নামাজ তুলনাহীন ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্কের অফুরন্ত উৎসব, খোদা-প্রেমের চির অতৃপ্ত তৃষ্ণা এবং ঐশী আলোর বন্যায় অবগাহন । নামাজ সেই মহান সত্তার সাথে প্রেমের অফুরন্ত উৎসব সমগ্র সৃষ্টি জগত যাঁর কর্তৃত্বাধীন, যাঁর শক্তি বিজয়ী, যাঁর পরিকল্পনা দৃশ্যাতীত এবং যাঁর রাজত্বের সীমানা অতিক্রম করা অসম্ভব। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি তাঁকে পুরোপুরি বুঝতে ও জানতে অক্ষম, তাঁর রহস্যময় মহিমান্বিত নূরের উজালায় সমস্ত জগৎ আলোকিত। তাই মহত্ত্বম সব গুণাবলীর অশেষ আঁধার এবং অনাদি, অক্ষয় ও অনন্ত, সৃজন-পালন ও ধ্বংসকারী, মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহই একমাত্র আরাধ্য ও উপাস্য। নামাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর এবাদত যেন নূরের দরিয়ায় প্রেমময় আত্মার অশেষ সিনান, পবিত্রতার চিরসবুজ গুলবাগিচায় খোদায়ী প্রেম-বিরহের গভীর আকুতি-মাখা গজল। মহান আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তণের মধ্যে প্রেমিক বান্দা খুঁজে পায় আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধ। নামাজী যখন নিজেকে আল্লাহর দাস মনে করে তখন এই মর্যাদাবোধ ও গৌরবময় সম্পর্কের কারণে সে অন্য সব শক্তিকে অসার বা মূল্যহীন মনে করে।
নামাজের রয়েছে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দিক। বাহ্যিক দিকের সৌন্দর্য ছাড়াও এর অন্তর্নিহিত চেতনার রয়েছে অশেষ প্রভাব। আল্লাহর সাথে বান্দার একান্ত ও একনিষ্ঠ কথোপকথনের প্রশান্তিদায়ক প্রাণস্পর্শী দৃশ্য দেখে বিমুগ্ধ হয়ে পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় বহু মানুষ। এমনকি অনেক অমুসলমানও নামাজের স্বর্গীয় আধ্যাত্মিক দৃশ্যে বিমোহিত হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। ২২ বছর বয়স্ক ফরাসী যুবক জ্যাক এভাবেই সুপথ তথা সিরাতুল মোস্তাকিম পেয়েছেন। নওমুসলিম মুহাম্মাদ ওরফে জ্যাক এ প্রসঙ্গে বলেছেন,একদিন প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে এক ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এ সময় দেখলাম এক ব্যক্তি ক্ষেতের পাশে নামাজ পড়ছিলেন। তার সমস্ত মনোযোগ যেন একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল । তার নম্রতা ও আদব-কায়দায় বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি একজন উপস্থিত এবং জীবন্ত ব্যক্তির সাথে কথা বলছিলেন। তাই দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম এবং তার প্রার্থণার প্রতি আকৃষ্ট হলাম। এরপর এ বিষয়ে গবেষণার সিদ্ধান্ত নেই। আর এটাই আমাকে শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছে।
নামাজ পবিত্র অন্তরের প্রাণশক্তি, সজীবতা ও প্রশান্তির উৎস এবং সুপথদ্রষ্টা চিরউজ্জ্বল প্রদীপ। যুবক-যুবতিরাও নামাজে খুঁজে পান অপার অনাবিল আনন্দ । নামাজের প্রাণ-জুড়ানো মধুর ধ্বনিতে পরিবেশ হয়ে ওঠে স্বর্গীয় আনন্দে ভরপুর, ফুলেল উচ্ছাসে প্রাণোচ্ছল এবং আধ্যাত্মিক সুবাসে সুরভিত। পার্থিব জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে আবদ্ধ এবং বস্তুগত চাহিদা মেটাতে ক্লান্ত ও শ্রান্ত মানুষের জীবনে নামাজ তথা আল্লাহর স্মরণ যেন আধ্যাত্মিকতার বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলার ও সজীবতা অর্জনের এক মুক্ত প্রাঙ্গণ। এ যেন এমন এক স্রোতধারায় অবগাহন যা ধুয়ে মুছে ফেলে মনের সমস্ত কালিমা, বস্তুগত গ্লানি; দূর করে অজ্ঞতা ও অসচেতনতার আঁধার। এ প্রাঙ্গণ এবং স্রোতস্বিনী ছাড়া মানুষের অন্তর হয়ে পড়ে নিস্প্রভ, পংকিল ও দূষিত। আর এ জন্যই নামাজ পবিত্র ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং নামাজ বা সালাত কায়েম করার ওপর এত বেশী জোর দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, নামাজ মানুষকে অশ্লীলতা ও পাপ থেকে মুক্ত রাখে। এ ছাড়াও সমস্যা ও সংকটের সময় নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাইতে বলেছে পবিত্র কোরআন। এভাবে নামাজ হল মানুষের বিপদ-আপদসহ সব সময়ের সহায় এবং অন্তরের সবচেয়ে বড় প্রশান্তির মাধ্যম। তাই নামাজ মানুষের জন্য অন্যতম প্রধান জরুরী বিষয়।
নামাজের রয়েছে অনেক সুপ্ত রহস্য বা দর্শন। মানুষ অনেক বিষয়ের প্রশিক্ষণ পায় নামাজের মাধ্যমে। মানুষের বেয়াড়া কূপ্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরা এবং আত্মাকে সংশোধিত ও দীপ্তময় করার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম নামাজ। নামাজে আত্মাকে বিনম্র ও অহংকারমুক্ত করার অনুশীলনের ফলে কূপ্রবৃত্তি জেগে ওঠার সূযোগ পায় না এবং খারাপ অভ্যাসও নামাজীর আচার-আচরণে স্থান পায় ন। এভাবে পরিশুদ্ধ হবার পর নামাজী সমাজকেও কল্যাণ ও উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা মাআরিজের ১৯ থেকে ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : মানুষকে খুবই অস্থিরচিত্ত দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে বিপদগ্রস্ত হলে হা-হুতাশ করতে থাকে এবং ঐশ্বর্যশালী হলে কৃপণ হয়ে পড়ে, তবে তারা নয় যারা নামাজ পড়ে; যারা তাদের নামাজে সদা-নিষ্ঠাবান।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হবার সুবাদে দেশটির বিপুল সংখ্যক মানুষ নামাজের গুরুত্বের প্রতি সচেতন হয়েছে। নামাজের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সম্প্রতি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৭ তম জাতীয় নামাজ সম্মেলন। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রীরা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি তাদের সমাবেশে বলেন, পবিত্র কোরআন ও হাদীসে নামাজের ওপর যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা থেকে বোঝা যায় নামাজ দৈহিক, আত্মিক ও সামাজিক রোগগুলো নিরাময়ের অন্যতম প্রধান ওষুধ। ইসলামের নির্দেশিত সমস্ত ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কাজ ও নিষেধাজ্ঞা মানুষের আত্মার ভিত্তিকে শক্তিশালী করাসহ সমাজ-সংস্কার এবং ইহকাল ও পরকালের কল্যাণে সুগম করার জন্য মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে দেয়া ওষুধের প্রেসক্রিপশান বা নির্দেশিকা। আর এসব ওষুধের মধ্যে সম্ভবতঃ নামাজই সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরো বলেন, মানুষের আত্মায় রয়েছে বিভিন্ন প্রবৃত্তি বা প্রবণতা। এসব প্রবৃত্তিকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ও ব্যবহার করা সম্ভব হলে মানুষ পরিপূর্ণতার চরম শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হবে। মানুষের সমস্যা হল তারা অসচেতনতা বা উন্মত্ত অবস্থা থেকে মুক্ত নয়। প্রতিটি মানুষের ভেতরে থাকা এই যে উন্মত্ততা তাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। মহান আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। নামাজে আল্লাহর স্মরণ শানিত ও প্রদীপ্ত হয়। মানুষ যখন নামাজ পড়ে তখন তার ভেতরের সতর্ককারী বিবেক সজীব বা প্রাণবন্ত হয়। এ বিবেক তাকে বার বার অশ্লীলতা ও অন্যায়ের ব্যাপারে সতর্ক করতে থাকে। এ বিষয়গুলোর উচ্চারণ ও পুনরাবৃত্তি অন্তরকে বিনম্র এবং ভীত-সন্ত্রস্ত রাখে। এ জন্যই বার বার নামাজ পড়ার বিধান দেয়া হয়েছে। রোজা বছরে একবার, হজ্বও একবার, কিন্তু নামাজ বার বার পড়তে হয় বা পড়া অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। নামাজের বিশেষ গুরুত্ব এখানেই।Â ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী নামাজের প্রভাব সম্পর্কে আরো বলেছেন, নামাজ পড়ার মাধ্যমে মানুষের দেহ ও অন্তর সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও নিরাপত্তা অনুভব করে। নামাজ বিনয় ও মনোযোগসহ পড়া হলে শুধু নামাজীর অন্তরই নয়, একইসাথে তার আশপাশের পরিবেশও কোমল, বিনম্র ও সুরভিত হয়। সমাজে প্রকৃত ও বিনম্র নামাজীর সংখ্যা যত বাড়বে ততই স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, লোভ-লালসা এবং অন্যায়-অবিচারের অন্ধকার কমে যাবে, বরং মুক্তি ও কল্যাণের আলো দিনকে দিন মানুষের মধ্যে প্রদীপ্ততর হয়ে উঠবে।
১৭ তম জাতীয় নামাজ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইরানের প্রেসিডেন্ট ডক্টর মাহমুদ আহমাদিনেজাদ নামাজকে বিজ্ঞান, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করে বলেন, নামাজ নিজেকে উন্নত করার মাধ্যম। আর এ জন্যই হাদীসে নামাজকে ধর্মের স্তম্ভ বলা হয়েছে। অর্থাৎ সমস্ত কল্যাণ ও পরিপূর্ণতার কেন্দ্রবিন্দু হল নামাজ এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক। এ কারণেই সমস্ত খোদায়ী বা ঐশী ধর্ম প্রথমেই মানুষকে নামাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
ডক্টর মাহমুদ আহমাদিনেজাদ আরো বলেছেন, নিয়াত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যমে নামাজ শুরু করতে হয়। আল্লাহর নৈকট্য অর্থ মহান আল্লাহর নামগুলোর দীপ্তীকে ধারণ করার যোগ্যতা অর্জন যে নামগুলোর মূল কেন্দ্রবিন্দু হল সমস্ত সৌন্দর্যের এবং চূড়ান্ত পরিপূর্ণতার জ্ঞান।
ইরানের প্রেসিডেন্ট নামাজকে খোদা-পরিচিতি বা খোদায়ী জ্ঞানের দরজা হিসেবে অভিহিত করে বলেন, নামাজের মাধ্যমে নামাজী খোদায়ী জ্ঞানের মহাসাগরে প্রবেশ করে। নামাজ যদি শুধু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য পড়া হয় তাহলে সমস্ত অজ্ঞতা ও অন্ধকার উজ্জ্বল আলোয় রূপান্তরিত হবে।
দুই দিনের এ সম্মেলনে নামাজের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার বিভিন্ন কৌশল ও পন্থা সম্পর্কে আলোচনা হয় এবং সম্মেলন শেষে নামাজ সম্পর্কে সেরা নিবন্ধ-লেখকদের মূল্যবান পুরস্কার দেয়া হয়।(রেডিও তেহরান)