ভূমিকা
নবুয়্যতের অপরিহার্যতার দলিলের আবেদন হল আল্লাহর বাণীকে সম্পূর্ণ অবিকৃত ও সংরক্ষিত অবস্থায় মানুষের নিকট পৌঁছানো যাতে এর মাধ্যমে তারা ইহ ও পরকালীন সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে।
অতএব মানুষের নিকট পৌঁছানো পর্যন্ত, অন্যান্য ঐশীগ্রন্থের মতই অবিকৃত ও সংরক্ষিত ছিল এ ব্যাপারে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। তবে আমরা জানি যে, অন্যান্য ঐশীগ্রন্থসমূহ মানুষের হস্তগত হওয়ার পর কমবেশী বিচ্যুতি ও বিকৃতির সম্মুখীন হয়েছিল অথবা কালের আবর্তে হারিয়ে গিয়েছিল। যেমনঃ হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত নূহ (আ.) এর কিতাবের কোন চিহ্নমাত্র আজ আর আমাদের হাতে নেই এবং হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈসার (আ.) কিতাব প্রকৃতরূপে পাওয়া যায় না।
অতএব প্রশ্নের অবকাশ থাকে, আমাদের নিকট এখন ঐশীগ্রন্থ হিসেবে যা বিদ্যমান, কোথা থেকে আমরা জানব যে, এটা ঠিক সেই গ্রন্থই যা স্বয়ং হযরত নবী (সা.) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং এতে কোন প্রকার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেনি অথবা কোন কিছুই এতে সংযোজন হয়নি কিংবা কোন কিছুই এ থেকে হ্রাস পায়নি?
তবে যদি কেউ ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান রাখেন অথবা কোরানের সংকলন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে মহানবী (সা.) এর সাহাবাগণ ও তাঁর পবিত্র উত্তরাধিকারীদের (আ.) প্রচেষ্টা সম্পর্কে অবগত থাকেন তদনুরূপ যদি কোরানের আয়াত মুখস্থ করণের ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানতে পারেন, (যেমনঃ শুধুমাত্র এক যুদ্ধেই সত্তর হাজার কোরানের হাফেজ শহীদ হয়েছিলেন)। অনুরূপ দীর্ঘ চৌদ্দশত বছরে যদি কোরানের বহুল প্রচারিত হওয়ার কথা এবং আয়াত সংখ্যা, শব্দ ও অক্ষর সংখ্যা ইত্যাদির গণনায় মুসলমানদের অক্লান্ত শ্রম সম্পর্কে ধারণা রেখে থাকেন তবে তিনি কখনোই এ পবিত্র গ্রন্থের ন্যূনতম বিকৃতি ঘটেছে বলে মনে করতে পারেন না। তবে ইতিহাসের এ বিশ্বস্ত সূত্রের সাহায্য ছাড়াও কোরানের ত্রুটিমুক্ততাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ধৃতিগত (অর্থাৎ নাকলী বা কোরান ও হাদীসের) দলিলের সমষ্টিগত আলোচনার মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করা যায়। অর্থাৎ কোরানের ত্রুটিমুক্ততাকে সর্বপ্রথমে কোরানে কোন কিছু সংযোজিত হওয়ার বিষয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করা যেতে পারে। অতঃপর আমাদের হাতে বিদ্যমান এ কোরান যে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে তা প্রমাণিত হওয়ার পর পবিত্র কোরানের আয়াতের মাধ্যমে এ থেকে কোন কিছু হ্রাস বা ঘাটতি না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা যেতে পারে।
অতএব কোন প্রকার বিকৃতি থেকে সম্মানিত গ্রন্থ কোরানের সংরক্ষিত থাকা সম্পর্কে আমরা দু’টি স্বতন্ত্র শিরোনামে আলোচনা করব।
পবিত্র কোরানে অতিরিক্ত কোন কিছু সংযুক্ত হয়নি
পবিত্র কোরানে অতিরিক্ত কোন কিছু সংযুক্ত হয়নি, এ ব্যাপারে সকল মুসলমানই একমত। এমনকি বিশ্বের সকল বিজ্ঞজনই এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন। এমন কোন ঘটনাই ঘটেনি, যা কোরানে কোন কিছু সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাব্য উৎস হবে এবং এ ধরনের সম্ভাবনার কোন প্রমাণ নেই। উপরন্তু পবিত্র কোরানে কোন কিছু সংযোজিত হওয়ার বিষয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের মাধ্যমে নিম্নরূপে অগ্রাহ্য করা যায়ঃ
যদি মনে করা হয় যে, কোন একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয় পবিত্র কোরানে সংযোজিত হয়েছে তবে তার অর্থ হল, কোরানের সদৃশ কিছু আনা সম্ভব হয়েছে। আর এ ধরনের ধারণা, কোরানের অলৌকিকতা ও এর সমকক্ষ কিছু করতে মানুষের অপরাগতার সাথে সামঞ্ছস্যপূর্ণ হতে পারেনা। যদি মনে করা হয় যে, শুধুমাত্র এক শব্দ অথবা একটি ক্ষুদ্র আয়াত (যেমনঃ مدهامّتان)১ সংযোজিত হয়েছে–যার অপরিহার্য অর্থ হল বক্তব্যের শৃংখলা বিনষ্ট হওয়া ও আলৌকিকতাপূর্ণ প্রকৃতরূপ থেকে বিচ্যুত হওয়া। আর এ রকমটি হলে, তা হবে কোরান অনুকরণযোগ্য ও সাদৃশ্য আনয়নযোগ্য হওয়া অর্থাৎ একটি ক্ষুদ্র অংশে হলেও মানুষ তার অনুরূপ আয়াত আনতে বা শব্দ সংযোজনে সক্ষম হওয়া। কারণ কোরানের সুবিন্যস্ত বিষয়বস্তুর অলৌকিকত্ব, শব্দ ও অক্ষরের নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর এর ব্যতিক্রম ঘটলে কোরানের অলৌকিকত্ব হারায়।
অতএব যে দলিলের উপর ভিত্তি করে পবিত্র কোরানের অলৌকিকত্ব প্রমাণিত হয়, ঠিক সে দলিলের মাধ্যমেই কোন প্রকারের অতিরিক্ত সংযোজন থেকে সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমনকরে একই দলিলে শব্দ ও বাক্যের অনুপস্থিতি ঘটার ফলে কোরানের অলৌকিকত্ব বিনষ্ট হওয়ার ব্যাপারটিও নিষিদ্ধ হয়ে থাকে। তবে একটি পূর্ণ সূরা বা একটি পূর্ণ বিষয় সম্পর্কিত আয়াত বা আয়াতসমূহের ঘাটতি না ঘটার ব্যাপারটি প্রমাণের জন্যে অন্য এক প্রকার দলিলের প্রয়োজন। কারণ এরূপ ঘাটতি, অন্য কোন আয়াতের অলৌকিকত্বের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না।
পবিত্র কোরান থেকে কোন কিছু হ্রাস পায়নি
প্রখ্যাত শিয়া ও সুন্নী আলেমগণ সুস্পষ্ট ভাষায় গুরুত্বারোপ করেন যে, যেমনিকরে পবিত্র কোরানে অতিরিক্ত কোন কিছু সংযোজিত হয়নি, ঠিক তেমনি এ থেকে কিছুই হ্রাস পায়নি। আর এ বিষয়কে প্রমাণের জন্যে তারা অসংখ্য যুক্তির অবতারণা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাদীসগ্রন্থসমূহে কিছু কিছু বানোয়াট ও জাল রেওয়ায়েতের উদ্ধৃতির ফলে এবং কোন কোন বিশ্বস্ত রেওয়ায়েতের ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যার কারণে২ কেউ কেউ ধারণা করেছেন, এমনকি অনুমোদন দিয়েছেন যে, কোরানের কোন আয়াত বাদ পড়েছে।
তবে যে কোন প্রকারের বিচ্যুতি (হ্রাস বা বৃদ্ধি) থেকে কোরানের মুক্ত থাকার স্বপক্ষে সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক সূত্র ব্যতীত এবং শব্দ বা আয়াতের ঘাটতি কোরানের অলৌককতাপূর্ণ বিন্যাস ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে, মু’জিযাহর দলিলের মাধ্যমে তা অগ্রাহ্য হওয়া ছাড়াও কোন আয়াত বা পূর্ণাঙ্গ সূরার ঘাটতি থেকে কোরান সংরক্ষিত থাকার বিষয়টি স্বয়ং পবিত্র কোরানের মাধ্যমেই প্রমাণ করা যেতে পারে।
অর্থাৎ বিদ্যমান সমস্ত কোরান আল্লাহর কালাম এবং কোন কিছুই এতে সংযোজিত হয়নি এ বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর, এর আয়াতসমূহকে দৃঢ়তম উদ্ধৃতিগত, বিশ্বাসগত ও চূড়ান্ত দলিল রূপে উপস্থাপন করা যায়। কোরানের এরূপ একটি আয়াত থেকে আমার জানতে পারি যে, মহান আল্লাহ যেকোন প্রকার বিচ্যুতি থেকে এ কোরানকে সংরক্ষণ করার নিশ্চয়তা দিয়েছেন, যা অন্যান্য ঐশীগ্রন্থসমূহের ব্যতিক্রম। কারণ ঐ গুলোর সংরক্ষণের দায়িত্ব মানব সম্প্রদায়ের উপর অর্পণ করেছিলেন। যেমনঃ ইহুদী ও নাসারাদের আলেমদের ব্যাপারে পবিত্র কোরানে এসেছে,
﴿بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ﴾
"কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল এবং তারা ছিল তার সাক্ষী।” (সূরা মায়িদাহ, ৪৪)
উল্লেখিত বিষয়টি কোরানের নিম্নলিখিত আয়াত থেকে অনুধাবন করা যায়ঃ
﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾
"আমরাই কোরান অবতীর্ণ করিয়াছি এবং আমরাই এর রক্ষক।” (সূরা হিজর-৯)
এ আয়াতটি দু’টি বাক্যের সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে। প্রথম বাক্যটিতে إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ»« অর্থাৎ "নিশ্চয় আমরাই এ কোরান নাযিল করেছি”–এর মাধ্যমে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে, পবিত্র কোরান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই নাযিল হয়েছে এবং অবতীর্ণ হওয়ার সময় এতে কোন প্রকার বিকৃতি ঘটেনি। আয়াতের অপর অংশে অর্থাৎ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ»« ‘‘এবং নিশ্চয় আমরাই একে সংরক্ষণ করব’’–বাক্যের প্রথমে إنّا বা নিশ্চয় ও «حَافِظُونَ» শব্দের পূর্বে ل গুরুত্ব প্রদানকারী দুটি প্রত্যয় যোগ করে এবং এতে ‘আমরা এর সংরক্ষণকারী’-কথাটি বলে সংরক্ষণ কর্মের অবিরত অবস্থার উপর গুরুত্বারোপের মাধ্যমে, যে কোন প্রকার বিকৃতির হাত থেকে কোরানের সার্বক্ষণিক সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।
বর্ণিত আয়াতটি কোরানে অতিরিক্ত কোন কিছু সংযোজিত না হওয়ার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করলেও এ ধরনের বিকৃতিকে নিষিদ্ধকরণের জন্যে এ যুক্তির অবতারণা এক ধরনের আবর্তন প্রক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কারণ কোরানে কোন কিছু সংযোজিত হওয়ার ধারণা এ আয়াতটিকেও সমন্বিত করে। ফলে এ ধরনের ধারণাকে স্বয়ং ঐ আয়াতের মাধ্যমে অগ্রাহ্য করা সঠিক হতে পারে না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ঐ (কোরানে কোন শব্দ বা বাক্য সংযোজিত হওয়ার সম্ভাবনার) ধারণাকে কোরানের অলৌকিকত্বের দলিলের মাধ্যমে বর্জন করেছিলাম। অতঃপর এ আয়াতটির মাধ্যমে আয়াত বা পূর্ণ সূরার ঘাটতি লাভ (এমনরূপে যে, এর অলৌকিকত্বপূর্ণ বিন্যাস ব্যবস্থার কোন ক্ষতি হয়না) থেকে সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারটিও প্রতিপাদন করেছিলাম। আর এভাবেই হ্রাস বা বৃদ্ধির মত যে কোন প্রকার বিকৃতি থেকে পবিত্র কোরানের সংরক্ষিত থাকার ব্যাপারটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ধৃতিগত দলিলের সমম্বয়ে প্রমাণিত হয়।
পরিশেষে এ বিষয়টি স্মরণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি যে, সকল প্রকারের বিকৃতি থেকে কোরান সংরক্ষিত থাকার অর্থ এ নয় যে, যেখানেই কোরান নামে কোন গ্রন্থ পাওয়া যাবে, তা-ই পূর্ণ কোরান হবে এবং মুদ্রণজনিত ও সূত্রগত সকল প্রকার ত্রুটি ঊর্ধ্বে থাকবে অথবা এর কোন প্রকারের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তাৎপর্যগত ত্রুটি অসম্ভব কিংবা এর আয়াত ও সূরাসমূহ অবতীর্ণ হওয়ার ক্রমানুসারে সজ্জিত হয়েছে। বরং এর অর্থ হল এই যে, কোরান মানুষের নিকট এরূপে বিদ্যমান থাকবে যে, সত্যানুসন্ধিৎসুগণ সকল আয়াতকেই এমনরূপে পাবে, ঠিক যে রূপে অবতীর্ণ হয়েছে।
অতএব এ কোরানের কোন কোন খণ্ডের অসম্পূর্ণতা ও অশুদ্ধি অথবা পঠন প্রক্রিয়ার বিভিন্নতা কিংবা অবতীর্ণ হওয়ার ক্রমিকতার ব্যতিক্রমে আয়াত ও সূরাসমূহের পুনর্বিন্যাস অথবা তাৎপর্যগত বিকৃতি ও বিচিত্র প্রকারের তাফসির বা ব্যাখ্যার উপস্থিতি, পূর্ববর্ণিত বিকৃতি থেকে কোরানের সংরক্ষিত থাকার সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি করে না।
মূল: আয়াতুল্লাহ মিসবাহ ইয়াজদি