আলী (আঃ)এর বাণী কোরআনের পর সবচেয়ে অলংকারপূর্ণ ভাষার নিদর্শন। মানব সভ্যতা ও ঐতিহ্যে আলী (আঃ) এর সাহিত্য যুগ যুগ ধরে ছিল,আছে এবং থাকবে। আলী (আঃ) যে কতোটা জ্ঞানী ছিলেন,কতোটা ওজস্বী ভাষার অধিকারী ছিলেন,কতো দূরদর্শী এবং সূক্ষ্মদর্শী মনীষী ছিলেন-বর্তমান সংঘাতবহুল বিশ্বে তাঁর বক্তব্যগুলোর যথার্থতা চিন্তা করে বিশ্বের সকল জ্ঞানী-গুণীই তাঁকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে।
এই কথাগুলো জর্জ জারদাক নামক একজন খ্রিষ্টান লেখকের। তিনি আলী (আঃ) এর জীবনী,তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁর বাণী বা বক্তব্যগুলো ভালো করে পড়ে বলেছেন-বর্তমান বিশ্বের মানুষের সকল সংকট থেকে মুক্তি পাবার উপায় হলো তাঁর সাহিত্যগুলো অধ্যয়ন করা।
মানুষ এবং তার সৃষ্টি কৌশলকে আলী (আঃ) গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে নিয়েছেন। তিনি ৮৩ নম্বর বক্তৃতার একাংশে মানব সৃষ্টির পর্যায়গুলোকে বর্ণনা করেছেন। মানুষের যেসব বিষয়ে অবশ্যই জানা দরকার সেসব সম্পর্কে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জটিল পর্দাময় অন্ধকার জরায়ুতে। সে ছিলো বীর্যের মধ্যে,তারপর হলো তরল বস্তুর পিণ্ড। তারপর ভ্রুণ বা জীবনের সূত্রপাত। এরপর পেটের ভেতর তৈরী হলো শিশু। তারপর দুগ্ধপায়ী শিশু এবং অবশেষে দেওয়া হলো হৃদয়,দেখার জন্যে চোখ,বলার জন্যে জিহ্বা। এসব দেওয়া হয়েছে এজন্যে যে যাতে ঐ শিশু নবীন যুবকের পর্যায়ে উন্নীত হয়ে বুঝতে শেখে,জানতে শেখে এবং খোদার নাফরমানির পথে পা না বাড়ায়।
এগুলো হচ্ছে মানব জীবনের প্রাথমিক পর্যায়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত। মানুষের আভ্যন্তরীণ দিকগুলো সম্পর্কে জ্ঞানী হযরত আলী (আঃ) একথাগুলো বলে অপরাপর প্রাণীকূলের সাথে মানুষের পার্থক্যটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন যে,আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে শেখার মতো একটি অন্তর দিয়ে সৃষ্টি করেছেন,তাকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন,চৈতন্য দান করেছেন। কারণটা হলো সে যেন বিচ্যুতির পথে না যায়। আলী (আঃ) মানুষের জীবনের অতি স্পর্শকাতর সময় যৌবনকালের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন,এই সময়টা এমন যে মানুষের ভেতরে যদি সচেতনতা না থাকে তাহলে মারাত্মক ভুলের সম্মুখীন হবে।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে একজন যুবক এই বয়সে তার মনের ইচ্ছাগুলোকে মেটানোর পেছনে লেগে থাকে,আমোদ-ফূর্তি করে বেড়ায় এবং এই বয়সে সে বহু কাজ করার ক্ষমতাও রাখে। কিন্তু যথেষ্ট জ্ঞান নেই। সেজন্যে জীবনটাকে নিরর্থকভাবে হেলায় কাটিয়ে দেয়। এ সম্পর্কে ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন,সে বিশ্বাস করতে চায় না যে ব্যর্থ হবে। গুনাহ করার ক্ষেত্রে তার মাঝে কোনোরকম ভয়ভীতি কাজ করে না। এভাবে ত্রুটি-বিচ্যুতির মাঝে সে কিছু সময় কাটায়। আল্লাহ যেসব নিয়ামত তাকে দিয়েছে সেগুলোকে কোনো কাজে লাগায় না।
তারপর আলী (আঃ) যৌবনকাল সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তুলে বলেন-যৌবন আল্লাহ দান করেছেন এবং মানুষ বার্ধক্যের দুর্বলতার মুখোমুখি হয়। তখন সে বহু কিছু বুঝতে শেখে। যৌবন কী জিনিস ছিল তা সে বার্ধক্যে গিয়ে উপলব্ধি করে। কিন্তু তখন তো তার সক্ষমতা বা শক্তি হ্রাস পায়। হযরত আলী (আঃ) বলেন-যৌবনের সর্বশেষ পর্যায়ে এবং সাফল্যের সর্বশেষ স্তরে মৃত্যুর যন্ত্রণা এসে তাকে গ্রাস করে। এই যন্ত্রণার ফলে সে দিনগুলোকে কাটায় দিশেহারা অবস্থায় আর রাতগুলোকে কাটায় নিদ্রাহীন উদ্বেগের মধ্য দিয়ে। প্রতিটা দিনই তার ভীষণ কষ্টে কাটে আর রাত কাটে দুশ্চিন্তা এবং রোগ-ব্যাধিতে। মৃত্যু ভয় এবং যন্ত্রণা তখন তাকে কাঁদতে বাধ্য করে। ইমাম আলী (আঃ) এরপর মানুষকে তার পরবর্তী জীবনের কথা ইঙ্গিতে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন-মানুষ যখন তার ইচ্ছার বাইরে অন্যদের মাধ্যমে কবরে শায়িত হয় এবং তারপর কেউ যখন তাকে আর দেখতে না পায়,তখন জীবনটাকে অন্যায় বা অবৈধভাবে কাটানোর কারণে জাহান্নামের আগুণে তাকে তো পুড়তে হয়-সেই আগুণে পোড়ার কষ্টের চেয়ে অধিক কষ্টকর আর কি কিছু আছে ?
এভাবে আলী (আঃ) সবার অভিন্ন পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু সবার মৃত্যু কেন একরকম নয় সে ব্যাপারে তিনি বলেন-যারা তাদের জীবনটাকে পশুর মতো কেবল ভোগ-বিলাসেই কাটিয়েছে,নিজের চিন্তাশক্তি বা বিবেককে যথার্থপথে কাজে লাগায় নি। তার মৃত্যু কষ্টকর তো হবেই। আবার যিনি তাঁর ছোট্ট জীবনটাকে সচেতনভাবে সৎ পথে ব্যয় করেছে, মৃত্যু তার জন্যে সৌভাগ্য বয়ে আনে। আলী (আঃ) তাঁর বক্তব্যের সমাপ্তিতে সকল জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ
হে আল্লাহর বান্দাগণ! কোথায় তারা! যারা দীর্ঘ জীবন যাপন করেছে এবং হাসি-উল্লাসে জীবন কাটিয়েছে ? যাদেরকে আল্লাহ দীর্ঘ জীবন দিয়েছেন অথচ তারা জীবনটাকে অর্থহীনভাবে কাটিয়েছে। কোথায় তারা যাদেরকে কঠিন শাস্তির ব্যাপারে জানানো হয়েছে এবং আল্লাহর নিয়ামতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ? হে আল্লাহর বান্দাগণ! যতোক্ষণ তোমার দেহে প্রাণ আছে ততোক্ষণ এই সুযোগকে গণীমত বলে মনে করো। যেসব অন্যায় তোমাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় সেগুলো থেকে দূরে থাকো এবং যে সমস্ত নোংরামির ফলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন সেগুলো থেকে পালিয়ে বাঁচো! নাহজুল বালাগায় চিত্তাকর্ষক যেসব বিষয় রয়েছে, ইবাদাত এবং আল্লাহর জিকির তার মধ্যে অন্যতম। ইবাদাত সম্পর্কে মানুষের মাঝে যেসব দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায় তা অভিন্ন নয়। কেউ কেউ ইবাদাত সম্পর্কে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন এবং কেবল এক ধরনের দায়িত্ব হিসেবে পালন করেন। আবার অনেকেই ইবাদাতকে দেখেন আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই নাহজুল বালাগায় লক্ষ্য করা যাবে। ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে ইবাদাত হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্তির সিঁড়ি এবং আল্লাহকে সাধ্যমতো চেনার আন্তরিক প্রয়াস।অন্যভাবে বলা যেতে পারে,বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো ইবাদাত। আলী (আ) ইবাদাতের আত্মা বলতে আল্লাহকে স্মরণ করাকেই বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন- আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর জিকিরকে অন্তরের মরীচা দূর করার উৎসের সাথে তুলনা দিয়ে বলেছেন এর মাধ্যমে শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং আনুগত্য লাভ করে। এরকম সবসময়ই ছিল এবং আছে যে,আল্লাহ কালের সর্বযুগেই এমনকি যেসময় নভী-রাসূলগণ ছিলেন না তখনো এমন কিছু বান্দার অস্তিত্ব রেখে দিয়েছেন এবং এখনো রক্ষা করছেন যাঁদের সাথে তিনি তাঁর অনেক রহস্য নিয়ে কথা বলেন এবং তাদের বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী আল্লাহ তাঁদের সাথে কথা বলেন। আলী (আ) এ ধরনের ইবাদাতকারীদের অবস্থান সম্পর্কে বলেন-ফেরেশতারা তাঁদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাদের ওপর শান্তির ছায়া নেমে এসেছে। তাঁদের জন্যে আকাশের দ্বারগুলো উন্মুক্ত হয়ে গেছে। তাঁদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহের শেষ নেই। আল্লাহর বন্দেগি করার মাধ্যমে তাঁরা আল্লাহর দরবারে অনেক উচ্চ মর্যাদা ও অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। তাঁদের কর্মকাণ্ড তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি আল্লাহর পছন্দনীয় বলেই প্রশংসনীয় হয়েছে। যাঁরা এভাবে আল্লাহকে ডাকেন,তাঁরা আল্লাহর ক্ষমা ও মাগফেরাতের সুগন্ধি অনুভব করেন এবং গুনাহের কৃষ্ণ পর্দা অপসারণকে অনুভব করেন।
ইসলামে ইবাদাত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে সমান্তরাল। আর ইবাদাত বিষয়টাই ইসলামে সমষ্টিগত, ব্যক্তিগত নয়। অর্থাৎ সবাই মিলে একত্রিত হয়ে এই ইবাদাত পালনের বিধান রয়েছে ইসলামে। এতে ব্যাপক সামাজিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে পালনীয় ইবাদাত যে নেই তা নয়। তবে সেগুলোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যা পালনের মাধ্যমে ব্যক্তি তাঁর জীবনের করণীয় কর্মের অংশের সাথে পরিচিত হয়। যেমন নামায। নামায হলো ইবাদাতের পরিপূর্ণ বাহ্যিক প্রকাশ। নামায আদায়ের মাধ্যমে নৈতিক এবং সামাজিক বহু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ব্যাপারে ইবাদাতকারী সচেতন হয়। সেইসাথে মানুষ পবিত্রতা,অন্যদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন,সময় জ্ঞান,দিক নির্ণয়,আল্লাহর যথার্থ বান্দাদের সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন হয়। ইসলামের সবচেয়ে বড়ো দিকটি হলো,অন্যদের ভালো ও উত্তম কাজগুলোকেও ইসলাম ইবাদাত বলে গণ্য করে।
আলী (আ) ইবাদাতকে খুবই উপভোগ্য বলে মনে করেন। দুনিয়াবি মজার সাথে যার তুলনা হয় না। ইবাদাতটা উৎসাহ ও উদ্দীপনাময়। তাঁর দৃষ্টিতে তিনিই সৌভাগ্যবান ইবাদাতের প্রাণবায়ু যাঁকে স্নেহের পরশ বুলিয়ে যায়। যিনি তাঁর সকল প্রকার অভাব-অভিযোগ,চাওয়া-পাওয়ায় আল্লাহর শরণাপন্ন হন। তিনিই সৌভাগ্যবান যিনি আলোকিত ভুবনে প্রবেশ করেন এবং সকলপ্রকার দুৎখ-বেদনা থেকে যিনি মুক্ত,সেইসাথে যিনি পরিপূর্ণ স্বচ্ছ,নির্মল ও আন্তরিক। এ ব্যাপারে নাহজুল বালাগা থেকেই বরং সরাসরি আলী (আ) এর বক্তব্য শোনা যাক।
কী সৌভাগ্যবান তিনি, যিনি আল্লাহ প্রদত্ত কর্তব্যগুলো পালন করেন। আল্লাহ তাঁর সাহায্যকারী। আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ফলে তাঁর কষ্ট ও অশান্তিগুলো যাঁতাকলের মতো পিষে গুঁড়ো হয়ে যায়। তিনি রাতের বেলা নিদ্রা থেকে দূরে থাকেন এবং রাত জাগেন। এঁরা হলো সেই দলভুক্ত যাঁরা প্রত্যাবর্তন দিবসের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এবং যাঁদের চোখ থেকে ঘুম অপহৃত হয়েছে,যাঁরা নিজেদের ঘুমের ঘর থেকে উঠে আল্লাহর জিকিরে মশগুল হয়ে পড়েন। এঁরা আল্লাহর দলভুক্ত এবং পরিত্রাণপ্রাপ্ত।