশান্তিগুলো যাঁতাকলের মতো পিষে গুঁড়ো হয়ে যায়। তিনি রাতের বেলা নিদ্রা থেকে দূরে থাকেন এবং রাত জাগেন। এঁরা হলো সেই দলভুক্ত যাঁরা প্রত্যাবর্তন দিবসের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এবং যাঁদের চোখ থেকে ঘুম অপহৃত হয়েছে,যাঁরা নিজেদের ঘুমের ঘর থেকে উঠে আল্লাহর জিকিরে মশগুল হয়ে পড়েন। এঁরা আল্লাহর দলভুক্ত এবং পরিত্রাণপ্রাপ্ত।