বাঙ্গালী
Monday 25th of November 2024
0
نفر 0

বিভিন্ন ফিকাহর দৃষ্টিতে খুমস

বিভিন্ন ফিকাহর দৃষ্টিতে খুমস

ইমামী মাজহাবের ফকীহ্গণ ফিকাহর কিতাবসমূহে ‘খুমস’ শিরোনামে একটি বিশেষ অধ্যায় সংযোজন করেছেন যা ‘যাকাত’ অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে। এ অধ্যায়ের মূল কোরআন মজীদের সূরা আনফালের ৪১ নং আয়াতে নিহিত রয়েছে। এ আয়াতে বলা হয়েছে :

وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُم مِّن شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّـهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّ‌سُولِ وَلِذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ

“তোমরা জেনে রাখ,নিঃসন্দেহে তোমরা যখন কিছু গণীমতের অধিকারী হবে তখন তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ্,তাঁর রাসূল,(রাসূলের) ঘনিষ্ঠ জন,ইয়াতীম,মিসকিন ও পথিকের জন্য।”

ইমামিগণ এ আয়াতে উল্লিখিত ‘গণীমত’-কে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলমানদের হস্তগত হওয়া সম্পদের মধ্যে সীমাবদ্ধ গণ্য করেন না;বরং তারা এতে সাত ধরনের সম্পদকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। নিম্নে এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হচ্ছে এবং সেই সাথে অন্যান্য মাজহাবের মতামতও উল্লেখ করা হচ্ছে।

১. যুদ্ধের গণীমত : যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত শত্রু সম্পদ (গণীমত)-এর এক-পঞ্চমাংশ (খুমস) দিতে হবে এ ব্যাপারে ইসলামের পাঁচ মাজহাব অভিন্ন মত ব্যক্ত করেছে।

২. খনিজ দ্রব্য : খনিজ দ্রব্য বলতে তা-ই বোঝায় যা ভূ-গর্ভ বা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উত্তোলন করা হয় যা পৃথিবীর (ভূ-গোলকের) অংশ বলে পরিগণিত এবং যার মূল্য আছে,যেমন : স্বর্ণ,রৌপ্য,সীসা,দস্তা,পারদ,তৈল,গন্ধক ইত্যাদি।

ইমামীদের মতে খনিজ দ্রব্যের মূল্য যদি স্বর্ণের নিসাবের মূল্যের সমান হয়,আর এ ক্ষেত্রে নিসাব হচ্ছে ২০ দিনার অথবা রৌপ্যের নিসাবের মূল্যের সমান হয় যার নিসাব হচ্ছে ২০০ দিরহাম,সে ক্ষেত্রে তার এক-পঞ্চমাংশ (খুমস) অর্থাৎ শতকরা ২০ ভাগ প্রদান করা ওয়াজিব হবে। এর চেয়ে কম মূল্যের হলে খুমস প্রদান ওয়াজিব হবে না।

হানাফীদের মতে খনিজ দ্রব্যের ক্ষেত্রে কোন নিসাব নেই;বরং কম বা বেশি হোক,সর্বাবস্থায়ই খুমস প্রদান করা ওয়াজিব।

মালিকী,শাফেয়ী ও হাম্বলীদের মতে খনিজ দ্রব্য যদি নিসাবের চেয়ে কম হয় তাহলে কিছুই দিতে হবে না,কিন্তু তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।

৩. গুপ্তধন : গুপ্তধন হচ্ছে এমন জায়গায় মাটির নীচে প্রোথিত সম্পদ যার অধিবাসীরা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং যে সম্পদের মালিককে চি‎হ্নিত করা বা খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। যেমন প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রত্নসম্পদ উদ্ধারের লক্ষে খনন কার্য চালিয়ে যা উদ্ধার করেন।

এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের মত হচ্ছে,গুপ্তধনের খুমস দেয়া ওয়াজিব এবং এ ক্ষেত্রে কোন নিসাব নেই। অতএব,কম হোক বা বেশি হোক,সর্বাবস্থায় খুমস প্রদান করা ওয়াজিব হবে।

ইমামী মাজহাবের মতে গুপ্তধন খনিজ দ্রব্যের মতই এবং উভয়ের খুমস ওয়াজিব হওয়া ও নিসাবের পরিমাণ অভিন্ন।

৪. সমুদ্র তলদেশের সম্পদ : ইমামীদের মতে ডুব দিয়ে সমুদ্র তলদেশ থেকে যা তুলে আনা হয়,যেমন:মুক্তা ও প্রবাল-এ সবের উত্তোলন ব্যয় বাদে মূল্য এক দীনার হলে খুমস দিতে হবে।

আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবের দৃষ্টিতে এ ক্ষেত্রে কিছুই দিতে হবে না-তা উত্তোলিত সম্পদের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন।

৫. প্রয়োজনাতিরিক্ত আয় : ইমামীদের মতে ব্যক্তির নিজের ও তার পরিবার-পরিজনের সাংবৎসরিক প্রায়োজন পূরণের পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে- তা যে পন্থায়ই উপার্জিত হয়ে থাকুক না কেন,যেমন : ব্যবসায়,চাকরি,দিনমজুরি,জমি-জমা ও বাড়িঘর থেকে লব্ধ আয় দান বা অন্য কোন পন্থায় অর্জিত হয়ে থাকুক,তা থেকে যদি ক্ষুদ্রতম মুদ্রা পরিমাণও অবশিষ্ট থেকে থাকে তাহলে তার খুমস দিতে হবে।

৬. হালাল-হারামের মিশ্রণ : কারো কাছে যদি হারাম সম্পদ আসে এবং তা তার হালাল সম্পদের সাথে মিশে যায় কিন্তু হারাম সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে তার জানা না থাকে অথবা তার মালিক কে ছিল তাও জানা না থাকে,তাহলে তার ঐ সম্পদ থেকে আল্লাহর রাস্তায় খুমস দিতে হবে। সে যখন তা প্রদান করবে অতঃপর বাকী সম্পদ তার জন্য হালাল হবে,এ ক্ষেত্রে হারাম সম্পদের পরিমাণ প্রদত্ত খুমসের তুলনায় কম হোক বা বেশি হোক। কিন্তু যদি সেই হারাম সম্পদ সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে তাহলে তাকে সে সম্পদই দিতে হবে। আর যদি হারাম সম্পদকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম না হয় এবং তার সঠিক পরিমাণ বা মূল্য জানা থাকে তাহলে তাকে সতর্কতার সাথে সে পরিমাণই আলাদা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মোটেই কম করা যাবে না,এমন কি তা তার সমস্ত সম্পদের সাথে মিশ্রিত হয়ে থাকলেও। আর যদি তার জানা থাকে যে,কাদের সম্পদ তার সম্পদের সাথে মিশ্রিত হয়েছে,কিন্তু কি পরিমাণ সম্পদ মিশ্রিত হয়েছে তা তার জানা না থাকে,তাহলে তার দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সাথে আপোষ করে ও ছাড় দিয়ে হলেও তাদের সন্তুষ্ট করা। মোট কথা,যখন কারো সম্পদের সাথে হারাম সম্পদ মিশে যায় কিন্তু ঐ সম্পদের মালিক ও পরিমাণ সম্পর্কে জানা থাকে না তখন ঐ সম্পদ থেকে খুমস দিতে হবে।

৭. ইমামীদের মতে কোন যিম্মি (ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক) যখন কোন মুসলমানের নিকট থেকে জমি ক্রয় করবে তখন ঐ যিম্মীকে তার খুমস প্রদান করতে হবে।

খুমসের ব্যবহার

শাফেয়ী ও হাম্বলী মতে গণীমত অর্থাৎ খুমসকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করতে হবে। এর প্রথম অংশ রাসূল (সা.)-এর এবং তা মুসলিম জনগণের কল্যাণের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এক অংশ ‘যিল কুরবা’ অর্থাৎ রাসূলের আত্মীয়-স্বজনদেরকে দিতে হবে;এখানে ‘যিল কুরবা’ হচ্ছে পিতার দিক থেকে যারা হাশিমের বংশধর;এ ক্ষেত্রে ধনী-গরীবে কোন পার্থক্য নেই। বাকী তিন অংশ ইয়াতীম,মিসকিন ও পথিকদের জন্য ব্যয় করতে হবে-তা তারা বনি হাশিমভুক্ত বা তার বহির্ভূত হোক,এতে কোন পার্থক্য নেই।

হানাফীদের মতে রাসূলের অংশ তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথেই বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু ‘যিল কুরবা’ বলতে তাঁদের মধ্যকার দরিদ্রদেরকে বোঝানো হয়েছে। অন্য দরিদ্রদের মত দরিদ্র হবার কারণেই তাঁদেরকে দিতে হবে,রাসূলের আত্মীয় হবার কারণে নয়।

মালিকীদের মতে খুমস-এর বিষয়টি মুসলমানদের ইমাম (শাসক)-এর হাতে ছেড়ে দিতে হবে এবং তিনি যেভাবে এর ব্যবহার উত্তম মনে করেন সেভাবেই ব্যবহার করবেন।

ইমামীদের মত হচ্ছে নিঃসন্দেহে আল্লাহ্,রাসূল (সা.) ও ‘যিল কুরবা’-এর তিন অংশ মাসুম ইমাম বা তাঁর প্রতিনিধির নিকট প্রত্যর্পণ করতে হবে এবং তিনি মুসলমানদের কল্যাণার্থে তা ব্যবহার করবেন। বাকী তিন অংশ বনি হাশিমের ইয়াতীম,মিসকিন ও পথিকদের দিতে হবে,এতে তাঁদের ছাড়া অন্যদের কোন অংশ নেই।

আশশে’রানী (الشعراني) লিখিত الميزان গ্রন্থের ‘যাকাত’ অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমরা এ অধ্যায়ের আলোচনা শেষ করতে চাই। শেরানী বলেন,“ইমামের দায়িত্ব হচ্ছে নিজ বিবেচনা অনুযায়ী খনিজ মালিকদের খনিজ সম্পদের একটি অংশ বায়তুল মালে প্রদানে বাধ্য করা যাতে খনিজ মালিকদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি না পায় যে,তারা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দাবী করে বসতে পারে এবং সৈন্যদের জন্য ব্যয় করে (তাদেরকে ঘুষ দিয়ে) বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে...।”

এটি একটি আধুনিক তত্ত্বেরই ভিন্নতর প্রকাশ। এ তত্ত্ব অনুযায়ী পুঁজি পুঁজিমালিকদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের দিকে এগিয়ে দেয়। উক্ত মত প্রকাশক (শে’রানী) এখন (১৩৮৩ হিজরী) থেকে ৪০৬ বছর পূর্বে ইন্তেকাল করেন।

[الفقه على المذاهب الخمسة গ্রন্থ থেকে অনুদিত । জ্যোতি,১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা।]

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

মহানবী (সাঃ)-এর আহলে বাইতকে ...
বেহেশতের নারীদের নেত্রী- সব যুগের ...
তাওহীদের মর্মবাণী-১ম কিস্তি
হাসনাইন (ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন) ...
খেলাফত তথা রাসূল (সা.)-এর ...
নবী (সা.) কিভাবে উম্মী ছিলেন বা কেন ...
আল কোরআনের অলৌকিকতা (১ম পর্ব)
Protest einer Antikriegsgruppe gegen Luftangriff Amerikas auf ein Krankenhaus
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র মাথা ...
১০ ই মহররমের স্মরণীয় কিছু ঘটনা ও ...

 
user comment